আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নববর্ষ দেশে দেশে!! থাই, চীন এবং পারস্য রীতি

বুদ্ধিমত্তা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। আপনি তখনই বুদ্ধিমান যখন আপনার পাশের লোক বোকা !! বছরের প্রথম দিন পর্বত থেকে সিংহ দৈত্য নিয়ান নেমে আসবে। খেয়ে ফেলবে সকল শস্য এবং গবাদী পশু এমনকি শিশুদেরও, এমনই বিশ্বাস চীনাদের। নিয়ানের এই অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় নিয়ান আক্রমণ করার আগেই নিয়ানকে দিতে হবে খাদ্য আর তাহলেই নিয়ান মানুষের কোন ক্ষতি করবেনা, হত্যা করবেনা শিশুদের। তাই বছরের প্রথম দিন সকল মানুষ মিলে আয়োজন করে নিয়ানের ভোজের।

যথা সময় নিয়ান আসে খেতে শুরু করে মানুষের দেয়া খাদ্য। কিন্তু হঠাৎ দেখা যায় লাল জামা পড়া এই শিশুকে দেখে নিয়ান পালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারে নিয়ানের লাল রঙ ভীতি। শুরু হয় নিয়ানকে তাড়ানোর জন্য লাল রঙের উৎসব। আর কালে কালে নানাবিধ আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা পরিব্যাপ্ত হয় দুই সপ্তাহ ব্যাপী।

সাথে নৃত্যের ছন্দে নানা ভঙ্গিমায় চলে পৌরানিক কাহিনীর গল্প বলা। আর চীন সজ্জিত হয় নানাবিধ লাল সাজে। সম্ভববত চীনারাই সবচাইতে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। দুই সপ্তাহ ব্যাপি তাদের এই নববর্ষ উদযাপন থাকে নানা বর্ণে বর্ণিল। শীত শেষে বসন্তের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় চীন জাতির নববর্ষ গণনা।

সে কারণে একে বসন্ত উৎসবও বলা হয়ে থাকে। বছর ভেদে জানুয়ারীর মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে শুরু হয় তাদের নববর্ষের প্রথম দিন। এ হিসেবে তাদের সামনের নববর্ষের প্রথম দিন শুরু হবে ফেব্রুয়ারীর ১০ তারিখে। এই সময়টাতেই মূলত চাইনিজরা দীর্ঘকালীন ছুটি ভোগ করে। চীনা রাশিচক্রে এ বছরটা যাচ্ছে ড্রাগনের ড্রাগনের বছর এবং আসছে বছর হবে সাপের।

নিয়ানের মুখোশ ঐতিহ্যবাহী সিংহরূপী নিয়ান নৃত্য নবর্ষের শোভাযাত্রায় ড্রাগন প্রতিকৃতি ঐতিহ্যবাহী ড্রাগন নৃত্য উৎসব মুখর নৃত্য শিল্পীগণ নবর্ষের আলোক সজ্জা শীতের দাপটে প্রকৃতি মৃতপ্রায়। ঝড়া পাতায় রুক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছপালা। দিন দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির রূপ। পৃথিবী যেন ধুঁকে ধুঁকে মরে যাচ্ছে। দূরে ঠেকে দিয়েছে সূর্যকে।

পৃথিবী যেন আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সবকিছু ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু না, জীবনদায়ী সূর্য তার সৃষ্টিকে এভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে পারেনা। প্রকৃতিকে বাঁচাতে আবারো এগিয়ে আসে সুর্য। আর সূর্যকে দুয়ারে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয় মানুষ। দক্ষিণায়ন থেকে সূর্য যেদিন বিষুব রেখায় আসে নানা আয়োজনে মানুষ বরণ করে নেয় আরেকটি নতুন বছরের।

ফুলে ফলে আবার সেজে উঠে প্রকৃতি। ৩০০০ বছরের জরাথ্রুস্থিয়ান ঐতিহ্যমতে সূর্যের উত্তরায়নে যেদিন দিনরাত সমান থাকে সেদিনই পালিত হয় নওরোজ বা নবদিন উৎসব। সাধারণত ২১শে মার্চ বা পারস্য ক্যালেন্ডার মতে ২১শে মার্চের ২/১ দিন আগে বা পরে সূর্যের বসন্তু বিষুবের দিন পালিত হয়ে থাকে পারস্যদের ঐতিহ্যবাহী নওরোজ উৎসব। পারস্য পুরাণ মতে পৌরাণিক রাজা জামশেদ নওরোজ প্রথার গোড়াপত্তন করেন। নওরোজে জরাথ্রস্থিয়ান রিউচুয়াল মতে পারস্যবাসী সাজায় তাদের ঐতিহ্যবাহী নওরোজ টেবিল।

বিভিন্ন প্রতীক হিসেবে সেখানে রাখে নানাবিধ ফুল ফল ইত্যাদি। যেমন, আয়না- আকাশের প্রতীক, আপেল- পৃথিবী প্রতীক, মোমবাতি- আগুনের প্রতীক, গোলাপ- জলের প্রতীক, শস্যদানা এবং সদ্য অঙ্কুরিত গাছ- শস্যের প্রতীক, মাছ- পশুর প্রতীক, ডিম- মনুষ্যত্ব এবং উর্বরতার প্রতীক, শুকনা ফল- প্রেমের প্রতীক, সিরকা- বার্ধ্যকের প্রতীক, পুডিং- সমৃদ্ধির প্রতীক ইত্যাদি। যেগুলো একই সাথে বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, সূর্য এবং চন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করে। ঐতিহ্যমতে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফল শস্য এবং গাছ দিয়ে সাজানো নওরোজ টেবিল পারস্যবাসী চীনাদের মত দুই সপ্তাহ ধরে নববর্ষের আচার আচরণ পালন না করলেও নওরোজ উপলক্ষে তারাও বিশেষ করে স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ অবকাশ যাপন করে থাকে। বেশীরভাগ সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেই নওরোজের প্রথম সপ্তাহে চলে বাৎসরিক ছুটির আমেজ।

ইরানের বাইরেও আফগানিস্থান, ইরাক কুর্দীস্থান, কসোভো, আজারবাইজান, কাজাখস্থান, তুর্কেমেনিস্থান, তাজিকিস্থান, উজবেকিস্থান প্রভৃতি দেশে নওরোজ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। পার্সিপলিসের দেয়াল চিত্রে ষাড় রূপী পৃথিবীকে ঘায়েল করছে সিংহ রূপী সূর্য। যা নওরোজের প্রতীক! পার্সিপলিসের নওরোজের উপহার প্রদানের দেয়াল চিত্র নওরোজ শোভাযাত্রা "এসো কর স্নান নবধারা জলে" বছরের শুরুতেই ধুয়ে দিতে হবে সকল ক্লান্তি সকল অশুভকে। আর এমনই ধারণা থেকে থাইল্যান্ডে পালিত হয় সংক্রান উৎসব। থাই নতুন বছরের প্রথম দিন ১৪ই এপ্রিল সকলে মেতে উঠে জলকেলিতে।

এই জলের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবেনা কেউ। না থাইবাসী না কোন পর্যটক! নবধারা জলে সকলকে স্নান করিয়ে থাইবাসী প্রস্তুত হয় আরেকটি নতুন বছরের। সংস্কৃত শব্দ সংক্রান্তি থেকেই সংক্রান কথাটির উৎপত্তি। যার অর্থ পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের দিনে জল খেলার পাশাপাশি চলবে ঐতিহ্যবাহী থাই নববর্ষ শোভাযাত্রা এবং বিশেষ ধর্মীয় প্রার্থনা উৎসব।

১৪ই এপ্রিল নববর্ষের প্রথম দিবস থাকলেও মূলত ১৩,১৪ এবং ১৫ই এপ্রিল এই তিনদিন ব্যাপি চলে থাইদের নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। থাইল্যান্ডের বাইরেও লাওস, কম্বোডিয়া ও মায়ানমারে পালিত হয়ে থাকে সংক্রান উৎসব। জলের উৎসবে থাইবাসী সংক্রান শোভাযাত্রা জল দিয়ে ভালোবাসা নিবেদন নববর্ষ পৌরানিক উপাখ্যান, আঞ্চলিক সংস্কৃতি ঐতিহ্য এবং জোতির্বিজ্ঞানের এক অপুর্ব সমন্বয় যা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠিকে দিয়েছে স্বতন্ত্র একটি উৎসব এবং নিজের শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার এক অকৃত্তিম প্রেরণা। আর এই প্রেরণার মাধ্যমে অশুভ শক্তি, অকল্যাণকর জাগতিক উপাত্ত মুছে নবধারা জলের স্নানে বছরের আবর্জনা সব দূর হয়ে যাক সকলের। সবাইকে ইংরেজী নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.