আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নটে গাছটি মুড়োলঃ পণ্ডিতের বিপদ

উইলিয়াম ম্যাকালক সম্পাদিত ১৯১২ সালে প্রকাশিত Bengali Household Tales অবলম্বনে আজকের গপ্পো পণ্ডিতের বিপদ।
…........................................................................
এক গাঁয়ে থাকত এক পণ্ডিত, সে ছিল বেজায় বুদ্ধু। তবে সারা গাঁয়ে সে এমন ভাব নিয়ে চলত যে সকলেই সেখানে মনে করত নাহ এই লোক কিছু জানে। গ্রামের লোক ছিল মূলত জেলে সম্প্রদায়ের লোক, পণ্ডিত ছিল তাদের গুরু। জেলেদের যখনই জানার দরকার ছিল যে সেইদিন চান্দ্রমাসের কয় তারিখ বা সপ্তাহের কোন দিন, তারা পণ্ডিতের কাছে যেত জানতে।

গাড়ল পণ্ডিত কি আর এত হিসাব জানে, সে করত কি পূর্ণচন্দ্রের পরদিন সকাল থেকে প্রতিদিন ভোরে ঘরের চিপায় একটা করে নুড়ি রাখত। এরকম পূর্ণচন্দ্র থেকে নতুন চাঁদ পর্যন্ত তার পনেরোটা নুড়ি হত। নতুন চাঁদ থেকে পূর্ণচন্দ্রও সে ঠিক একই কাজ করত। এভাবে কেউ তারিখ জানতে চাইলে ঘরে ঢুকে নুড়ি গুণে পণ্ডিত বলে দিত কয় তারিখ।
ভালই যাচ্ছিল দিন এরকম।

তবে এক সকালে হল কি, পাশের বাড়ির দুই বিড়াল ক্যাঁওম্যাঁও করে মারামারি করতে করতে পণ্ডিতের ঘরে ঢুকে সব নুড়ি এলোমেলো করে দিল। পণ্ডিত ঘরে এসে দেখে সাড়ে সব্বোনাশ, সব নুড়ি একবারে ঘোঁট পাকিয়ে আছে, বুঝার উপায় নাই কিচ্ছু। আর এমনই কপাল, তখন দুই জেলে এসে বলল ও বামুনঠাকুর, আজ কি বার কও দিকিনি।
পণ্ডিতের তো চক্ষুস্থির, কি বার তা কি করে কই? সে একটু মাথা চুল্কে নিল, তারপর বাইরে বের হয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, হে জনগণ, আজ ঘোঁটমঙ্গল দিবস।
ঘোঁটমঙ্গল দিবস? এ আবার কি, এ নাম তো কখনো শুনিনি।

জেলেরা ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
মৃদু হেসে পণ্ডিত বলল, হ্যাঁ অতি অল্প লোকেই তার কথা জানে বটে। বস্তুত বহু পণ্ডিত লোকেও এর খবর রাখে না। তাই বলে তো ঘোঁটমঙ্গল দিবস নাই হয়ে যায়না তাই না?
অবিশ্যি অবিশ্যি, ঘাড় নেড়ে জেলেরা বলল, ঘোঁটমঙ্গল নাই হয়ে যাবে তা হয় নাকি! আচ্ছা ঠাকুর এই ঘোঁটমঙ্গল দিবসের কিরকম বিধান?
হ্যাঁ ঘোঁটমঙ্গল বড় সহজ দিবস নয়। বিরাট মণ্ডপে পূজা দিতে হবে, তাতে লাগবে আটানব্বই সের ঘি আর আটচল্লিশ সের আতপ চাল।

। পূজার ঠাকুরকে দিতে হবে দুইটা লাল গাই, ছয় জোড়া ধুতি আর সুগন্ধী কাঠের খড়ম। তারপরে হতে হবে ব্রাহ্মণভোজন, কমপক্ষে বাহাত্তরজন তো লাগবেই। ঘোঁটমঙ্গল দেবীর বাসনা এই দিনে বিরাট মেলার আয়োজন করা চাই বটতলায়।
আচ্ছা আচ্ছা।

ঘোঁটমঙ্গল দেবী কিরকম?
হ্যাঁ ঘোঁটমঙ্গল দেবী। আহা। ভক্তের কাছে উনি ধরা দেন বিড়ালের রূপে। গাঁয়ের প্রত্যেকের ঘরে দুইটা মাটির বিড়ালরূপী মূর্তিপূজার আয়োজন কর।
জেলেরা নাচতে নাচতে ঘরে ফিরে গিয়ে ঘোঁটমঙ্গল দিবসের আয়োজন শুরু করল।

দেখতে দেখতে সারা গাঁয়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল ঘোঁটমঙ্গল দিবসের কথা। বটতলায় বসল তুমুল মেলা। ঢ্যাঙ্কুচুকুর ঢ্যাঙ্কুচুকুর ঢাকের বাড়িতে কান পাতা দায় হল বটতলার মাঠে। দূর দূর থেকে লোকে ছুটে এসে বিরাট গীতবাদ্য বসিয়ে দিল। গাঁয়ের লোকের মুখে হাসি আর ধরে না, ঘোঁটমঙ্গল দিবস বলে কথা।


এই সময় গাঁয়ের পথে পাল্কিতে যাচ্ছিলেন এক রাজার সভাপণ্ডিত। হাউকাউ দেখে পাল্কি থামিয়ে তিনি শুধালেন ওহে জনতা, কি ঘটনা হে? এক গ্রামবাসী অবজ্ঞাভরে বলল, আহা তাও জানোনা বুঝি। আজ ঘোঁটমঙ্গল দিবসের মেলা।
ঘোঁটমঙ্গল দিবসের মেলা? জন্মেও শুনিনি বাপু।
হ্যাঁ মস্ত পণ্ডিতেরাই এর কথা জানেন শুধু।

যেমন আমাদের গাঁয়ের পুরুতঠাকুর। তার কোন কিছুই অজানা নেইকো। বিড়ালরূপী ঘোঁটমঙ্গল দেবী স্বয়ং তাকে দর্শন দিয়েছিলেন সদ্য।
বিড়ালরূপী ঘোঁটমঙ্গল দেবী? বল কি হে? সাতান্ন বছর শাস্ত্র অধ্যয়ন করলাম এই বিড়ালরূপী দেবীর কথা তো কোত্থাও পেলাম না। যাও হে তোমাদের পুরুতকে খবর দিয়ে নিয়ে এস।

তার সাথে আমার দুইচার বিষয়ে তর্ক করার বাসনা।
গাঁয়ের লোকে গিয়ে ব্রাহ্মণকে খবর দিল যে এক টিকিওলা পণ্ডিত তাকে তর্কে আহ্বান করছে ঘোঁটমঙ্গল দেবীকে নিয়ে। পণ্ডিত মনে মনে ভাবল ধুরো, এ কি নূতন বিপদ বাবা। সে গম্ভীর হয়ে বলল, সে ডাকলেই আমায় যেতে হবে নাকি? তার দরকার সে নিজেই আসুক আমার ঘরে।
গাঁয়ের লোক গিয়ে রাজার পণ্ডিতকে বলল উঁহু এইখানে নয়, চল আমাদের পুরুত ঠাকুরের ঘর।

সেইখানে মজমা বসবে। মৃদু হেসে পণ্ডিত বললেন আচ্ছা ঠিক আছে। এক কাজ করি বরং, মাঝামাঝি কোথাও বসি। তিনিও কিছুদূর আসুন আমিও কিছুদূর যাই।
মাথা নেড়ে গাঁয়ের লোক ভাবল নাহ এ বেশ ন্যায্য প্রস্তাব।

তারা গিয়ে পুরুতকে তাই বলল। তখন পুরুত বলল সে আসবে কিভাবে? সকলে উত্তর দিল পণ্ডিত আসছে পাল্কিতে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সে বলল বটে, সে আসবে পাল্কিতে আর আমি যাব পায়দল? কক্ষনো নয়।
গাঁয়ের লোক ভাবল তাই তো। এ তো বড় অন্যায্য বিচার।

তারা গিয়ে পণ্ডিতকে একথা বলতেই তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন তা পাল্কি নেই তো তোমরা তাকে ঘাড়ে করে নিয়ে আসতে পারো না? তাহলেই তো গোল মিটে যায়।
এইবার গাঁয়ের ঠাকুর পড়ল বিষম গোলে। গেলেও ইজ্জত যাবে না গেলেও রক্ষা নাই। মহাযন্ত্রনা। বিরস মুখে তিনি যাবার আয়োজন করতে লাগলেন।

কপালে চন্দনের তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। দুই মুশকো জোয়ানের ঘাড়ে চড়ে তিনি চললেন মাঠের দিকে।
কাছাকাছি আসতেই রাজার পণ্ডিত উঠে দাঁড়ালেন, আর মৃদু হেসে সংস্কৃতে বললেন আগচ্ছ আগচ্ছ, অর্থাৎ কিনা আসতে আজ্ঞা হোক। গাঁয়ের পণ্ডিত কি আর সংস্কৃত বোঝে, সে মুখ বিকৃত করে তেড়ে গিয়ে বলল তুই আগচ্ছ ব্যাটা কাউয়ার বাচ্চা।
এই শুনে রাজার পণ্ডিত ভারি থতমত খেয়ে গেলেন।

হাত তুলে তিনি সংস্কৃতে বললেন তিষ্ঠ, তিষ্ঠ। অর্থাৎ খাড়াও খাড়াও। শুনে গাঁয়ের পণ্ডিত বলল তুই তিষ্ঠ। তোর বাপ ছিল তিষ্ঠ। তোর গুষ্টিসুদ্ধ সবগুলি একেকটা তিষ্ঠ।

বুঝছিস?
রাজার পণ্ডিতের তো কথা আটকে গেল। একি যন্ত্রণা বাপু। তিনি আবার হাত তুলে বললেন, স্থির ভাব, স্থির ভাব। অর্থাৎ কিনা শান্ত হউন। গাঁয়ের পণ্ডিত আবার তেড়ে গিয়ে বলল তুই আরো বড় স্থির ভাব ব্যাটা ভাম কোথাকার।

ভাগ এখান থেকে।
গাঁয়ের লোক এরকম দেখে ভাবল তর্কে তাদের পণ্ডিতই জয়ী হয়েছেন, রাজার পণ্ডিতের তো মুখে কথাই নাই! তারা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল পণ্ডিতজি কি জয়! হরি হরি! পণ্ডিতজি কি জয়!
রাজার পণ্ডিত মনে মনে ভাবলেন এ তো বড় আবালের কারখানায় এসে পড়া গেল। এদের বুঝানো আমার কম্ম নয়। যাই বলি এরা বুঝবেই না ছাতা কিছু। যাকগে, করুক এরা বিড়ালের পূজা।

আমার কি। তবে এই পণ্ডিতটিকে একটা শিক্ষা না দিলে চলছে না।
তিনি করলেন কি, মাটি থেকে গাঁয়ের পণ্ডিতের মুখ থেকে খসে পড়া একটা দাড়ির চুল সাবধানে তুলে হাতে নিলেন আর পাল্কির দিকে হাঁটা ধরলেন। সকলে তো অবাক, পণ্ডিত তাদের ঠাকুরের দাড়ি নিল কেন? তারা দৌড়ে গিয়ে শুধাল ওহে পণ্ডিত, দাড়ি কিরকম?
পণ্ডিত হেসে বলল, তাও জানোনা বুঝি? তোমাদের পুরুত সত্যই মহাপণ্ডিত, তবে গূঢ় তত্ত্ব হল তার সকল পাণ্ডিত্য আসলে দাড়িতে। কেউ যদি তার দাড়ির অধিকারী হয় তবে সে ঠিক ঠাকুরের মতই মহাপণ্ডিত হবে।

তাই আমি নিলাম একখানা।
এই কথা শুনে সকলে ছুটে গিয়ে পুরুতকে ধরল। দাড়ি চাই দিতে হবে। পুরুতঠাকুর ভারি বিরক্ত হয়ে বললেন ধুরো যা সর, দাড়ির মধ্যে বুদ্ধি আবার কার কবে থাকে? ভাগ সব।
কে শোনে কার কথা।

আপসে দাড়ি না পেয়ে জনতা ঠাকুরকে পেড়ে ফেলে পটাপট দাড়ি উপড়ে নিতে শুরু করল, আর পণ্ডিত তো চিৎকার করে অস্থির বাপরে মারে ছেড়ে দেরে ওরে নারে একিরে গেলরে। এমন সময় আবার দূর থেকে রাজার পণ্ডিতের গলা শোনা গেল। তিনি বললেন, হে জনতা। তোমাদের কি বলেছি যে পণ্ডিতের গোঁফের ভেতর দাড়ির তিন ডবল বুদ্ধি পোরা আছে? যারা দাড়ি পাওনি তারা গোঁফ চেষ্টা করে দেখতে পারো।
জনতার তুমুল উল্লাসে ঢাকা পড়ে গেল গাঁয়ের ব্রাহ্মণের আর্তনাদ।

আর দাঁত বের করে হেসে সেই সুমধুর শব্দ শুনতে শুনতে রাজার পণ্ডিত তার পথ ধরলেন।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।