আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থার হাল

দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আাসে কই মুখে

কোন জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত হল একটি ’শিক্ষিত জনগোষ্ঠী’ যা ওই জাতির ’মেরুদন্ড’স্বরূপ। মেরুদন্ড ছাড়া কোন প্রাণী যেমন সোজা হয়ে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না তেমনি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া কোন জাতি উন্নতির চরম শিখরে আরোহণের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে স্বগর্বে নিজেকে পরিচিত করতে পারে না, কেবল অন্য জাতির অনুদান আর ঋণ নিয়ে তার আগ্যাধীন হয়ে কোন রকম বেঁচে থাকে। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি ততো উন্নত আর এই শিক্ষিত জাতি সৃষ্টিতে যে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে তাহল- সবার জন্য সুশিক্ষা। কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষা অর্জন অতি মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক ও বাণিজ্যিক হওয়ায় মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে তাদের ছেলে-মেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধাপে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দিতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যেখানে পরিবারগুলোকে রাতদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দিনাতিপাত করতে হয় সেখানে প্রকৃতির বৈরী আচরণে প্রতিবছর সিডর, আইলা, বন্যা ইত্যাদির মত বড় বড় বিপর্যয়ের কারণে ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে এ সমস্ত পরিবারগুলোর আয়ের উৎস।

যেখানে বাংলাদেশের মত একটা কৃষি নির্ভর দেশ প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় সেখানে এ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে কেমন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় পরিবারগুলোর মৌলিক চাহিদা পূরণেই যখন মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায় তখন আমাদের দেশের অসংখ্য জ্ঞান পিপাসু ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা এসব পরিবারগুলোর কাছে কেবল দিবা স্বপ্নেরই নামান্তর। অপরদিকে জনবহুল এই দেশে পূর্বে যেখানে কেবল চাকরী পাওয়াটা খুব কষ্টের বিষয় ছিল সেখানে বর্তমানে প্রাইভেট টিউশন জোগাড় করাটাও রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে তুলনা করা যেতে পারে ভার্সিটির সীমিত আসন সংখ্যার সাথে! ফলে টিউশনি করে পরিবারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমানোর সুযোগটাও আর থাকে না। আবার যেখানে চাকুরির ক্ষেত্রে একটা পদের জন্য শতশত আবেদনপত্র জমা পড়ে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের পার্ট-টাইম কাজের সুযোগটাও পাওয়া যায় না। দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পূর্ব হতে গতানুগতিকভাবে চলে আসছে ।

তবে বর্হিবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বর্তমানে শিক্ষার কারিকুলাম অনেকটা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু পূর্বের সেই প্রথাগত শিক্ষাদানের পদ্ধতি এখনো চালু আছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তরসুরী হতে প্রাপ্ত একই ধারায় শিক্ষা দান করে আসছে । কারিকুলাম যতই পরিবর্তন করা হোক না কেন, তাদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না । ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, মাধ্যমিক স্তর হতে যখন শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আসে তখন তাদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠানের দেওয়া জ্ঞান সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না।

তাই দেখা যায়, কলেজগুলোতে ইংরেজী, অংক, রসায়নের মত বিষয় গুলোতে ক্লাসে শিক্ষারর্থীদের উপস্থিতি অনেক কম। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে প্রাইভেট নামক অনানুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত কিছু সহজ পদ্ধতি অনুসরণে কেবল পাস করার বা নিশ্চিত এ+ পাওয়ার নিমিত্তে শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ততটা গুরুত্ব দেয় না। ফলে বাংলা থেকে শুরু করে ব্যবহারিক বিষয় গুলোতেও তারা প্রাইভেট নির্ভর হয়ে পড়ে । অবস্থা দেখে মনে হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার আর সার্টিফিকেট প্রদান কেন্দ্র । কিন্তু বিপত্তি কেবল নিম্নবিত্ত পরিবার গুলোর জন্যে ।

কারণ, প্রাইভেট এর ক্ষেত্রে বিষয় প্রতি ৩০০-৫০০/= টাকা প্রতি মাসে দিতে হয় ,তা আবার ১০-১২ দিনে মাস । যেটা যারপরনাই অসম্ভব ,কারণ বিজ্ঞান বিভাগের ক্ষেত্রে ৪-৫টা বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হয় । অপর দিকে বই খাতা তো আছেই । আর এই সুযোগে অনেক নিম্নমানের বা কেবল প্রস্তাবিত এমন সব গতানুগতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নবিত্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনেক সুযোগসুবিধার কথা বলে তাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে নেয় । মাধ্যমিক হতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পূর্বের গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে জ্ঞানার্জনের মূল উদ্দেশ্যটা বুঝতে না পারায় তারা কেবল মুখস্ত বিদ্যাকে পুঁজি করে পরীক্ষার খাতায় বেশী নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে ।

ফলশ্রুতিতে তারা প্রতিটা বিষয়ের মৌলিক ও ব্যবহারিক বিষয়বস্তুকে এড়িয়ে যায় । কেননা এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষার ’প্রশ্ন ও উত্তর’ এ দুটিকে কেন্দ্র করে গাইড বই নামক দ্বিতীয় এক অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকায় যে কোন শিক্ষার্থী ঘরে বসেও ভালো নম্বর পেতে পারে । এতে আছে বাংলা, অংক, ইংরেজী সহ সকল বিষয়ের সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তর। এরই ফলশ্রুতিতে যখন তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন লাভের প্রতিযোগিতায় নামে তখন তাদের সেই মুখস্থ বিদ্যা আর কাজে লাগে না । ফলে দেখা যায় , প্রতি বছর বহু এ+ ধারী শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্খিত বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না।

বাধ্য হয়ে সাধারণ অন্য কোন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে হয়, যা তাদের কাছে বাংলা প্রবাদের ন্যায়-”নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভালো”। দেশের পাবলিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে মনে হয় এখানেও যেন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে নি। যেন পূর্বের মত সেই কচ্ছপের গতিতে আজও এর কার্যক্রম চলছে । যেখানে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাংকিং-এ তাদের অবস্থানকে সম্মানজনক পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছে সেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান পাঁচ হাজারের উপরে । এখনো সেই প্রথাগতভাবে চলে আসছে বছরের শেষের দিকে তথাকথিত ’’কোর্স সমাপ্তি” যেটা যে কোন শিক্ষার্থীর জন্যে ’over eating’ , যার ফলাফল হল বমি করে খাতায় রেখে আসা ।

আবার ছাত্র রাজনীতির নামে প্রায়ই শিক্ষা কাযক্রম স্থবির হয়ে পড়ে ,ফলে চার বছরের কোর্স অনেক সময় ছয় হতে সাত বছরে শেষ হয় । অপর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক মানের অনেক বিষয় থাকলেও পর্যাপ্ত ল্যাব স্থাপন ও ব্যবহারিক যন্ত্রপাতির অভাবে তাতে তেমন কোন সুফল পাওয়া যায় না । তাই দেখা যায় , বিষয় হলো জেনেটিক্স ইঞ্জীনীয়ারিং , মাইক্রোবায়লজি ফার্মেসী ইত্যাদি কিন্তু উন্নতমানের কোন বিকারক , প্রযুক্তি ও ব্যবহারিক যন্ত্রপাতিই নেই! আবার বিষয় হলো টেক্সটাইল কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই, কেবল হাতে-কলমে ও বইয়ের মাধ্যমে শেখা শুধু তাত্তিক জ্ঞান । ফলে চাকরির ক্ষেত্রে তার ঐ তাত্ত্বিক জ্ঞান চাকরির প্রথম ধাপটিও অতিক্রম করতে সাহায্য করে না । যুদ্ধ পরবর্তী বছরগুলোতে যদি ফিরে দেখি তবে সাফল্যের পাল্লায় কেবল হাতে গোনা কয়েকজনের অর্জনেই চোখে পড়ে ।

কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়নে সকলেরই অগ্রনী ভূমিকা প্রয়োজন। তা না হলে শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও দেশের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না । যদি আমরা জাপান , ভিয়েতনাম , মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের দিকে তাকায় তবে দেখব যে , তাদের সকল সাফল্যের পেছনে রয়েছে পুরো জাতির হাত । কিন্তু এখনও আমরা যদি এভাবে কচ্ছপের ন্যায় এগিয়ে চলি তবে সাফল্যের পথ পেতে বড় দেরি হয়ে যাবে । তার মধ্যে বোধ করি আমাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকাই বেড়ে যাবে।

পার্শ্ববতী দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে , দেশগুলোর সাথে আমাদের বৈরী সম্পর্ক সেই প্রথম হতে আজও। আমাদের নিজেদের অধিকারগুলোকে তারা দাবার গুটির মত সরিয়ে দিয়ে তাদের যা ইচ্ছা তাই করে এবং তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমাদের উপর নানা রকম অমানবিক বিষয় জোর করে চাপিয়ে দেয়। বর্তমানে গ্যাস , কয়লা খনি নিয়ে ভারত ও মায়ানমার এর সাথে বিরোধ এখন চরমে। এর মূল কারণ হলো আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতি ব্যবস্থা। তাদের কাছে আমাদের অধিকার ছোট কারণ, আমাদের দেশটা হলো ছোট।

কিন্তু এভাবে আর কত দিন চলা যাবে? তাছাড়া প্রতিবেশী মায়ানমার এবং পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের অস্ত্র কেনার আমাদের জাতীয় জীবনে কতটুকু হুমকি তা ভাবার সময়ে এসেছে। কিন্তু এ প্রতিযোগিতায় নিজেদের সুরক্ষায় দৃঢ় অর্থনীতি ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। আর তা অর্জন করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন অপরিহার্য। কারণ “যে জাতি শিক্ষা ব্যবস্থায় যত উন্নত, সে জাতি অর্থনীতিতে তত উন্নত”। আর এ কাজে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

কিন্তু এটা সত্য যে, আমরা উন্নয়নশীল, সরকারের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। নিঃসন্দেহে তাদের ভূমিকা অনেক বড়। তার প্রমাণ, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল । বিভিন্ন সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় তার অবস্থান এখন শীর্ষে ।

কিন্তু আর্শ্চয হলেও সত্য যে , যেখানে একটা ক্রিকেটারের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ লাখ টাকা ব্যয় করে সেখানে শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছার বড়ই অভাব। আজ আধুনিক যুগে অস্তিত্বের প্রতিযোগিতায় জিততে হলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ভূমিকা রাখা দরকার । আজ দেশের বহু শিক্ষার্থী অর্থাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পূর্বে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেই ঝরে পড়ে । কিন্তু এদের মধ্যে থাকতে পারে নিউটন , আইন্সটাইন , স্টিফেন হকিং এর মত অনেক বড় মানুষ । কিছু যন্ত্রের জন্যে ল্যাবে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা , গবেষণা পড়ে থাকে।

কেউ নেই সেটার যথাযথ ব্যবস্থা করার কারণ , এর জন্য দরকার অর্থের। আবার শিক্ষা খাতে বাজেটের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের অনেক সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হতে হয় । তাছাড়া বাজেটের টাকা নিয়ে দূর্নীতি হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ হয় । তাই সরকারকে এ দিকে যথাসম্ভব সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে, যেন শিক্ষা খাতে বাজেটের টাকা নিয়ে দূনীতি না হয় । এছাড়া সরকারের উচিৎ বিভিন্ন বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অবদান রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করা ও তাদের সাথে একত্রে কাজ করা ।

লেখক: ছাত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্মেসী বিভাগ Email-

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।