আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাজ নেই দুর্বিষহ জীবন

দিনমান অপেক্ষা করেও কোনো কাজ জোটাতে পারেননি মালেক, মানু, আক্কেল আলী, জৈনুদ্দিনসহ ২০-২২ জন দিনমজুর। দিনের আয়ে দিন চলে তাদের। রামপুরা ব্রিজের ঢালে অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের খোঁজ নিতে গেলে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হন জৈনুদ্দিন (৫৮)। বলে ওঠেন, 'কে মরল কে বাঁচল, তাতে আমাগো কী? কার ফাঁসি অইব, কে রাজা অইব হেইডা দিয়া কি মোগো দিন চলব? কিছু অইলেই দিয়া দেয় হরতাল, পান থিকা চুন খসলেই ডাইকা ফেলায় অবরুধ। ' জৈনুদ্দিনের পাশে কোদাল হাতে দাঁড়ানো আরেক দিনমজুর আক্কেল আলী (৫০) বলেন, 'আরে ভাই, যারা হরতাল-অবরুধ দিতেছে তাগোর ঘরে তো খাওনের অভাব নাই।

আমাগো কাজ দিউক, পেটে খাবার দিউক আমরাও হরতাল হরতাল কইয়া গলা ফাটামু। ...' একের পর এক হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ। একটানা চার দিনের অবরোধে কাজ জোটাতে না পারা শ্রমিক-মজুরদের ঘরে রান্নাবান্নাও বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ নেই- খাবারও নেই। পরিবারের কষ্ট-যন্ত্রণার ক্ষোভ ফুটে ওঠে জৈনুদ্দিন, আক্কেল আলীদের কণ্ঠে।

সকালে অবরোধ শেষ হলেও ঠিকাদার মালামাল নিয়ে নির্মাণ সাইটে পেঁৗছাতে না পারায় গতকালও বেকার ছিলেন তারা। কিন্তু আজ খালি হাতে ঘরে ফেরার কোনো উপায় নেই আক্কেল আলীর। অবরোধের প্রথম তিন দিনে দেনা করে পরিবারের পাঁচ সদস্যের মুখে কোনোমতে দুই মুঠো জুটিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই আর চুলা জ্বলছে না। তাই গতকাল সকালে আক্কেল আলীর ভাগ্যে খাবার জোটেনি।

হরতাল-অবরোধ এলেই আক্কেল আলীর মতো অর্ধাহারে-অনাহারে সীমাহীন কষ্টে চলে কোরবান আলী, রহিমউদ্দিন, নেছার মিয়া, জুলহাস মণ্ডলসহ লাখো শ্রমিকের পরিবার। তারা কেউ রাজধানীর কামলা হাটের দিনমজুর, কেউ বা ঠেলাচালক, আবার কেউ স্টেশন-টার্মিনালের কুলি-মজুর। প্রতিদিনই ১৫০-২০০ টাকায় তাদের শ্রম বিক্রি করেন, দিনভর কাজ শেষে ফিরে যান বাসায়। মজুরির টাকায় কেনা হয় চাল-ডাল, আলু, পিয়াজ- চলে রান্নার আয়োজন। নিত্য আয়ের টাকাতেই যাদের সংসার চালানো কঠিন, সেখানে তিন-চার দিন কাজ না থাকলে তাদের অবস্থা কী দাঁড়ায়, সহজেই অনুমেয়।

অবরোধে রিকশা-ভ্যান চালানো নিষেধ না থাকলেও গ্যারেজ মালিকরা তা বের করেন না। ফলে হাতে গোনা কিছু চালক রিকশা নিয়ে বের হলেও যাত্রীর অভাবে স্ট্যান্ডে স্ট্যান্ডে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। হরতাল, অবরোধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। কারখানার গেটেও ঝোলে তালা। তাই কাজও নেই।

নির্মাণশ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী। তাদের অবস্থা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় আরও খারাপ। অনেকেই স্বামীপরিত্যক্তা। শ্রমজীবী মায়ের আয়ে চলে পুরো পরিবার। স্বাভাবিক অবস্থায়ই তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না আর হরতাল-অবরোধে তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।

অবরোধের জের হিসেবে নগরীর ম্যাঙ্,ি লেগুনা, অটোর চালকরা আছেন আরও বিপাকে। বাসাবো স্ট্যান্ডের লেগুনাচালক জোনায়েদ আলী জানান, কড়া হরতালেও তারা স্থানীয়ভাবে লেগুনা, ম্যাঙ্,ি অটোরিকশা নিয়মিত চালাতেন। কিন্তু এবারের অবরোধে বনশ্রী এলাকায় এক লেগুনাচালককে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর থেকে আর চালানোর ঝুঁকি নেওয়া যাচ্ছে না। জোনায়েদ আলী বলেন, 'চার দিনের অবরোধে চালক-হেলপাররা সবাই আছেন খাওয়ার চিন্তায়, আর আমি আছি বাসাভাড়ার মহাফাঁপরে। প্রতিদিন আয় করা টাকা থেকে বাসাভাড়ার জন্য আলাদাভাবে দেড় শ টাকা করে জমা রাখতাম।

কিন্তু টানা অবরোধের কারণে বাসাভাড়ার সে টাকা খরচ করেই সংসার চালাতে হয়েছে। ১ তারিখে ভাড়া দেব কোত্থেকে সে চিন্তায় পেটে ভাত যাচ্ছে না ভাই। '

হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভে অভিন্ন অবস্থা : ইদানীং নিম্ন আয়ের মানুষ হরতাল-অবরোধের প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের লক্ষ্য করেই পেট্রল বোমা ছোড়া হচ্ছে, জ্যান্ত মানুষকেই পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। ফলে আরও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মানুষের মধ্যে।

হরতাল-অবরোধ কিংবা বিক্ষোভে অভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে রাজধানীতে। রাজনৈতিক কর্মসূচি মানেই হামলা, ভাঙচুর, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, বোমা-ককটেল, গুলিবর্ষণের ঘটনা। কোনো কর্মসূচিকে আলাদা করে ভাবতে পারছে না শ্রমজীবী মানুষ। বিক্ষোভ মিছিল হলেও তারা ককটেল-বোমার বিস্ফোরণ দেখতে পান, চলে পুলিশের ধাওয়া, গুলি, গ্রেফতার অভিযান। এসব কারণে হরতালেও বাইরে বেরোতে চায় না মানুষ, অবরোধেও বাসায় থাকা নিরাপদ ভাবে।

গত সপ্তাহে হরতাল আর চলতি সপ্তাহে অবরোধের ফলে রাজধানীতে প্রাণচাঞ্চল্য নেই বললেই চলে। রাস্তাঘাট, মার্কেট-বাজারে লোকজন নেই, তাই নগরীর ফুটপাতের চিরচেনা ভিড়ও নেই। যারা ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে দোকান খুলেছেন, ক্রেতাদের অভাবে তারাও অলস সময় কাটাতে বাধ্য হন। তেজগাঁও রেলগেট-সংলগ্ন ট্রাকস্ট্যান্ডে চালকরা জোট বেঁধে গল্প-গুজব আর তাস খেলে সময় কাটাচ্ছিলেন। অবরোধ শেষ হলেও গতকালের জন্য ট্রাক, পিকআপ ভাড়া নিতে কাউকে দেখা যায়নি।

চালকদের একজন আবু হানিফ (৪২) বলেন, 'হরতাল অবরোধ নিয়া আছি বড় মসিবতে। একদিন হরতাল-অবরোধ হলে আগে-পরের তিন দিন তার জের চলে। গাড়ি চালাইলে ভেঙে ফেলে, আগুনে পুড়ে দেয়-আবার না চালাইলে বউ, ছেলে-মেয়েসহ উপোস কাটাতে হয়। '

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।