আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন পথে লিবিয়া?

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা

তামীম রায়হান ............................. উত্তর আফ্রিকার প্রচুর সম্ভাবনাময় দেশ লিবিয়া। ১,৮০০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দেশটিতে জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ছয় মিলিয়ন। আয়তনের দিক দিয়ে লিবিয়া পৃথিবীর ১৭তম এবং আফ্রিকা মহাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। স্বৈরশাসক গাদ্দাফির একনায়কতন্ত্রের দুঃশাসনে লিবিয়ার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তির প্রহর গুণছিল। লিবিয়ার মানুষ বিশ্বাস করতো, দক্ষ এবং উদার নেতৃত্ব পেলে তাদের দেশ অল্প কয়েকদিনেই দুবাইকে পেছনে ফেলে দেবে।

কিন্তু বিগত চল্লিশ বছর ধরে গাদ্দাফির স্বেচ্ছাচারিতা এবং অন্যায় অত্যাচার ও দেশের মানুষের প্রতি তার অবিশ্বাস লিবিয়াকে নিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারের দিকে। অবশেষে পাশ্ববর্তী দেশ তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া ‘আরব বসন্ত’ তাদেরকে সে সুযোগ করে দেয়। গাদ্দাফির কবল থেকে মুক্ত হতে রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ মানুষ। ২০১১ সালের ১৭ ফেব্র“য়ারীর পর থেকে বদলে যায় দৃশ্যপট। শুরু হয় সংঘাত এবং বিদ্রোহ।

বেনগাজি, বায়যা শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরেও। গাদ্দাফির নির্দেশে সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং আক্রমণ শুরু করে। বছরব্যাপী ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর অক্টোবরের ২০ তারিখ ধরা পড়েন গাদ্দাফি। তাকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। ২৩ অক্টোবর থেকে লিবিয়া নতুন করে স্বাধীন ঘোষিত হয়।

পতাকা বদলে ফেলা হয় এবং এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করে দেশটি। কিন্তু তারপর? লিবিয়াবাসী ভেবেছিল, এখন থেকে তারা অন্তত শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপদে দু মুঠো খেয়ে বাঁচতে পারবে। সে আশায় তারা নতুন সরকার এবং বিদ্রোহীদেরকে স্বাগত জানিয়েছিল এবং সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল। স্ েঘটনার পর প্রায় দু’বছর পেরিয়ে গেছে। এ দু বছরে লিবিয়ার আকাশে কালোমেঘ আরো ঘন হয়েছে।

গাদ্দাফির পতনের পর ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ এবং পারস্পরিক গোত্রকলহে সার্বিক অবস্থার করুণ অবনতি গোটা লিবিয়াবাসীকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আড়ষ্ট করে রেখেছে। বিদ্রোহ সমাপ্তির পর দু বছর পেরিয়ে গেলেও লিবিয়া এখনো কঠিন বিপদজনক সময় পার করছে। দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা, জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব, সশস্ত্র বিদ্রোহীদের পারস্পরিক সংঘাত এবং নেতাদের বিভক্তি এ বিপদকে উস্কে দিয়েছে। লিবিয়ায় এখন মানুষের হাতে হাতে অস্ত্র। সশস্ত্র কয়েকজন মিলে গ্র“প তৈরী করে অন্যদেরকে শায়েস্তা করছে।

অতীতের কোনো শত্র“তা বিবাদের প্রতিশোধ নিচ্ছে। লিবিয়ার বর্তমান নামকাওয়াস্তে সমাসীন সরকারের সামনে এ বিশৃঙ্খলা দমন করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিবিয়ার অবস্থা যেন দিনদিন গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সোমালিয়া হয়ে যাচ্ছে। এমন নৈরাজ্যের আধাঁরে দুবাই হওয়ার স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে লিবিয়াবাসীর। দেশটির পুলিশবাহিনী, সেনাবাহিনী এবং সীমান্তরক্ষা বাহিনীসহ সর্বত্র এ বিভক্তি ও বিশৃঙ্খলা চলছে।

যেসব সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনীকে বিভিন্ন সরকারী নিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তারা কেউই নিজেদের স্বার্থ ছাড়া একচুল নড়ছে না। ফলে পারস্পরিক বিবাদে সব জায়গায় স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রত্যেকটি গ্র“প নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনই শক্তি প্রদর্শনের খেলায় গত অক্টোবর মাসে ১০ তারিখে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও অপহরণ করেছিল একটি সশস্ত্র গ্র“প। এর আগে ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বেনগাজির মার্কিন দূতাবাসে হামলা করা হয় এবং আমেরিকার রাষ্ট্রদূতসহ তিনজন মার্কিনী ওই হামলায় নিহত হন।

এ বিভক্তি ও শক্তি প্রদর্শনের মূলে রয়েছে গোত্রগত সংঘাত, আঞ্চলিক বিবাদ এবং রাজনৈতিক আদর্শের পার্থক্য। দিনে দিনে ইসলামপন্থী এবং লিবারেলদের মধ্যে দূরত্ব ও সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। বিশ্লেষকদের মতে স্বাধীন লিবিয়ার বর্তমান সরকার প্রথমেই যে ভুল করে ফেলেছে তার সংশোধন হতে অনেক সময় লেগে যাবে। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই জনগণের হাতে রয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও একত্রিকরণের সুযোগ কাজে লাগায়নি। ফলে দিনদিন অস্ত্রধারীদের সংখ্যা বেড়েছে।

২০১১ সালের ২৩ অক্টোবর স্বাধীনতা ঘোষণার দিন লিবিয়ায় অস্ত্রধারী বিদ্রোহীদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার। আর সরকারী হিসাবমতে বর্তমানে তা তিনগুণ বেড়ে দুই লাখ সত্তর হাজার ছাড়িয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনসমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আলি যায়দানের যোগ্যতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলছেন, আলী যায়দানের মন্ত্রীসভার সদস্যদের অবয়বে গাদ্দাফির ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। আমরা তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

’ তারাবলুস, বারকা এবং ফেযান- এ তিনটি বৃহৎ অঞ্চল নিয়ে গঠিত লিবিয়ায় চলমান এ সঙ্কট এবং অনাস্থার মধ্যে কেউ কেউ বিভক্তির দাবিও তুলছেন। তারা তিনটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করে ফেডারেল পদ্ধতিতে লিবিয়াকে ভাগ করতে চাইছেন। লিবিয়ার রাজধানী তারাবলুস (ত্রিপোলী) এবং বেনগাজিসহ অন্যান্য শহরে প্রায় প্রতিদিনই কেউ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীতে মিছিল বের করছেন আবার বিপক্ষে অন্যরা ঐক্যবদ্ধ লিবিয়ার জন্য শ্লোগান দিচ্ছেন। এভাবেই খনি নিয়ন্ত্রণ থেকে নিয়ে সীমান্ত পাহারা এবং প্রশাসনের সর্বত্র এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে গোটা লিবিয়ায়। আমি যেখানে থাকি- কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে পৃথিবীর প্রায় ৭০টি দেশের ছাত্ররা রয়েছে।

এদের মধ্যে লিবিয়ার তরুণবন্ধুরাও আছেন। কয়েকদিন আগে এক আড্ডায় গাদ্দাফি সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন আমাকে চমৎকৃত করেছে। তাদের ভাষায়, ‘গাদ্দাফি একজন দয়া ও দানের বৃক্ষ ছিলেন। কিন্তু তিনি এতবড় বৃক্ষ যে তার ফলগুলো সব লিবিয়ার সীমানার বাইরে অন্যান্য আফ্রিকার দেশে গিয়ে পড়তো। আমরা নিজেরা কিছুই পেতাম না।

’ আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, গাদ্দাফির পতনের পর তোমরা কি এখন সত্যিই ভালো আছো? এক কথায় কেউ জবাব দিতে পারেনি। কয়েক বছর পর অবস্থা ভালো হবে এমন আশার ভুমিকা শুনিয়ে তাদের সরল স্বীকারাক্তি, ‘ঠিক এই মুহূর্তে কথা বলতে হলে বলবো, আমরা ভালো নেই। যে বিদ্রোহীদেরকে ভালোবেসে সমর্থন দিয়েছি, তারাই এখন দেশটির বিপদ ও পতন এবং বিভক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ঘরে ঘরে অস্ত্র। ব্যক্তিগত কিংবা গোত্রগত দ্বন্দে সবাই এখন অস্ত্রের গরম দেখাচ্ছে।

গাদ্দাফির আমলে বাক স্বাধীনতা ছিল না। এখন বাকস্বাধীনতার অতি ব্যবহারে আমাদের স্বপ্ন এবং সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি না, আমরা কোথায় যাচ্ছি। এভাবে কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। ’ - আলজাজিরা, আলআরাবিয়া, বিবিসি, সিএনএন, আলআহরাম, স্কাইনিউজআরাবিয়া অবলম্বনে


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।