আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শব মিছিল

ম্যারিনা নাসরীন (সীমা)

‘শব মিছিল’ ম্যারিনা নাসরীন । --------------------------------------------------------------------------- গত বছর এই সময়ে টিভি স্ক্রিনে বারবার বিশ্বজিৎ নামের যুবকটির রক্তাক্ত চেহারা তার বাঁচার আকুতি আর দা হাতে এ যুগের দজ্জাল দের ভয়ংকর রূপ দেখে আমার মধ্যে একটা ভাবান্তর হয় । জীবনের উপর থেকে সমস্ত রঙ উঠে গিয়েছিল । সে সময় দুঃখী হয়ে যাওয়া ছেলে টিকে নিয়ে আমি ‘শব মিছিল’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম । গল্পটি একটা সাইটে প্রথম পুরস্কার ও পেয়েছিল ।

আমি ফেসবুকে এ পর্যন্ত পুরো কোন গল্প পোস্ট করিনি । আজ বিশ্বজিতের আত্মা হয়ত কিছুটা হলেও শান্তি পেয়েছে । তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমার লেখা সেই গল্পটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম । আশা করছি পড়ে ভাল লাগবে । সময়টা থমকে ছিল ঠিক বারোটায় ! যুবকটি শুয়ে ছিল রংচটা ট্রলিতে ।

বড় বড় ভেজা চোখ দুটি আধখোলা । ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে আছে একটি গজদাঁত । মুষ্টিবদ্ধ হাতটির বুড়ো আঙ্গুলটা কাটা পড়েছে বাহাদুর শাহ পার্কের মোড়েই । রক্তাক্ত যুবক, অপেক্ষা করছিল পোস্টমর্টেমের । ফালা ফালা করে কাটা হয়েছে সুখী যুবকের শরীরটিকে ।

সেখান থেকে চুয়ে চুয়ে আসা রক্তের ধারাগুলি যেন এক একটি বহতা নদী । কোনটিতে কান্নার জল, কোনটি বিষাদের, কোনটিতে আবার জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন । লম্বা করিডোরে নৈঃশব্দ জমাট বেঁধে আছে । যেন গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দুপুর অথচ শীতের এখন মাঝামাঝি সময় । যুবকটির শরীর জুড়ে মাছিদের মচ্ছব চলছে ।

শকুনের হিংস্রতা নিয়ে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা রক্তের নেশায় । কিছু দূরে ঘাড় গুঁজে বিড়ি ফুঁকছে বৃদ্ধ বুধু ডোম । রক্ত চোখে তার রাজ্যের উদাসীনতা । সেও অপেক্ষা করছে । ডাক পড়লেই ট্রলিটা ঠেলে নিয়ে যেতে হবে লাশ কাটা ঘরে ।

সময় সচল হয় । যুবকটির অপেক্ষা শেষ হয়েছে, সাথে বুধু ডোমেরও । আধখাওয়া বিড়ি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে । সেটি পড়ে গিয়ে মরা ফুল গাছের টবটিতে । বিড়ির আগুন মুখ থেকে সূক্ষ্ম একটা ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে ।

উস্কানি পেলে এই সূক্ষ্ম ধোঁয়া কখনো কখনো দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে পারে এটা মানুষ অনেক সময় মনে রাখে না । ট্রলির চার চাকায় অকস্মাৎ আর্তনাদ উঠলো ঘড়ঘড়ররররররর...। ট্রলির আহাজারিতে সুখী যুবকটির ইন্দ্রিয়গুলো ধীরে ধীরে সজাগ হয়ে ওঠে । তার রক্তাক্ত ত্বক বাতাসের স্পর্শ পেয়ে যেন শিহরিত হয়, বন্ধ চোখের তারা গুলো বোধ হয় একটু কেঁপে ওঠে । কথা বলার নেশায় চিরকালের লাজুক যুবকের ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক হয়ে নীরবে বাঙময় হয়ে ওঠে ।

ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি আসে । হঠাৎ করে তার শিশুবেলার দোলনার কথা মনে পড়ে যায় । মায়ের কোলের কথা মনে হয় । সুখী যুবকটি আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় । শীতের সকালটা আজ একটু অন্যমনস্ক ।

বৃদ্ধদের শুকনা ঠোঁটের মত শুষ্ক খসখসে । ২৭/২ নবদ্বীপ বসাক লেনের স্যাঁতসেঁতে গলির শেষ বাড়িটা কখনো সূর্যের আলোর মুখ দেখেছে বলে মনে হয় না । টিনের চালে ছাওয়া দেড়খানা ঘরের আধটিতে অলস শুয়েছিল সাধারণ চেহারার সুখী যুবকটি । পলেস্তারা খসা এবড়োথেবড়ো দেওয়ালে বলিউডের নায়িকা ক্যাটরিনা হাসি মুখে ঝুলে আছে । যুবকটির বড় প্রিয় সে ।

বঙ্গবাজারের ফুটপাত থেকে কেনা কম্বলে তেমন ওম নেই । সেটি সে গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শোয় । আজ সারা দেশে কোন এক রাজনৈতিক দল অবরোধ ডেকেছে । নিজের দেশেই মানুষ কে কাকে অবরোধ করবে, কেন করবে, সেসব খবরে যুবকের তেমন আগ্রহ নেই । তার চিন্তা একদিন দোকান খুলতে না পারলে যে ক্ষতি হয় তার মত ছোট দর্জি সেটা আর পূরণ করতে পারে না ।

যত যাই হোক তাকে দোকান খুলতেই হবে । অনেক কাজ বাকি । সামনে বিজয় দিবস । আজকাল বাঙ্গালিরা নানা দিবসে নানান রঙের কাপড় পরে আনন্দ করে । এতে তার লাভ ।

বিজয় দিবসে লাল সবুজ কাপড়ের চল বড় বেড়েছে । অনেক গুলো কাপড়ের অর্ডার পেয়েছে সে, সেগুলো এই দুইদিনে শেষ করতে হবে । রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে । একটু পরেই ডাল ফোঁড়নের গন্ধে ছোট্ট ঘরটি ভরে ওঠে । রংবেরঙের কিছু শান্তির প্রজাপতি যেন নিম্নবিত্তের ঘরজুড়ে ওড়াওড়ি শুরু করে দেয় ।

যুবকটি ধীরেধীরে বিছানা ছাড়ে । রান্না ঘরে এসে উঁকি দেয়, ‘বউদি, একটু গরম জল হইব ? স্নান সাইরা দোকানে যাইতে হইব । ’ ‘আইচ্ছা । যাও, দিতাছি । কিন্তু গুলমালের মইধ্যে আইজকা আর দোকান খুলনের কাম নাই।

’ ‘কি যে কও ! দোকান না খুললে চলব ? মেলা অর্ডার নেওয়া আছে । সময়মত ডেলিভারী না দিতে পারলে কাস্টমার খেপবো না ?’ লাইফ বয় সাবান গায়ে ঘষেঘষে আয়েশ করে গোছল সারে যুবক । পাঁচফোড়ন দেওয়া ডাল, আলুভর্তা আর জলপাইয়ের আচার দিয়ে পেট পুরে ভাত খায় । সাদা রঙের চেক শার্টটি গায়ে দিয়ে সুখী যুবকটি যখন একটা একটা করে বোতাম লাগাচ্ছিল আর গুনগুন করে গান গাইছিল শহরের আর একটি প্রান্তে তখন কিছু অসুখী যুবক হকিস্টিক, রামদা, চাপাতি ইত্যাদি মারণাস্ত্র শান দিতে ব্যস্ত ছিল । তাদের মুখে কোন গান ছিল না ।

তাদের চোখের চাহনি বিভ্রান্ত ছিল । তাদের শার্টের উপরের দুটি করে বোতাম খোলা ছিল । সুখী যুবকটি জানত না ওর মত সুখী ছেলেদের আজ রাস্তায় বের হতে নেই । আজ রাস্তা এসব অসুখী যুবকদের দখলে থাকবে । লাল দলের যুবক ।

নীল দলের যুবক । ঘর থেকে বের হতে যাবে এমন সময় ভাইয়ের ছোট্ট ছেলে টোকন পিছন থেকে শার্ট টেনে ধরল, ‘কাক্কু, আওনের সময় আমার লাইগা আলুজ আনবা কইলাম । ’ ‘আলুজ আবার কিরে বেটা ?’ ‘ধুর ! জানো না, বোকা কুনহানকার? আলুজ হইল চিপস । ’ ‘আইচ্ছা আনুমনে । ’ ‘এই ছ্যারা, পিছে থেইকা ডাকন নাই ।

অকল্যাণ হয়, ’ শিশুটির মা ধমকে ওঠে । ‘ধুর বউদি, কোন যুগে পইড়া আছ ? এই গুলান কিছু না ভাগ্যে যা আছে হইব । আইচ্ছা অহন যাইগা । ’ ‘সাবধানে যাইও ভাই, রাস্তা ঘাটে বেশি গুলমাল দেখলে ফিরা আইস । ’ ঘর ছেড়ে যখন সে গলির পথে নামে সময় তখন সকাল আটটা বেজে চল্লিশ ।

ড্রেনের উপরের স্লাবের উপর দিয়ে সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে । স্লাব গুলো একবার খট করে শব্দ করে উঠে আবার নেমে শব্দ করে থেমে যায় । যুবকের এটা প্রতিদিনের একটি খেলা । অচিরেই সে মেইন রোডে পৌঁছে যায় ২৭/২ নবদ্বীপ বসাক লেনের সুখী সাধারণ যুবকটি । কেএফসির দেওয়ালে ঝুলে থাকা বৃদ্ধ লোকটি প্রতিদিনের মত হেসে তাকে স্বাগত জানায় ।

কিছুদিন আগেই কেএফসির এই দোকানটি এলাকায় খুলেছে । বড় লোকেরা নাকি মাঝে মাঝেই এখানে মুরগী ভাজি খেতে আসে । যুবকটি অনেকদিন ভেবেছে টোকনটাকে একদিন কেএফসি নিয়ে মুরগী ভাজি খাওয়াবে । সুযোগ পেলে সরলাকেও সেখানে আসতে বলবে । সেটা আর হয়নি ।

তাতে অবশ্য তার কষ্ট নেই । সে জানে তাদের মত মানুষের সব ইচ্ছা পূরণ হয় না । এটাই প্রকৃতির নিয়ম । হাসিখুশি যুবকটি বৃদ্ধ লোকটির সাথে আজো হাসি বিনিময় করে সামনে এগিয়ে যায় । রাস্তার দুপাশের দোকানপাট সব বন্ধ ।

রুটির দোকানেও তালা লাগানো । গলির মুখের অপুষ্ট কুকুর গুলো আজ মন খারাপ করে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে । কিছু অল্প বয়সী যুবক লাঠিসোটা হাতে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে । দুইএকটি রিকশা আসলে যাত্রীদেরকে নামিয়ে দিচ্ছে, রিকশাওয়ালার শরীরে নির্দ্বিধায় আঘাত করছে । রিকশার চাকা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে ছিদ্র করে দিচ্ছে, যেন এটা তাদের খেলা ! এক রিক্সাওয়ালা একটু দূরে গিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, "শালারা !" যুবকটি শুনে মুচকি হাসে ।

দুর্বলেরা ক্ষমতাবানদের সামনে কিছু বলতে পারে না । এভাবে আড়ালেই তারা মনের ক্ষোভ ঝাড়ে । রাস্তায় লোকজনের চলাচল কম, যারা আছে বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে চলেছে । যুবকটি অভ্যাসবশতঃ সব কিছুই দেখল, কিন্তু সে খেয়াল করল না যে রাস্তায় চলা মানুষ গুলোর মুখে হাসি নেই । কারো কারো কপালে ভাঁজের রেখা, কিছুটা ব্যস্ত কিছুটা সন্ত্রস্ত ।

যুবকটি রাস্তায় সূর্যের আলো পড়তে দেখেছিল । কিন্তু সে দেখলনা যে আজকের সূর্যের রঙটি ঠিক সোনালি ছিলনা । যুবকটির মোবাইল বাজছে । দেড় হাজার টাকার চাইনিজ মোবাইল । ‘হ্যালো, মা ।

ভাল আছ ?’ ‘হ বাবা । তুমি কই ?’ ‘মা আমি দোকানে যাইতেছি । ’ ‘কেন, বাবা ? আইজ না ডাহায় গোলমাল হইব হুনলাম । তুমি ঘরতন কেন বারাইছ ?’ ‘আরে না । আমার আর কি হইব ? আমি কি দল করি নাকি ? চিন্তা কইর না তো মা ।

দোকান তো কাছেই । হাইটা পাঁচ মিনিটও লাগব না । ’ ‘বাবা সাবধানে যাইও । আর সামনের হপ্তায় পারলে একটু বাড়িত আইও । তোমারে কদ্দিন দেহি না ।

’ ‘আইচ্ছা মা, আমুনে । অহন রাখি । ’ সময় তখন সকাল নয়টা । সাধারণ চেহারার সুখী যুবকটি শিস দিতে দিতে পথ পার হতে গিয়ে একটু হোঁচট খায় । সে পাত্তা দেয় না ।

একটা মিছিল আসছে । সব কোট-টাই পরা ভদ্র বেশধারী মানুষ অথবা অমানুষের মিছিল । মিছিলের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে । হঠাৎ যেন ছন্দ পতন হয় । পায়ের কাছেই বিকট শব্দে কিসের যেন বিস্ফোরণ ঘটে ।

এই শব্দের সাথে সে মোটেই পরিচিত নয় । চারদিকে কালো ধোঁয়া ছেয়ে গিয়েছে । আর্তনাদ করে দিশেহারা হয়ে পড়ে সুখী যুবকটি । বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখে তার দিকে ছুটে আসছে কিছু রক্তচক্ষুধারী অসুখী যুবক । যুবকটি প্রাণপণে ছুটে পালাতে থাকে ।

আর পেছনের যুবকগুলোর মুখ থেকে শোনে রক্ত পিপাসু হায়েনাদের তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মত শব্দ, ‘ধরধর মারমার’ । তারা কেন তাকে ধরতে চায়, মারতে চায় সাধারণ যুবক সেটি বুঝতে পারেনা । প্রাণভয়ে একলা যুবকটি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে । অসুখী যুবকের দল তার কাছেই এসে পড়েছে । দুষ্টু বালকদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নিরীহ প্রজাপতি যেমন দিশাহীন ভাবে উড়ে উড়ে এক পাতা থেকে আরেক পাতার পিছনে আশ্রয় নেয়, তেমনি যুবকটিও দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে দৌড়াতে থাকে ।

কয়েক বছর ধরে এ এলাকায় থাকে সে । তবুও কেমন জানি সবকিছু অচেনা ঠেকছে । কোনদিকে কি, সে বেমালুম ভুলে গিয়েছে । না বুঝে এক দোকানের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে আশ্রয় নেয় সে । হায় ! সুখী যুবক ।

মায়ের কথা শোনেনি সে । বউদির কথাও শোনেনি । এমনকি পথ চলতে যখন হোঁচট খেল, সেটাকেও পাত্তা দেয়নি । উন্মত্ত চেহারার যুবকেরা একা যুবকটিকে ঘিরে ফেলে । তাদের অস্ত্র উদ্যত হয় ব্যথিত যুবক হাত জোড় করে আকুতি জানায়, ‘আমি লাল নই, নীল নই, আমি সাধারণ মানুষ ।

আমাকে ছেড়ে দাও । ’ কিন্তু, বীর পুঙ্গবেরা কি এত সহজে রণে ভঙ্গ দিতে পারে ? নিরীহের রক্তে অস্ত্র রঞ্জিত না হলে তাদের যে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় ! তারা তাদের ক্রোধকে চেহারায় ফুটিয়ে তুলছিল । রক্তচক্ষু অসুখী যুবকের হাত ধরে নেমে আসে অসময়ের ইবলিশ । চকচকে ধারালো ইস্পাত যুবকের ঘাম ঝরানো শক্ত পেশি ভেদ করে ঢুকে গেল । আহ ! গতকাল ধোয়া সাদা শার্টটা নিমিষেই লাল হল......রক্তলাল ।

থকথকে ছোট ছোট মাংস পিণ্ড ছড়িয়ে পড়ল আশে পাশে । মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ে তার মনে হ'ল, সামনের হপ্তায় তার মার সাথে দেখা আর হয়ত হবে না । আর সেই মমতাময়ী মায়ের স্মৃতি আরও কম সময়ে তাকে অশরীরী তেজ এনে দিল । তাকে বাঁচতে হবে । মায়ের সাথে দেখা করে তার হাতে মাসের টাকাটা তুলে দিতে হবে ।

সেই শক্তির জোরে উন্মত্ত যুবকদের ব্যূহ ভেদ করে সে বেরিয়ে এল । ছুটতে লাগল আবার দিশাহীন হয়ে । বাহাদুর শাহ পার্কের মোড় । সময় তখন নয়টা বিশ । সুখী যুবকটি জানত না ।

রাস্তায় আজ অসুখী মানুষের ভিড় । আবারো তাকে ঘিরে ব্যূহ বানাল সেসব মানুষেরা । তার শরীরে আঘাতের পর আঘাত নেমে আসছে । ধরাশায়ী রক্তাক্ত যুবক অসহায় চোখে এতক্ষণে আকাশের দিকে তাকাল । সে অবাক হয়ে দেখল, সূর্যটা সোনালী নয় ।

আজকের সূর্যটার রঙ টকটকে লাল । সূর্যটা কি আসলেই লাল ছিল নাকি তার রক্তের রঙ মেখে লাল হয়েছিল সেটা সে বুঝতে পারল না । কিছু দামী ক্যামেরার টেলিফটো লেন্সে প্রতিযোগিতা চলছে কে তার অসহায়ত্বকে সবচেয়ে সুন্দর করে পরদিনের পত্রিকা আর আজকের ব্রেকিং নিউজে তুলে ধরতে পারে । অদূরে সরকারী পোশাকধারীরা গম্ভীরভাবে পার্কের গাছগুলোর পাতা গুনছে । যুবকটি আবার ক্লান্ত চোখে আকাশের লাল সূর্যের দিকে তাকাল ।

তার শক্তি শেষ হয়ে আসছে । অসংখ্য আঘাতে চেরা শরীরে থেকে লহুরেখা পিচের রাস্তায় যেন আল্পনা আঁকছে । শেষ বারের মত যুবকটি বাঁচার আকুতিতে চারদিকে দৃষ্টি ফেলল । যদি কোন মানুষ থাকে আশে পাশে । যুবকটি দেখল তার আশেপাশে অনেক বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকা প্রাণী ।

আকারে তার মতই । তবে তাদের মানুষ বললে ভুল হবে । তারা যেন ভাবলেশহীন প্রস্তর মূর্তি । যুবক আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়ায় । কিন্তু হোঁচট খেয়ে লুটিয়ে পড়ে সরুগলির কঠিন মাটিতে ।

তার বুক চিরে একটা শব্দ বেরিয়ে আসে , 'মাগো' তার দুচোখের কোণ বেয়ে পানির দুটি ধারা নেমে আসে । এই অশ্রু তার শরীরের এত যন্ত্রণার জন্য নয়, সে যে মারা যাচ্ছে, তার জন্যে নয় । তার আশেপাশের অসুখী মানুষগুলোর জন্যেও নয় । তার দুঃখ ছোট্ট টোকনের জন্য । যে অপেক্ষা করছে এক প্যাকেট চিপসের জন্য ।

দূরে অপেক্ষায় থাকা তার মায়ের জন্য । সরলার ভেজা দুটি চোখের জন্য । সুখী যুবকটি ধীরে ধীরে দুঃখী হয়ে উঠছে । একটু ঝিমুনি এসেছিল, হঠাৎ একটা মায়ার স্পর্শ তাকে আবার জাগিয়ে তুলল । সামনে তারই মত সাধারণ চেহারার একজন সুখী মানুষ, ‘বাজান, একটু উঠ ।

আমারে ধর , তোমারে আমার রিস্কায় কইরা হাসপাতালে লইয়া যাই। ’ যুবকের মুখে তৃপ্তির হাসি । খুব ব্যথা । ঠোঁট বাঁকাতে খুব কষ্ট হচ্ছে । কিন্তু তবুও, সব ব্যথা ভুলে সে হাসছে ।

অন্ততঃ একজন পাওয়া গেল, যে মানুষ । রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য প্রস্তর মূর্তি তাদের পাথর চোখে দেখল একজন সাধারণ সুখী মানুষ আর একজন দুঃখী হয়ে ওঠা রক্তাক্ত মানুষকে তার বাহনে সওয়ারী করে চলেছে । পিছনে রেখে যাচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্তরেখা । যুবকটি হাসপাতালের বারান্দায় অপেক্ষা করছে সাথে দরিদ্র রিকশাচালক । আহারে অসহায় যুবক, রাস্তায় হোঁচট খেয়েও কেন বুঝলনা আজ সবখানে অসুখী মানুষের ভিড় ।

তার শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে কিন্তু একজন সাধারণ যুবকের রক্তের দামই বা কতটুকু ? গলায় স্টেথোস্কোপ প্যাঁচানো অসুখী মানুষটি জানিয়ে দেয় সরকারী পোশাকধারীর কথা ছাড়া তার চিকিৎসা চলবে না । সময় গড়ায়, হাসপাতালের মেঝে আরও অনেক সাধারনের মত তার রক্তে রঞ্জিত হয় । দুঃখী যুবকটি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে । তার চোখে কালো পর্দা নেমে আসে তারপর কোন এক ফাঁকে সে নাতিদীর্ঘ সময়ের নদী থেকে অসীম সময়ের সমুদ্রে ঢলে পড়ে । সময় তখন দুপুর একটা ।

যুবকটি অপেক্ষা করছে লাশকাটা ঘরে । যুবকটি অপেক্ষা করছে পোস্টমর্টেমের । হাজার ওয়াটের বাতির আলোয় চোখ ঝলসে ওঠে । কাঁচির টুংটাং শব্দে হঠাৎ করে মনে হয় ডাল ফোড়নের মিষ্টি গন্ধে ছুটে আসবে প্রজাপতিরা । কিন্তু না ।

যুবকের নাকে রক্তের আঁশটে গন্ধ আসছে । আহা ! কত নির্দয়ভাবে তার শরীর কেটে চলেছে অসুখী মানুষগুলো । এরা তারাই, যারা মানুষ বাঁচানোর শপথ তো ঠিকই নিয়েছিল, কিন্তু তাকে বাঁচাতে যাওয়ার আগে সরকারী পোশাকধারীদের অনুমতির জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেছিল । আর সেসময় যুবকটি অপেক্ষা করছিল মহাযাত্রার বাস ছাড়ার । কিন্তু এখন, তার কাটা শরীরকে আরও কাটতে তাদের হাত কাঁপছে কি ? নির্বিকার মুখগুলোর ভাঁজে সে প্রশ্নের জবাব নেই ।

সময় তখন রাতের মধ্যভাগ । চিতার বুকের আগুন অনেক আগেই নিভে গিয়েছে । বাতাসে লাশ পোড়ার গন্ধ । একসময়ের সুখী যুবকের বুকের পাঁজরের পোড়া ভস্মগুলি বুড়িগঙ্গার পানিতে কেবল মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে । অকস্মাৎ হিমেল বাতাসে তুফান ওঠে ।

সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে মধ্যরাতের শ্মশানবাসীরা । তুফানের সেই ঘূর্ণিপাক থেকে বেরিয়ে আসে সাধারণ সুখী সেই যুবক । চোখের বৃত্তে যেন তার আগুনের হোলি খেলছে । যুবকটি নিঃশব্দে এগিয়ে চলে । পিছনে যোগ দেয় ঈর্ষার আগুনে ঝলসে শব হয়ে যাওয়া আরও হাজারো প্রাণ ।

বুড়িগঙ্গার তীর ঘুরে তারা ওয়ারী, আজিমপুর, বনানী হয়ে চলে যায় রায়ের বাজারে । সেখান থেকে ফিরে আসে শহীদ মিনারে । তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে একুশ আর একাত্তরের পুণ্যাত্মারা । বীরশ্রেষ্ঠদের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্যরকম একটি মিছিলের । সে মিছিলে হানাহানি নেই, কাটাকাটি নেই, কথার কোন ফুলঝুরিও নেই ।

তাঁদের দৃষ্টির মশালে মহানগরীর আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে । সে আলোক ধাঁধায় নগরবাসীর ঘুম ভেঙ্গে যায় । তারা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখে সব ঘরের কপাট খুলে গিয়েছে । হাজার হাজার যুবক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে । যোগ দিয়েছে সেই শান্তির মিছিলে ।

তাদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনি হয়, জেগে ওঠো শ্মশান, সমাধি, কবরবাসী জেগে ওঠো মানুষেরা সময় হয়েছে তোমাদের আজ মিছিলে যাবার । দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় শব মিছিল । ধীর পায়ে তারা এগিয়ে যায় সামনের দিকে .....তাঁদের দৃষ্টি ঊর্ধ্বমুখী হয় । সময় তখন নতুন একটি সূর্য উঠার ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।