আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (১৯তম পর্ব)

তিনি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেন খানেখানানের পছন্দের বিষয়গুলো। যারা নারী, অর্থ কিংবা মদে আসক্ত তাদের বশীভূত করা অতি সহজ। কিন্তু খানেখানান আবদুর রহিমের নাকি এই তিনটি অভ্যাসের একটিও ছিল না। ফলে আব্বাজান পেরেশানিতে পড়ে গেলেন। কেউ কেউ বুদ্ধি দিলেন কবিতাপাঠ, সংগীতসন্ধ্যা কিংবা জাঁকজমক সহকারে শ্রীকৃষ্ণ ও হনুমানজীর কীর্তনের ব্যবস্থা করা।

আমাদের অঞ্চলটিতে হিন্দু মুসলমানরা বহু বছর ধরে সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করে আসছিল। ফলে মুসলমান জায়গিরদারের হাভেলীতে হিন্দুদের কীর্তন অনুষ্ঠানের পথে কোনো বাধাই ছিল না। আব্বাজান হিন্দু নেতাদের সঙ্গে কথা বললেন। সবাই খুব খুশি হলো। মনেশ্বর নামক এক হিন্দু জমিদার পরামর্শ দিলেন মহাকবি তুলসী দাসকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।

খানেখানান যদি এই স্থানে এসে তুলসী দাসকে দেখেন তবে তার আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকবে না। মনেশ্বর বাবুর পরামর্শটি আব্বাজানের খুবই পছন্দ হলো। স্থানীয় অভিজাত হিন্দুদের এক প্রতিনিধি দল পাঠানো হলো কবি তুলসী দাসের কাছে।

রামভক্ত কবি হিসেবে তুলসী দাসের খ্যাতি তখন ছড়িয়ে পড়ছিল দুনিয়াব্যাপী। সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাকবি বাল্মিকীর রামায়ণ তিনিই প্রথম হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করে সর্বত্র হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে দেবতা রামের আরেক সহযোগী হনুমানকে নিয়ে তিনি রচনা করেছেন হনুমান চরিত্র। বারানসীর গঙ্গাতীরে হনুমানজীর নামে একটি মন্দির স্থাপন করে তুলসী দাস সেখানেই বসবাস করছিলেন। বিশ্বসাহিত্যের বিস্ময় তুলসী দাস তার রামলীলা নামক কাব্যের জন্য ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের হৃদয়ে ইতোমধ্যেই দেবতা হিসেবে আসন লাভ করেছেন।

আমি যে সময়ের কথা বলছি অর্থাৎ ১৫৯১ সালে তুলসী দাসের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। হিন্দুরা যেহেতু পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে তাই তারা তুলসী দাসকে কলিযুগের বাল্মিকী বলত।

এর অবশ্য কারণও ছিল। হিন্দু পুরাণ মতে, দেবতা শিব তার স্ত্রী পার্বতীকে বলেন হনুমানের আশীর্বাদ পাওয়ার পরে বাল্মিকী একবার সংস্কৃত ভাষায় রামের কীর্তি বর্ণনা করবে। আবার এর বহুকাল পর কলিযুগে সে অন্য ভাষায় রাম কীর্তন বর্ণনা করবে। (ভবিষ্যতের পুরাণ, পতিস্বর্গ পর্ব ৪.২০)। এর বাইরে তুলসী দাসকে নিয়ে রয়েছে আরও নানা রকম কিংবদন্তি।

১৫৩২ সালে তিনি যখন রাজাপুরে জন্মগ্রহণ করলেন (বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের চিত্রাকুট জেলায় অবস্থিত) তখন সময়টা ছিল শ্রাবণের সপ্তমীর শুক্লপক্ষ (শ্রাবণ মাসের ৭ তারিখের অমাবস্যার রাত)। জন্মের পর দেখা গেল তার মুখে ৩২টি দাঁত রয়েছে এবং আকার-আকৃতিতে তাকে ৫-৬ বছরের শিশু বলে মনে হচ্ছিল। জন্মের সময় তার মা কোনো প্রসববেদনা অনুভব করলেন না এবং নবজাতক হিসেবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তুলসী দাস কোনো কান্না না করে কেবল রাম রাম ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকলেন। এ জন্য শৈশবকাল থেকেই তাকে 'রাম বোলা' বলা হতো।

হিন্দু অভিজাতরা কবি তুলসী দাসকে রাজি করিয়ে ফেললেন আমাদের হাভেলিতে তসরিক আনার ব্যাপারে।

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত আমাদের গ্রামটি আসলেই ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। অন্যদিকে খানেখানানের নাম এবং স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিক্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা শুনে তিনি কালবিলম্ব না করে রওনা দিলেন। বয়স ৯৪ বছর হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন বলবান যুবকের মতো হৃষ্টপুষ্ট এবং শক্তিশালী মানুষ। তার আগমন উপলক্ষে আমাদের হাভেলিতে রীতিমতো মেলা বসল। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক এসে পাশর্্ববর্তী পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু ফেলে বসবাস শুরু করল।

সুবেদার চাচা তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। অন্যদিকে গ্যারিসনের পশ্চিম দিকে বসল বিরাট এক মেলা। খানেখানান আবদুর রহিম যখন এলেন তখন কমপক্ষে এক লাখ লোক তাকে স্বগত জানাল যারা গত কয়েক দিন ধরে ওই অঞ্চলে তীর্থ যাত্রীর ন্যায় বসবাস করছিল কেবল তুলসী দাসের জন্য। লাখো লোকের কাছে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়ার পর খানেখানান যখন হাভেলির মধ্যে প্রবেশ করে মহাকবি তুলসী দাসের সাক্ষাৎ পেলেন তখন তার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি আমার আব্বাজানকে জড়িয়ে ধরে অনেকগুলো কৃতজ্ঞতা চুম্বন দিলেন।

এত বড় একজন মানুষের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আব্বাজান আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। তিনি শুরু করলেন কান্না। এ দৃশ্য দেখে আমি এবং আমার সহেলী জেবুনি্নসার প্রথমে খুব হাসি পেল। আমরা ফিক করে হেসে দিলাম। কিন্তু একটু পর আবার কেন জানি কান্না পেল।

আমরা দুজনে শুরু করলাম কান্না। আমাদের সেই কান্না দেখে খানেখানান এগিয়ে এলেন এবং দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। রাজপুরুষের সান্ত্বনা পেয়ে আমাদের কান্নার গতি আরও বেড়ে গেল।

মহাকবি তুলসী দাস এবং খানেখানানের পারস্পরিক সম্পর্ক দেখে আমরা বড়ই আশ্চর্য হলাম। দুজন একই কামরায় থাকতেন।

প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও তুলসী দাস খালি পায়ে থাকতেন। তিনি রোজ মাথা কামাতেন এবং সারা শরীরে এক ধরনের ঔষধি তেল মাখতেন। খাওয়া-দাওয়া করতেন খুবই কম এবং কথা বলতেন আরও কম। অন্যদিকে খানেখানানের ছিল মাথাভর্তি বাবরি চুল এবং মুখভর্তি অসম্ভব সুন্দর দাড়ি। কেবল বিশ্রামের সময় ব্যতিরেকে তিনি সব সময় তার রাজকীয় পাগড়ি পরে থাকতেন।

দুজন মহাপুরুষই আমাকে এবং জেবুনি্নসাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। আমাদের নানা রকম হাসির গল্প শোনাতেন এবং মাঝেমধ্যে খানেখানানের মাথার পাকা চুল গণনার দায়িত্ব দিতেন। আমি এবং আমার সহেলী খুবই আনন্দ ও নিষ্ঠার সঙ্গে তার মাথার পাকা চুল গণনার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে। পরপর খানজাদা আমাদের দুজনকে একটি করে আশরাফি দিতেন। আমাদের এ দৃশ্য দেখে কবি তুলসী দাস মুচকি মুচকি হাসতেন।

খানজাদার নির্দেশে আমরা কখনো-সখনো কবির হাত-পা এবং পিঠ টিপে দিতাম। আরামে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন এবং গড় গড় শব্দে নাক ডাকতেন। আমাদের তখন ভারি ইচ্ছে হতো তার টাক মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু খানজাদার ভয়ে আমরা ওই কাজটি করতে পারতাম না।

দুজন মহান অতিথির আগমনে আমাদের হাভেলিতে খুশির বন্যা বইছিল।

আমি আর জেবুনি্নসা ছিলাম অতিমাত্রায় খুশি। কারণ আমাদের তখন ওস্তাদজীর কাছে পড়তে যেতে হতো না। আমরা স্বাধীনভাবে পুরো হাভেলি, গ্যারিসন, মেলা এবং আগত দর্শনার্থীদের তাঁবুর কাছে দল বেঁধে ঘোরাফেরা করতাম। খানজাদার দেওয়া স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ইচ্ছা মতো মিঠাই মণ্ডা আর হরেক রকম খেলনা কিনতাম। হররোজ এ রকম সুযোগ পাওয়ার কারণে আমার বয়সী প্রায় ৫০-৬০ জন গ্রাম্য পাহাড়ি মেয়েদের সঙ্গে আমাদের পরম বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

ওইসব মেয়ের বেশির ভাগই ছিল দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তারা আসত মেলার পণ্যসামগ্রী এবং সাপ খেলাসহ নানা রকম তামাশা দেখার জন্য। আমাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আমরা যা কিছু কিনতাম তার সব কিছুই ওদের দিয়ে দিতাম। আমাদের কাছে প্রতিদিন খরচ করার জন্য দুটো স্বর্ণমুদ্রা থাকত, যা দিয়ে কয়েক মণ মিঠাই মণ্ডা কিনলেও কিছু অর্থ থেকে যেত। আমাদের ক্রয়কৃত মিঠাই মণ্ডা কিংবা শত শত খেলনা যখন ওদের দিতাম তখন খুশিতে তাদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

কবি তুলসী দাস এবং খানেখানানের বিদায়ের দিন যতই ঘনাতে লাগল ততই আমরা বিষাদগ্রস্ত হতে থাকলাম। এরই মধ্যে আমার আব্বাজান সুযোগ বুঝে তার মনের কথাটি খানজাদার কাছে উপস্থাপন করলেন। আমার কথা শুনে খানজাদা একবাক্যে কেবল সুপারিশ করতেই রাজি হলেন না বরং শাহেনশাহ এবং মালেকা-ই আলিয়া রুকাইয়া সুলতান বেগমকে রাজি করানোর দায়িত্বও নিলেন। আব্বাজান আম্মাহুজুরসহ আমাদের খান্দানের নেতারা যখন এ সুসংবাদ শুনলেন তখন আনন্দের আতিশয্যে গরিব প্রজাদের জন্য বিশেষ ভোজের আয়োজন করলেন। সবার আনন্দে আমিও আনন্দিত হলাম।

খানেখানান বিদায় নেওয়ার তিন মাসের মাথায় আমাদের হাভেলিতে সম্রাজ্ঞী রুকাইয়া সুলতান বেগমের প্রাসাদের অধ্যক্ষের কাছ থেকে পত্র এলো যে- মোগল হেরেমের সম্মানিতা বাসিন্দা হিসেবে সেখানে অবস্থান করে আঠারো বছর বয়স অবধি রাজসিক শিক্ষাগ্রহণ করার জন্য আমাকে সদাশয় সম্রাট অনুমতি প্রদান করেছেন। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে সম্মতিপত্র পেলে রাজকীয় বাহিনীর একটি চৌকস দল আমাকে যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে আমাদের হাভেলি থেকে রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে পেঁৗছে দেবে। চিঠি পাওয়ার পর আমাদের হাভেলিতে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করল। আব্বাজান খুশিতে অতিমাত্রায় উদার হয়ে উঠলেন। দুই হাতে অকাতরে দান-খয়রাত করতে লাগলেন।

আমার সহেলিও দারুণ খুশি হলো। জেবুনি্নসা অনেক আগেই মনোনয়ন পেয়েছে। কিন্তু তার ডাক এখনো আসেনি। তার আব্বা-আম্মাও এ নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাছাড়া তারা এখনো জানতে পারেনি কোন সম্রাজ্ঞীর প্রাসাদে জেবুনি্নসার ঠাঁই হবে।

অন্যদিকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমারটা হয়ে যাওয়া এবং সম্রাটের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীর প্রাসাদে ঠাঁই পাওয়ার খবরে তারা ওপরে ওপরে খুশি হলেও মনে মনে ঈর্ষা অনুভব করতে থাকল আর নিজেদের তকদিরের দোষ দিতে থাকল।

আমার দশ বছরের কিশোরী মনের অভিব্যক্তি বোঝানোর ভাষা আজ অবধি আমি রপ্ত করতে পারিনি। আমার বয়সী কয়েকটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারা আমাকে অনেক কিছু বলতে চাইত। কিন্তু আমার আম্মাহুজুর অতি সতর্কতার সঙ্গে আমাকে ওইসব মেয়ে থেকে আলাদা করে রাখত।

ফলে অতি অল্প বয়সে অনেক মেয়ে যেমন অনাগত দিনের যৌবনদীপ্ত কাণ্ড-কারখানা নিয়ে পাকনামোমূলক সব জ্ঞান অর্জন করে_ আমি ছিলাম তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আম্মাজান, চাচাজান, মামাজান, কিংবা ভাইজানদের বাইরে অন্য পুরুষ বা কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে প্রেমময় সম্পর্কের কথা এখনো পর্যন্ত আমার মাথায় আসেনি। মোগল হেরেমে ঢোকার দুর্লভ এবং অতি সম্মানজনক আমন্ত্রণ পাওয়ার পর আমার মানসপটে কেবল ভেসে উঠত বড় বড় প্রাসাদ, হাজার হাজার সৈন্যের কুচকাওয়াজ, রাজকুমারীদের কলকাকলী এবং একজন অজানা রাজকুমারের ঘোড়ার খুরের শব্দ। পরিবারের লোকজনের উৎসাহ এবং নানা উদ্দীপনামূলক বক্তব্যের কারণে আমি নিজেকে পরম সৌভাগ্যবতী ভাবতে আরম্ভ করলাম। এরই মধ্যে আমাদের পরিবারের সম্মতিপত্র পাওয়ার পর আগ্রার ফতেপুর সিক্রির রাজদরবারের একদল সৈন্য এলো আমাকে সম্মানের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

হাতি, ঘোড়া এবং পালকির ব্যবস্থা ছিল আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাত্রাপথে আমি যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব সেভাবেই রক্ষী দল সব কিছুর ব্যবস্থা করবে বলে আমাকে আশ্বস্ত করা হলো।

একদিন সকালবেলা আমি রওনা করলাম আগ্রার উদ্দেশে। আমার সমবয়সী শত শত পাহাড়ি বালিকারা আমাকে বিদায় জানাতে এলো। জেবুনি্নসা এবং তার বাবা-মা এলেন।

সবাই অশ্রুসজল নেত্রে আমাকে বিদায় দিল। এ অনুষ্ঠানে আমার জন্য সবাই কাঁদলেও কেন জানি আমার কারও জন্য কান্না পাচ্ছিল না। ইতিপূর্বে অনেক তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কারণে-অকারণে আমি কেঁদেকেটে একাকার করেছি। তাছাড়া কান্না করতে আমার ভালোই লাগত। অনেকক্ষণ কাঁদলে মনটা হালকা হয়ে যায় আর সঙ্গে উপরি হিসেবে অনেকের সহানুভূতিও পাওয়া যায়।

এ জন্য কান্নার সুযোগ পেলেই আমি কাঁদতাম। আর মাঝেমধ্যে উপযাচক হয়ে কান্নার উসিলা খুঁজে ফিরতাম। আশপাশের কোনো বাড়িতে কেউ মারা গেলে বা অসুস্থ হলে আমি সেখানে যেতাম এবং সেই পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সুর করে কাঁদতাম। আমাদের হাভেলির আশপাশের কয়েকটি বস্তিতে কয়েকজন দরিদ্র পরিবার বাস করে। তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এসব বস্তিতে বসবাস করত।

তাদের ভাষাও ছিল আলাদা। আবার তারা কান্নাও করত হরেক রকম সুরে। এসব সুরের মধ্যে রাজস্থানি এবং পারস্য দেশীয় কান্নার সুর আমার ভালো লাগত। এ জন্য আমি সময় পেলেই কখনো রাজস্থানি ঢঙে আবার কখনো পারস্য দেশীয় ঢঙে কাঁদতাম। আমার আম্মাহুজুর এসব কান্নার সুর শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন।

তিনি ওই দুটি সুরের একটিও শুনতে পারতেন না- কখনো-সখনো বিরক্তিতে লাফালাফি শুরু করতেন। আমি সুরের ছন্দ বাড়িয়ে দিতাম। আম্মাহুজুর ওই মহাবিরক্তিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তাড়াতাড়ি আমার দাবি মেনে নিতেন।

একটি কাঁদুনে মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও আমার কেন যে সেদিন কান্না এলো না তা আমি আজও ভেবে পাই না। তবে আমি কেঁদেছিলাম এবং কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা গিয়েছিলাম।

কিন্তু সেটা ছিল ভিন্ন কারণে। আমার তিন জোড়া সাদা রঙের কবুতর এবং এক জোড়া টিয়া পাখি ছিল। পাখিগুলো আমি প্রায়ই খোলা আকাশে ছেড়ে দিতাম এবং আবার ডাক দিলেই তারা উড়ে এসে আমার মাথার ওপর বসত। কেউ কেউ বসত কাঁধে বা হাতের ওপর। আমার বিদায়ের সময় হঠাৎ তাদের কথা মনে পড়ল।

আমি পাখিগুলোর খাঁচার কাছে গিয়ে সেগুলোকে চিরদিনের জন্য মুক্ত করার উদ্দেশে দরজা খুলে দিলাম। অন্যান্য দিন খাঁচার দরজা খোলামাত্র তারা ফুড়ুত করে উড়ে যেত এবং নিকটস্থ গাছের ডালে গিয়ে বসত। এরপর ডাকলে কাছে আসত। কিন্তু ঘটনার দিন তারা হেলেদুলে বের হলো। কোনো শব্দ করল না এবং উড়ে গাছের ডালে না গিয়ে সরাসরি আমার কাঁধের ওপর বসল।

কয়েকটি কবুতর পায়ের কাছে বসে পড়ল। করুণ সুরে তারা ডাকতে লাগল। এক সময় আমার মুখমণ্ডল ও পায়ে তাদের মাথা ঘষতে লাগল। আমার বুঝতে কোনোই অসুবিধা হলো না যে, পাখিগুলো তাদের মালিকের বিদায়ের ঘটনা জানতে পেরেছে। পাখিদের কান্না শুনে আমারও ভীষণ কান্না পেল।

কাঁদতে কাঁদতে আমার বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। এবার আমার মনে হলো_ স্বজনদের ছেড়ে দূরে যাওয়ার বেদনায় আমি ভারাক্রান্ত হয়ে গুমরে মরছিলাম অনেকক্ষণ ধরেই। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে কাঁদতে পারিনি। পাখিদের স্পর্শে সেই জমাটবাঁধা পুঞ্জীভূত কান্নায় জোয়ার এসেছে। কাঁদতে কাঁদতে আমি সংজ্ঞা হারালাম।

ফলে সেদিন আর যাত্রা হলো না। পরের দিন খুব ভোরে যাত্রা শুরু করলাম নতুন গন্তব্যে। যাত্রাপথে আমাদের কাফেলা বহু জায়গিরদার, সুবেদার এবং নগর কোতোয়ালের হাভেলি অতিক্রম করল, আমরা যেখানেই যাত্রাবিরতি করলাম সেখানকার সরকারি মহল থেকে যারপরনাই যত্ন-আত্দি এবং সম্মান পেলাম। অনেকে আবার আমাকে আকর্ষণীয়

উপঢৌকন প্রদান করল। [চলবে]

 

 




এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.