আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ বাবা'র সপ্তদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে বাবাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

আজ ৬ ডিসেম্বর ২০১৩। ১৯৯৬ সালের এই দিনে আমার বাবা সবাইকে ছেড়ে পরপারে চলে যান। ১৭ বছর আগের সেই দিনের প্রতিটি মুহূর্ত আমি ভুলতে পারিনি। আজ বাবা'র সপ্তদশ মৃত্যুবার্ষিকী। সবাই আমার বাবা'র জন্য দোয়া করবেন।

বাবা ছিল আমার সবচেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড। বাবা'র সঙ্গে আমি সব বিষয়ে খুব প্রাণান্ত আলোচনা করতাম। যুক্তি পাল্টা যুক্তি তুলে ধরতাম। বাবাকে নিয়ে আমি প্রচুর গাছ লাগিয়েছি। সেই গাছগুলো এখন অনেক বড় বড়।

বাবা'র সঙ্গে অনেক মাছ ধরেছি। বাবা'র সঙ্গে মাঠে মরিচ লাগিয়েছি। ইরিধানে পানি সেচ করেছি। সবজি ক্ষেতে সবজি লাগিয়েছি। আমার বাবা ছিলেন একজন আদর্শ কৃষক।

আমি একজন আদর্শ কৃষকের সন্তান। বাংলাদেশে এটাই আমার গর্ব করার মত একমাত্র বিষয়। তোমাকে খুব মিস করি বাবা, খুব। তোমাকে খুব ভালোবাসি, বাবা। তোমাকে হারিয়ে আমি জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়েছি।

তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ বাবা!! দূর আকাশের মিটিমিটি নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে তোমাকে খুঁজে ফিরি। তোমার হাসিমুখ আমার এখনো সঙ্গী। তোমার দরাজ গলার অট্টহাসি এখনো আমার কানে ভেসে আসে। তুমি নেই, যেনো অনেক কিছুই নেই। এই নেই'র ভেতর আমার আর ভালো লাগে না বাবা।

সত্যি ভালো লাগে না। তোমাকে খুব মিস করি বাবা, খুব মিস করি। বাবা ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন সফল সংগঠক। গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের বাড়িতে মোট তিন গ্রুপের আগমন ঘটতো। খুব গোপনে অনেক খোঁজ খবর নিয়ে খাবার আর ইনফরমেশান সংগ্রহ করার জন্য আমার মায়ের কাছে আসতেন মুক্তিযোদ্ধারা।

পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি যেটিকে সবাই নকশাল নামে চিনতো, তাদের কিছু আনাগোনা ছিল আমাদের বাড়িতে। তাদের দলের অনেকে বিভিন্ন সময়ে বাবাকে খুন করার হুমকি দিয়ে যেতেন মা'র কাছে। তারা অনেক সময় আমাদের কাচারি ঘরে রাতে ঘুমাতেন। মায়ের রান্না করা খাবার খেতেন। আর যাবার সময় বাবা কখন আসেন, সে বিষয়ে মায়ের কাছে জানতে চাইতেন।

একবার তারা আমার বৃদ্ধ দাদু ভাইকে জিম্মি করে বাবাকে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর তৃতীয় পক্ষটি ছিল রাজাকার-পাকসেনাদের দল। তারা দিনের বেলায় এসে বাবাকে খুঁজে যেতেন। আমাদের বাড়িতে কোনো মুক্তি পালিয়ে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতেন। গোটা যুদ্ধের নয় মাস বাবা পালিয়ে পালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাবা ক্লাশ থ্রি পর্যন্ত স্কুলে গেছেন। থ্রি পাশ করে ক্লাস ফোরে ওঠা হয়নি তার। বাবা'র হাতের লেখা বেশ ভালো ছিল। ছোট ছোট অক্ষরে লিখতেন। বাবা কিছু ডায়েরি লিখতেন।

সেখানে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের তারিখ লিখে রাখতেন। কিষানের হিসাব লিখে রাখতেন। কারো কাছ থেকে ঋণ নিলে সেই টাকার হিসাব লিখে রাখতেন। কাউকে টাকা পয়সা দিলে সেই হিসেব লিখে রাখতেন। জমির খাজনা পরিশোধের তারিখ ও টাকার হিসেব লিখে রাখতেন।

জমিতে কোন ফসল কখন দিবেন সেই তারিখ লিখে রাখতেন। ধান কাটার তারিখ লিখে রাখতেন। মোট ধানের হিসাব বছর ওয়ারি লিখে রাখতেন। আর আলাদা একটা পাতায় আমাদের ভাইবোনদের জন্ম তারিখ লিখে রাখতেন। সেখানে বাবা'র বন্ধু জ্যোতিষি শিব নারায়ন হিরা আমাদের ভাইবোনদের যে কষ্টি হিসেব করে বলতেন, তার সারাংশ লিখে রাখতেন।

একবার শেরে বাংলা একে ফজলুল হক আমাদের পাশের থানা চিতলমারীতে জনসভা করতে আসলেন। বাবা তখন যুবক। শেরে বাংলাকে দীর্ঘা থেকে চিতলমারী পর্যন্ত মাঝির নৌকায় বাবা ও তার কয়েকজন বন্ধুরা সঙ্গ দিয়েছিলেন। সেটা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ের কথা। চিতলমারী শেরে বাংলা'র নৌকা পৌঁছালে সেখানে তাকে স্বাগত জানান হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব।

তখন শেরে বাংলা'র সঙ্গে করমর্দনের পর নেতারা একে নৌকার অন্যান্য সবার সঙ্গেও করমর্দন ও কোলাকুলি করেছিলেন। সেটা ছিল বাবা'র জীবনে একটা অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি। আরেকবার রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন খাল কাটা কর্মসূচি হিসেবে মাটিভাঙ্গা ও নাজিরপুর সফর করেন, তখন নাজিরপুরে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে তিনি দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। সেই টেবিলে বাবাও অন্যান্য বিশিষ্ট জনদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। জিয়া তখন বলেছিলেন, আপনারা তো সবাই আওয়ামী লীগের লোক।

আমাকে যে এভাবে আপ্পায়ন করলেন, তাতেই আমি খুশি। আমি খাল কেটে দেওয়ায় আপনাদের এলাকায় আবার কুমির আসবে নাতো? এটা নিয়ে সেখানে হাসাহাসি'র একটা হল্লা পড়ে গিয়েছিল। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বাবু ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল ছিলেন বাবা'র বন্ধু মানুষ। তিনি আমাদের বাড়িতে শিক্ষামন্ত্রী থাকা অবস্থায় একবার এসেছিলেন। এরাশাদ যখন রাষ্ট্রপতি তখন সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রী ছিলেন মোস্তফা জামাল হায়দার।

তিনিও বাবা'র বন্ধু ছিলেন। জামাল সাহেবের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে বরইবুনিয়ায়। তিনি বাড়িতে আসলে সময় পেলেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী'র মামা হলেন জামাল সাহেব। মতিয়া চৌধুরীও একবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন।

মতিয়া চৌধুরী'র মায়ের সঙ্গে (জামাল সাহেবের বড় বোন) আমারও অনেকবার দেখা হয়েছে। উনি ছোটদের খুব পছন্দ করতেন। আমরা কলেজে যাবার পথে বা ফেরার পথে ওনাদের বাড়িতে কুলবরই খাবার লোভে ঢু মারতাম। উনি আমাদের দেখলেই বসিয়ে রেখে কুলবরই আনিয়ে খেতে দিতেন। আর সবার বাবার নাম বাড়িঘরের খোঁজখবর নিতেন।

ওনার বাবাকে আমরা দেখেছি। আমরা ডাকতাম হাজি সা'ব। উনি আরব বেদুঈনদের মত লম্বা আলখেল্লা পড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন। ওনাকে দেখলেই আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে উচ্চারণ করতাম, সাপ সাপ সাপ.... জবাবে উনি হাঁক ছাড়তেন, কোথায় সাপ? আমরা হাজি সা'ব বলেই ভো দৌড় দিতাম। পরে উনি বাবা'র কাছে নালিশ দিতেন।

কিংম্বা বাড়িতে ঢুকে মায়ের কাছে নালিশ দিতেন এই বলে যে, তোমাদের বাড়ির খোকায়রা ভারী দুষ্টু! বাবা'র কাছে রোচজ প্রচুর মানুষ আসতেন। একেবারে খুব ভোরে কখনো আসতেন যতীন চন্দ্র নাগ। আমরা ডাকতাম যতীন'দা। যতীন দা'র কাজিনদের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় তদবিরের জন্য বাবাকে নিয়ে নাজিরপুর যাবার জন্য বা পরামর্শ নেবার জন্য যতীন'দা আসতেন।

কখনো গভীর রাত পর্যন্ত যতীন'দা আমাদের বাড়িতে বাবা'র সঙ্গে বসে দুনিয়ার গল্পো করতেন। যতীন'দার পেশা ছিল কাঠমিস্ত্রী। যতীন'দার হাতেই আমার কাঠমিস্ত্রী বিদ্যায় হাতেখড়ি। কখনো সকাল বেলা আসতেন চিত্ত ঘরামী ও তার মা। চিত্ত'দার বাবা নেপাল ঘরামী মারা যাবার পর এই পরিবারের সকল খোঁজখবর বাবা রাখতেন।

চিত্ত'দা ও তার মা আসতেন একটা নালিশ নিয়ে। চিত্ত'দার ছোট ভাই জীবন ঘরামী ছিল ভীষণ ডানপিঠে। তাকে কিভাবে স্কুলমুখী করা যায় এটাই তাদের আর্জি থাকতো। বাবা জীবনকে পরে স্কুলমুখী করেছিল। জীবন'দা আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় হলেও আমাদের ক্লাসে পড়তেন।

ক্লাস টেন পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। কখনো আসতেন রনজিৎ মন্ডল আর তার মেজো চাচা ধীরেন চন্দ্র মন্ডল। পালদের সঙ্গে মন্ডলদের জমি নিয়ে মামলা ছিল। সে বিষয়ে পরামর্শের জন্য তারা আসতেন। রনজিৎ মন্ডল'রা পাঁচভাই, অজিত, রনজিৎ, রেবতী, প্রভাস, প্রকাশ আর একবোন শোভা।

ওদের বাবা মহেন্দ্রনাথ মন্ডল ছিলেন বাবা'র পরম বন্ধু। তিনি মারা যাবার পর ওই পরিবারের সত্যিকারের গার্ডিয়ানের ভূমিকা পালন করেছেন আমার বাবা। এছাড়া আসতেন বাবা'র বন্ধু শিব নারায়ন হিরা, যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, অমল সিংহ, মাস্টার অনীল সিংহ, মাস্টার যতীষ বাগচি, মনি মন্ডল, আমার হাইস্কুলের হেডস্যার মনীন্দ্রনাথ মজুমদার, আমার শিক্ষক অনন্ত মজুমদার, আমার শিক্ষক অমৃত লাল রায়, আমার শিক্ষক নিরোদবিহারী রায়, সমাজসেবক প্রভাষ চন্দ্র মজুমদার, সমাজসেবক ডাক্তার শান্তিরঞ্জন রায়, সমাজসেবক ডাক্তার সুধীর চন্দ্র মন্ডল, সমাবসেবক কানাই মন্ডল, চেয়ারম্যান আবদুস সাত্তার, চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ, সমাজসেবক যোগেশ হালদার, মাস্টার অনীল হালদার, সমাজসেবক শামসুল হক মহাজন, সমাজসেবক মেম্বার মোক্তার হেসেন, সমাজসেবক আজাহার হোসেন, সমাজসেবক মাস্টার দীন মোহাম্মদ, মাস্টার সত্যাংশু মন্ডল, মাস্টার জগদীশ মন্ডল প্রমুখ। বাবা'র কাছে প্রায় রোজ যারা আসতেন তাদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ মামা, রসুল মামা, সাত্তার মামা, জামীর মামা, নটবর কাকা, সদাই'দা, যতীন্দ্রনাথ মন্ডল, হরিদাস কাকা, হরিপদ পাল, যোগেন মাঝি, হরবিলাশ, অনীল মাস্টার, আজিজ কাকা, সোলায়মান জামাই, ফটিক মামা, নালু নানা, রাঙ্গু মামা, সালেক জামাই, নালেক তাউঈ, কাদের মাঝি, বিপিন বাঢ়ৈ, সতীশ বড়াল, আলী খাঁ নানা, আইউব কাকা, মোসলেম খালু, হামিদ জামাই, খালেক খালু, খালেক শিকদার, মালেক মোল্লা, ডাঃ চিত্তরঞ্জন ঢালী, ডাঃ আজম মামা, রুস্তুম তাউঈ, ডাঃ সুভাস চন্দ্র হালদার প্রমুখ। গ্রামের বিভিন্ন শালিস দরবার নিয়ে যে সব মাতুব্বরগণ প্রায়ই বাবা'র কাছে আসতেন তারা হলেন, আবদুর রাজ্জাক মুন্সী নানা, শামসুল হক মুন্সী নানা, ডাঃ আলাউদ্দিন শেখ নানা, কানাই মন্ডল, ডাঃ সুধীর মন্ডল, মনি মন্ডল, কানাই মন্ডল, শিব নারায়ন হিরা, ধীরেন্দ্র নাথ মন্ডল, রনজিৎ মন্ডল, অনীল মাস্টার, প্রভাস মজুমদার, অনন্ত মজুমদার, মনীন্দ্রনাথ মজুমদার, যোগেশ হালদার, মাস্টার দীন মোহাম্মদ, মাস্টার গোলাম মোস্তফা, নূর মোহাম্মদ ফরাজী, মোক্তার মেম্বার, রাজ্জাক ফকির, চেয়ারম্যান আবদুস সাত্তার, চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ প্রমুখ।

দশগ্রামের নানান পেশার মানুষের সঙ্গে বাবা'র ওঠাবসা ছিল। তাদের কেউ কৃষক, কেউ কাঠমিস্ত্রী, কেউ পাট বিক্রেতা, কেউ পল্লী ডাক্তার, কেউ খেয়ানায়ের মাঝি, কেউ জেলে, কেউ কিষাণ, কেউ কামার, কেউ কুমার, কেউ দইওয়ালা, কেউ পানবিক্রেতা, কেউ ফার্মেসির দোকানদার, কেউ হাটের ফেরিওয়ালা, কেউ খেজুরগাছের গাছিয়াল, কেউ মাতুব্বর, কেউ প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদ, কেউবা একেবারে সরাসরি আত্মীয়। সবাই তাদের নানা ধরনের বিষয় নিয়ে পরামর্শ করার জন্য বাবা'র কাছে আসতেন। কেউ আসতেন স্রেফ কখন জমিতে শস্য বুনবেন সেই হিসাব নিতে। কেউ আসতেন কখন ধান কাটা শুরু করা যায়, সেই পরামর্শ নিতে।

কেউ আসতেন স্রেফ গল্পো করতে। হরেব রকম মানুষের সঙ্গেই বাবা'র নিবিঢ় বন্ধুত্ব ছিল। বাবা'র মৃত্যু'র পর তাদের কেউ কোনো দিন বাবা'র সম্পর্কে কোনো খারাপ কিছু বলেননি। বাবা'র জীবদ্দশায় বরং এদের অনেকে পেছনে অনেক কথাবার্তা বলতেন। তবু মেজর কোনো সমস্যায় পরলেই তাদেরই দেখতাম বাবা'র কাছে সুপরামর্শের জন্য আসতেন।

এমনও দেখেছি, যাদের মধ্যে জমি নিয়ে মামলা চলছে, সেই দুই পক্ষের লোকই আলাদা আলাদা সময় বাবা'র কাছে আসতেন। বাবা তাদের সরাসরি জানিয়ে দিতেন, ও এসেছিল, ওর জন্য যেটা করণীয় সেটা বলে দিয়েছি। তোমার জন্য এটা করলে ভালো হবে। সবচেয়ে ভালো হয় তোমরা মামলা উঠিয়ে আমাদের নিয়ে বসে বিষয়টা মিটিয়ে ফেলো। এমন অনেক জটিল বিষয় যেটা আদালতে সমাধান হয়নি, বাবা'র পরামর্শ নিয়ে উভয় পক্ষ মামলা তুলে নিজেরা বসে মিটিয়ে ফেলেছে।

অনেকে আসতেন মামলার কোন ধাপে কি করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ নিতে। বাবা সবাইকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে সব সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতেন। কখনো কখনো কেউ আসতেন তাদের ছেলেমেয়েদর পরীক্ষার ফিস দিতে না পারায় পরীক্ষা যাতে বন্ধ না হয়, সেজন্য বাবা'র কাছে অনুরোধ নিয়ে। বাবা যেনো স্কুলে গিয়ে মাস্টারদের সঙ্গে দেখা করে ফিস মওকুফ বা পরে দেবার ব্যবস্থা করেন। অনেক সময় বাবা নিজেই তাদের ফিস দিয়ে দিতেন।

অনেকের চাকরির সুপারিশ করার জন্য বাবা চিঠি লিখতেন। সেই চিঠি'র শ্রুতি লেখকের দায়িত্ব পালন করতাম আমি। বাবা বলতেন, আমি লিখতাম। লেখা শেষ হলেই আবার পড়ে শুনাতাম। বাড়তি কিছু লেখা'র দরকার হলে সে বিষয়ে আমাকে ইঙ্গিত করতেন।

আমি তখন চিঠি লেখায় পটু হয়ে উঠেছিলাম। বাবা যাদের কাছে চিঠি লিখতেন, সেসব চিঠি'র প্রায় সবই আমার হাতে লেখা। পরপর তিনবার ইরিধান উৎপাদনে বাবা নাজিরপুর থানার মধ্যে সেরা কৃষক নির্বাচিত হয়ে পুরস্কার জিতেছিলেন। পুরস্কার হিসেবে একবার পেয়েছিলেন একটা ফুটবলের মত গোল রেডিও। সেই রেডিও ছিল ছোটবেলায় আমার বিনোদনের সঙ্গী।

ওটা আমার ছোট ভাই আর আমি মিলে ইঞ্জিনিয়ারিং করে করে নষ্ট করেছি। রেডিও'র ভেতর কি কি আছে দিনের মধ্যে সুযোগ পেলেই তা আমরা একবার খুলতাম আর একবার লাগাতাম। শুধু সন্ধ্যায় বিবিসি শোনার আগে যদি ঠিক করতে না পারতাম তাহলেই ধরা খেয়ে যেতাম। তখন সেই রেডিও বাজারে সুজিত'দার দোকানে নিতে হত ঠিক করার জন্য। রেডিওতে দেশী বিদেশী খবর শোনা ছিল বাবা'র খুব প্রিয় একটি বিষয়।

বিশেষ করে সন্ধ্যায় বিবিসি আর রাতে ভয়েস অব আমেরিকা'র খবর। সেই খবর শোনার জন্য অনেকেই তখন আমাদের বাড়িতে ভিড় করতেন। বাবা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। দুপুরে বাড়িতে থাকলে দুপুরের খাবারের পর একটা হালকা ঘুম দিতেন। আর রাতে দশটার মধ্যে খেয়ে ভয়েস অব আমেরিকা'র খবর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতেন।

এটা প্রায় নিয়মিত রুটিনের মত ছিল। কোনো কেনাকাটা না থাকলেও বাবা হাটের দিন হাটে যেতেন। কেনাকাটার দায়িত্ব ছিল জামীর মামা'র। জামীর মামা আমাদের বাড়িতে থাকতেন। সার্বক্ষণিক বাবার এসিসট্যান্ট হিসেবে সবকিছু দেখভাল করতেন তিনি।

কোনো কিছু কেনাকাটার থাকলে মা সেই লিস্ট বলতেন জামীর মামাকে। জামীর মামা হাট থেকে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতেন। বাবা আসতো রাত করে। বাবা'র সঙ্গে রাতের খাবারে মিনিমাম তিনজন সঙ্গী প্রায় সময়ই থাকতো। তারা খাওয়া দাওয়ার পর পান খেয়ে কিছু গাল গপ্পো করে তারপর চলে যেতেন।

যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি দেখেছি, সেটা হল মানুষ বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। বাবা হাটে যাবার সময় পেছনে প্রায় বিশ ত্রিশ জনের একটা লাইন থাকতো। এই লাইন গোটা পথে বাবা কি বলছেন, কি আলাপ করছেন, তাই মনযোগ দিয়ে খামাখা শুনতো। অনেককে দেখতাম, হাটের আগে আগে এসে আমাদের কাচারি ঘরে বসে আছেন। বাবা রেডি হয়ে রওনা দিলে তারাও তখন যাবেন।

এই ফাঁকে তারা অবশ্য পান বিড়ি তামাক খেয়ে সময় কাটাতেন। পান আর তামাক আমাদের। বিড়ি হিজ হিজ হুজ হুজ। আবার হাট থেকে ফেরার সময় যদি বাবা'র ফিরতে দেরি হয়, সেই খবর তাদের কেউ নিজ দায়িত্বে মায়ের কাছে দিয়ে যেতেন। যেনো একটা পরম দায়িত্ব তাদের ছিল সেই খবরটি আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবার।

বাবা'র মৃত্যু'র পরে সেই সব পরিচিত মুখগুলোকে আমি সত্যিকারভাবেই ব্যথিত হতে দেখেছি। তাদের চোখে আমি পানি দেখেছি। তাদের আর্তনাদ আমি শুনেছি। কতো রাজ্যের মানুষ যে বাবাকে চিনতেন! যখন বাবা'র নাম বলতাম, তখন তারা খুব খাতির করতেন। বলতেন, ও তুমি অমুকের পোলা!! তোমার বাবায় কেমন আছে? বাবা'র পড়ার মুড থাকলে দেখতাম আমির হামজার পুঁথি পড়ছেন সুর করে।

এছাড়া রোজ সকালে নামাজ পড়ার পর বাবা নেয়ামুল কোরআন পড়তেন। বাবা আরবি পড়তে পারতেন না। বাংলায় লেখা নেয়ামুল কোরআন পড়তেন। কিছু দোয়া ও হাদিসের বাংলা ও আরবি মিক্সড বই বাবা নিয়মিত পড়তেন। বাবা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন।

কখনো নামাজ পড়তে মিস হলে বাবা কা'জা নামাজ পড়তেন সময় করেই। বাবা ছিলেন পুরোপুরি ধার্মিক একজন মুসলমান। কিন্তু বাবা'র কাছে সকল ধর্মের মানুষ আসতেন। বাবা কীর্তন গান শুনতে যেমন যেতেন। তেমনি কবি গান, রামায়ন শুনতেও যেতেন।

কিন্তু বাবাকে কখনো ওয়াজ শুনতে যেতে দেখেনি। বাবা ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন মানুষ। মানুষ পরিচয়টি ছিল তার কাছে সবার আগে। সে পথের ভিক্ষুক হোক, রাষ্ট্রের মন্ত্রী হোক, স্কুলের বখাটে ছাত্র হোক আর জমির কিষান হোক না কেন, সবার সঙ্গেই বাবা'র মেলামেশাটা একটা সুন্দর ছকের মত। আর মানুষে যে বাবাকে ভালোবাসতেন, সেটা আমরা এখনো টের পাই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।