আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তবে কি জরুরি অবস্থা?

পরিস্থিতি দিন দিন জটিলতর হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা 'বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলই নয়', 'ওরা কিছুই করতে পারবে না', এরকম ভেবে যা ইচ্ছা তাই করতে চেয়েছিলেন। সরকারে থেকেও নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল না এলেও কিছু আসে যায় না এরকম মনোভাব নিয়ে একতরফা নির্বাচন করতে ব্রতী হয়েছিলেন। প্রায় ৬৫ বছরের আওয়ামী লীগ বোঝেনি বিএনপি বলে কোনো কথা নয়, কথা হলো জনগণকে নিয়ে। পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জিতে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন।

সংঘবদ্ধ না হলেও একটি সিভিল সোসাইটি যে ভেতরে ভেতরে গড়ে উঠেছে তা টের পাননি। ড. কামাল, ড. ইউনূস, এবিএম মূসা, ড. আকবর আলি খান, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ সিভিল সমাজের গণ্যমান্য সবার সঙ্গে ইতরবিশেষের মতো আচরণ করেছে। ভেবে দেখার মতো শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি যে, এরা বিএনপি না করলেও গণতন্ত্রের পক্ষের লোক। টেলিভিশনের টকশোগুলোতে যখন যুক্তি আর বিবেকের কথা বলা হয়েছে তখন তাদের গায়ে জ্বালা ধরেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এদেরকে মধ্যরাতের সিঁধেল চোর বলে ডেকেছেন।

ফলে সত্যে থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছেন।

২ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র গ্রহণের শেষ সময় আবেদনপত্রগুলো গ্রহণ করার পর দেখা গেল এর করুণ অবস্থা। মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে মাত্র ১১১৩টি, যা ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের চেয়েও কম। ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে মাত্র ১৫টি, যার একটি বাদে সবাই আবার ক্ষমতাসীন জোটের অন্তর্গত। সবচেয়ে বড় সার্কাস দেখালেন বর্তমানকালের সর্বশ্রেষ্ঠ থর্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

টিকটিকির লেজ খসে পড়ার মতো মহাজোট থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ঘোষণা করলেন এখন থেকে তিনি বিরোধী দল, যদিও মহাজোটের মন্ত্রিসভায় তার মন্ত্রীর সংখ্যা ১ থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৭টি। কি চমৎকার। শরীর থেকে বড় একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কিন্তু কোনো রক্ত ঝরল না, কেউ ব্যথাও পেল না। উভয়ই হাতের দুই আঙ্গুল উঁচু করে ৩২ পাটি দাঁত বের করে বিজয়চিহ্ন দেখাল।

'আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে'।

এখানেই শেষ নয়, এত আনন্দের মাঝেও কি কারণে যেন রাজার (প্রেসিডেন্ট) মন খারাপ, তার মনের মধ্যে বিরোধী দলের জন্য দরদ উথলে উঠেছে। বললেন তাদের রেখে আমি নির্বাচনে যেতে পারি না। আমি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করছি। হাত তালি দিয়ে উঠলেন বিএনপির কোনো কোনো নেতা।

এতদিনে না বন্ধুর মতো কাজ করল এরশাদ, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দল কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। আর এদিকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অমায়িক হাসি দিয়ে বললেন, নির্বাচনের ব্যাপারে এরশাদ সাহেব এখনো শেষ কথা বলেননি। ওবায়দুল কাদের কি জেনারেল এরশাদের প্রাইভেট সেক্রেটারি? নাকি থর্ট লিডার?

পাঠক, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এত রঙিন নাটক খুবই কম মঞ্চস্থ হয়েছে। এরশাদ যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেটাও ছিল একটি ট্র্যাজেডি নাটকের মতো। তার কথায় তার মনের বাষ্পবারি বিন্দুর মতো ঝরে যাচ্ছিল।

নয় বছরের একজন রাষ্ট্রপতির কি দুর্ভাগ্য! তার সর্বশেষ কথাটিকে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। এরশাদ কি সত্যি তার এই শেষ বক্তব্যে স্থির থাকবেন? কে জানে? যখন এই লেখা লিখছি তখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার খবর আমি শুনিনি। তিনি কি সরকারে আছেন না বিরোধী দলে তা তার অবস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির একজন উপদেষ্টাসহ মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল সাত। এরশাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করতে গিয়েছিলেন রওশন এরশাদসহ চারজন।

তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা কথা বলেছেন। কিন্তু পদত্যাগপত্র জমা না দিয়েই ফিরে এসেছেন। কেন? পদত্যাগপত্র জমা দিলেন না কেন? আড়াই ঘণ্টা ধরে 'কি কথা তাহার সনে'? বাকি তিনজন মন্ত্রী তো যানইনি। অতঃপর বলা হলো সব মন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দেবেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছে। এও এক নাটক।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যদি পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করেন? তিনি যদি বলেন, নিয়মমাফিক আপনারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন, তখন কি করবেন এরশাদ? তখন কি আরেক নাটক শুরু হবে? যে নাটক শুরু হয়েছিল সোহেল তাজ এবং সুরঞ্জিত সেনকে দিয়ে। তার শেষ অঙ্ক কি মঞ্চস্থ হবে এরশাদের মন্ত্রীদের দিয়ে?

এমনিতেই বিরাট এক নাটক তৈরি করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেড়-দিন লুকিয়েছিলেন কেন, কোথায় কে জানে? বেরিয়ে এলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে কথা বলতে। বৈঠক শেষে সুজাতা সিং চলে গেলেন আর র্যাব-পুলিশ এসে এরশাদের বাড়ি ঘিরে ফেলল। তখন শুরু হলো আরেকটি নাটক।

ভয়ানক ক্ষিপ্ত এরশাদ চারটি পিস্তল দেখিয়ে বললেন, এগুলো সবই লোডেড। যদি তাকে গ্রেফতার করা হয় তাহলে তিনি পিস্তলের গুলিতে আত্দহত্যা করবেন। কি ভয়ানক কথা। নয় বছর দায়িত্বে থাকা একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের বর্তমান আচরণে এমন ভগ্নহৃদয় যে, তিনি মৃত্যু ছাড়া জীবনের আর কোনো গন্তব্য খুঁজে পাচ্ছেন না। আর আমাদেরও কেমন নিষ্ঠুর রাষ্ট্র, এখনো তাকে বিদ্রূপ করছে, থুথু দিচ্ছে।

পত্র-পত্রিকাগুলো লিখছে, লোকটা যদি সত্যিই আত্দহত্যা করে তবে তার দায় তো রাষ্ট্রের উপর বর্তাবে। তারা অবিলম্বে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সব মারণাস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে রাষ্ট্রকে। হা-হতোস্মি, কারা এ দেশের রাষ্ট্রপতি হয় আর কারাই বা দেশ চালায়? এতকিছুর পর এরশাদ যদি ফিরে আসেন তাতে পরিস্থিতি বদলাবে না। তার এ অবস্থান পরিবর্তনের ফলে সরকার এবং এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে আরও বিশাল প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তিনি যদি আরেকটি পোল ভল্ট জাম্প দিয়ে ফিরেও আসেন তবুও এই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতায় কোনো মাত্রা যোগ হবে না। থুথু একবার আকাশে ছুড়ে দিলে তা আবার মুখেই এসে পড়ে।

কিন্তু ইতোমধ্যেই এ নির্বাচনের মহড়ায় পদ্মা দিয়ে পানির সঙ্গে অনেক রক্তও গড়িয়ে গেছে।

৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন নির্বাচন হবেই, সংবিধান সমন্বিত রাখতে হবে। হায়রে সংবিধান! তোমার পাতাগুলো আজ খামচে ধরেছে স্বৈরাচারের থাবা।

এরশাদ কি আবার ফিরে আসবেন নির্বাচনে? প্রশ্ন আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় এ কারণে যে, তিনি ফিরে এলেও এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ক্ষতি যা হওয়ার তা আগেই করা হয়েছে। সরকার এবং জাতীয় সংসদ থেকে জাতীয় পার্টির সদস্যদের পদত্যাগ সেই কফিনে শেষ পেরেক ঢুকে দেবে। কি করবে তখন সরকার? যে রকম জরুরি সভায় বলা হয়েছে, 'সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য' জোর করে নির্বাচন করবে? তাতে দেশ-বিদেশের মানুষ হাসবে। নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবেই না।

একটাই পথ সম্ভবত খোলা আছে সরকারের। সেটা হলো জরুরি অবস্থা ঘোষণা। তাতে সরকার কিছু সময় পাবে কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কি?

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।