আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চার দেয়ালের অন্ধকারে লুকিয়ে যে ধন

লোকচক্ষুর আড়ালে খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন কর্নেলিয়াস গুরলিট্। বিয়ে করেন নি, বান্ধবী ছিল না, সন্তানাদিও নেই, এমন কি হেলথ ইনশিওরেন্সও নেই তার। জার্মানির মতো এমন এক সুশাসিত দেশে এমনি ভাবে জীবন যাপন করে কেউ, সেটিও খুবই অস্বাভাবিক। থাকতেন মিউনিখের এক বহুতল ভবনে অতি সাধারণ একটি এপার্টমেন্টে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে সে বাড়িতে হানা দিল পুলিশ আর কাস্টমস।

একটি মাঝারি আকারে ঘরে নামি দামি চিত্রকরদের আঁকা ছবি যক্ষের ধনের মতো আগলে ছিলেন গুরলিট। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০০ ছবি। বাজেয়াপ্ত করে একটির পর একটা করে ছবি বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করলো তদন্তকারীরা। সেদিকে তাকিয়ে বিরাশি বছর বয়েসের হতবাক গুরলিট বললেন, “এসব নিয়ে যাবার দরকার কি? আমি মারা গেলে তো দেশই পাবে সব”। এই ছবিগুলোর মূল্যমান কতোটা আকাশচুম্বী, তখনও তা টের পায়নি তদন্তকারীরা।

কোনো পাহারা ছাড়াই এপার্টমেন্টহাউজের মুল দরজার সামনে স্তূপীকৃত করা হল। তারপর তোলা হল গাড়িতে।
ফ্রাঙ্ক মার্ক
পরে জানা গেল, পিকাসো, স্যাগাল, রেনোয়া, ম্যাটিস, টুলুজ লুটরেক, বেকম্যান, অটো ডিক্স সহ অনেক অনেক নামী দামি চিত্রকরের ছবিতে টইটম্বুর গুরলিটের এই সংগ্রহে। অনেকের কাছে এসব ছবির অস্তিত্বই অজানা। ছবিগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য কি, সেটি ভাবতে গেলে চক্ষু চড়কগাছ হবারই কথা।

প্রায় একশো কোটি ইউরো বলে জানিয়েছেন বোদ্ধারা। কি করে এই বিরাট যক্ষের ধনের মালিক হলেন গুরলিট, সেটি জানতে গেলে প্রায় আশি বছর আগে ফিরে যেতে হয়।
স্যাগাল
১৭৩৭ সালে জার্মানির নাৎসি সরকার তাদেরই ঘোষিত তথাকথিত “বিকৃত শিল্পকর্ম” থেকে দেশকে উদ্ধার করার লেবাসে এক তৎপরতা শুরু করে মিউনিখে। পরে সে তৎপরতা অস্ট্রিয়া সহ আরো অন্যান্য দখলকৃত দেশে বিস্তারিত হয়। জার্মানির বিভিন্ন মিউজিয়াম থেকেই একুশ হাজার ছবি বাজেয়াপ্ত হয় তখন।

খুব তাড়াতাড়িই দখলকৃত দেশের মিউজিয়াম, ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও ধনি ইহুদীদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা ছবি মিলিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ছয় লাখে। “বিকৃত শিল্পকর্ম” ব্যনারের আওতায় একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করে নাৎসি সরকার। প্রায় বিশ লাখ দর্শক শেষবারের মতো এই ছবিগুলো দেখার সুযোগ পান। তার পরপরই বার্লিনের একটি গুদামঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয় এই সংগ্রহ। তবে গোয়েবলস সহ কিছু কিছু উপরের স্তরের নাৎসি নেতারা কিছু ছবি বিক্রি করে সম্পদ বাড়িয়েছেন বলে জানা যায়।

হিটলারের আদেশে ১৯৩৯ সালের মার্চে প্রায় পাঁচ হাজার ছবি গুদামঘরের উঠানে আগুনে পুড়িয়ে তাদের কর্মতৎপরতার নজির দেখায় নাৎসিরা।
মাক্স লিবারমান
সমরাস্ত্র জোগানে আর্থিক ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে কিছু ছবি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করার পরিকল্পনা করে নাৎসি সরকার। চারজন শিল্পবোদ্ধাকে এই কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদেরই একজন কর্নেলিয়াস গুরলিটের বাবা, তৎকালীন হামবুর্গ মিউজিয়ামের প্রাক্তন পরিচালক হিলডেব্রান্ট গুরলিট। গুরলিটের দাদীও ইহুদী, একারণেই কিছুদিন আগে মিউজিয়ামের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছিল তাকে।

তারপরও শিল্পবোদ্ধা হিসেবে তার দক্ষতা নাৎসীদের কাজে আসবে ভেবে আবার ডাকা হয় তাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর নাৎসি সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ সহযোগিতার অপবাদ থাকার পরও তার দাদীর পরিচয়ের জোরেই বেঁচে যান হিলডেব্রান্ট গুরলিট। যুদ্ধজয়ী আমেরিকা তথাকথিত “বিকৃত শিল্পকর্ম” নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে চায় নি আর। ছবিগুলোর অধিকাংশই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, কোনো এক শুনানিতে আমেরিকানদের এ কথাই জানান হিলডেব্রান্ট গুরলিট। তার বাড়িতে হানা দিয়ে প্রায় একশো ছবি উদ্ধার করার পরও সেগুলো নিজেরই সংগ্রহ বলে চালিয়ে দিয়ে আবার ফিরে পান সেগুলো।

পরবর্তী সময়ে চিত্রকর্ম নিয়ে অবাধে নিজের ব্যবসাও চালিয়ে যেতে পারেন। ১৯৫৬ সালে মৃত্যুর আগ অবধি জার্মানির ডুসেলডর্ফে একটি নামীদামী শিল্পকলা একাডেমীর প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করেন গুরলিট। তার সন্মানে একটি রাস্তার নামকরণও তারই নামে করা হয়।
অটো গ্রিবেল
বাবার এই বিশাল যক্ষের ধন হাতে পেয়েও লোক-চোখের অন্তরালে খুব সাধারণ, কিন্তু অদ্ভুত এক জীবন যাপন করেন কর্নেলিয়াস গুরলিট্। বিশাল ব্যবসা না ফেঁদে নিজের একাকী জীবন ধারণের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে একটা দুটো ছবি বিক্রি করে বেশ ভালোই চলছিল তার।

বাইরের পৃথিবীর সাথে কোনো যোগাযোগই ছিল না তার। কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না। এমনকি বাড়িতে ফোনও ছিল না তার। ছবি সংক্রান্ত কোনো তথ্যের দরকার না হলে খবরের কাগজও পড়তেন না, বাড়িতে কোনো রেডিও বা টেলিভিশনও ছিল না। জার্মানির সমাজ ও রাজনীতিতে প্রতিদিনের নিত্যনৈমিত্তিক যা ঘটে, এসব নিয়ে কোনো ধারনা ও আগ্রহ ছিল না তার।

ধীরে ধীরে রাষ্ট্র, সমাজ, এমনকি প্রতিবেশীরাও ভুলে যায় তাকে। কিন্তু তারপরও কেন তার বাড়িতে পুলিশ আর শুল্ক আদায়কারীদের হামলা, সেটিও বলা দরকার। ২০১০ সালের ২২ সে সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডে একটি ছবি বিক্রি করে ফেরার সময় ট্রেনে তল্লাসির সময় তার কাছে আশি হাজার ইউরো পায় পুলিশ। কর ফাঁকি দেয়ার জন্যে জার্মানরা তাদের জমানো টাকা অবৈধ ভাবে সুইস ব্যাঙ্কে রাখে, এটি নতুন কিছু নয়। সেজন্যে এই পথের ট্রেনে তল্লাসি হয় প্রায়ই।

অবৈধ ভাবে টাকা পাচারের দায়ে গুরলিটের বিরুদ্ধেও তোলা হয় একই অভিযোগ। এরই জের ধরে মিউনিখের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। তখনই মহা মূল্যবান ছবিগুলো বাইরের আলোতে বেরিয়ে আসে। তারপরও প্রায় দেড় বছর এই ঘটনা গোপন রাখে সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তা। এবছর নভেম্বরের মাঝামাঝি সাংবাদিকদের তদন্তে ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে পড়ায় শোরগোল শুরু হয় জনসাধারণের মাঝে।


মিউনিখে এই বাড়িতে গুরলিটের এ্যপার্টমেন্ট
গুরলিটের বিশাল এই সম্পদ নিয়ে বেশ সমস্যাতেই পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রতিটি ছবি আলাদাভাবে পরীক্ষা করে এর মৌলিকত্ব প্রমাণে পেরিয়ে যাবে বছরের পর বছর। ছবিগুলোর মালিকানা নিয়েও কোনো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেয়া আজ অবধি সম্ভব হয়নি। কে মালিক? আশি বছর আগে যারা ছিলেন, গুরলিট বা জার্মান সরকার? কিছু ছবি ছিল অবশ্যই হিলডেব্রান্ট গুরলিটের নিজস্ব সংগ্রহ। কিন্তু কোনগুলো, তার প্রমাণ কে দেবে? আর বাকিগুলো অবৈধ ভাবে সংগৃহীত হলেও এই অবৈধতার মেয়াদ জার্মান আইনে আশি বছরে পেরিয়ে যাবারই কথা।

সে হিসেবে ছবিগুলো তো গুরলিটকেই ফিরিয়ে দেয়া আইনসংগত। তবে এই আইন তথাকথিত “বিকৃত শিল্পকর্ম” বেলায় প্রযোজ্য কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সময়মত জনসাধারণকে না জানানোয় এখানকার সরকারী কর্মকর্তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে নানা আলোচনা। যদি আশি বছরের আগের মালিকদেরই ফিরিয়ে দিতে হয়, তাহলে তাদেরকে বা তাদের উত্তরসূরিদের খুঁজে বের করা কতোটা সম্ভব, এসব নিয়েও তুমুল তর্কবিতর্ক চায়ের টেবিলে, কফি-শপে, শুঁড়িখানায়, অফিসে-আদালতে, সবখানেই। এর মাঝে কিছু ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়েছে।

আইনের হাওয়া কোনদিকে বয়, সেদিকেই চোখ সবার।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।