আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প- “পিঙ্কু ও মিস্টার ডেভিল”

ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে হানাহানি সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক!


পিঙ্কুদের বাসাটা খুব আজব এক জায়গায় । ঘুরঘুটটি এক কানাগলি, তার একদম শেষ মাথায় মনখারাপ-মনখারাপ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোতালা বাড়িটা । দোতালায় বাড়িওয়ালা আর তার তিনছেলে থাকে। নীচতলায় থাকে পিঙ্কুরা , আর আরেকটা ফ্যামিলি- মুখোমুখি দুই ফ্ল্যাটে বাসা ভাড়া নিয়ে। তাদের বাড়ির সামনের সরু গলি ধরে সামনে এগুলে হাতের ডাইনে পড়বে মিলব্যারাক লঞ্চঘাট , বামে পোস্তগোলা শ্মশানঘাট ।


পিঙ্কু তাদের সেই মনখারাপ করা বাড়ির সিঁড়িতে মনখারাপ করেই বসে আছে । বেলা বারোটা বাজে । ডিসেম্বরের শীতের আমেজ তাকে অথবা আকাশের সূর্য- কাউকেই খুব একটা স্বস্তিতে রাখে নি । শীতের কনকনে হাওয়া পিঙ্কুকে একদম কাবু করে ফেলেছে। হাফহাতা শার্টের ওপর পিঙ্কুর পাতলা সোয়েটার মোটেও শীত আটকাতে পারছে না ।

এদিকে শীতকাল বলে পৃথিবী নিজের কক্ষপথে এমন বেকায়দায় ঝুলে আছে যে সূর্যও ঠিকভাবে নিজের তাপ দেয়ার ক্ষমতাকে ভালো ভাবে ঝালাই করতে পারছে কোথায় ?
পিঙ্কুর স্কুল ছুটি হয়েছে এগারোটায় । তারপর সে একছুটে বাসায় চলে এসেছে ।
পিঙ্কু পিছনে ফিরে তাকালো। তাদের ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। ঝুঁকে উবু হয়ে গেটের নীচ দিয়ে তাকালে রুমের ভেতর টিম টিম করে জ্বলতে থাকা হলুদ বাতির আলো দেখা যায় ।


“ভাইয়া আজও ঘরে আছে” – পিঙ্কু মনে মনে ভাবে । পিঙ্কু উঠে দাঁড়িয়ে ত্রস্ত পায়ে গেটের সামনে যায় । ঢোক গেলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার । দরজার ছিটকানির সাথে ঝোলা তালা দিয়ে গেটে মৃদু ধাক্কা দেয় বার দুই । ভেতর থেকে রিঙ্কুর চাপা ঝাঁঝালো গলার আওয়াজ পাওয়া যায় – “আহ! বললাম না , দুটোর পরে আয় !!”।

পিঙ্কু এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় বসে পড়ে ।
পিঙ্কুর বড় ভাই রিঙ্কু । একরুমের এই ফ্ল্যাটেই তাদের ছোট্ট পৃথিবী। রিঙ্কু-পিঙ্কুর মা মারা যান পিঙ্কুকে জন্ম দিতে গিয়ে। মাকে নিয়ে পিঙ্কুর কোনও স্মৃতি নেই ।

মাকে সে শুধু ছবিতে দেখেছে । ছবিটাতে মা গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পড়া । মায়ের সাথে সেই ছবিতে আছে রিঙ্কু-পিঙ্কুর বাবা। পিঙ্কুর কাছেই সব সময় সে ছবিটা থাকে । পিঙ্কু ছবিটাকে তার বালিশের নীচে রেখে ঘুমায় ।

রোজ রাতে ঘুমুতে যাবার আগে একবার তার মায়ের ছবি দেখে সে আর অবাক হয়। ভাবে – এই বুঝি তার মা!
পিঙ্কুর বয়স যখন ঠিক দু’বছর , তখন রিঙ্কু-পিঙ্কুর বাবা তাদের জন্য নতুন একটা মা নিয়ে আসেন ।
জন্মের পর থেকেই টিনের কৌটোর দুধ খেয়ে বড় হওয়া পিঙ্কুর যে একটা মায়ের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল- তা নয় । কিন্তু রিঙ্কু-পিঙ্কুর বাবা তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের এই বলে বুঝিয়েছিলেন যে নেহায়েত দুধের শিশু পিঙ্কুর দেখভালের জন্যই মূলত তার আরেকবার বিয়ে করা খুব দরকার । রিঙ্কু ততদিনে বড় হয়ে উঠেছে ।

হাইস্কুলে ক্লাস করছে। সে খুব ভালো করেই বুঝেছিল যে পিঙ্কুর দেখভালের ব্যাপারটা আসলে কিছুই নয় । বাবা তার অথবা পিঙ্কুর খোঁজখবর নিয়ে খুব একটা চিন্তিত-ই নন । তবে বাবাকে এ নিয়ে তারা দোষ ও দিতে পারত না। ইসলামপুরে বাবার কাপড়ের দোকান ।

ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক দশটা , তখন বাবা নিজ হাতে দোকানের শাটার খুলতেন । পরে আবার সব হিসেব মিলিয়ে রাত এগারোটায় দোকানের ঝাঁপি ফেলে সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরতেন। রাতে এসে দুপুরে ঠিকা ঝিয়ের হাতের রান্না করা বাসি- ঠাণ্ডা – বিস্বাদ- পানসে তরকারী দিয়ে ভাত খেতে বসে তার আর মেজাজ ঠিক থাকতো না। পিঙ্কু ছোট বলে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো অনেক আগে। বাবার রাগ ঝাড়ার জন্য হাতের কাছে একমাত্র সহজলভ্য বস্তু থাকতো রিঙ্কু।

তাই মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে হইচই শুনে জেগে উঠে পিঙ্কু দেখত তার ভাইয়াকে বেদম পিটাচ্ছে তার বাবা।
সমস্ত ঝামেলার টোটকা সমাধান হিসেবে রিঙ্কু-পিঙ্কুর জন্য নতুন মা নিয়ে আসেন বাবা । তবে রিঙ্কু- পিঙ্কুর জীবনে আসল ঝামেলা শুরু হয় তখন , যখন নতুন মা তাদেরকেই সব ঝামেলার মূল হিসেবে দেখা শুরু করেন।
সেই রাতটাও ছিল ভীষণ শীতের এক রাত । ছোট্ট পিঙ্কুর দু-তিন ধরে বিষম জ্বর।

বাবা ব্যাবসার কাজে ছিলেন ঢাকার বাইরে। বাড়িতে খালি রিঙ্কু-পিঙ্কু আর তাদের নতুন মা। নতুন মা সেদিন সন্ধ্যা থেকেই টিভিতে জোরে সাউনড দিয়ে কোলকাতার বাংলা সিনেমা দেখছিলেন। সন্ধ্যা থেকেই পিঙ্কুর জ্বর অস্বাভাবিক ভাবে বাড়লো। রিঙ্কু বার কয়েক পিঙ্কুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা নতুন মাকে বলতে গিয়ে গেট থেকে ফেরত চলে এসেছে।

সাহস করে বলে উঠতে পারে নি। মাঝরাতে হঠাৎ পিঙ্কু মুখ দিয়ে গোঙ্গানির শব্দ করতে করতে অচেতন হয়ে পড়ে । রিঙ্কু সন্ধ্যা থেকেই পিঙ্কুর পাশে বসা। শীত থেকে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন নিজের পাতলা কাথাখানি খুলে সে বহু আগেই পিঙ্কুর গায়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে শীতে কাঁপছে । কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না যেন।

পিঙ্কু দ্রুত অস্বাভাবিকভাবে নেতিয়ে পড়ছিল। ভয় ডর সবকিছু ভুলে রিঙ্কু গিয়ে নতুন মাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে । শীতের রাতে আরামের ঘুম ভাঙ্গার কারণে নতুন মা কাঁচাঘুম ভাঙ্গা চোখে কিছুক্ষণ ক্রুর দৃষ্টিতে রিঙ্কুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন পিঙ্কুকে পাঁজাকোল করে বাথরুমে নিয়ে যেতে , তিনি মাথায় পানি দেবেন । রিঙ্কু কোলে করে ভাইকে বাথরুমে নিয়ে গেলে নতুন মা প্রথমে বাথরুমে এসে বড় বালতিতে ঠাণ্ডা পানি ভর্তি করেন ।

তারপর জ্বরে টালমাটাল অবস্থায় বসে থাকা ছোট্ট পিঙ্কুর মাথায় ঝপাস করে সব পানি একবারে ঢেলে দেন । রিঙ্কুর বুক সে অমানবিক দৃশ্য দেখে ধড়াস করে লাফ দিয়ে ওঠে। পিঙ্কুর গলা দিয়ে বের হয়ে আসা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ রিঙ্কুর বুকে ছুরির ফলার মত গিয়ে বেঁধে । হতভম্ভ রিঙ্কু বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে একবার মৃত্যুমুখে প্রায় যাত্রা শুরু করা তার আদরের ছোটভাই-এর দিকে আরেকবার স্থির দৃষ্টিতে পিঙ্কুর দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলতে থাকা নতুন মায়ের দিকে তাকালো। ধাক্কা সামলে নিয়ে সাথেসাথে চিলের মত ছোঁ মেরে পিঙ্কুকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তোয়ালে দিয়ে সারা শরীর মুছে দিতে থাকলো।

রিঙ্কু দেখল পিঙ্কুর সারা শরীর দ্রুত গতিতে নীলচে হয়ে আসছে। পাশের বাড়ির বুলা আপুদের সহায়তায় সেই রাতেই পিঙ্কুকে হাসপাতালে ভর্তি করায় রিঙ্কু। রিঙ্কু-পিঙ্কুর বাবা খবর পেয়ে পরদিন ভোরেই ঢাকায় এসে হাসপাতালে তার দুই ছেলেকে দেখতে আসেন। এসে দেখেন , পিঙ্কুর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিঙ্কু। তার চোখের নীচে রাজ্যের কালি জমা।


রিঙ্কু-পিঙ্কুর বাবা এদিন তার জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজটা করেন। সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তার দুই ছেলেকে তার নতুন স্ত্রীর রোষানল থেকে দূরে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেবেন। সেই থেকেই রিঙ্কু-পিঙ্কু একরুমের এই ফ্ল্যাটে ভাড়া আছে ।
পিঙ্কু এ পর্যায়ে খুবই অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়ায়। আবার সাথে সাথেই ধপ করে বসে পড়ে।

এই কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে হাঁটাহাঁটি করার আইডিয়া একেবারেই বেমাক্কা। লাভের লাভ কিছুই হবে না , শুধু শুধু আরও ভালো করে ঠাণ্ডা চেপে বসানো হবে । এমনিতেই বুকে কফ জমে আছে।
কলাপসিকেল গেটের বাইরে মিস্টার ডেভিল কে ছোটাছুটি করতে দেখা গেলো । পিঙ্কু মুখ দিয়ে মৃদু চুকচুক আওয়াজ করতেই ছুটে এসে মিঃ ডেভিল লম্বালম্বি ভাবে শুয়ে পড়লো, একদম পিঙ্কুর পায়ের কাছে ।


মিঃ ডেভিল পিঙ্কুদের গলির কুকুর । গায়ের রঙ কুচকুচে কালো । লেজটা সরু হয়ে প্রায় সুতোর মত হয়ে এসেছে। । সারাদিন চারথাবা দিয়েই যেন ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে শরীর চুলকোতে থাকে ।

চুলকাতে চুলকাতে প্রায় সব লোমই তুলে ফেলেছে । গায়ের এখানে ওখানে এখন কেবল খাবলা খাবলা কিছু পশম দেখা যায়। ক্ষীণকায় শরীরের সাথে অসামঞ্জস্যতায় পূর্ণ মিঃ ডেভিলের তীব্র উজ্জ্বল কমলা দুটো চোখ । সবসময়ই ধকধক করে জ্বলছে যেন ।
গায়ের রঙ আর এ কিম্ভুতকিমাকার আকার- প্রকৃতির জন্যই রিঙ্কু-পিঙ্কু মিলে ওর নাম রেখেছে মিঃ ডেভিল।

রিঙ্কু অবশ্য কুকুরটার নাম লুসিফার রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু উচ্চারণের সুবিধার জন্য পিঙ্কু মিঃ ডেভিল নামটাই বেছে নিয়েছে ।
নাম মিঃ ডেভিল হলেও কুকুর হিসেবে সে ভারী সুবোধ । ক্ষিধে পেলে গলির শেষপ্রান্তের কসাইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে করুণ স্বরে কুইকুই আওয়াজ করতে থাকে একটানা । যেদিন ভাগ্য ভালো থাকে সেদিন কিছুক্ষণ কুইকুই করলেই একটুকরো চর্বি বা হাড় জুটে যায় ।

যেদিন ভাগ্য খারাপ থাকে , সেদিন হাড়ের বদলে জোটে লাথি । কিন্তু মিঃ ডেভিল দমে না। একটু দূরে সরে গিয়ে কিছুক্ষণ ধরে নিরীক্ষা করতে থাকে কসাইকে । পরে সুযোগ বুঝে আবার এগোয় ।
কখন সে প্রথম দফার চেষ্টাতেই মাংস জোটাতে পারবে তার একটা ছক মোটামুটি অ্যাদ্দিনে দাঁড়া করিয়ে ফেলেছে মিঃ ডেভিল ।

যখন কসাই তার দোকানে একা বসে থাকে , বেচাবিক্রি থাকে না- সে সময় কসাইয়ের মেজাজ থাকে খারাপ। ফলে মাংস চাইতে গেলেই মাংসের বদলে মার জোটে । তবে যখন কাস্টমার থাকে , কসাই মাংস কাটায় ব্যাস্ত থাকে – তখন করুণ সুরে একটু আর্তনাদ করলেই মনের ফুর্তিতে এক-দু’ টুকরো মাংস মিঃ ডেভিলকে ছুঁড়ে দেয় সে।
মিঃ ডেভিলের সাথে রিঙ্কু- পিঙ্কুর , বিশেষত পিঙ্কুর সম্পর্ক বেশ গভীর। রিঙ্কু এখন কলেজে পড়ে ।

সেকেন্ড ইয়ারে। কলেজের ক্লাস , তারপর একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়া , আবার নিজে প্রাইভেট পড়া – সব মিলিয়ে এখন রিঙ্কুর বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। পিঙ্কুর স্কুল আবার ওদের বাসা থেকে হাঁটা পথে দশমিনিট। সকাল সাতটায় পিঙ্কু ঘুম থেকে উঠে দেখে রিঙ্কু দৌড়াদৌড়ি করে নাস্তা রেডি করছে। পিঙ্কু ধীরে ধীরে বিছানা ছাড়ে, খুব ঢিমে তালে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে ঢোকে, আস্তে আস্তে দাঁত মেজে , মুখ ধুয়ে , ফ্রেস-ট্রেস হয়ে সে যখন বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে ততক্ষণে রিঙ্কু নাস্তা সাজিয়ে খাটে বসে আছে ।

রিঙ্কু ঝড়ের গতিতে নাস্তা শেষ করতে থাকে । আর পিঙ্কু আস্তে আস্তে চিবিয়ে চিবিয়ে নাস্তা করে । যেন রিঙ্কুর ব্যাস্ততার সাথে অপ্রকাশ্য এক অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করে সে দেখাতে চায় – জগত যেই নিয়মেই চলুক, পিঙ্কু চলবে তার নিজের গতিতে, রাজকীয় ভাবে , ঢিমে তালে।
নাস্তা শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে সাতটা। পিঙ্কুর স্কুল আটটায়।

এদিকে রিঙ্কুর কলেজ সাড়ে আটটা থেকে । রিঙ্কু আবার ছোটাছুটি করে তার কলেজের বই-খাতা গুছান শুরু করে। পিঙ্কু তার স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে নেয়। কিন্তু পিঙ্কু জুতোর ফিতা বাঁধতে পারে না । পারে না ডান পাশে সিঁথি করে চুল আঁচড়াতে।

এসব-ই পিঙ্কুর স্কুলের ড্রেসকোড। একটু উনিশ-বিশ হবার সাথে সাথে পিটি টিচারের ধুন্ধুমার মার পীঠে এসে পড়ে।
রিঙ্কু নাস্তা খাওয়া শেষ করে পিঙ্কুর চুল আঁচড়ে দেয় , জুতার ফিতা লাগিয়ে দেয়। তারপর দুই কাঁধে নিজের আর পিঙ্কুর ব্যাগদুটো ঝুলিয়ে পিঙ্কুর হাত ধরে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে । পিঙ্কুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজে কলেজের দিকে রওনা হয়।


পিঙ্কুর স্কুল ছুটি ১২ টায়। এদিকে রিঙ্কুর কলেজ শেষে টিউশনি করিয়ে বাসায় আসতে আসতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। পিঙ্কু একা একা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসে।
দুইটা রাস্তা দিয়ে পিঙ্কু বাসায় ফিরতে পারে । একটা হচ্ছে পোস্তগোলা বাজারের পাশে মেইন রাস্তা দিয়ে , আরেকটা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের শ্মশানঘাট ঘেঁষে সোজা যে রাস্তা সোজা সদরঘাট গেছে – সেটা ।

খুব বেশী বৃষ্টি হলে নদীর তীরের রাস্তাটা একেবারে হাঁটু-কাঁদায় ডুবে থাকে । তাই বর্ষাকালের সময়টুকু পিঙ্কু খালি মেইনরোড ধরে বাড়ি আসে। এছাড়া বছরের বাকী সময়টুকুতে সে নদীর তীরের রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরে । বিষাক্ত বর্জ্যের প্রকোপে বুড়িগঙ্গার পানিদূষণ নিয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষের মাথাব্যাথার অন্ত নেই । কিন্তু পিঙ্কুকে বুড়িগঙ্গার পানির রঙ অতটা ভাবায় না।

সে বুড়িগঙ্গার তীরে ভেসে যাওয়া বড় বড় ষ্টীমারগুলির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে পার করে দিতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা । নদীর ওপর যে আকাশ ভেসে থাকে , তার রঙ অন্য যেকোনো জায়গার আকাশের চেয়ে বেশী বর্ণময় লাগে পিঙ্কুর কাছে। লুঙ্গী গুটিয়ে পরে পিঙ্কুর বয়েসি যে রাস্তার ছেলেগুলি নদীর তীরে বসে মাছ মারার চেষ্টা করে –পিঙ্কু তাদের সাথে মিশে কয়েকদিন মাছ ধরেছে । কিন্তু রিঙ্কু যেন কিভাবে টের পেয়ে গিয়ে পিঙ্কুকে কান ধরে বাসায় নিয়ে এসে দিয়েছে বেদম পিটুনি । তারপর থেকেই পিঙ্কুর মাছ ধরা খেলা শেষ ।


যেদিন রিঙ্কুভাইয়া দেরি করে বাসায় ফেরে সেদিন পিঙ্কুকে বকা দেবার কেউ থাকে না। পিঙ্কু যা খুশী তাই করতে পারে। যতক্ষণ খুশী রাস্তায় ঘুরতে পারে । ঘোরাঘুরি শেষ করে পিঙ্কু তাদের সরু গলির মুখে এসে দাঁড়াতেই গলির অন্য প্রান্ত থেকে মিঃ ডেভিল ছুটতে ছুটতে এসে পিঙ্কুর একদম পায়ের ওপর এসে পড়ে । পিঙ্কুকে ঘিরে পাক খেতে থাকে ।

দুজন মিলে একসাথে হেঁটে এসে পিঙ্কুদের বাসার সামনে দাঁড়ায়। পিঙ্কু দরজা খুলে ঘরে ঢোকে । সকালে বা আগের রাত্রে রান্নাকরা যে খাবার টুকু থাকে তা খায়। খেয়ে ভাতঘুম দেয়। একঘুমে বিকাল হয়ে যায় ।

কখনো কখনো পিঙ্কু ঘুম থেকে উঠে দেখে রিঙ্কুভাইয়া চলে এসেছে।
সমস্যা হয় সেই দিনগুলোতে, যখন রিঙ্কুভাইয়া হঠাৎ হঠাৎ দুপুরে বাসায় চলে আসে। সেদিনগুলোতে আর পিঙ্কু তার আরামের রুটিন মাফিক চলতে পারে না। আরাম তো আরাম , পিঙ্কু সেদিন ঘরেই ঢুকতে পারে না । তাকে বসে থাকতে হয় গেটের বাইরে , সিঁড়িতে- যেমন সে আজকে বসে আছে ।


তবে রিঙ্কুভাইয়া একা আসে না , তার সাথে থাকে মনিকা আপু।
মনিকা আপু পিঙ্কুর কোনও আত্মীয় না। গত মাস দুই ধরে মনিকা আপু নিয়মিত তাদের বাসায় আসছে। পিঙ্কু হিসাব করে দেখছে, প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার মনিকা আপু তাদের বাসায় আসে। পিঙ্কু বাসায় থাকা অবস্থায় যদি রিঙ্কুভাইয়া মনিকা আপুকে নিয়ে এসে হাজির হয় , তবে রিঙ্কুভাইয়া পিঙ্কুর হাতে দশ টাকা গুঁজে দিয়ে বলে বাইরে ঘুরে চটপটি বা ফুচকা খেয়ে আসতে।

আর যদি পিঙ্কু স্কুল থেকে আসার আগেই রিঙ্কুভাইয়া মনিকা আপুকে নিয়ে চলে আসে , তবে পিঙ্কুকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। যেমন আজকে পিঙ্কুকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
যে বিষয়টা পিঙ্কুর মাথায় আজকাল খালি ঘুরঘুর করে তা হল- গেট আটকে ভাইয়া আর মনিকা আপু করে কি ?
পিঙ্কু ক্লান্ত হয়ে হেলান দিয়ে বসে দেয়ালের সাথে। আজ পাঁচ টাকার বদলে টিফিনের জন্য বরাদ্দ পুরো দশটাকা দিয়ে সে চালতার আচার কিনে খেয়েছে। বড়ই বা জলপাইএর আঁচার ভালো লাগে না পিঙ্কুর।

ওগুলোর রঙ যেন কেমন কেমন। চালতার আঁচার পিঙ্কুর অলটাইম ফেভারিট। তার থেকেও বেশী প্রিয় অবশ্য আঁচারের সাথে দেয়া বিট লবণ । নোনতা- নোনতা, টক , ঝাল , মিষ্টি মিলিয়ে সে কি অপূর্ব স্বাদ ! পিঙ্কু যতবার আঁচার কিনতে যায় , হাঁ করে আঁচারওয়ালার বিট নুনের বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নোংরা একটা বোতলে কিভাবে যে এত অপূর্ব সুস্বাদু একটা বস্তু ভরে রাখে , তা পিঙ্কুর মাথায় আসে না ।


আজ পাঁচ টাকার আচারের সাথে একটু বেশী বিট নুন চাইতেই আচারওয়ালা বলল, পাঁচ টাকার আচারে এর চেয়ে বেশী বিট নুন দেয়া যাবে না। পিঙ্কু কিছুক্ষণ দোনোমনো করে আরও পাঁচটাকা বাড়িয়ে পুরো দশ টাকার আঁচার কিনে নেয় । আঁচারওয়ালা শালপাতার ওপরে রাখা আচারে ছড়িয়ে দেয় অনেকগুলো করে বিট নুন। পিঙ্কু চোখ বড় বড় করে দেখে , আচারের ওপর ছড়িয়ে আছে আছে তারার মত তার পছন্দের লবণের গুড়ো !
সেই আঁচার হোক , অথবা লবণের কারনেই হোক – স্কুল চলার সময় থেকেই পিঙ্কুর পেট ব্যাথা করছে । ক্লাস ছুটির পর সে বাসায় এসেছে প্রায় ছুটতে ছুটতে।

কিন্তু এসে দেখে এই বিপত্তি। রিঙ্কু ভাইয়া মনিকা আপুকে নিয়ে এসে গেট আটকে বসে আছে ।
পিঙ্কু গেট নক করেছে একবার। ভাইয়া বলেছে দুটোর পরে আসতে। কিন্তু পেট ব্যাথা কি মানুষের ঠিক করে দেয়া নিয়ম মেনে শুরু হয়? গেট নক করে যে চেঁচিয়ে বলবে তার বাথরুমে যাওয়া দরকার – পিঙ্কু সেটাও পারছে না।

বড় হয়ে গেছে না সে ? তার একটা আত্মমর্যাদা বোধ আছে। সে কি মনিকা আপুর সামনে চেঁচিয়ে বলতে পারে – “রিঙ্কুভাইয়া , দরজা খোলো , পেট ব্যাথা করে , বাথরুমে যাবো” ?
কাজেই পিঙ্কু পেট চেপে ধরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বসে আছে অনেকক্ষণ থেকে । সামনে বসে লেজ নাড়াচ্ছে মিস্টার ডেভিল।
“ মিঃ ডেভিল , খুব পেট ব্যাথা করছে। কি করা যায় ?”
“ সহজ সমাধান , রাস্তায় ঝামেলা মিটিয়ে ফেলো!”
“ সেকি? রাস্তায় কিভাবে? মানুষজন আসা যাওয়া করছে, লজ্জা পাব না ?”
“ লজ্জা পাও বলেই তো এত ঝামেলা ।

আমাদের দেখো – লজ্জা নেই বলেই আমরা রাস্তাঘাটে যে স্বাধীনতা ভোগ করি , সে স্বাধীনতা তোমাদের দরজা আটকে ভোগ করতে হয়। ”
পিঙ্কু চোখ সরু করে মিঃ ডেভিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার রীতিমত আফসোসই হচ্ছে কুকুর না হয়ে মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্য।
কিন্তু , মিঃ ডেভিলের দরজা আটকে স্বাধীনতা ভোগ করার কথায় তার মনে পড়ে গেলো , রিঙ্কুভাইয়া এখনো মনিকা আপুকে নিয়ে গেট আটকে বসে আছে। তার পেট ব্যাথা করছে , এবং সে বাথরুমে যেতে পারছে না।


“ মিঃ ডেভিল , বাথরুমে যাওয়া দরকার”
“ বললাম তো, রাস্তায় সেরে ফেলো”
“ আমি তো , মানে , রাস্তায় ইয়ে করতে পারব না”
“তাহলে আর কি করবে?” মিঃ ডেভিল শ্বাস ছাড়ে, একটু বিরতি নেয়-“ দরজা ধাক্কাও”
“ভাইয়া তো মনিকা আপুকে নিয়ে রুমের ভেতরে। এখন তো ভাইয়া গেট খুলবে না”
“ভালো ঝামেলা”
পিঙ্কু কিছুক্ষণ ইতস্তত করে , তার পর জিজ্ঞাসু চোখে মিঃ ডেভিলের দিকে তাকায়-
“ আচ্ছা মিঃ ডেভিল, তোমার কি মনে হয় ? দরজা আটকে ভাইয়া আর মনিকা আপু করেটা কি?”
মিঃ ডেভিলের মনোযোগ তখন গলির মাঝামাঝি জমিয়ে রাখা আবর্জনার স্তুপের ওপর। তার এক কোনায় কি একটা যেন নড়ছে। শুকনো হাড়, বাসি আবর্জনা আর চর্বি খেয়ে খেয়ে পেটে চর পড়ে গেছে। অনেকদিন পর জ্যান্ত কিছু শিকার করতে পারলে ভালো লাগবে।


মিঃ ডেভিল দায়সারা গোছের জবাব দেয়-
“ তুমিই বল, তোমার কি মনে হয়?”
পিঙ্কু বসে বসে মাথা চুলকায়। গেট আটকে ভাইয়া আর মনিকা আপু কি করে , তা নিয়ে সে চিন্তা করছে অনেকদিন থেকেই । চিন্তার সুতো মেলে ধরলে তা থেকে কেবল ডালপালা-ই ছড়িয়েছে। কিন্তু কোনও সুতো ধরেই সে নিশ্চিত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে নি। পিঙ্কুর চিন্তাভাবনাগুলি ছিল এইরকম-
১।

রিঙ্কুভাইয়া গেট আটকে মনিকা আপুর সাথে মার্বেল খেলে।
একদম ছোটবেলা থেকেই রিঙ্কু- পিঙ্কু দুইভাইয়ের মার্বেল খেলা খুব প্রিয়। রিঙ্কু বড় হয়ে গেছে বলে এখন আর বাইরে, রাস্তায় মার্বেল খেলতে পারে না। তাই মনিকা আপুকে নিয়ে গেট আটকে ঘরের ভেতর মার্বেল খেলে ।
কিন্তু এটা সত্যি না হবারই সম্ভাবনা বেশী।

পিঙ্কুদের মেঝে সিমেন্টের। আর সিমেন্টের ওপর মার্বেল খেলা খুবই মুশকিল। নিশানা ঠিক রাখা যায় না।
২। রিঙ্কুভাইয়া আর মনিকা আপু মিলে গেট আটকে সিনেমা সিনেমা খেলে।


ছোটবেলায় পিঙ্কু রিঙ্কু দুইভাই মিলে সিনেমা সিনেমা খেলত। রিঙ্কু হতো ভিলেন , পিঙ্কু হিরো। তাদের বালিশগুলোর একটা হত নায়িকা, আর বাকীগুলো রিঙ্কুর সাগরেদ গুন্ডা। রিঙ্কু নায়িকাকে অপহরণ করে নিয়ে যেত, পিঙ্কু গিয়ে ফাইট করে নায়িকা উদ্ধার করত ।
রিঙ্কুভাইয়া হয়ত এই খেলাটাই মনিকা আপুর সাথে খেলে।

পিঙ্কু দেখে ফেললে লজ্জা পেতে হবে, এই কারণেই হয়ত দরজা বন্ধ করে রাখে।
এছাড়া আরও নানারকম ব্যাখ্যা পিঙ্কু দাঁড় করিয়েছে। যেমন- রিঙ্কুভাইয়া আসলে মনিকা আপুর প্রাইভেট টিউটর। পিঙ্কুর সামনে পড়া ভুল করলে মনিকা আপু লজ্জা পাবে , এইকারণে ভাইয়া গেট আটকে দেয়। অথবা গেট আটকে রিঙ্কুভাইয়া আর মনিকা আপু নাচানাচি করে।

অথবা হয়ত কিছুই করে না, চুপচাপ বসে থাকে। মনিকা আপু হয়ত পিঙ্কুকে পছন্দ করে না , তাই রিঙ্কুভাইয়া পিঙ্কুকে ভিতরে ঢুকতে দেয় না। আসল কারণটা যে কি , কে জানে?
মনিকা আপু পিঙ্কুকে পছন্দ করুক বা না করুক , রিঙ্কুভাইয়া যে মনিকা আপুকে অনেক ভালোবাসে, তা পিঙ্কু জানে । রিঙ্কুভাইয়ার একটা মোবাইল ফোন আছে , সেটা দিয়ে সে সারারাত মনিকা আপুর সাথে কথা বলে। কথার টানেই বোঝা যায়, রিঙ্কুভাইয়ার কত ভালবাসা মনিকা আপুর জন্য।


পিঙ্কুর মনোযোগ আবার মিঃ ডেভিলের ওপর ফিরে এলো । মিঃ ডেভিল তার থাবার নীচে একটা আধমরা ইঁদুরের বাচ্চা ধরে রেখেছে। মিঃ ডেভিল কি এখন ইঁদুরটা খাবে ? পিঙ্কু তো জানে যে কেবল বেড়াল-ই ইঁদুর মেরে খায়!
“মিঃ ডেভিল, পেট ব্যাথা করছে” – পিঙ্কু ককিয়ে ওঠে।
মিঃ ডেভিলকে এখন দেখতে খুব কিম্ভূতকিমাকার লাগছে। ইঁদুরটার লেজ কামড়ে ধরে বসে আছে সে ।

ইঁদুর তার মুখ থেকে পেন্ডুলামের মত ঝুলছে ডানে বামে, বামে ডানে , ফের ডানে বামে ।
“ গেট নক করো , পিঙ্কু”
পিঙ্কু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। তার একহাত পেটে। আসলেই তার অনেক পেট ব্যাথা করছে। কোনোমতে হেঁটে সে গেটের কাছে গিয়ে গেটে মৃদু ধাক্কা দেয়-
“ ভাইয়া, গেট খোলো”
সাথে সাথে ভেতর থেকে রিঙ্কুর রাগী গলা ভেসে আসে-
“ বললাম না, দুইটার পর আয় ?”
রিঙ্কুর চিৎকার শুনে পিঙ্কুর পেটব্যাথা আরও বেড়ে যায়।

সে ক্ষীণ স্বরে আবার ডাকতে থাকে-
“ভাইয়া, গেটটা খোলো না”
গেট থেকে কয়েক পা পিছিয়ে আসে পিঙ্কু। সে তার ভাইয়ের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। রিঙ্কু বেশ শব্দ করে গেট খুলে প্রথমে দ্রুত গেটের চারপাশে একটা সাবধানী নজর বুলিয়ে নেয়-
“তোর সমস্যা কি? বললাম না দুটোর পর আসতে?”
রিঙ্কু চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করে। পিঙ্কু অবাক হয়ে যায়। পিঙ্কু লক্ষ্য করেছে, মনিকা আপু থাকা অবস্থায় রিঙ্কুভাইয়ার গলার টোন পুরো চেঞ্জ হয়ে যায়।

ভাইয়া সবসময় একটা টেনশনে থাকে। পিঙ্কুর সাথে দুরব্যাবহার করতে থাকে।
“পেট ব্যাথা ভাইয়া, বাথরুমে যাবো”
রিঙ্কু স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পিঙ্কুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর গেট ছেড়ে সরে দাঁড়ায়-
“ তারাতারি কর”
পিঙ্কু দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। পেছনে রিঙ্কু শব্দ করে গেট আটকে দেয়।


মনিকা আপু খাটের ওপর আসাম গেড়ে বসা। ঝুঁকে বসে কি একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছে। পিঙ্কুকে দেখে সে একটা মিষ্টি হাসি দেয়।
পিঙ্কু তার পেটব্যাথা নিয়েও লাফোমিটারে হিসেব করা শুরু করে। কারো হাসি কি মন থেকে দেয়া , না শুধু সৌজন্য দেখানোর জন্য দেয়া এটা হিসেব করার জন্য পিঙ্কু নিজের মনে মনে একটা হিসেব করার কাল্পনিক ডিভাইস বসিয়ে নিয়েছে।

ডিভাইসটার নাম রেখেছে সে লাফোমিটার।
মনিকা আপুর হাসিকে কত নম্বর দেয়া যায় ?
লাফোমিটারের কাঁটা চল্লিশের ঘরে এসে থেমে যায়। লাফোমিটারের কাঁটায় কেউ আশি না পেলে পিঙ্কু হাসির প্রতিউত্তরে হাসি দেয় না। মনিকা আপুর হাসি ফেল করেছে। তার হাসি মন থেকে দেয়া না।

কিন্তু মনিকা আপুর কেস ভিন্ন , তার হাসির প্রতিউত্তরে পিঙ্কুর হাসতেই হয়। নইলে যদি আবার রিঙ্কুভাইয়া রাগ করে ?
বাথরুমের দরজার সামনে এসে পিঙ্কু থমকে দাঁড়িয়ে যায়। তার বাথরুমের স্যান্ডেল ভেজা! কে ভিজিয়েছে ? রিঙ্কুভাইয়ার একজোড়া আলাদা বাথরুমের স্যান্ডেল আছে। রিঙ্কু ভাইয়া কখনো পিঙ্কুর স্যান্ডেল ভেজায় না । কারণ রিঙ্কুভাইয়া জানে , পিঙ্কু কখনো ভেজা স্যান্ডেল পায়ে বাথরুমে যেতে পারে না।


তবে কি মনিকা আপু ?
পিঙ্কু জোরে চিৎকার দেয়-
“ রিঙ্কুভাইয়া!!!”
রিঙ্কু চিন্তিত মুখে জানালার টেনে দেয়া পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। পিঙ্কুর তীক্ষ্ণ চিৎকারের সাথে সাথে সে ঘুরে পিঙ্কুর দিকে তাকায়-
“ কি হয়েছে?”
“ আমার জুতা ভেজা কেনো ? এখন আমি বাথরুমে যাবো কি পায়ে দিয়ে ?”
পিঙ্কু খেয়াল করে , মনিকা আপু হচকচিয়ে উঠেছে । রিঙ্কু-পিঙ্কুর জুতো বিভাজন নীতি অথবা ভেজা জুতো পরে বাথরুমে যাবার অপারগতার ব্যাপারে সে কিছুই জানতো না আগে থেকে । রিঙ্কু পিঙ্কুকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে-
“ আমার জোড়া পায় দিয়ে যা , ওটা তো ভেজা না”
“ না , তোমার জুতা পড়বো না। এগুলি অনেক বড়।

আমার পা থেকে খুলে যায়”
রিঙ্কু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। মনিকার চলে যাবার সময় কাছিয়ে আসছে। সে পিঙ্কুকে হালকা ধাক্কা দেয়-
“ যা , আমি বলছি, আমার জুতো পরে যা আজকের মত”
রিঙ্কুভাইয়ার রাগীরুপ দেখে পিঙ্কু বড়সাইজের জুতোজোড়া পায়ে গলিয়ে বাথরুমে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে পিঙ্কু আবার থেমে যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্ক বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে- “দুই যোগ দুই সমান চার”- এই লজিক মেনে কাজ করে।

কিন্তু শিশুমস্তিষ্ক মাঝেমাঝেই প্রচলিত যুক্তিবিদ্যার ধার না ধেরেই কাজ করে বসে। হঠাৎ করে এমন কিছু বলে বা করে বসে , যা বলার বা করার আগে একজন বয়স্ক মানুষ একশো বার ভেবে নিত ।
রিঙ্কুও বুঝতে পারলো না, কেনো তার গার্লফ্রেন্ডের সামনে দাঁড়িয়ে তার ছোটভাই বলে উঠলো-
“ উঁহু , বাথরুমে যাবো না। বাথরুমে গন্ধ !”
রিঙ্কু বজ্রাহত হয়ে যায়। খুব কষ্ট করে ঘুরে তাকায় মনিকার দিকে।


গল্প-কবিতায় অপমানে নীল হয়ে যাবার যে কথা আমরা হররোজ গল্প কবিতায় পড়ি , তা সত্যি হলে এতক্ষণে মণিকার মুখ আসলেই গাঢ়নীল রঙে পরিবর্তন হয়ে যেতো । মনিকা মাথা নিচু করে বসে থাকে এক মুহূর্ত, তারপরেই খাট থেকে নিজের ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে হাঁটা দেয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রিঙ্কু আচমকা সম্বিত ফিরে পায়। প্রায় ছুটে গিয়ে দরজা আগলে দাঁড়ায়-
“ মনিকা, যেও না প্লিজ, থামো!”
মনিকা রিঙ্কুর হাত থেকে ছুটতে রীতিমত ধস্তাধস্তি করতে থাকে।
“ মনিকা , ও ছোটো।

কথা গুছিয়ে বলতে পাড়ে না। কোথায় কি বলতে হয় না বলতে হয় – তার ধারণা এখনো ওর ঠিক হয় নি। ”
মনিকা কিছুটা শান্ত হয়। রিঙ্কু হাত ধরে টেনে এনে মনিকাকে খাটে বসিয়ে দেয়।
পিঙ্কু এর মধ্যে দেখছে , বাথরুমের দরজার পেছনে একটা ইঁদুর মরে পরে আছে।

ভয়ানক ভুল করে ফেলেছে ও। ওর মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্ক না হলেও ও ঠিক বুঝতে পারে, গড়বড় হয়ে গেছে বিশাল বড়। এখন ?
“ঠাশ” – চড়ের আওয়াজ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে । পিঙ্কু ছিটকে গিয়ে বাথরুমের দরজার ওপর পড়ে । এক ফোঁটা – দুই ফোঁটা , পড়ে ফোয়ারার মত পানি ঝরতে থাকে পিঙ্কুর চোখ থেকে।


তীব্র ক্রোধে রিঙ্কুর বুক হাপরের মত ওঠানামা করছিলো। কনুই খিমচে ধরে সে পিঙ্কুর-
“ যা , বের হ ! বাইরে যা !”
পিঙ্কু ঝটকা দিয়ে হাত ছুটিয়ে এক দৌড়ে বাইরে চলে আসে। সিঁড়িতে বসে অঝরে কাঁদতে থাকে । তার ছোট্ট জীবনে আগে তাকে এত বড় অপমান কখনো সইতে হয় নি।
“ কাদছ কেনো ? রিঙ্কু তোমাকে বাথরুমে যেতে দেয় নি?” বেশ কিছুক্ষণ পর মিঃ ডেভিলের গলা শুনে পিঙ্কু মুখ তুলে তাকায়।

মিঃ ডেভিল সামনের দু পায়ের ওপর মুখ রেখে শুয়ে আছে। হঠাৎ করে কি হল কে জানে, মিঃ ডেভিল লাফ দিয়ে উঠে তার লেজের গোড়ার দিকটা কামড়ে ধরার জন্য অদ্ভুত কসরত করা শুরু করলো!
পিঙ্কু বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে মিঃ ডেভিলের দিকে তাকায়। মিঃ ডেভিলের শরীরের অর্ধেক লোম-ই নাই হয়ে গেছে। উকুন বোধহয় অনেক।
পিঙ্কু সিঁড়িঘর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ায়।

সরু গলির ওপর এক চিলতে আকাশ। তাতে বেশ কয়েকটা রঙিন ঘুড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা ঘুড়ি পাশের গলির আরিফের। আরিফের ঘুড়ি আলাদা ভাবে অর্ডার দিয়ে বানানো, তাই দেখলেই চেনা যায়। আরিফ বাড়িওয়ালার ছেলে।

ওর ঘুড়ির কোনও অভাব নেই। সাকরাইনের আগে ওর ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা লাগিয়ে দিলে ও পাড়ার ছেলেপেলেদের এমনিতেই দুএকটা ঘুড়ি দিয়ে দেয়। গেল বছর পিঙ্কু সারাদিন ধরে আরিফের সুতোয় মাঞ্জা লাগানোর পর ওকে আরিফ গাঢ় গোলাপি রঙের একটা ঘুড়ি দিয়েছিলো। সেটা এত পছন্দ হয়েছিল পিঙ্কুর যে সাকরাইনের আগের রাতে সে ঘুড়ি নিয়ে ঘুমুতে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখে , পায়ের নীচে চাপা পড়ে ঘুড়ি গেছে ছিঁড়ে।


পিঙ্কু মনে মনে হিসেব করে - আগামি কাল এক শুক্রবার, তারপরের শুক্রবার হচ্ছে সাকরাইন । তাহলে হাতে আছে মোট সাত দিন । এই সাত দিনে কি সে দশটাকার মত জমাতে পারবে ? তাহলেই তো দুটো ঘুড়ি কেনার টাকা হয়ে যায়! অথবা আরও একটুখানিক কষ্ট করে যদি আর দু টাকা জমাতে পারে, তাহলে বারোটাকায় তিনটা ঘুড়ি-ই কিনে ফেলতে পারে ও! ঘুড়িবিক্রেতা ডব্লিউ মামার সাথে রিঙ্কুভাইয়ার ভালো খাতির আছে । রিঙ্কুভাইয়া বললেই ডব্লিউ মামা বারো টাকায় তিনটা ঘুড়ি দেবে। কিন্তু নাহ, বেঁকে বসলো পিঙ্কু ।

রিঙ্কুভাইয়াকে তো বলা যাবে না। রিঙ্কুভাইয়ার সাথে ও কথাই বলবে না আর কখনো জীবনে।
ঠোঁট গোল করে শিষ দিতে দিতে পিঙ্কু পকেট থেকে কিছু মার্বেল বের করে মাটিতে ছড়িয়ে দেয়। মাটির মধ্যে গোল গর্ত করে ক্যাপি করা আছে। সেটার মধ্যে মার্বেল ফেলার চেষ্টা করতে থাকে।


পরক্ষনেই ওর মন আবার খারাপ হয়ে যায়। সুতো? মাঞ্জা দেয়া সুতো সে কই পাবে? সুতো কেনার জন্য তো কোনো টাকা তো নেই তার।
“দূর ছাই”- হতাশ হয়ে পিঙ্কু আবার মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। সুতোর কথা আগেই ভাবা উচিত ছিল। তাহলে আর এতক্ষণ ঘুড়ি কেনা নিয়ে লম্বালম্বা স্বপ্ন দেখাঁ হত না।

কপালে আছেই আরিফের হয়ে বেগার খাটা। তাই খাটতে হবে, কি আর করা। এবার সাথে একটু সুতো-ও চেয়ে নিতে হবে সাথে।
হঠাৎ ঠং করে পিঙ্কুর দৃষ্টি আটকে যায় তাদের গলির মাথায়। ছাইরঙ্গা সাফারি পড়া , চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা – ওটা বাবা না ?
দুর্গাপূজোর সময় ঢাকির ঢাক যে ছন্দে বাজে – তীব্র উৎকণ্ঠায় পিঙ্কুর হৃদপিণ্ড প্রায় গলার কাছে উঠে এসে সেই একই লয়ে ধড়াস ধড়াস শব্দ করতে থাকে।

পিঙ্কু চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গেলে। কপাল থেকে ঘামের স্রোত নেমে আসে শীতের দিনেও।
রিঙ্কু ভাইয়া তাকে পই পই করে বলে দিয়েছে, মনিকা আপু থাকা অবস্থায় বাবার ছায়াও যদি তাদের বাড়ির আসে পাশে দেখা যায় তবে যেন যত দ্রুত সম্ভব তাকে জানানো হয়।
বাবা দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে আসছেন। এখন আর রিঙ্কুভাইয়া কে ডাক দিতে গিয়েও লাভ নেই -পিঙ্কু ভাবে।

কারণ, হাতে সময় নেই। গেট খুলে রিঙ্কুভাইয়া আর মনিকা আপু বের হবা মাত্র বাবার সামনে পড়বে। তারপর... তারপর যে কি হবে তা ভাবতে আর সাহস হয় না পিঙ্কুর।
একি? বাবা কি মাংসের দোকানের সামনে থেমে গেলেন? হ্যাঁ , তাইতো মনে হচ্ছে! ঝুলিয়ে রাখা মাংসের দিকে ইশারা করে দরদাম করছেন। বাবা মাংস কিনলে তো হাতে আরও দুই-তিন মিনিট সময় পাওয়া গেলো।


পিঙ্কু লাফ দিয়ে উঠে দরজা ধাক্কা দিতে গিয়েও হঠাৎ থেমে যায়!
পিঙ্কুর বুকের কাছে ক্ষোভ দলা পাকিয়ে উঠে কণ্ঠে এসে জমা হয়। পিঙ্কু আবার কষ্ট করে ঢোক গেলে।
কিছুক্ষণ আগে ভাইয়া তাকে মনিকা আপুর সামনে চড় মেরেছে। ব্যাথায় তার বাম কান এখনো ঝিঁঝিঁ করছে। ব্যাথাটা বড় নয় , এতবড় একটা ছেলে পিঙ্কুকে যে তিনি তার বান্ধবীর সামনে চড় মারলেন- এটা কি তার ঠিক হয়েছে ? এরকম অপমান পিঙ্কুকে তার জীবনে কখনোই সইতে হয় নি।

পিঙ্কুর কি আত্মমর্যাদা বোধ নেই? বেশ হবে! বাবা আসবে , সব দেখবে , ঘাড় ধরে রাস্তায় টেনে আনবে রিঙ্কু ভাইয়াকে। দেবে সবার সামনে মার।
মনিকা আপুর যে কি হবে , সেটা পিঙ্কু বুঝতে পারছে না। হয়তো সে ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে। বাবা তখন তাকেও ধরে এনে পিটুনি দেবেন।

কত্তবড় সাহস!! পিঙ্কুর জুতো ভেজায়!!
পিঙ্কু সিঁড়িতে ধুপ করে বসে পড়ে। সে জানাবে না রিঙ্কুভাইয়াকে বাবার কথা। জীবনে আজ প্রথমবারের মত তার নিজেকে ব্যাপক ক্ষমতাবান মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে আজ রিঙ্কুভাইয়ার ভাগ্য পুরোপুরি তার হাতে বাঁধা!
“ পিঙ্কু, ঠিক করছ না ! ওঠো , উঠে গেট নক করো। রিঙ্কুকে বলে দাও যে তোমাদের বাবা এসেছেন”
পিঙ্কু খেয়াল করে , মিঃ ডেভিল স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।


“না না না!! বলব না!”
“ পিঙ্কু, এটা জেদ দেখানোর সময় না। যাও, ছুটে গিয়ে রিঙ্কুকে বল যে তোমাদের বাবা এসেছেন”
“ বলব না। বেশ ভালো হবে। বাবা রিঙ্কুভাইয়াকে ঐ মেয়ের সাথে দেখবেন। তারপর দেবেন রাম ধোলাই! বেশ হবে! রিঙ্কুভাইয়া আমাকে মারল কেন তাহলে?”
“ পিঙ্কু! রিঙ্কু তোমার ভাই, ওকে সবার সামনে তোমার বাবা মারলে তোমার তা দেখতে অনেক ভালো লাগবে?”
এ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.