আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চির-অন্তরালে চিরন্তনী

ছাবি্বশ দিন মৃত্যুর সঙ্গে অসম লড়াই করে শেষ পর্যন্ত যবনিকা এক রহস্যময়ীর মহাজীবনে। পঁয়ত্রিশ-বছরের স্বেচ্ছা-নির্বাসনের অবসান ঘটল শুক্রবার সকালে মধ্য-কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। প্রবল শ্বাসকষ্টের কারণে ২৩ ডিসেম্বর রাতে সেখানে ভর্তি করানো হয়েছিল বাঙালির স্বপ্নমানবীকে। সেখানেও তিনি ছিলেন অভিপ্রেত আড়ালেই। চিকিৎসক ও নিকটজন ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিল না তার কাছে।

তিন তারিখ সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাসপাতালে গিয়েও সেই অবগুণ্ঠনে সম্মান রেখেই যাননি তার কেবিনে। বিষণ্ন কন্যাকে সাহস আর দৃঢ়চেতা চিকিৎসকদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে এসেছিলেন কেবল। পরদিন সেই খবর জেনে মহানায়িকা ডেকে পাঠিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। দেখা হয়েছিল দু'জনের, আন্তরিক কিছু কথাও। মুখ্যমন্ত্রী সুচিত্রার দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছিলেন।

পরে আরও ক'দিন সুচিত্রা-মমতা সাক্ষাৎ ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী যথেষ্টই উদ্বিগ্ন ছিলেন তার স্বাস্থ্যের বিষয়ে। উদ্বিগ্ন ছিলাম আমরা সবাই। প্রার্থনা করেছিলাম তার আরোগ্য।

কিন্তু, সবার শুভকামনা আর চিকিৎসকদের কঠিন পণ তুচ্ছ হয়ে গেল মৃত্যুর অমোঘ আবির্ভাবে।

এত দিন ধরেই কেবিনের আশপাশে ওতপেতে বসেছিল সে, মৃত্যু। অবশেষে সকাল ৮টা পঁচিশে ছোঁ মেরে তুলে নিল বাঙালির চিরন্তনীকে। হৃদরোগের ছোবল সইতে পারলেন না ৮৩ বছরের চিত্রনায়িকা। ৩৫ বছর সুদীর্ঘ স্বেচ্ছা-অন্তরাল থেকে চির-অন্তরালে গেলেন সুচিত্রা সেন। মৃত্যুর পরেও তিনি এক দূর-মরীচিকা হয়েই থেকে গেলেন।

আমরা তার আড়াল-বাসনায় মর্যাদা দেওয়ার সুযোগ পেলাম। হাসপাতাল থেকে কফিনবন্দি হয়ে বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ি হয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে পৌঁছলেন মহানায়িকা। একটা কুড়ি মিনিটে সশস্ত্র বাহিনী তিনবার তোপধ্বনি করে বিদায় জানাল তাকে। তখন ফুলে-ঘেরা কফিনের সামনে চিত্রার্পিতের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে কন্যা মুনমুন, নাতনি রিয়া-রাইমা।

বৃহস্পতিবার থেকেই মহানায়িকা বারবার বাড়ি ফেরার কথা বলছিলেন চিকিৎসকদের।

শুক্রবার সকালে তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে প্রথমেই ওই বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের 'ছুটি' গল্পের কথা। এ যেন জীবনের পরপারে যে-বসত কল্পনা করি আমরা, সেই বাড়ি ফেরা। সুচিত্রা কি আসলে ফিরতে চেয়েছিলেন সেই আবাসেই।

আমরা তো সুচিত্রারহিত হয়েই থেকেছি এতকাল।

কিন্তু, আমাদের জানা ছিল, তিনি আছেন আমাদের এই মহানগরীতেই। আছেন আমাদের চাক্ষুষের ওপারে, এক সুদূর স্বপ্নে সংলগ্ন হয়ে। এই মহানগরের সঙ্গে সেই কবে নাড়ির যোগ হয়েছিল তার, তার কাছেই বেঁধেছিলেন অভিনয়ের জুটি উত্তমকুমার, বসন্ত চৌধুরী, রবীন মজুমদার, বিকাশ রায়, অশোককুমার, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, সমিত ভঞ্জ, প্রদীপকুমার, দেব আনন্দ, সঞ্জীবকুমার প্রমুখ অবিনশ্বর অভিনেতাদের সঙ্গে। ভাবতে ভালো লাগে, সেইসব অমর অভিনেতাদের সঙ্গে এবার দেখা হবে সুচিত্রার। আর দিলীপকুমার, ধর্মেন্দ্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো নায়করা স্বভাবতই আবার সুচিত্রাস্মৃতিমগ্ন হবেন।

আমি নতুন করে ভাবব আমার দেবী চৌধুরাণীকে। মনে মনে একটি প্রসূন রেখে দেব তার পায়ের কাছে। দেবী চৌধুরাণী আমার কাছে চিরস্মরণীয়। আরও দুটি ছবিতে মহানায়িকার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। 'চতুরঙ্গ' আর 'কৃষ্ণকান্তের উইল'।

দুর্ভাগ্যের বিষয় ছবি দু'টি মুক্তি পায়নি। দেবী চৌধুরাণীতে কাজ করার সময় আমি টালিগঞ্জে একেবারেই নবীন। আর সুচিত্রা সেন তার আগেই মহানায়িকার মুকুটমণ্ডিত। তার তথাকথিত অহঙ্কার বিষয়ে আমি ছিলাম যথেষ্ট অবহিত। কিন্তু, কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তার অনন্যতা।

আমার প্রতি যথেষ্ট ভ্রূক্ষেপ ছিল মহানায়িকার। আমি তাকে 'ম্যাডাম' সম্বোধন করতাম, তিনি আমাকে 'রঞ্জিতবাবু'। বয়স এবং অভিজ্ঞতার গৌরবে আমাকে কখনোই বিন্দুমাত্র তাচ্ছিল্য করেননি তিনি। গেওখালির আউটডোরে কাজের ফাঁকে আমার সঙ্গে নানা ঠাট্টা তামাশায় মেতেছেন। পরে বুঝেছি, সেসব তিনি করেছেন আমার কুণ্ঠা ভেঙে দেওয়ার জন্য।

তখন তার পাশে অভিনয় করতে আমার একটুকুও অসুবিধা হয়নি। সুচিত্রা সেনের কথা ভাবতে গেলে আজ ঝরাপাতার মতো উড়ে আসে অগাধ স্মৃতি। আজও তার সঙ্গে অভিনয়ের সুখস্মৃতি আমাকে সতত শিহরিত করে। মনে করতে পারি, তার সাবলীল শক্তিময়তা। একদিন অন্তত দশ-বাক্যের একটি সংলাপ উচ্চারণের আগে তিনি পরিচালক দীনেন গুপ্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ঠিক কোন বাক্যটিতে চোখে জল আনব?' পাশে বসে এই প্রশ্ন শুনে আমি স্তম্ভিত।

গি্লসারিন ছাড়া এমনভাবে নির্দিষ্ট মুহূর্তে চোখে জল আনা যায়! সুচিত্রার কথা ভাবতে গেলে আমাদের স্বভাবতই মনে পড়ে হলিউডের প্রবাদ-অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বোর কথা। নির্বাকযুগের অভিনেত্রী গার্বো অভিনয় সরণি ধরে পেঁৗছেছিলেন সবাকযুগের সীমাহীন সাফল্যে। কিন্তু, অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতা-অতিরিক্ত এক বিপন্ন বিস্ময় তাকে শেষ পর্যন্ত একা ও আলাদা করে দিয়েছিল। তিনি চলে গিয়েছিলেন দুরূহ কুয়াশার অন্তরালে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, 'আপনি কি একা হতেই চান?' গার্বো সপ্রতিভ বলেছিলেন, 'আমি মোটেই একা হতে চাই না।

বরং, আমাকে একা করে দেওয়া হোক। ' সুচিত্রাকে এমন প্রশ্নই করেছিলেন সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায়। তিনি প্রায় একইভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, 'আমি হয়তো একা। কিন্তু, কখনওই একাকী নই'।

সুচিত্রা বলতে বাঙালি চিরকাল বুঝেছে ওই সি্নগ্ধ ব্যক্তিত্ব, ওই নির্মোক।

তিনি আসলে এক সুদূর প্রতিমার মতো। তিনি থেকেও নেই, না-থেকেও আছেন। তার সেই পাখির নীড়ের মতো চোখ, দৃষ্টির দীপ্তি, বিষাদ, অভূতপূর্ব গ্রীবাভঙ্গি, চলন, বচন, হিন্দোল, কুহকের এক সামগ্রিকতাই আমাদের সুচিত্রা। তিনি আমাদের মধ্যে থেকেও, কখনোই আমাদের মধ্যে ছিলেন না। বলা যায়, তিনি যেমন তিলে-তিলে রচনা করেছেন নিজেকে, আমরাও আমাদের কল্পনায় কম রচিনি তাকে।

আর আমাদের কল্পনা যত প্রসারিত হয়েছে, তিনি ততই আরও দূরবর্তিনী হয়েছেন।

তবু, আমরা এতদিন জানতাম, তিনি আছেন আমাদের সঙ্গেই। ইচ্ছা করলেই আমরা গিয়ে দাঁড়াতে পারি তার বাড়ির সামনে। আজ থেকে আমাদের হয়তো সংশয় হতে থাকবে, আদপেই সুচিত্রা সেন নামে কোনো মানবী ছিলেন কি না ইহজগতে। হয়তো মনে হবে, তিনি বুঝি কবিতার বনলতা সেন।

পাশাপাশি আজ থেকে আমাদের সঙ্গে চিরসংযোগ তৈরি হবে তার। বাঙালির মনে আজ থেকেই শুরু হবে তার পুনর্জন্ম। সৌজন্যে : সংবাদ প্রতিদিন

 

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.