আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এস এম আলী : আজ আপনাকে বড়ই প্রয়োজন

এ দেশের কিংবদন্তি সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী আমাদের বড় ভাই।

আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় ভাইর ভূমিকা খুবই অনন্য। ছোটরা তাকে ভয় পায়, কারণ তিনি একাধারে ভাই ও অভিভাবক। কিন্তু আমাদের বড় ভাই তার ভদ্র, নম্র ও মধুর ব্যবহার দিয়ে আমাদের হৃদয় জয় করেছিলেন। তাকে আমরা ভয় পেতাম কম, শ্রদ্ধা করতাম বেশি।

ছাত্রজীবন থেকেই তার সাংবাদিক হওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল ও বিভিন্ন কাগজে লিখতেন। ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করার পর সাংবাদিক জীবনে পুরোপুরি প্রবেশ করলেন। ৫০ দশকে সাংবাদিকের জীবন মসৃণ ছিল না। ছিল না অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। আমাদের বাবা ও চাচা আসাম সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ আমলা।

সেই যুগে আমলাদের ছিল অপরিসীম ক্ষমতা। কিন্তু ক্ষমতার আকর্ষণ ত্যাগ করে সাংবাদিকের অজানা ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করলেন তিনি। প্রথমে ঢাকার বিভিন্ন কাগজে কাজ করে করাচিতে পাড়ি দিলেন। প্রথমে 'ইভিনিং স্টার' ও পরে প্রভাবশালী পত্রিকা 'ডন'-এ কাজ করেন। লন্ডন পাড়ি দিলেন ১৯৫৩ সালে।

সেখানে পেশাগত শিক্ষা গ্রহণ করে কিছু দিন বিবিসিতে কাজ করে ঢাকায় ফিরলেন ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে। ঢাকায় ফিরে তার প্রথম পত্রিকা 'পাকিস্তান অবজারভার'-এ যোগ দিলেন এবং বিভিন্ন বিদেশি কাগজেও লেখা শুরু করলেন। লাহোরের বিখ্যাত সংবাদপত্র 'পাকিস্তান টাইমস' তাকে সহ-সম্পাদকের পদে নিয়োগ দিল। কিছু দিন কাজ করার পর তারাই তাকে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পাঠাল হংকং থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'এশিয়া ম্যাগাজিন' নামক পত্রিকায়। শুধু রবিবারে প্রকাশিতব্য এই সচিত্র ম্যাগাজিনটি একটু ভিন্ন ছিল।

এটি এশিয়া মহাদেশজুড়ে বড় বড় পত্রিকার সঙ্গে বিতরণ করা হতো। ষাটের দশকে পত্রিকাটি ঢাকায়ও বিতরণ করা হতো। তার সাংবাদিক উৎকর্ষতা দিয়ে তিনি তার স্বকীয়তা প্রমাণ করলেন ও পুরো এশিয়া মহাদেশের সাংবাদিক জগতে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। ব্যাংককের তদানীন্তন সান্ধ্যপত্রিকা 'ব্যাংকক পোস্ট' তাকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দিল। তিনি অচিরেই 'ব্যাংকক পোস্ট'কে একটি নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা হিসেবে বের করলেন।

যার প্রথম দিনের হেডলাইন ছিল 'সুপ্রভাত ব্যাংকক'। অচিরেই সেই পত্রিকা এই অঞ্চলের সর্বাধিক পঠিত কাগজ হিসেবে সমাদৃত হলো। বড় ভাইকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একে একে সিঙ্গাপুরের 'নিউ নেশন', হংকংয়ের 'হংকং স্ট্যান্ডার্ড' ও ম্যানিলায় অবস্থিত 'প্রেস ফাউন্ডেশন অব এশিয়ার' কর্ণধার হিসেবে কাজ করলেন। এই ফাউন্ডেশনের প্রধান কাজ ছিল এশিয়ার তরুণ সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আধুনিক সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলা।

আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইউনেস্কোর আঞ্চলিক যোগাযোগ উপদেষ্টা হিসেবে কুয়ালালামপুরে গেলেন। একনাগাড়ে একযুগ কাজ করলেন। অবসর নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন ১৯৯০ সালের শেষ দিকে। তার উদ্দেশ্য ঢাকা থেকে একটা উচ্চমানের ইংরেজি পত্রিকা বের করা। ইচ্ছা করলে ইউনেস্কোর পেনশন নিয়ে তিনি এ অঞ্চলের যে কোনো শহরে অবসর জীবনযাপন করতে পারতেন।

ব্যাংকক, হংকং, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুরে তখন ঢাকা থেকে সাংবাদিক জগতে কাজ করার অনেক বেশি সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, যার দৃঢ় সংকল্প ছিল মরার আগে 'দেশের জন্য কিছু করা দরকার'। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে তার সর্বশেষ সৃষ্টি 'ডেইলি স্টার' প্রকাশিত হলো দেশের সাংবাদিক জগতে এক অনন্য তারকা হিসেবে। অচিরেই তা পাঠকসমাজে সমাদৃত হলো। পেল ভীষণ জনপ্রিয়তা।

তার নিজস্ব কলাম 'মাই ওয়ার্ল্ড' ও প্রতিদিনের সম্পাদকীয়ই পত্রিকাটির বিশাল জনপ্রিয়তার প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু এত খাটাখাটি সইল না। ১৯৯৩ সালের ১৭ অক্টোবর বড় ভাই মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক ও তিনি তার পেশাগত নৈতিকতা পালন করতেন অত্যন্ত কঠোরভাবে। অনেক বিশ্বনেতা তাকে একান্তে যেসব 'অফ দ্য রেকর্ড' কথা বলতেন, তা তিনি কখনো প্রকাশ করতেন না।

আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীরা তাকে অনেক কিছুই বলেছেন সম্পূর্ণ তার বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে। তার উপদেশ নিয়েছেন। আমরা ভীষণ পীড়াপীড়ি করলেও তিনি এসব ব্যাপারে মুখ খুলতেন না। ঢাকায় যে বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকতেন সেটা ছিল তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিবের নিজস্ব বাড়ি। তিনি নিচতলায় থাকতেন ও বড় ভাই থাকতেন দোতলায়।

তখন সরকারের কোনো ভুল পদক্ষেপের জন্য কড়া সমালোচনা করতেন বড় ভাই। মন্ত্রিসভার সদস্যদের বার্ষিক কর্মসম্পাদন রিপোর্ট লিখতেন তার কাগজে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে। একবার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গ্রেড দিলেন 'বি-মাইনাস'। মন্ত্রী সাহেব কিছুটা দুঃখিত। আমি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে কিছুটা বিব্রত।

কিন্তু বড় ভাইর এক কথা, 'আমার একমাত্র দায়বদ্ধতা আমার পাঠকের কাছে, আর কারও কাছে নয়। ' একবার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাকে একটা ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন তখন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সচিব কিছু একটা যোগ দিতে চেষ্টা করলেন। বড় ভাইর সোজা কথা-'আমরা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে এসেছি, আর কারও নয়। ' একইভাবে তদানীন্তন বিরোধী দলের মহাসচিব তার কড়া সম্পাদকীয় পড়ে উষ্মা প্রকাশ করলেন। বড় ভাই তার কলামে লিখলেন, 'কাউকে খুশি করার জন্য তিনি সম্পাদকীয় লেখেন না।

' সোজা কথায় তার লেখা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, বাস্তবধর্মী ও পেশাগত। সেখানে আপসের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তার পত্রিকা তখনো আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল না। কীভাবে তার পত্রিকার কর্মচারীদের বেতন দেবেন তা নিয়ে তিনি প্রতিনিয়তই চিন্তাগ্রস্ত থাকতেন। সরকারি বা দলীয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার জীবন হতে পারত অনেক সচ্ছল।

নিজের ব্যক্তিগত একটা ছোট্ট গাড়ি নিয়ে অফিসে যেতেন ও অত্যন্ত সাধারণ মামুলি জীবনযাপন করতেন। আজ দেশ এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। গ্রেফতার, হরতাল ও অবরোধ এক অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। জনজীবন আজ বিপর্যস্ত।

অনমনীয় অবস্থান আজ সর্বত্র। আজ দেশে একজন সর্ব গ্রহণযোগ্য-নিরপেক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছে না, যার লেখা সবাই পড়বে, যার উপদেশ সবাই মানবে। এ ধরনের জাতীয় সংকটকালে বড় ভাই সব সময় বলতেন, 'আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম নিয়ে এগিয়ে এলে দেশের যে কোনো সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই খুঁজে পাব। ' বড় ভাই আজ আপনার খুব প্রয়োজন বোধ করছি। আপনার জন্মদিনে আপনার চিরশান্তি কামনা করি।

আমিন।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।