আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষ চেষ্টায় কূটনীতিকরা

৫ জানুয়ারি ভোটের পর নতুন সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করছেন ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকরা। তাদের এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের পক্ষ থেকে অবস্থান ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এর আগে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতের অমিলের কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থা কাটাতে শেষ চেষ্টায় নেমেছেন প্রভাবশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মোজেনা ও যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন ফের নতুন করে দূতিয়ালি শুরু করেছেন দুই পক্ষের সঙ্গে। তারা এ সপ্তাহে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পৃথক বৈঠকের পর দুই দিন ধরে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছেন।

গতকালও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন মোজেনা। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভিন্নভাবে এ চেষ্টা চালাচ্ছে। জাপান ও চীনের দূতাবাসের পক্ষ থেকেও বার্তা দেওয়া হয়েছে। কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে সরকারকে অভিন্ন বার্তা দিয়ে বলা হয়েছে, 'এখন সমাধানে পেঁৗছাতে না পারলে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়গুলো সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থমকে যেতে পারে। তাই ভিন্ন কোনো উপায়ে হলেও ঐকমত্যে পেঁৗছাতে হবে।

' অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হবে। এরপর নতুনভাবে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ শুরু করা হবে। অন্যদিকে, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কূটনৈতিক সূত্রগুলোর তথ্যানুসারে, জাতিসংঘ দূত তারানকোর সফরে প্রভাবশালী সব দেশেরই সমর্থন ছিল। কিন্তু এ মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর সমঝোতার নানান চেষ্টা চালানো ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকরা সাময়িক হতাশায় ডুবে যান।

এ সময় আসে বড়দিনের ছুটি। তারা ছুটি কাটাতে ঢাকার বাইরে যান। স্বল্পসময়ের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফেরার পর তখন নির্বাচনের আর বাকি মাত্র সাত দিন। ঢাকায় ফিরেই তারা দেখেন পরিস্থিতি আরও অনিশ্চয়তার দিকে গেছে। বেগম খালেদা জিয়াকে অঘোষিত গৃহবন্দী রাখা হয়েছে।

ঢাকা আসার এক ঘণ্টার মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছার কথা সরকারকে জানান ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক জানান, মূলত দুই কারণে ছিল এ সাক্ষাৎ। এক. খালেদা জিয়া আসলেই গৃহবন্দী কি না তা পরখ করে দেখা। দুই. পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না তা সরাসরি খালেদা জিয়ার কাছ থেকে জানা। সোমবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পর মঙ্গলবার তিনি বৈঠক করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে।

সেখানেও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। সূত্র জানায়, সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে বৈঠকে গিবসন অচলাবস্থা কাটাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। জবাবে সৈয়দ আশরাফ বলেন, '৫ জানুয়ারির নির্বাচন হতে দিন। এরপর বিএনপির সঙ্গে আরেকটি সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে। ' এ সময় ব্রিটিশ হাইকমিশনার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকালীন পরিবেশ বর্ণনা করে বলেন, 'তার (খালেদা) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমার মনে হয়েছে তিনি একপ্রকার গৃহবন্দী।

' প্রত্যুত্তরে সৈয়দ আশরাফ বলেন, 'বিএনপি চেয়ারপারসন জনগণকে লাগাতার অবরোধের মাধ্যমে বন্দী করে রেখেছেন। ' ব্রিটিশ হাইকমিশন সূত্র জানায়, দুই দলের মনোভাব সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত থাকা রবার্ট গিবসন মূলত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে সংলাপের শেষ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নূ্যনতম সৌজন্য না দেখিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ শেষেই বিএনপির কূটনৈতিক যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা নেতাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আটক করেন, যা তাকে বেশ ব্যথিত ও বিস্মিত করেছে।

অন্যদিকে, সোমবার ছুটি শেষে কাজে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মোজেনা পর দিন গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। আগের দিন রাতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও সাবেক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সঙ্গে আলোচনা করেন।

সূত্র মতে, বেগম জিয়ার সঙ্গে সংকট সমাধানের ভিন্ন কোনো পদ্ধতি আছে কি না তা নিয়ে আলোচনা করেন মোজেনা। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন স্পষ্টই জানিয়ে দেন এর সমাধান হতে পারে শুধু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করে নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা। মোজেনা গতকাল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিনের সঙ্গে বৈঠকে তাকে সোমবার আটক ও হয়রানির ঘটনায় সমবেদনা জানান। এদিকে, গতকাল স্থানীয় একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক প্রসঙ্গে ড্যান মোজেনার নিজের লেখা মতামত ছাপা হয়েছে। এতে তিনি বাংলাদেশের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করে বলেছেন, বর্তমান অচলাবস্থার অবসান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে, ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতার জন্য যে কোনো ধরনের মধ্যস্থতার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু এত দিনের এ সমঝোতা না হওয়ায় হতাশার কথাও জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র।

অন্যদিকে, ঢাকার কূটনীতিতে অন্যতম ভূমিকায় থাকা প্রতিবেশী নয়া দিলি্ল সরকারের পক্ষ থেকেও অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সে আলোচনা হচ্ছে নয়া দিলি্ল-ওয়াশিংটনের মধ্যে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ সে দেশের গণমাধ্যম 'দ্য হিন্দু'-কে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ইস্যুতে মতভিন্নতা কাটাতে আগ্রহের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে ভারত।

ঢাকার সংকট উত্তরণে নয়া দিলি্ল ওয়াশিংটনকে পাশে চাইছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে সালমান খুরশিদ এটাও বলেছেন, পাশের দেশ হিসেবে ভারতের ভাবনাকে প্রাধান্য দিলে যুক্তরাষ্ট্রেরই লাভ হবে।

বড়দিনের ছুটি কাটিয়ে ঢাকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের প্রধান উইলিয়াম হানার গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় ফেরার কথা। উইলিয়াম হানা ঢাকায় ফিরলে ইউরোপের কূটনীতিকরা যাবেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এদিকে, গতকাল সকালে ইউরোপের দেশগুলোর কূটনীতিকরা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন।

এর আগে সোমবার একই ধরনের বৈঠক করেন তারা। বৈঠক শেষে সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর কাছে ইউরোপের কূটনীতিকরা বলেন, ক্ষমতাসীন হিসেবে আওয়ামী লীগকেই অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। জানা গেছে, উপদেষ্টা গওহর রিজভীর মাধ্যমে সরকারের কাছে নিয়মিত বার্তা পাঠাচ্ছেন ইইউ কূটনীতিকরা।

অসমর্থিত সূত্রের খবর, জাতীয় সরকারের বিষয়ে একটি প্রস্তাব ঢাকার কূটনীতিকরা আলোচনায় তুলেছেন। এতে বাংলাদেশের সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নাইট উপাধিতে ভূষিত একজন বাংলাদেশি ব্যক্তিত্বকে প্রধান করে একটি সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি রাজনীতিকরাও থাকবেন।

কিন্তু এ প্রস্তাব নিয়ে আগ্রহও দেখাচ্ছে না কোনো পক্ষই।

ইইউর ঢাকা অফিস সূত্র জানায়, ইইউর আট কূটনীতিক ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছেন। এ প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়গুলোয় সম্পর্ক কী হবে। যেমন গত মাসের মাঝামাঝি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর মতামতসংবলিত প্রতিবেদন তৈরি করে ইইউ সদস্য দেশগুলোর পাঠানো হয়েছিল। ঢাকার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই তখন ব্রাসেলস থেকে ইইউ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয়।

এরপর নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে একে একে না করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথ, রাশিয়া। আগ্রহ হারায় অন্যরাও। প্রক্রিয়াধীন প্রতিবেদনে কী থাকছে- জানতে চাইলে ইইউর এক কূটনীতিক বলেন, এটি এখনই বলা কঠিন। তবে এ অচলাবস্থা না কাটলে ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের যোগ্য বলে ইইউ মনে করছে না, স্বাভাবিকভাবেই সে নির্বাচন জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

সে বিবেচনায় এ ধরনের নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা আগের অবস্থানের বিপরীতমুখী হবে। জানা যায়, প্রায় একই ধরনের প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও চীনের দূতাবাস। অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, তিন মাস ধরেই ঋণ, সহায়তা, শিল্প, বাণিজ্য বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় সফর বন্ধ থাকায় নতুন কোনো চুক্তি বা প্রকল্প অনুমোদন সম্ভব হয়নি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকার সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোর পক্ষ থেকে ডিসেম্বরেই আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলো স্থগিত করার মৌখিক অনুরোধ জানানো হয়েছে।

 

 



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।