আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের রমা, কলকাতার সুচিত্রা

সুচিত্রা সেন। বাংলা চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি। মহানায়িকা নামেও ডাকা হয় তাকে। সুচিত্রা বর্তমানে বেলভিউ হাসপাতালের ৬-বি নাম্বার কেবিনে চিকিৎসাধীন আছেন। সেখান থেকে কখনো ভেসে আসে সুস্থতার খবর, কখনো অবনতির খবর।

এদিকে ভক্তদের হৃদয়ে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে চিন্তার রেখা। কলকাতার মানুষ তাকে নিয়ে যেমন চিন্তিত, তার থেকে কোনো অংশে কম চিন্তিত নয় বাংলাদেশের মানুষ। কারণ তিনি কলকাতার সুচিত্রা, কিন্তু আমাদের রমা। এ মহানায়িকা আড়ালে থাক, তবুও ভালো থাকুক- এ প্রত্যাশাই সবার। তার শুভকামনায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ বিভাগের এই ক্ষুদ্র আয়োজন।

 

উত্তম কুমারকে বলা হয় মহানায়ক। সেই সূত্রে অবশ্যই মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। উত্তম-সুচিত্রা জুটি মিলেই তো মহাকাব্য রচিত হয়েছে।

উত্তম কুমার নেই। সুচিত্রা এখনো আছেন।

নিজেকে আড়ালে রেখে তিনি এখনো আমাদের কাছে রয়ে গেছেন সেই চিরচেনা রূপেই। আমাদের কাছে সুচিত্রার বার্ধক্য নেই, চামড়ায় বলিরেখা নেই, চুলে সাদা রঙ নেই। আর তাই আমরা সুচিত্রার অসুস্থতা শুনে ঘাবড়ে যাই, কিন্তু মৃত্যু কামনা করি না।

সুচিত্রা সেন এখন অসুস্থ। সবার চোখে কলকাতার মানুষের অস্থিরতা বেশি ধরা পড়ছে।

কিন্তু কোনো অংশেই কি অস্থিরতা কম বাংলাদেশের মানুষের মনে?

না। আমরাও অস্থির। আমাদের রমাই তো এই সুচিত্রা সেন। তিনি কলকাতার নায়িকা হতে পারেন, বাংলাদেশের মেয়ে তো! আমাদের আবহাওয়াতেই তার বেড়ে ওঠা। বাংলাদেশের আলোতে তিনি জীবনে প্রথম চোখ মেলেছেন, বাংলাদেশের বাতাস থেকে তিনি প্রথম অঙ্েিজন নিয়েছেন, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শিখেছেন।

শুধু সুচিত্রার শৈশব নয়, তার কৈশোরের গোল্লাছুট আর দুরন্তপনাও বাংলাদেশে। জীবনের প্রথম ষোলটি বছর তার কেটেছে এই দেশে। তাই বলা যায়, সুচিত্রার জীবনের সবচেয়ে মধুর সময়টাই তিনি বাংলাদেশে কাটিয়েছেন। শুধু বাপের বাড়িই নয়, তার শ্বশুরবাড়িও বাংলাদেশে। ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়।

তাই দুই কুল থেকে সুচিত্রা আমাদেরও।

৬ এপ্রিল, ১৯৩১ সাল। পাবনার এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের অন্দরমহল থেকে ছড়িয়ে পড়ল এক নবজাতকের চিৎকার। বাড়ির কর্তা করুণাময় দাশগুপ্ত মেয়ের মুখ দেখে খুশি। এলাকায় মিষ্টি বিলিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনি কন্যা-সন্তানের পিতা হয়েছেন।

করুণাময় দাশগুপ্ত নিজের স্ত্রী ইন্দিরা দাশগুপ্তের সঙ্গে আলাপ করে মেয়ের নাম রাখলেন রমা দাশগুপ্ত। এ রমাই আজকের সুচিত্রা। তিনি ছিলেন সংসারের পঞ্চম সন্তান এবং তৃতীয় কন্যা। রমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের বাড়িতে। রমার বাবা ছিলেন এলাকার প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

তাই পড়াশোনায় ছিল বেশ কড়াকড়ি ভাব। পাবনার মহাখালি পাঠশালায় পড়াশোনা শুরু করেন রমা। প্রাইমারি পাঠ চুকিয়ে তিনি ভর্তি হন পাবনা গার্লস স্কুলে। এখানে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেন রমা। তারপর?

তারপর ট্র্যাজেডি।

দেশ ভাগের সময় নিজের আবাস ছেড়ে রমাদের চলে যেত হলো কলকাতায়। শুরু হয় রমাদের নতুন জীবন, নতুন সংগ্রাম। সংগ্রামের স্রোতে রমাও গা ভাসিয়েছিলেন। আর এভাবেই তিনি পেয়ে যান নিজের গন্তব্য। হয়ে যান সুচিত্রা সেন।

পাবনায় সুচিত্রাদের বাড়িটি এখনো রয়েছে। পাবনা সরকারি বাণিজ্য মহাবিদ্যালয়ের বিপরীতে বাড়িটি সুচিত্রা সেনের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধুঁকে ধুঁকে ক্ষয়েও যাচ্ছে। আমরা গুণীর মর্যাদা দিতে জানি না। জানি না গুণীর স্মৃতি সংরক্ষণ করতেও।

তাই বাড়িটি ধুঁকে ধুঁকে ক্ষয়ে যাচ্ছে।

সুচিত্রার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি পিঠ নিয়ে আলোচনা হলো এতক্ষণ। অন্য পিঠও আছে।

কলকাতায় গিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন সুচিত্রা। ১৯৪৭ সালে তিনি সাতপাকে জড়ান দিবানাথ সেনের সঙ্গে।

শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা আগেই বলা হয়েছে। ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। আরও পরিষ্কার করলে ঠিকানাটা দাঁড়ায়, গেণ্ডারিয়ায় একটি সড়ক আছে দীননাথ সেন রোড নামে। এ দীননাথ সেন সুচিত্রার দাদাশ্বশুর। ওই সড়কেই বাড়ি ছিল।

এ সড়কেই একটি মিষ্টি দোকান ছিল। সোনা মিয়ার রসগোল্লা নামে। সুচিত্রার খুব প্রিয় ছিল সোনা মিয়ার হাতে তৈরি রসগোল্লা। এতই প্রিয় ছিল যে সোনা মিয়াকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেখা হয়নি।

দেশ ভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অতিষ্ঠ হয়ে সুচিত্রার শ্বশুরবাড়ির মানুষও কলকাতায় চলে যান। অথচ তারা ছিলেন গেণ্ডারিয়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং অভিজাত।

কলতার বালিগঞ্জে গিয়ে আবাস গড়েন দীননাথের ছেলে আদিনাথ সেন। জমিদারি এস্টেটও কিনেছিলেন তিনি। আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেন বিলেত থেকে পড়াশোনা করে এসেছিলেন।

চলনে-বলনে সাহেবি ভাব। এ ছেলের জন্য আদিনাথ সেন পাত্রি খুঁজছিলেন। এ সময় তার চোখে পড়ে পাবনা থেকে সদ্য কলকাতায় যাওয়া মেয়ে রমা দাশগুপ্তকে। দেখেই মুগ্ধ তিনি। এমন অনন্য সুন্দরীকেই তো তিনি মনে মনে ছেলের জন্য খোঁজ করছিলেন।

রমার বাবাকে জানানো হলে আর অমত করেননি। এমন বড় ঘর, অমতের কোনো কারণও ছিল না। তাই ১৯৪৭ সালে মাত্র এক দিনের সিদ্ধান্তে রমার বিয়ে হয়ে যায় দিবানাথ সেনের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়ি থেকেই তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় 'সেন' উপাধি। রমা দাশগুপ্ত হয়ে যান রমা সেন।

শ্বশুরবাড়ির বারান্দা থেকেই রমা অভিনয়ে আসেন। তার শ্বশুরই ব্যবস্থা করে দেন। কারণ ওই সময়ে নামকরা নির্মাতা বিমল রায় ছিলেন রমার মামাশ্বশুর। বিমল রায় রমা সেনকে সুচিত্রা সেন হিসেবে গড়ে তোলেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ব্যবস্থা করে দেন।

প্রথমে অন্যদের ছবিতে অভিনয় করেন। এরপর বিমল রায় সুচিত্রা সেনকে হিন্দি 'দেবদাস' ছবিতে দীলিপ কুমারের বিপরীতে অভিনয় করান। পার্বতী চরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয়ে বিমোহিত হয় দর্শক। আর থেমে থাকতে হয়নি সুচিত্রাকে।

অভিনয়ে শ্বশুরের পাশাপাশি সুচিত্রাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন স্বামী দিবানাথ সেন।

কিন্তু স্বামীর সঙ্গে আর টিকেনি সম্পর্ক। ১৬ বছর সংসার করে তারা ইতি টানেন বাসর জীবনের। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সুচিত্রা বাংলাদেশেরই মেয়ে। তাই তার অসুস্থতায় বাংলাদেশের হৃদয়ও পুড়ে। সুস্থ হয়ে উঠুন মহানায়িকা।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।