আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই দুপুরে

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

অগ্রহায়নের দ্বিতীয় শেষ দিনে পটুলের বাপ মারা গেলে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো । প্রায় হাভাতে পরিবারের মানুষজনদের কাছে আপনজনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু বলতে কিছু নেই । যে কোন সময়েই যে কেউ পৃথিবী থেকে সাইড কেটে যেতে পারে । পটুলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বার কারণটা পিতৃবিয়োগের শোক যতো না তার চাইতে অনেক বেশী বৈষয়িক ।

সেই পিচ্চি বয়সে কোন এক রাস্তা থেকে ফেলে থাকা চক আর স্লেট নিয়ে যেদিন থেকে বাসার উঠানে বসেছিলো সেদিন থেকেই তার পড়ালেখার হেব্বি শখ । অনেক কষ্টেসৃষ্টে নানা ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে ক্লাশ টেন পর্যন্ত পড়ালেখা করে টেস্ট পরীক্ষাও দিয়ে ফেলেছে । মাস দুয়েক পর ম্যাট্রিক দিবে তখনই এই ঘটনা । বাপহীন এই অবস্থায় কিভাবে কি ব্যবস্থা করবে বুঝে উঠতে পারেনা ।

পটুলের কাছে টাকাপয়সা যাই আছে তাতে ম্যাট্রিক দেওয়ার পয়সা কুলাবে কিনা বলতে পারেনা ।

নিজেদের জমি-জিরাতও যা ছিলো তার অনেকটাই চলে গেছে এনজিওর ঋণ শোধ করতে করতে । সংসারের স্টিয়ারিং ধরার পর থেকেই পটুলের মা সালেহা চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো । সে কোত্থেকে কি করবে কিচ্ছু ভেবে পায়না ।

পটুল সংসার নিয়ে এতো কিছু ভাবেনা । তার মাথার চিন্তা একটাই ।

কোনভাবে ম্যাট্রিকটা দিবে । এনজিওর শার্টপ্যান্ট পরা স্যারগুলা কি সুন্দর সেজেগুজে এসে তাদের সবার সাথে কথা বলে দেখতে দারুণ লাগে তার । এদিকে একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে বিকালে বাজারে যেতে যেতে স্কুলের ধর্মশিক্ষকের চোখে পড়ে গেলো ।

“ কিরে পটুল এইখানে করস কি রে তুই ? সামনে পরীক্ষা অহন এমনে ঘুইরা বেড়াইলে কেমনে কি ? “

পটুল চুপ করে থাকে । লোকটাকে কখনোই পছন্দ করেনি ।

বিশ্রী কুতকুতে চোখের ভাষা কোনকালেই ভালো লাগতোনা ।

“ শিগগির বাড়িত গিয়া পড়তে যা । আইচ্ছা শুন , তোর মা কি “ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো স্কুলের ধর্মশিক্ষক হাফিজুল ।

পটুল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে । এতোক্ষণ ধরে এই খাটাশটার সাথে কথোপকথন অসহ্যকর ।

দ্রুতই যেই পথ দিয়ে এসেছিলো সেই পথেই বাড়ি চলে গেলো ।

চেয়ারম্যান বাড়িতে কাজ নেওয়ার পর থেকে সালেহার অবস্থা একটু ফিরেছে । স্বামীর মৃত্যুর পর যেই প্রবল দিশেহারা অবস্থা ছিলো তার থেকে অনেকটাই বের হয়ে এসেছে । কোন এক কারণে চেয়ারম্যান মফিদুর তার উপর অত্যাধিক প্রসন্ন । কারণটা সালেহার কাছে আদপেই বোধগম্য না ।

এমন না যে তার শরীরের উপরে সাহেবের কুনজর আছে । কাজ করতে করতে আঁচল সরে গেলে কোনকালেই সেদিকে চোখ দেয়নাই লোকটা । সালেহা তাই সেটা নিয়ে অতশত ভাবতে চায়না । গরীব মানুষের এতো আজাইরা বিষয় নিয়া ভাবার মানে নাই ।

এদিকে পটুলের থেকে তিন বছরের বোন রেশমাকে এইসব জটিলতার কিছুই স্পর্শ করেনা ।

এখনো প্রতিদিন বিকাল হলেই একটু দূরে নদীর পাড়ে খেলতে চলে যায় । মেয়ের বুকে ঢেউ ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছে । শারীরিক পরিবর্তনগুলোর লক্ষণ বেশ সুস্পষ্টই হতে থাকবে সামনের দিনগুলায় । সালেহা এসব ভেবে মেয়েকে সরাসর কিছু না বলে অন্য অজুহাতে অনেকবারই খেলতে যেতে নিষেধ করেছে । রেশমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।

আবারো নদীর পাড়ে খেলতে গিয়ে একদিন প্রচন্ড মার খেলো । পটুলের এসবে কোন মাথাব্যাথা হয়না । তার খালি একটাই চিন্তা । পড়ালেখা শেষ করে এনজিওর প্যান্টশার্ট পরা স্যারদের মতো সাইকেলে করে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াবে ।

এদিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে পটুল দেখতে থাকলো কারণে অকারণেই রেশমা মার খাচ্ছে মা সালেহার কাছে ।

প্রথমে ভাবলো মাকে কিছু বলবে । কিন্তু ইদানিং মার সাথে কথা বলতে ভয় লাগে তার । সালেহা প্রতিদিনই রুদ্র মূর্তিতে থাকে নিজের মেয়েকে কেলানোর সময়ের পরেও । পটুলের পরীক্ষা নিয়ে কোন কথাই জিজ্ঞেস করেনা । কেবল ছেলের খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে নিষ্ঠার সাথে নীরবে দায়িত্ব পালন করে যায় ।

পরীক্ষার দিনে সকালে কেবল দুচারটা ভাত মুখে গুঁজে দিয়ে পরীক্ষার হলে চলে যায় পটুল । কিভাবে প্রতিদিন ভাত পাচ্ছে সেটাও পটুলের মাথায় ঢোকেনা ।

পরীক্ষার হলে ঢুকলেই সেসবের কিছু আর মাথায় রাখতে চায়না । নিবিষ্ট মনে পরীক্ষা দিয়ে যায় । যতোদূর বুঝছে একটা কিছু ভালো ফলাফল করে ফেলতে পারে এভাবে পরীক্ষাগুলো দিতে পারলে ।

এভাবে বিজ্ঞান পরীক্ষা পর্যন্ত সময় চলে গেলো ।

অংক পরীক্ষার আগে তিন দিন বন্ধ ছিলো । বন্ধের দ্বিতীয় দিনের বিকালে নিয়মমাফিক বাড়ি থেকে বের হয়ে বাজারের পঞ্চাশ গজ দক্ষিণে যেই মাঠে মানুষজন গরু চরায় আর চাষারা দিনের কাজ শেষে বিড়ি টানে সেখানে চুপচাপ বসে থাকলো অনেকক্ষণ । নিজের একবজ্ঞা মাথায় এনজিওর স্যারদের সাইকেল ছাড়া অন্য কোন চিন্তা এলোনা । মৃত বাপের কথা মনে করে অল্প একটু কাঁদলো তবু চোখ মুছে স্বাভাবিক হতে সময় নিলোনা গোধূলী লগ্নে ।



হাঁটতে হাঁটতে যখন বাড়ী পৌঁছালো ততক্ষণে মাগরিবের আজান প্রায় শেষের দিকে । উঠানে পা রাখতে রাখতে বোন রেশমাকে আশেপাশে কোথাও দেখলোনা । উঠান থেকে ডানে একটু যেতেই অবাক হয়ে দেখলো চেয়ারম্যান স্যার সালেহার হাতে একগুচ্ছ টাকা গুঁজে দিয়ে ঢিলে হয়ে থাকা পাজামার গিঁট লাগাতে লাগাতে বের হলো । আচ্ছা টাকাটা নেওয়ার সময়ের আগেই কি মার শরীর কি ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে উঠেছে ? পরীক্ষার সময়ে সকালে নিয়মিত ভাত পাওয়ার রহস্যদ্ধার করতে পেরে পটুলের গলা দিয়ে বমি ঠিকরে বের হয়ে আসবে বলে মনে হলো । তবুও হলোনা ।

পটুল সব দেখে ফেলেছে মাকে বুঝতে না দিয়েই ছুটে পালিয়ে গেলো । এদিকে আর সাড়ে পনেরো ঘন্টা পরেই পরীক্ষা ।

পরদিন পরীক্ষার হল থেকে দুই ঘন্টার মধ্যেই এক্সপেল হবার পরপরই বিপর্যস্ত পটুল বাড়ি ফিরে এসেছিলো । ফিরে দেখে মায়ের পর এবারে ভরদুপুরে দরজা বন্ধ করে ছোট বোনটাকে ‘ লাগাচ্ছিলো ‘ তার স্কুলের ধর্মশিক্ষক হাফিজুল । মা সালেহার সব শারীরিক বাঁধা অতিক্রম করেই পাকঘর থেকে খুঁজে নিয়ে দরজা ভেঙ্গে দা দিয়ে হাফিজুলের মাথার ঠিক পেছনে তিনটা কোপ বসিয়েছিলো ।

সামনের রক্তের ফোয়ারা , সম্পূর্ণ নগ্ন ছোট বোন এসবের কিছুই পটুলকে স্পর্শ করছিলোনা । কেবল মনে হতে লাগলো এই জন্মে তার আর সাইকেলের করে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ানো হলোনা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।