আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Never Underestimate Anybody: জীবন থেকে নেয়া একগুচ্ছ প্রেরণার গল্প (স্বপ্ন সত্য করার গল্প)

বোকারা ভাবে তারা চালাক, চালাকরা ভাবে তারা চালাক। আসলে সবাই বোকা। বোকার রাজ্যে আমাদের বসবাস
রিমন হযরত শাহজালাল (রহঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে আছে কফি হাতে। অন্যমনস্ক রিমনের চোখ হতে গড়িয়ে পড়া একফোঁটা অশ্রু তার অজান্তেই কফির কাপে গিয়ে পরল, চকলেট বর্ণের কফির ঘন তরলে মৃদু একটা ঢেউ তুলে মিলিয়ে গেল নিমিষে। এই মুহূর্তে রিমনের স্মৃতিরা ভীষণভাবে ঢেউ তুলতে লাগল রিমনের মনোজগতে।

অতীতের চেনা-অচেনা শত অলিগলি হতে জানা-অজানা কতশত স্মৃতিরা একে একে আছড়ে পরতে লাগল রিমনের চেতনা জুড়ে। শীতের মধ্য রাতের এই শান্ত লাউঞ্জে রিমন বসে রইল তার ক্লান্ত দেহটা নিয়ে, মনটা উড়তে লাগলো স্মৃতির ককপিটে বসে। রিমন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ছোট বেলা হতে মুখচোরা আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবের ছেলে, অনেকে যেটাকে লাজুক বলে ভুল করে থাকে। নিজের ভুবনে ডুবে থাকা রিমন ছোট বেলা হতে অজানা কোন এক ভুবনে ডুবে থাকত।

পড়ালেখার নাম শুনলে কান্না করে বাড়ী মাথায় তুলতো, কত যে বকা আর পিটুনি খেয়েছে পড়াশুনার জন্য তার ইয়াত্তা নেই। আজ মনে হলে নিজে নিজেই হাসে রিমন। প্রায় দশ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হল, তার সহপাঠীগুলো সব বয়সে তার চেয়ে ছোট ছোট। প্রথম দিকে মোটেও ভালো লাগত না স্কুল, তখন স্কুলে গেলে টিচারদের বকাঝকা আর না গেলে বাসায় বাবা-মা’র পিটুনি। এভাবে বড় হতে হতে এক সময় প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিকে ঢাকার এক নামকরা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিল, তাও ছোট মামা’র কল্যাণে...... ছোট মামার উৎসাহে...... ।

ছোট মামার কথা মনে হতেই কিছুক্ষন আগে দেখা ছোট মামার চেহারাটা ভেসে উঠল। ছলছল চোখে নীরবে কিছু না বলেও অনেক কিছুই বলে গেলেন এই বিদায় বেলায়। হয়ত এখনো বাইরে দাড়িয়ে আছেন কোন এক কোনে, নীরবে-একাকী। হাই স্কুলের কথায় কত কথা মনে দোলা দিয়ে যায়। স্কুলের বন্ধুরা, টিচাররা আরও কত কি? মজার ব্যাপার যে রিমন ছোট বেলায় স্কুল নাম শুনলে আতঙ্কে আঁতকে উঠতো, সেই রিমন পরপর চার বছর স্কুলে হাইয়েষ্ট এটেডেন্স এ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল।

হায়রে স্কুল! একটা দীর্ঘশ্বাসে কফির কাপটা কেপে উঠল। আলতো ঠোঁটে একটা চুমুক দিল কাপটাতে রিমন, কোন কফি তার গলা ভেজালো কিনা তা বোঝা গেল না। তবে স্মৃতির ঝাঁপি যে তার চেতনাকে নস্টালজিয়ার এক অজানা আদ্রতায় ভিজিয়ে যাচ্ছে এই নভেম্বরের শীতের রাতে, তা হয়ত কেউ দেখছে না। ছোট বেলা হতে রিমনের খুব শখ ছিল ছোটখাট জিনিস সংগ্রহে রাখা। এই যেমন পুরানো কলম, বাল্ব, স্ক্রু-নাট-বল্টু, খেলনার নষ্ট মোটর ইত্যাদি।

বাসার সবাই সারাক্ষন বকাঝকা, উত্তমমধ্যম...... তবুও রিমনের এই শখ থেমে থাকেনি। মজার ব্যাপার এই ব্যাপারটায় ছোট মামা খুব আগ্রহ ছিল, সবাইকে বলত, “দেখিস ও বড় হয়ে একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে”। হ্যাঁ রিমনের আজীবন লালিত স্বপ্ন সে একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হবে। আজকের এই মধ্যরাতে রিমনের ঠোঁট দুটি একটু হয়ত নড়ে উঠলো। নিজের অজান্তেই কি বলে উঠল, “মামা তোমার রিমন সত্যি পেরেছে, সে পেরেছে......” নারীকণ্ঠের সুরেলা আওয়াজে রিমন বাস্তবে ফিরে এল।

নিজের লাগেজ নিয়ে এগিয়ে গেল। এরপরের সময়গুলো রিমন কেমন ঘোর লাগা হয়ে এগিয়ে গেল। প্লেনে নিজের সিটে গা এলিয়ে দেয়া পর্যন্ত আনমনে কি যেন বলে গেল তা বোঝা গেল না। কিভাবে কি হয়ে গেল? এই ভেবে রিমন খুব অবাক হয়। তার মনের সাধ, স্বপ্ন সব কিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এস.এস.সি.’র পরে তাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল ঢাকা কলেজের কলা অনুষদে।

কিন্তু বাসার সবার বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে বড় মামা একরকম জোর করে তাকে “ঢাকা পলিটেকনিক ইনিষ্টিটিউট” এ ইলেক্ট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সেও ভর্তি করিয়ে দিলেন। মনে পড়ে মামা বলেছিলেন, “পারবিতো এই ডবল লোড নিতে”, সে শুধু ঘাড় নেড়ে বলেছিল হ্যাঁ। এইচ.এস.সি.’র কলা বিভাগের রেগুলার স্টুডেন্ট এর পাশাপাশি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং! দুটো পাশাপাশি চালাতে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে। সারাদিনে দুই ইনিষ্টিটিউটে ক্লাস করা, সম্পূর্ণ ডিফারেন্ট দুইটা অনুষদে! কিন্তু বহু কাঠখড় পুড়িয়ে কলা বিভাগ হতে সসম্মানে এইচ.এস.সি. পাশ করলে আবার পরিবারের সবার জোরাজুরিতে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের নীচের দিকের একটি সাবজেক্টে ভর্তি হতে হয়। ফলে তার পুরোটা একাডেমীক ক্যারিয়ার দুই নৌকোয় পা দিয়ে কাটাতে হয়েছে।

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করার পরপর একটা চাকুরীর অফার পেয়ে চাকুরীতে জয়েন করে রিমন, বাদ দিয়ে দেয় কলা অনুষদের অনার্স কোর্স। বাসা থেকে সবাই রাগারাগি করলেও সে খুশি ছিল। খুশি ছিল এই কারনে যে, কলা বিভাগের নির্জীব বিষয়গুলো পড়ার যন্ত্রণা হতে বেঁচে গিয়েছিল। এর পরের পাঁচটা বছর নীরবে কাজ করে গেছে অফিসে, আর স্বপ্নের জাল বুনে গেছে মনে মনে। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনী শেষে রাতে প্রাইভেটে বি.এস.সি. শেষ করেছে।

প্রথম প্রথম অফিসের সহকর্মীদের ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা, বসের অহেতুক বাড়তি কাজ চাপিয়ে দেয়ার সাথে ছিল বাসার সকলের বক্র চাহুনিসহ আরও কত কি! কিন্তু সবকিছু সামলে রিমন তার বি.এস.সি. কোর্স শেষ করেছে; শুধু শেষ করেছে নয়, ভালো রেজাল্ট করেই শেষ করেছে। এরপর ছয় বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন কোম্পানি থেকে ট্রেনিংএ সিঙ্গাপুর গেল। সেখানে সে অভাবনীয় এক কাণ্ড করে বসল। একবারে স্ক্র্যাপ ইকুইপমেন্ট রিপেয়ার করে তা দিয়ে একটি মেশিন দাড় করালো, হেড অফিসে এই খবরে তোলপাড় হয়ে গেল। পরের দুই বছরে তার হু হু করে প্রোমোশন এবং শেষে সিঙ্গাপুরের হেড অফিসে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ।

আজ সে স্থায়ীভাবে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে এই মাতৃভূমি। হয়ত মাঝে মাঝে আসবে, হয়ত না! কিন্তু রয়ে যাবে মধুর সব স্মৃতি। দিনের পর দিন মাত্র দুই টাকা যাতায়াত বাবদ বরাদ্দ নিয়ে ঢাকা শহরে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ রোজ পাড়ি দেয়া, শুকনো নানরুটি চিবিয়ে বছরের পর বছর লাঞ্চ সারা... আরও কত কি! কিন্তু জীবন থেমে থাকেনি, রিমন থেমে থাকেনি। কারণ, রিমনের কাছে জীবনের মূলমন্ত্র, “Think Simply, Make Simple, Live Simple”।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।