আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবি ঠাকুরের "কাবুলিওয়ালা"

1
আজকাল স্রেফ জীবিকার তাগিদে দলে দলে লোকজন চলে যাচ্ছে দূর প্রবাসে। অথচ একটা সময় ছিল যখন সুযোগ আর সীমাহীন ধনসম্পদে ভরপুর ছিল এই ভারতীয় উপমহাদেশ। আশেপাশের দেশগুলো সহ বহু দূরদূরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ এসেছিল এখানটায় শুধু ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। সেই স্বর্ণময় দিন আর নেই। সর্বশেষ জীবিকার তাগিদে শ্রমজীবী মানুষদের এদেশে আসতে দেখেছিলাম সম্ভবত আশির দশকের শেষের দিকে (দলে দলে রোহিঙ্গারা আজো প্রবেশ করছে বাংলাদেশে, তাতে অবশ্য জীবিকা আর জীবন বাঁচানোর দায়- দুটোই আছে), তখন বয়স নিতান্ত কম ছিল , নাকবোঁচা কিছু নির্মাণ শ্রমিকদের দেখেছিলাম চট্রগ্রামের নির্মাণাধীন কিছু ভবনে কাজ করতে।

বলাবাহুল্য ওরা ঠিক কোথা থেকে এসেছিল এবং কোথায় বা হারিয়ে গিয়েছিল, সেটি আর পরবর্তীতে জানা হয়নি। যাহোক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবদ্দশায় এমন অজস্র দেশান্তরী শ্রমজীবী মানুষের আনাগোনা দেখেছেন বাংলার পথে ঘাটে। এদের মধ্যে অনেকেই যথারীতি উঠে এসেছে তার লেখনীতে। এমন অজস্র অবিস্মরণীয় চরিত্রের মাঝে যে চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তার ঘর ছিল সুদূর আফগানিস্তানের কাবুলে। কাবুলিওয়ালা গল্পের নামটি নিয়ে দীর্ঘদিন একধরনের বিভ্রান্তিতে ডুবে ছিলাম।

‘কাবুলিওয়ালা একজন ফেরিওয়ালা ধরনের লোক যে কিনা কাবুলি নামের খাদ্যদ্রব্য শিশুদের কাছে বিক্রি করে’- এমন একটা ধারনা দীর্ঘদিন আমার মাথায় খেলে বেড়িয়েছে। আমাদের জন্মের অনেক আগেই বাংলার সেই অসীম ধনভাণ্ডার- শৌর্যবীর্য বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল। একটু বড় হবার পর থেকেই আমরা দেখেছি রাস্তাঘাটে অনাহারী মানুষের ঢল, স্রেফ ভিক্ষাবৃত্তিকেই অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে বিশ্বাস করে ফেলেছে- এমন অজস্র মানুষ। এর মাঝে সোনা-রুপায় মোড়ানো ঐশ্বর্যশালী এক বাংলার রুপ কল্পনা করা ছিল আমাদের জন্য দুরহতম কাজগুলোর একটি, যেখানে দূরদূরান্ত থেকে দলে দলে লোক ছুটে আসছে ছোট একটি কাজের সন্ধানে। কাবুলিওয়ালা গল্পে এমনই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা যায় যেখানে সুদূর কাবুল থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসা কাবুলিওয়ালা রহমত ঘটনাক্রমে পরিচিত হয়ে যায় লেখকের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মিনি’র সাথে।

তখনতো যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো উন্নত ছিলনা, ধরে নেওয়া যাক কাবুলিওয়ালা রহমত স্রেফ পায়ে হেঁটেই এই বঙ্গদেশে এসেছিল। যেকারনে ঝানু ব্যবসায়ীর মত নিজের লাভের হিসেবটুকু বুঝে নেওয়াটাই কাবুলিওয়ালার জন্য স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেটি না করে কাবুলিওয়ালাকে বরং দেখা গেল অনাত্মীয় মিনি’র সাথের সম্পর্কটিকেই বেশি গুরুত্ব দিতে। বিষয়বুদ্ধিহীন কাবুলিওয়ালা ব্যবসাপাতি ফেলে রেখে প্রায় প্রতিদিনই চলে আসতো মিনি’র সাথে দেখা করতে, সাথে বাদাম-কিসমিস কিংবা পেস্তাবাদামের মত মহার্ঘ সব উপঢৌকন। গল্পের এ পর্যায়ে কাবুলিওয়ালার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়।

‘বিশ্বাস করে ঠকা’- এ যেন আমাদের বাঙালীদের জীবনে এক অলঙ্ঘনীয় পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিনি’র মা ও যথারীতি গল্পের এ পর্যায়ে কাবুলিওয়ালার উদ্দেশ্য নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন এবং কাবুল দেশে দাস ব্যবসার হাল হকিকত নিয়ে কিছু অনুসন্ধান চালালেন। মিনির মায়ের আশঙ্কাটি ভুল ছিলনা। তবে বিশ্বাস করে এ গল্পে বরং ঠকতে হয়েছিল কাবুলিওয়ালাকে। স্পষ্টবাদী, ভয়ডরহীন কাবুলিওয়ালা অবশ্য সেই প্রতিবেশী তস্করকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে দেরি করেনি।

ছুরিকাঘাতের মত সাংঘাতিক অপরাধের দায়ে কাবুলিওয়ালাকে কারাগারে পাঠানো হল। সময় তার নিজ গতিতেই বয়ে যায়, কাবুলিওয়ালার জন্য কোন কিছু থেমে থাকলোনা। পাঁচবছরের সেই পিচ্চি মিনি বড় হতে হতে একসময় বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেল। মিনির বিয়ের দিন করুন ভৈরবী রাগিণী যখন শরতের রৌদ্রের সাথে মিলেমিশে পুরো বিশ্বজগতকে আবছা করে দিচ্ছিল, তখনই সেই অস্পষ্ট কুয়াশাকে পাশে সরিয়ে দৃশ্যপটে এসে আবার হাজির হল কাবুলিওয়ালা রহমত। মিনি’র মা সহ অনেক পাঠক দীর্ঘদিন ধরে মনের গভীরে একটি প্রশ্ন জমিয়ে রেখেছিল- ‘কাবুলিওয়ালা আসলে কি চায়?’ জীর্ণ মস্ত ঢিলা জামাটার ভেতরে হাত চালিয়ে বুকের কাছ থেকে এক টুকরো ময়লা কাগজ বের করে কাবুলিওয়ালা সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিল।

তখনতো ফটোগ্রাফের দিন ছিলনা। কাবুলে রেখে আসা কন্যার হাতের ভুষো মাখানো কাগজটি সম্বল করে কাবুলিওয়ালা প্রতি বছর আসতো বঙ্গদেশে, পথে ঘাটে মেওয়া বেঁচে বেড়াত। বড় বড় দার্শনিক বা লেখকরা নাকি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হন। রবি ঠাকুর বাঙালী জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভেবেছিলেন- সেটি এখন আর বলা যাচ্ছেনা, তবে পাশার দান বদলে গেছে। এখন বিভিন্ন সম্ভ্রান্তবংশীয় বাঙালীরাই কাবুলিওয়ালা হয়ে দূর দূরান্তে মেওয়ার মতোনই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পণ্য ফেরি করে বেড়ান... দেশে পড়ে থাকে মিনিরা।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।