আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ই-গর্ভমেন্ট মাস্টার প্ল্যান কেন প্রয়োজন?

"ধর্মীয় কুসংস্কারে যারা আবদ্ধ তারা সব সময়েই দরিদ্র থাকে। "

মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন
কোন কঠিন বা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য অর্জন/বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সর্বাঙ্গীণ দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল/পরিকল্পনা গ্রহণকরার নামই হচ্ছে মাস্টার প্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা। বিশেষত দীর্ঘদিন অভ্যস্থ একটি প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন ব্যবস্থা (ই-গর্ভমেন্ট বা ডিজিটাল সরকার) গ্রহণের মানসিক প্রস্তুতি ও সদিচ্ছা একান্ত অপরিহার্য। অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাসহ সার্বিক কার্যক্রমকে গতিশীল তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের নাগরিক সনদ অনুযায়ী ভোক্তাদের দোরগোড়ায় সরকারের সেবা পৌছে দেয়া আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মানের পূর্বশর্ত। মানসিক প্রস্তুতি ও সদিচ্ছা বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল (মাস্টার প্ল্যান)।

উদাহরণ হিসেবে আমরা সিঙ্গাপুরের কথা বিবেচনা করতে পারি। আশিরদশকের প্রথমদিকে ই-গর্ভমেন্ট মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের কাজ (৪টি ধাপে) হাতে নিয়েছিল সিঙ্গাপুর সরকার যা এখনো চলমান রয়েছে। ই-গর্ভমেন্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক দুর এগিয়েছে সিঙ্গাপুর। তথাপি দেশটি এখনো পর্যন্ত নিজেদেরকে তথ্য-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ আধুনিক তথা ডিজিটার সিঙ্গাপুর দাবী করছেনা। ই-গর্ভমেন্ট মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের সফলতা হিসেবে সিঙ্গাপুর ২০১৫ সাল নাগাদ (Building on the success of the earlier e-Government master plans, eGov2015 will witness a shift from a "Government-to-You" approach to a "Government-with-You" approach) তাদের কঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাবে বলে আশা করছে।



“তথ্য-প্রযুক্তি” বান্ধব বর্তমান সরকার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনপূর্ব “শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ” শ্লোগনসহ নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৪ ঘোষণা করে। সম্মানীত পাঠকগণের জ্ঞাতার্থে ইশতেহারের ১০ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক অংশটুকু হুবহু তুলে ধরা হলোঃ ১০.১: আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা, দ্রুত নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রেক্ষিতে কৃষি জমি ও জলাশয়ের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ প্রতিটি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নকে (আরএনডি) সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবিষ্কার, প্রযুক্তি ও মানবজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে রাষ্ট্র ও সরকার বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের বিশেষ মর্যাদা দান, তাদের চাকরির বয়সসীমা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা এমন পর্যায়ে আনা হবে যাতে তারা আরাধ্য গবেষণা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করতে পারেন এবং নতুন নতুন আবিষ্কারে আত্মনিবেদন করতে পারেন। ১০.২: বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা এবং পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন ও হালনাগাদ করা হবে।

মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরে আইটি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার এবং ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারিত করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন দ্রুততর করা হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার করা হবে। সফটওয়্যার শিল্পের প্রসার, আইটি সার্ভিসের বিকাশ, দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনকুবেটর এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন এসব কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।

একই সঙ্গে আউট সোর্সিং ও সফটওয়্যার রপ্তানি ক্ষেত্রে সকল প্রকারের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। ১০.৩: দেশজুড়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা যেমন থ্রি-জি চালু হয়েছে। ফোরজি- ও চালু করা হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা হবে।

২০১০ সালে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হয়।

পরবর্তিতে এই বিভাগ দুটিকে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করা হয়। অধুনা (১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন পূর্ণ মন্ত্রী ও একইসাথে একজন প্রতিমন্ত্রীকে দায়ীত্ব দেয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গিকারের প্রতিফলন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। প্রথম দিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তব রূপটি কেমন হবে তা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মনে সংশয় ছিল। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

যেখানে কেউ চাইলেও দুর্নীতি করতে স্বক্ষম হবে না। স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতাসহ সার্বিক কার্যক্রম হবে গতিশীল। সরকারের সেবা থাকবে ভোক্তাদের দোরগোড়ায়। তথ্য-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পালেই (সর্বত্র তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমেই) কেবমাত্র এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে যারা সরকার পরিচালনা করছেন (সরকারের সকল পর্যায়ের কর্তাব্যক্তি) তাদের সততা, সদিচ্ছা ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) প্রতি আগ্রহ থাকা আবশ্যক।

যারা মনে-প্রাণে দুর্নীতিগ্রস্ত ও যাদের মধ্যে আইসিটি ভীতি কাজ করে তারা কচ্ছব গতিতে চলতে চাইবেন যা কাম্য নয়। আর তাদের মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন সম্ভর নয়। মনে রাখা দরকার, মোট ভোটারের প্রায় ৭০ শতাংশই হলো তরুন প্রজন্ম। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রযুক্তি বান্ধব নেতৃত্বের সাথেই থাকবেন তরুন প্রজন্ম।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তর/পরিদপ্তরে রাজস্ব খাতে দুই শতাধিক প্রথম শ্রেণীর আইসিটি কর্মকর্তা (সহকারী প্রোগ্রামার/ সহকারী ম্যানটিন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার/ প্রোগ্রামার/ ম্যানটিন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার/ এ্যসিস্টেন্ট সিস্টেম এনালিষ্ট/ সিনিয়র প্রোগ্রামার/ সিস্টেম এনালিষ্ট/ সিনিয়র ম্যানটিন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার/ সিনিয়র সিস্টেম এনালিষ্ট/ প্রিন্সিপাল ম্যানটিন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার/ সিস্টেম ম্যানেজার) কর্মরত আছেন।

এখনো পর্যন্ত এসকল জনবলের জন্য সরকার কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে কোন কর্মপরিধি নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাহীন এই দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন ক্ষমতা নেই। স্ব-স্ব মন্ত্রনালয়/দপ্তরের প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং, আইনগত সংস্কার, ওয়ার্ক-ফ্লো পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে এসকল জনবলের ভূমিকা রাখার তেমন কোন সুযোগ এখনো প্রতিয়মান নয়। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এসকল জনবলের বেতন ভাতা বাবদ সরকারের রাজস্ব খাতের বিপুল ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য আউটপুট সরকার পাচ্ছে না। তাছাড়া স্বতন্ত্র (স্ব-স্ব) মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্মরত থাকায় এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে শূন্য পদগুলো পূরণের কারণে বছরের পর বছর ধরে তাঁরা পদোন্নতির সুযোগ বঞ্চিত।

ফলে এই খাতে বর্তমানে কর্মরত জনবল কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলছে। ফলে সরকারের আইসিটি খাতকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার বিষয়ে ভবিষ্যৎ তরুন প্রজন্মও সন্দিহান। সরকারের সকল আইসিটি জনবলকে আইসিটি মন্ত্রনালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে এনে একটি আইসিটি সার্ভিস গঠনের মাধ্যমে সরকারের আইসিটি খাতকে একটি সম্মানজনক পেশায় পরিণত করে দক্ষ আইসিটি জনবলকে এই খাতে আকৃষ্ট করা প্রয়োজন। যারা হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অগ্রণী সৈনিক ও রক্ষক।

একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার ইলেক্ট্রনিক আন্ত-যোগাযোগ ব্যবস্থা।

এক্ষেত্রে সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের অভ্যন্তরীন প্রয়োজনে আইসিটি সংশ্লিষ্ট কোন উন্নয়ন (সফটওয়ার/হার্ডওয়ার সংশ্লিষ্ট) করে তবে সে প্রতিষ্ঠান হয়তো তাদের নিজস্ব গন্ডির মধ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে, কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আন্ত-যোগাযোগ দূরহ হবে বইকি। এমনকি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি পৃথক-পৃথক ভাবে নিজস্ব ধ্যান-ধারনায় আইসিটি সংশ্লিষ্ট কোন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে তবে সরকারী অর্থের অপচয় হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেমোতাবেক আইসটি মন্ত্রণালয় একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্ণিমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সমন্বয় সাধণের লক্ষ্যে। সে জন্য দরকার ই-গর্ভমেন্ট মাস্টার প্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা। যার মাধ্যমে আমরা সবাই মিলিত হব জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বাস্তবায়নের মহামিছিলে! আর বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ স্থান করে নেবে দুর্নীতিমুক্ত, সভ্য ও আধুনিক ধ্যান ধারনার নব্য সহযাত্রী হিসেবে।



[লেখকঃ মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা। ই-মেইলঃ ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।