আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রায় কার্যকর না হলে বিশৃঙ্খলা হবে

দেশে শীঘ্রই যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায় কার্যকর হওয়া দরকার। সরকার যত দ্রুত তা করবে ততই ভালো। তা না হলে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। দেশে শান্তি বজায় রাখতে দ্রুত যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায় কার্যকর প্রয়োজন। কারণ যারা মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন এবং সে চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন তাদের বিচার করা না হলে সেই গোষ্ঠীটি পুনরায় দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করবে।

তবে যে সরকারই আসুক না কেন শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাদের কাজ করে যেতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি তাই স্বাভাবিকভাবেই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা বিষয়ে আমরা আশাবাদী। আমি বিশ্বাস করি দেশের উন্নতির জন্য তরুণ প্রজন্ম তাদের সবটুকু ঢেলে দেবে। স্বাধীনতার স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তার মূল্যায়ন আমি করতে পারব না। কিন্তু এটি বলব, বহু ঘাত-প্রতিঘাতে বেশ কিছু ভালো অর্জন আমাদের আছে।

আমার চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাবাহিনীতে। '৭১ সালে যখন স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয় তখন পরিবার নিয়ে তিন মাসের ছুটিতে পূর্ব পাকিস্তানে আমার জন্মস্থান হবিগঞ্জে বেড়াতে আসি। এ সময় সিলেটের এমপি জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরী আমাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বলেন। তখন আমি রব দাদাকে বলি, 'আমি এত দিন এটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।

আপনি বলেছেন, আমি যুদ্ধে অবশ্যই অংশগ্রহণ করব। ' জেনারেল রব আমাকে যুদ্ধের চার নম্বর সেক্টর সিলেট শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দিলেন। নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব পেয়ে বেশ আনন্দিত হলাম। সে সময় আমার সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সামরিক বাহিনীর লোক সংখ্যায় খুব কম ছিল। কেবল যারা ছুটিতে ছিল তারাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

আমরা এ সময় সিলেটের সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিলাম। এতে হবিগঞ্জের ছেলেরা খুব উৎসাহিত হলো। প্রায় দু-তিন মাসের ট্রেনিংয়ে প্রায় দু-তিন শ ছেলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলো। আমরা প্রথম হবিগঞ্জ শত্রুমুক্ত করলাম। এরপর শেরপুর ও যাদিপুর দখলমুক্ত করলাম।

শুনতে পেলাম হানাদার বাহিনী কুশিয়ারা নদীর পাড়ে অবস্থান নিয়েছে। এ জন্য সে জায়গাটি শত্রুমুক্ত করতে আমি জেনারেল রবের কাছে সময় চাইলাম। এরই মধ্যে শত্রুরা খবর পেয়ে গেছে, আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলাম। এ সময় শেরপুর ও যাদিপুরে বেশ বড় ধরনের লড়াই হয়। প্রায় চার-পাঁচ দিন টানা লড়াইয়ের পর এ অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়।

এ সময় দলে সৈন্যসংখ্যা বাড়ানোর জন্য আমরা জেনারেল রবের কাছে সাহায্য চাইলাম। তখন তিনি ইপিআরের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যদের সহযোগিতায় আমাদের সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলো দেড় শর মতো সৈন্য। এতে চার নম্বর সেক্টরে সৈন্যসংখ্যা আরও বেড়ে গেল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে সিলেটকে পাক সেনা থেকে মুক্ত করা হলো।

এ সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের অনেক সাহায্য করে। একদিন ভারত থেকে এক ছেলে এসে বলল, 'স্যার আমি ক্যাপ্টেন হামিদ, একজন ভারতীয় সৈন্য। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে আপনাকে সহযোগিতা করতে। ' এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী গোলাবারুদ দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছিল। মনে পড়ে কানাইঘাটে অপারেশনের জন্য আমাকে 'বীর উত্তম' উপাধি দেওয়া হয়।

কানাইঘাট শত্রুমুক্ত করা ছিল আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ সিলেট জয় করতে হলে অবশ্যই কানাইঘাট জয় করতে হবে। সে সময় আমরা জানতে পারলাম সুরমা নদীর অন্য প্রান্তে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে শত্রুর ওপর আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করি। শেষ পর্যন্ত শত্রু তার অবস্থান থেকে পিছে সরে যায়।

আমার ধারণা, পাক সেনারা আমাদের থেকে সৈন্য ও অস্ত্রে এগিয়ে থাকলেও যেহেতু তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে ভুল কাজ করছিল সে কারণে তাদের মানসিক শক্তি দুর্বল ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে আমার বাড়ি ও ব্যবহারের জিনিস ফেলে এসেছিলাম। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আর সেখানে ফিরে যাইনি। আমি বাংলাদেশ আর্মিতে যোগ দিই। নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি মিলিয়ে আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি তা স্বাধীনতার এত বছর পর যে খুব খারাপ চলছে তা নয়।

তবে আমরা যারা সংখ্যালঘু তারা নিজেদের বাঙালি হিসেবেই পরিচয় দিতে চাই। যত দিন আমি বেঁচে থাকব একজন বাঙালির মতো করেই জীবনযাপন করে যাব। যদি সরকার দেশের কৃষ্টি, কালচার ও সংস্কৃতির সঠিক বিকাশ ঘটাতে পারে তবেই দেশ ভালোভাবে চলবে। আর এর পুরো দায়ভার সরকারের। যেহেতু এ দেশে জন্মেছি তাই দেশের প্রয়োজনে যে কোনো সময় এগিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করব না।

অনুলিখন : জিন্নাতুন নূর

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।