আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন এক অজানা গন্তব্যে বাংলাদেশ



একসাগর রক্তের বিনিময়ে যে লাল সবুজ পতাকা পেয়েছি সেই পতাকার মানকে সমুন্নত রাখার ব্যথতা বতমান জীবিত বাংলাদেশীদের জন্যে চরম লজ্জাস্কর। সবোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে যারা স্বাধীনতা সাবভৌমত্ব এনেছিল তাদের স্বপ্নপূরণের ব্যথতায় ভবিষ্যত প্রজন্ম নিশ্চিতভাবেই বতমান প্রজন্মকে দায়ী করবে। আমাদের শক্তিতো আমাদের মানুষেরাই। এই মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করে কেউ যদি নিজেকে জনগণের সেবক হিসাবে পরিচয় দেয় তা রীতিমত হাস্যকর হয়ে ওঠে। শাপলা শালুকের এই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে তার দেশের চেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান বস্তু আর কিছু নেই।

এই দেশেরই কোন অমানুষের অপতৎপরতার ফলে মাটির ওপরে দেশপ্রেমিক মানুষের চোখের পানি কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষের লাল রক্ত গড়িয়ে পড়লে তাতে জাতির আখেরে কল্যাণ লাভ কখনই হবেনা। যেই মানুষটি মায়ের আদরে আর বাবার সোহাগে বেড়ে ওঠেছে, উদার প্রকৃতির আলো বাতাসে পরম মমতায় বড় হয়েছে তাকে যে লোভী স্বাথপর মানুষরুপী পশুরা বিপদগ্রস্ত করে তারা কোন দলের শত্রু শুধু নয় তারা মানুষের শত্রু, মানবতার দুশমন,অসভ্যতার প্রতীক। মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করেই যৌক্তিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে যে স্বাধীনতা তার জন্মগত অধিকার। যদি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা না যায়, রাস্তাঘাট-অফিস আদালত-বাসস্থান-যানবাহনে জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান না হয় তবে গণমানুষের সত্যিকার মুক্তি মিলবেনা। জীবনকে সুন্দর-সহজ-উন্নত করাটা প্রত্যেকেরই আজন্ম সাধ।

সব সাধই সাধ্যের বাইরে চলে যায় যদি উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। স্বাধীন দেশের মানচিত্র সৈকতবিহীন একটি প্রস্তরময় দ্বীপের মত হয়ে যায় যদি সেখানকার জননেতারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশ ও জাতির উন্নতির শ্বাস-প্রশ্বাসকে রুদ্ধ করে। আলোহীন অরণ্যে যেমন জন্মাতে পারেনা কোন সবুজ উদ্ভিদ তেমনি দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম ছাড়া জন্মাতে পারেনা কোন দয়ালু নেতা। স্রোতহীন নদীর গতিহীনতা যেমন প্রাণহীন দেহের মত তেমনি শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি বিহীন দল মাঝিবিহীন নৌকার মতো।

আজ আগুনের লেলিহান শিখা যেমনি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে চিরনি:স্ব ও চিরভষ্ম করে দিচ্ছে বাইরের জগতকে তেমনি হতাশা-হিংসা-লোভ ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে ভেতরের জগতকে। সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত না করে সম্ভাবনার বিকাশ তেমনই অসম্ভব যেমনিভাবে স্বাধীনতা ব্যতীত কোন জাতিকে তার স্বকীয়তা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ বজায় রেখেই বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। স্বণের তৈরি তীর বুকে বিধলে কষ্ট কম অনুভূত হবে এটাকে যেমন কেউ যৌক্তিক বলবেনা তেমনি গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্রের আবিভাব ঘটলে জাতি সামনে এগুবে এটাকেও স্বাভাবিক সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মানুষ গ্রহণ করবে না। স্বর্ণ নির্মিত শৃঙ্খলের চাইতে যেমনিভাবে বেদুঈনের অনিশ্চিত জীবনও বেশি আনন্দের তেমনিভাবে দুনীতিবাজ নেতা ও মনুষত্ব বজিত বিবেকহীন কমীদের কোন রাজনৈতিক দলের আধিপত্যের চাইতে নীতিহীন দল ছাড়া দেশও বেশি ভাল থাকতে পারে। শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন,স্বাধীনতা লাভ করা যেমন কঠিন,স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কঠিন।

আজ আমাদের অস্রের সংগ্রাম শেষ হয়েছে। এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম কে দেশ গড়ার সংগ্রামে রূপান্তরিত করতে হবে। মুক্তির সংগ্রামের চেয়েও দেশ গড়ার সংগ্রাম কঠিন। তাই দেশ গড়ার কাজে আমাদের সর্ব শক্তি নিয়োগ করতে হবে। তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্মান জানাতে যেয়ে যদি রাজপথে লাশ ফেলতে হয়,মানব শরীরকে অগ্নিদগ্ধ করতে হয়,ভবিষ্যত প্রজন্মের সুস্থ বিকাশের পথকে রুদ্ধ করতে হয়, মিল-কারখানা-প্রতিষ্ঠানকে জ্বালিয়ে দিতে হয়-তবে দেশের মানুষের উন্নতি ও সামগ্রিক মঙ্গলের স্বাথেই এসব নিমম নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে বিদায় জানানো উচিৎ।

এটা ঠিক যে, পরের স্বাথের চেয়ে নিজের স্বাথ হাসিলের বাসনা যদি প্রবল হয়ে ওঠে তবে কেউ নিজে সামান্যতম ছাড় দিতে বা কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করতে চাইবেনা। যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেশের মানুষের চিন্তার,বলার এবং লেখার স্বাধীনতা দিতে পারেনা সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই পঙ্গু ও পঁচা। রাজনৈতিক স্বাথ চরিতাথকরণে যদি কারো মুখের খাবার কেড়ে নিতে হয়, গামেন্টস জালিয়ে দিয়ে শ্রমিককে কমহীন ও মালিককে সবশান্ত করতে হয়,মানুষ হত্যায় দায়ী অপরাধীকে নিরাপদ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে হয়,কলমের বদলে শিক্ষাথীর হাতে অস্র তুলে দিতে হয়,মেধা-যোগ্যতা-সততাকে বিবেচনা না করে দলীয় স্বাথে নিয়োগ-পদোন্নতি দিতে হয় তবে এমন রাজনীতিকে সমথন করা অসম্ভব। সম্মানজনক জীবিকা লাভের পথ ও পদ্ধতির বিনিময়ে বক্র পথে স্বর্গরাজ্যের বাসিন্দা হবার লোভ লালসা-বিকৃত রুচিরই বহি:প্রকাশ। দেশের যৌবন শক্তি কোনোদিন প্রার্থনা করবেনা যে,মুষ্টিমেয় কিছু আকৃতিতে মানুষ আর কমে শয়তানের খেয়াল খুশির খেসারত দিতে দেশটা নরক রাজ্য হোক।

কারো অবিবেচনাপ্রসূত অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত আর তুঘলকি কমকান্ডে যদি গোটা দেশটাই একটি কারাগারে পর্যবসিত হয়-তবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে ঐ ব্যক্তি ও তার দল কোন অজানা নিমম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। মুখে নীতিবাক্য আর কমে অনৈতিকতা পরের অনিষ্ট করার ক্ষেত্রেই ভুমিকা রাখে। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি চচার মধ্য দিয়েই দেশের দীঘস্থায়ী উন্নতির পথ উন্মুক্ত রাখা সম্ভব। কোন ব্যক্তি বা দলের অবস্থান ইতিহাসের পাতায় স্বণাক্ষরে লিখিত হয় তখনই যখন সে ব্যাপক জনসমথন লাভ করে, বৃহত্তর কল্যাণে চেষ্টা-সাধনা করে। এটি মাথায় রাখতে হবে যে, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব।

অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে বাঁচা অপেক্ষা প্রতিবাদী হয়ে শির দাঁড়া উচুঁ করে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করাও সুখকর। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্যে আার ১৯৭১ সালে দেশের তরে জীবন দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি আমরা জান দিতে পারি কিন্তু মান দিতে পারি না। দেশকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে হলে দেশী-বিদেশী সকল অতৎপরতা সম্পর্কে প্রত্যেকটি বাংলাদেশীকে সতর্ক থাকতে হবে। কোন প্রতিবন্ধকতাই যেন দেশের সার্বিক অগ্রগতি ব্যাহত না করে সেই দিকেই খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে কোন ক্রমেই আমরা বিপদ ও বিপন্নের দিকে ঠেলে দিতে পারি না।

এই দেশ ও জাতিকে আশার আলোকে আলোকিত করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব ঐক্যবদ্ধভাবেই পালন করা সম্ভব। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এ তেইশ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের। নিজেদের যথাযথ অধিকার আদায়ের জন্য সংঘটিত ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা, ৬৯'র গণঅভু্যত্থান, ৭০'র নির্বাচন ও তৎপরবর্তী অসহযোগ আন্দোলন যা সর্বশেষে ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে।

বাংলাদেশ নতুন ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করেই মাত্র নয় মাসে গ্রহণ করে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। সংসদীয় গণতন্ত্র, স্বাধীন বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক সাম্য, মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে এ দেশে সামরিক শাসন আসে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পরত সামরিক ব্যক্তি বর্গের দ্বারা এদেশ পরিচালিত হয়েছে। ১৯৯০ তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবার শুরু হলেও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে অনেক বার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর অবিবেচক আচরণের কারণে সামরিক বাহিনী সমর্থিত অনির্বাচিত সরকার দু'বছর অবৈধভাবে দেশ পরিচালনা করেছে। আজ ২০১৩ সালে এসেও আমরা দেখছি, বিরোধী পক্ষকে দমন-নির্যাতন করা ক্ষমতাসীনদের অন্যতম মিশন। যার কারণে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিরোধী পক্ষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, ঘের দখল, জমি দখল, বাড়ি দখল, স্থাবর সকল সম্পত্তি দখল, গাছ-ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া এমনকি নারীদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে দেয়া, হত্যা করা বা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা যেন সাধারণ বিষয়।

নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সভা, সমাবেশ, মিছিল ও আন্দোলনকে নাশকতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া ক্ষমতাসীনদের অভ্যাস। বিনা কারণে বিরোধীদের প্রতি মামলা ও গ্রেপ্তার ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত যেন। বিভিন্ন আইন করে বিরোধী দমন এর ফলে গণতন্ত্র আমাদের দেশে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের স্বেচ্ছাচারিতার আর বিরোধীদলের অবিবেচক আচরণের কারণে গণতন্ত্র আমাদের দেশে ব্যর্থ মতবাদে পরিণত হতে চলেছে। ক্ষমতার অংশীদারদের প্রায় সকলেই যার যার অবস্থান থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে অভ্যস্ত।

নিজের স্বার্থোদ্ধার, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যক্তিগত ব্যবহার, অন্যকে বঞ্চিত করার মানসিকতা আমাদের চরিত্রে পরিণত হয়েছে। আর দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমরা কয়েকবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত দুর্ভাগ্য অর্জন করেছি। এছাড়াও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের নগ্ন হ্স্তক্ষেপ নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করছে। আমাদের রাজনীতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের ঝটিকা সফর শঙ্কার সৃষ্টি করে। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে আমাদের রাজনীতিবিদদের ধরনা দেয়ার বিষয়টিও মারাত্মক হতাশার সৃষ্টি করে।

নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কথা আমরা ভুলে গেছি। যার ফলে ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের মানুষ ৭৫হাজার কোটি টাকার সাহায্য প্রদান করেছিল তবু আমরা দেশটাকে গড়তে পারিনি। এপর্যন্ত যত বৈদেশিক অনুদান এসেছে তার ৭৫ ভাগ লুট হয়েছে। অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের জন্ম হয়েছে।

আমাদের শ্রম সস্তা বলেই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এখানে কারখানা খুলে পণ্য উৎপাদন করছে। আমরা আমাদের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তরিত করতে পারিনি; প্রাকৃতিক সম্পদেরও উত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন,‘এদেশ হিন্দুর নয়, মুসলমানদেরও নয়। এ দেশ কে যে নিজের দেশ বলে ভাববে এদেশ তার। এদেশের কল্যাণ দেখে যার মন আনন্দে ভরে উঠবে এ দেশ তার।

এ দেশের দুঃখে কাদঁবে যে এদেশ তার। আর তার এবং তাদের এদেশ যারা এদেশের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে ও ভবিষ্যতেও দেবে। ’ দরকার ঐক্যের চেতনাবোধ। জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত শিল্পোন্নতির গোড়ার দিনগুলোতে জাতীয় ঐকতানে খাই খাই বন্ধ রাখতে পেরেছিল। ভারত-মালয়শিয়ার সরকারি কর্মচারি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান দেশীয় গাড়ীতে চড়েছে, পুলিশ-সেনাবাহিনীর ব্যাবহৃত গাড়ী দেশে বানিয়েছে।

আর আমাদের দেশে গার্মেন্টস আর প্রবাসী শ্রমিকের আয়ের টাকা কিংবা দান-দেনার টাকায় বিদেশ থেকে পাজেরো-পেট্রোল কেনা হয়। বিচার, শিল্প, ব্যাংকিং আর কাস্টমস এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করেনা। আসলে দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব ছাড়া কোন সেক্টরের সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব না। চরম রাজনৈতিক অস্থিরতায় তৈরি বৈরী পারিপার্শ্বিকতায় অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে বাংলাদেশের মানুষ। আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ভাল না থাকলে উদ্যোক্তাদের অতিরিক্ত ঝুঁকি বাড়ে।

যদি আইন শৃঙ্থলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার সংকট তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তবে সব ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য শ্লথ কিংবা অচল হয়ে পড়বে। শুধু ব্যবসায়ীরা কেন বাংলাদেশের বর্তমান সহিংস ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সব শ্রেণী পেশার মানুষই। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সরকার ও বিরোধী দলের আপোসহীন মনোভাব ও বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে বাড়ছে উৎকণ্ঠা; যা আতঙ্কগ্রস্ত ও হতাশ করে ফেলেছে শান্তিপ্রিয় দেশবাসীকে। দেশের সচেতন মানুষ ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচীকে কখনই সমথন করেনা।

শান্তিপূর্ণভাবে জীবন পরিচালনা ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান করতে হলে শান্তিপূর্ণ উপায়েই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন হওয়া দরকার। দেশের উন্নয়ন ও মানুষের উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে গণতান্ত্রিক সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন। সহিংস কর্মসূচির ফলে বাড়ে চরম হতাশা, স্থবির হয়ে পড়ে উৎপাদন, বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠান যাতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সংঘাত ও সংঘর্ষের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে দেশ যে ক্রমান্বয়ে বিপর্যয়ের দিকেই যাচ্ছে-ভাবতেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠি। এটা ঠিক যে, জনসাধারণকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি করে নেতারাও স্বস্তিতে থাকতে পারবে না।

সংঘাতময় রাজনীতির আশংকায় অর্থনীতি হয়ে পড়েছে স্থবির,বিনিয়োগ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত, প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব,শিল্পোৎপাদন হচ্ছে ব্যাহত,রফতানি খাতে ঘটছে বিপর্যয়,ব্যাংকিং ব্যবসাতে হচ্ছে নৈরাজ্যের সৃষ্টি, বীমা ব্যবসাতে ধস নামছে,শেয়ার বাজারেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি হবে নিম্নমুখী,নেতিবাচক প্রভাবে দেশের কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের মাটি ও মানুষের স্বাথে একসঙ্গে বসে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, গোটা অর্থনীতিকে গভীর সংকটে ফেলে কোনোদিনই জনগণের ভোগান্তি ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির লাগামকে টেনে ধরা যাবে না।

হরতাল-অবরোধ-ভাঙ্চুর কখনই প্রতিবাদের একমাত্র যৌক্তিক ভাষা হতে পারে না। এটাও ঠিক শুধু হরতালের কারণে নয়- অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণেও। আমি এটাও বলছিনা যে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাই অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়ার একমাত্র কারণ। তবে এটা জোর দিয়েই বলতে পারি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশকে গতিহীন করে দিলে এর দায়ভার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বাসরোধ করে কেউ দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।

রাজনৈতিক সঙ্কটের ফলে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব রাজনৈতিক দল আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা খুঁজে বের করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখাবে এটাই দেশের মানুষ আশা করে। একদিকে রাজনৈতিক সংঘাত, আরেকদিকে বাজারে সবকিছুর অগ্নিমূল্য-স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোকে চরম হতাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জীবন নিবাহের ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আমি মনে করি, একদিকে বিরোধী দলীয় নেতাদের জেলে রাখা, অন্যদিকে আলোচনার কথা বলা অথহীন।

দেশে যদি সাংবিধানিক অধিকার ফিরে না আসে, রাজনীতিবিদরাই যদি ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে ফেলে তবেতো তা ভয়াবহ সমস্যারই কারণ হবে। সঙ্কট সমাধানে সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের মানসিকতার পরিবর্তন খুব বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে। হিংসা বিদ্বেষ ও মিথ্যাচারের যে চচা রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে এমন অবস্থায় দেশ চলতে পারে না। দেশে আজ তিন কোটি লোক বেকার। দেশের বিদ্যমান অবস্থায় অর্থনীতির বিকাশ সম্ভব নয়।

একটি বিশেষ চেতনার কথা বলে পরিকল্পিতভাবে দেশে বিভাজন বাড়ানো হচ্ছে। এটি সন্দেহাতীতভাবে সত্য চলমান সংঘাত গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। দেশের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতা বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, যা কাটিয়ে উঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ জন্য পিছিয়ে যাওয়া আর পেছনে টানার এই সংস্কৃতি থেকে রাজনীতিবীদদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা দেশকে রক্ষা করবে, জাতিকে রক্ষা করবে, ব্যবসায়ীদের শান্তিতে ব্যবসা করতে দেবে। দেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা দেশপ্রেমিক জনগণ কখনই বরদাশত করবেনা। একসাগর রক্তের বিনিময়ে যে লাল সবুজ পতাকা পেয়েছি সেই পতাকার মানকে সমুন্নত রাখার ব্যথতা বতমান জীবিত বাংলাদেশীদের জন্যে চরম লজ্জাস্কর।

সবোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে যারা স্বাধীনতা সাবভৌমত্ব এনেছিল তাদের স্বপ্নপূরণের ব্যথতায় ভবিষ্যত প্রজন্ম নিশ্চিতভাবেই বতমান প্রজন্মকে দায়ী করবে। আমাদের শক্তিতো আমাদের মানুষেরাই। এই মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করে কেউ যদি নিজেকে জনগণের সেবক হিসাবে পরিচয় দেয় তা রীতিমত হাস্যকর হয়ে ওঠে। শাপলা শালুকের এই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে তার দেশের চেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান বস্তু আর কিছু নেই। এই দেশেরই কোন অমানুষের অপতৎপরতার ফলে মাটির ওপরে দেশপ্রেমিক মানুষের চোখের পানি কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষের লাল রক্ত গড়িয়ে পড়লে তাতে জাতির আখেরে কল্যাণ লাভ কখনই হবেনা।

যেই মানুষটি মায়ের আদরে আর বাবার সোহাগে বেড়ে ওঠেছে, উদার প্রকৃতির আলো বাতাসে পরম মমতায় বড় হয়েছে তাকে যে লোভী স্বাথপর মানুষরুপী পশুরা বিপদগ্রস্ত করে তারা কোন দলের শত্রু শুধু নয় তারা মানুষের শত্রু, মানবতার দুশমন,অসভ্যতার প্রতীক। মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করেই যৌক্তিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে যে স্বাধীনতা তার জন্মগত অধিকার। যদি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা না যায়, রাস্তাঘাট-অফিস আদালত-বাসস্থান-যানবাহনে জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান না হয় তবে গণমানুষের সত্যিকার মুক্তি মিলবেনা। জীবনকে সুন্দর-সহজ-উন্নত করাটা প্রত্যেকেরই আজন্ম সাধ। সব সাধই সাধ্যের বাইরে চলে যায় যদি উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়।

স্বাধীন দেশের মানচিত্র সৈকতবিহীন একটি প্রস্তরময় দ্বীপের মত হয়ে যায় যদি সেখানকার জননেতারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশ ও জাতির উন্নতির শ্বাস-প্রশ্বাসকে রুদ্ধ করে। আলোহীন অরণ্যে যেমন জন্মাতে পারেনা কোন সবুজ উদ্ভিদ তেমনি দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম ছাড়া জন্মাতে পারেনা কোন দয়ালু নেতা। স্রোতহীন নদীর গতিহীনতা যেমন প্রাণহীন দেহের মত তেমনি শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি বিহীন দল মাঝিবিহীন নৌকার মতো। আজ আগুনের লেলিহান শিখা যেমনি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে চিরনি:স্ব ও চিরভষ্ম করে দিচ্ছে বাইরের জগতকে তেমনি হতাশা-হিংসা-লোভ ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে ভেতরের জগতকে।

সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত না করে সম্ভাবনার বিকাশ তেমনই অসম্ভব যেমনিভাবে স্বাধীনতা ব্যতীত কোন জাতিকে তার স্বকীয়তা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ বজায় রেখেই বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। স্বণের তৈরি তীর বুকে বিধলে কষ্ট কম অনুভূত হবে এটাকে যেমন কেউ যৌক্তিক বলবেনা তেমনি গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্রের আবিভাব ঘটলে জাতি সামনে এগুবে এটাকেও স্বাভাবিক সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মানুষ গ্রহণ করবে না। স্বর্ণ নির্মিত শৃঙ্খলের চাইতে যেমনিভাবে বেদুঈনের অনিশ্চিত জীবনও বেশি আনন্দের তেমনিভাবে দুনীতিবাজ নেতা ও মনুষত্ব বজিত বিবেকহীন কমীদের কোন রাজনৈতিক দলের আধিপত্যের চাইতে নীতিহীন দল ছাড়া দেশও বেশি ভাল থাকতে পারে। শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন,স্বাধীনতা লাভ করা যেমন কঠিন,স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কঠিন। আজ আমাদের অস্রের সংগ্রাম শেষ হয়েছে।

এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম কে দেশ গড়ার সংগ্রামে রূপান্তরিত করতে হবে। মুক্তির সংগ্রামের চেয়েও দেশ গড়ার সংগ্রাম কঠিন। তাই দেশ গড়ার কাজে আমাদের সর্ব শক্তি নিয়োগ করতে হবে। তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্মান জানাতে যেয়ে যদি রাজপথে লাশ ফেলতে হয়,মানব শরীরকে অগ্নিদগ্ধ করতে হয়,ভবিষ্যত প্রজন্মের সুস্থ বিকাশের পথকে রুদ্ধ করতে হয়, মিল-কারখানা-প্রতিষ্ঠানকে জ্বালিয়ে দিতে হয়-তবে দেশের মানুষের উন্নতি ও সামগ্রিক মঙ্গলের স্বাথেই এসব নিমম নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে বিদায় জানানো উচিৎ। এটা ঠিক যে, পরের স্বাথের চেয়ে নিজের স্বাথ হাসিলের বাসনা যদি প্রবল হয়ে ওঠে তবে কেউ নিজে সামান্যতম ছাড় দিতে বা কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করতে চাইবেনা।

যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেশের মানুষের চিন্তার,বলার এবং লেখার স্বাধীনতা দিতে পারেনা সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই পঙ্গু ও পঁচা। রাজনৈতিক স্বাথ চরিতাথকরণে যদি কারো মুখের খাবার কেড়ে নিতে হয়, গামেন্টস জালিয়ে দিয়ে শ্রমিককে কমহীন ও মালিককে সবশান্ত করতে হয়,মানুষ হত্যায় দায়ী অপরাধীকে নিরাপদ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে হয়,কলমের বদলে শিক্ষাথীর হাতে অস্র তুলে দিতে হয়,মেধা-যোগ্যতা-সততাকে বিবেচনা না করে দলীয় স্বাথে নিয়োগ-পদোন্নতি দিতে হয় তবে এমন রাজনীতিকে সমথন করা অসম্ভব। সম্মানজনক জীবিকা লাভের পথ ও পদ্ধতির বিনিময়ে বক্র পথে স্বর্গরাজ্যের বাসিন্দা হবার লোভ লালসা-বিকৃত রুচিরই বহি:প্রকাশ। দেশের যৌবন শক্তি কোনোদিন প্রার্থনা করবেনা যে,মুষ্টিমেয় কিছু আকৃতিতে মানুষ আর কমে শয়তানের খেয়াল খুশির খেসারত দিতে দেশটা নরক রাজ্য হোক। কারো অবিবেচনাপ্রসূত অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত আর তুঘলকি কমকান্ডে যদি গোটা দেশটাই একটি কারাগারে পর্যবসিত হয়-তবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে ঐ ব্যক্তি ও তার দল কোন অজানা নিমম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না।

মুখে নীতিবাক্য আর কমে অনৈতিকতা পরের অনিষ্ট করার ক্ষেত্রেই ভুমিকা রাখে। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি চচার মধ্য দিয়েই দেশের দীঘস্থায়ী উন্নতির পথ উন্মুক্ত রাখা সম্ভব। কোন ব্যক্তি বা দলের অবস্থান ইতিহাসের পাতায় স্বণাক্ষরে লিখিত হয় তখনই যখন সে ব্যাপক জনসমথন লাভ করে, বৃহত্তর কল্যাণে চেষ্টা-সাধনা করে। এটি মাথায় রাখতে হবে যে, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে বাঁচা অপেক্ষা প্রতিবাদী হয়ে শির দাঁড়া উচুঁ করে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করাও সুখকর।

১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্যে আার ১৯৭১ সালে দেশের তরে জীবন দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি আমরা জান দিতে পারি কিন্তু মান দিতে পারি না। দেশকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে হলে দেশী-বিদেশী সকল অতৎপরতা সম্পর্কে প্রত্যেকটি বাংলাদেশীকে সতর্ক থাকতে হবে। কোন প্রতিবন্ধকতাই যেন দেশের সার্বিক অগ্রগতি ব্যাহত না করে সেই দিকেই খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে কোন ক্রমেই আমরা বিপদ ও বিপন্নের দিকে ঠেলে দিতে পারি না। এই দেশ ও জাতিকে আশার আলোকে আলোকিত করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

এ দায়িত্ব ঐক্যবদ্ধভাবেই পালন করা সম্ভব। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এ তেইশ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের। নিজেদের যথাযথ অধিকার আদায়ের জন্য সংঘটিত ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা, ৬৯'র গণঅভু্যত্থান, ৭০'র নির্বাচন ও তৎপরবর্তী অসহযোগ আন্দোলন যা সর্বশেষে ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। বাংলাদেশ নতুন ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করেই মাত্র নয় মাসে গ্রহণ করে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান।

সংসদীয় গণতন্ত্র, স্বাধীন বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক সাম্য, মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে এ দেশে সামরিক শাসন আসে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পরত সামরিক ব্যক্তি বর্গের দ্বারা এদেশ পরিচালিত হয়েছে। ১৯৯০ তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবার শুরু হলেও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে অনেক বার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর অবিবেচক আচরণের কারণে সামরিক বাহিনী সমর্থিত অনির্বাচিত সরকার দু'বছর অবৈধভাবে দেশ পরিচালনা করেছে।

আজ ২০১৩ সালে এসেও আমরা দেখছি, বিরোধী পক্ষকে দমন-নির্যাতন করা ক্ষমতাসীনদের অন্যতম মিশন। যার কারণে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিরোধী পক্ষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, ঘের দখল, জমি দখল, বাড়ি দখল, স্থাবর সকল সম্পত্তি দখল, গাছ-ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া এমনকি নারীদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে দেয়া, হত্যা করা বা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা যেন সাধারণ বিষয়। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সভা, সমাবেশ, মিছিল ও আন্দোলনকে নাশকতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া ক্ষমতাসীনদের অভ্যাস।

বিনা কারণে বিরোধীদের প্রতি মামলা ও গ্রেপ্তার ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত যেন। বিভিন্ন আইন করে বিরোধী দমন এর ফলে গণতন্ত্র আমাদের দেশে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের স্বেচ্ছাচারিতার আর বিরোধীদলের অবিবেচক আচরণের কারণে গণতন্ত্র আমাদের দেশে ব্যর্থ মতবাদে পরিণত হতে চলেছে। ক্ষমতার অংশীদারদের প্রায় সকলেই যার যার অবস্থান থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে অভ্যস্ত। নিজের স্বার্থোদ্ধার, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যক্তিগত ব্যবহার, অন্যকে বঞ্চিত করার মানসিকতা আমাদের চরিত্রে পরিণত হয়েছে।

আর দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমরা কয়েকবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত দুর্ভাগ্য অর্জন করেছি। এছাড়াও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের নগ্ন হ্স্তক্ষেপ নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করছে। আমাদের রাজনীতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের ঝটিকা সফর শঙ্কার সৃষ্টি করে। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে আমাদের রাজনীতিবিদদের ধরনা দেয়ার বিষয়টিও মারাত্মক হতাশার সৃষ্টি করে। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কথা আমরা ভুলে গেছি।

যার ফলে ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের মানুষ ৭৫হাজার কোটি টাকার সাহায্য প্রদান করেছিল তবু আমরা দেশটাকে গড়তে পারিনি। এপর্যন্ত যত বৈদেশিক অনুদান এসেছে তার ৭৫ ভাগ লুট হয়েছে। অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের জন্ম হয়েছে। আমাদের শ্রম সস্তা বলেই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এখানে কারখানা খুলে পণ্য উৎপাদন করছে।

আমরা আমাদের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তরিত করতে পারিনি; প্রাকৃতিক সম্পদেরও উত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন,‘এদেশ হিন্দুর নয়, মুসলমানদেরও নয়। এ দেশ কে যে নিজের দেশ বলে ভাববে এদেশ তার। এদেশের কল্যাণ দেখে যার মন আনন্দে ভরে উঠবে এ দেশ তার। এ দেশের দুঃখে কাদঁবে যে এদেশ তার।

আর তার এবং তাদের এদেশ যারা এদেশের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে ও ভবিষ্যতেও দেবে। ’ দরকার ঐক্যের চেতনাবোধ। জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত শিল্পোন্নতির গোড়ার দিনগুলোতে জাতীয় ঐকতানে খাই খাই বন্ধ রাখতে পেরেছিল। ভারত-মালয়শিয়ার সরকারি কর্মচারি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান দেশীয় গাড়ীতে চড়েছে, পুলিশ-সেনাবাহিনীর ব্যাবহৃত গাড়ী দেশে বানিয়েছে। আর আমাদের দেশে গার্মেন্টস আর প্রবাসী শ্রমিকের আয়ের টাকা কিংবা দান-দেনার টাকায় বিদেশ থেকে পাজেরো-পেট্রোল কেনা হয়।

বিচার, শিল্প, ব্যাংকিং আর কাস্টমস এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করেনা। আসলে দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব ছাড়া কোন সেক্টরের সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব না। চরম রাজনৈতিক অস্থিরতায় তৈরি বৈরী পারিপার্শ্বিকতায় অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে বাংলাদেশের মানুষ। আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ভাল না থাকলে উদ্যোক্তাদের অতিরিক্ত ঝুঁকি বাড়ে। যদি আইন শৃঙ্থলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার সংকট তৈরি হয়।

বিনিয়োগকারীরা যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তবে সব ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য শ্লথ কিংবা অচল হয়ে পড়বে। শুধু ব্যবসায়ীরা কেন বাংলাদেশের বর্তমান সহিংস ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সব শ্রেণী পেশার মানুষই। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সরকার ও বিরোধী দলের আপোসহীন মনোভাব ও বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে বাড়ছে উৎকণ্ঠা; যা আতঙ্কগ্রস্ত ও হতাশ করে ফেলেছে শান্তিপ্রিয় দেশবাসীকে। দেশের সচেতন মানুষ ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচীকে কখনই সমথন করেনা। শান্তিপূর্ণভাবে জীবন পরিচালনা ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান করতে হলে শান্তিপূর্ণ উপায়েই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন হওয়া দরকার।

দেশের উন্নয়ন ও মানুষের উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে গণতান্ত্রিক সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন। সহিংস কর্মসূচির ফলে বাড়ে চরম হতাশা, স্থবির হয়ে পড়ে উৎপাদন, বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠান যাতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সংঘাত ও সংঘর্ষের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে দেশ যে ক্রমান্বয়ে বিপর্যয়ের দিকেই যাচ্ছে-ভাবতেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠি। এটা ঠিক যে, জনসাধারণকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি করে নেতারাও স্বস্তিতে থাকতে পারবে না। সংঘাতময় রাজনীতির আশংকায় অর্থনীতি হয়ে পড়েছে স্থবির,বিনিয়োগ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত, প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব,শিল্পোৎপাদন হচ্ছে ব্যাহত,রফতানি খাতে ঘটছে বিপর্যয়,ব্যাংকিং ব্যবসাতে হচ্ছে নৈরাজ্যের সৃষ্টি, বীমা ব্যবসাতে ধস নামছে,শেয়ার বাজারেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি হবে নিম্নমুখী,নেতিবাচক প্রভাবে দেশের কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের মাটি ও মানুষের স্বাথে একসঙ্গে বসে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, গোটা অর্থনীতিকে গভীর সংকটে ফেলে কোনোদিনই জনগণের ভোগান্তি ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির লাগামকে টেনে ধরা যাবে না। হরতাল-অবরোধ-ভাঙ্চুর কখনই প্রতিবাদের একমাত্র যৌক্তিক ভাষা হতে পারে না।

এটাও ঠিক শুধু হরতালের কারণে নয়- অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণেও। আমি এটাও বলছিনা যে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাই অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়ার একমাত্র কারণ। তবে এটা জোর দিয়েই বলতে পারি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশকে গতিহীন করে দিলে এর দায়ভার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বাসরোধ করে কেউ দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। রাজনৈতিক সঙ্কটের ফলে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব রাজনৈতিক দল আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা খুঁজে বের করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখাবে এটাই দেশের মানুষ আশা করে। একদিকে রাজনৈতিক সংঘাত, আরেকদিকে বাজারে সবকিছুর অগ্নিমূল্য-স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোকে চরম হতাশা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।