এক
চলার পথের এক আধলা ইঁটে হোচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিয়েই সে তার কাঁধের উপর খসে পড়া আঁচল আবার টেনে নিয়ে মাথায় দেয়। চৈত্র মাসের দুপুর। খাঁ খাঁ করছে চারিদিক। তার গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে আছে। সে ভাবে কোথাও একটু বসতে পারলে ভাল হতো।
সেই সাথে একটু ঠান্ডা পানি। আর তার সাথে যদি একটু ভাত পাওয়া যেত!গরম ভাত না হোক একটু পান্তা ভাত আর লবন মরিচ। ভাতের কথা মনে আসতেই তার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। গত রাত থেকে পেটে একটা দানাও পড়েনি। এমনিতেই অভুক্ত তার উপর এতটা পথ পায়ে হেঁটে ঝাঁঝালো রৌদ্র মাথায় নিয়ে পথ চলতে গিয়ে তার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসে।
কোথাও যে বসে জিরিয়ে নেবে তার উপায় নেই। সারাক্ষনই মনে হচ্ছে যেন পিছু পিছু কেউ তাড়া করে আসছে। রাস্তার পাশে বাড়ির সামনে একটা টিউবয়েল দেখতে পেয়ে সে এগিয়ে যায়। কিছুটা পানি খেয়ে হাত মুখে আর মাথায় পানি দিয়ে সে আঁচল দিয়ে গা মুছে নেয়। টিউবয়েলের কাছেই একটা মাঝারি কাঁঠাল গাছ ছড়িয়ে রেখেছে শীতল ছায়া।
তার ডালে কয়েকটি শালিক মনের আনন্দে কিচিরমিচির করছে। গাছের শীতল ছায়া তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে একটু জিরিয়ে নেও্য়ারর জন্য। বাড়িটার ছাঁদ থেকে একযোগে একরাশ পায়রা ডানা ঝাপটে আকাশে উড়াল দেয়। সে আকাশে দিকে তাকাতেই সুর্য যেন একঝাঁক রোদের বর্শা ছুড়ে তার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে তার তাই একবার ভাবে এই বাড়ির মানুষের কাছে কিছু খাবার চেয়ে নেবে কিনা।
পরক্ষনেই তার মনে হয় সে তো ভিক্ষুক নয়। তাই গা ঝাড়া দিয়ে আবার উঠে পড়ে। এখনো অনেক পথ বাঁকি। যত তারাতারি পৌঁছানো যায় ততই ভাল।
দুই
গ্রামের নামটি পলাশপুর।
গ্রামের মাঝ দিয়ে পাকা সড়ক চলে গেছে বরাবর গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে। সড়কের দুইপাশে কাঁচা,পাকা,আধাপাকা সব বসত বাড়ি। সড়ক শুধু নামেই পাকা। বহু বছরের অত্যাচারের ফলে আর সংষ্কারের অভাবে জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে বসন্ত রোগীর মুখের মত চেহারা ধারন করেছে। হবেই বা না কেন।
এটিই শহরের সাথে যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে বাস চলে না বটে কিন্ত অন্যসব যানবাহন এমনকি গরু মহিষের গাড়ি পর্যন্ত চলে। এই গ্রামে সড়কের একধারে বসত বাড়ির পরেই বিস্তীর্ন ফসলের মাঠ আর অন্যধারে বসতবাড়ি শেষ হলেই গভীর খাল আর খাল পাড় হলেই অন্য গ্রাম। এই গ্রামের মানুষজন বেশি সুখিও না আবার খুব অসুখিও না। এখানে দিন কাটে দিনের মত কিন্ত কেউ তার খবর রাখে না।
মানুষ তার আপন গতিতে কাজকর্ম করে। জীবনের অমিত প্রবাহ যেন এখানে এসে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়েছে। জীবন এখানে নিস্তরঙ্গ বেশিরভাগ সময়েই। শুধু মাঝে মাঝে জন্ম মৃত্যু বিয়ের মত জিনিসগুলো মানুষের জীবনে ঢেউ তোলে। তারপর সেই ঢেউএর দোলা থেমে গেলেই সব একেবারে আগের মত।
তবে হঠাত হঠাত দুই একটি অন্যরকম ঘটনা মানুষগুলোকে ভীষন নাড়া দেয়। তখন কিছুদিন তারা দলে দলে জটলা করে আর আলোচনা করে। সেই আলোচনাও এক দেখার মত বিষয়। একটা জিনিসকে যে কত দৃষ্টিতে দেখা যায় আর কত রকম করে ব্যাখ্যা করা যায় তা এই গ্রাম্য আলোচনা না শুনলে কেউ বুঝবে না। এছাড়া ঘটনা নিয়ে নানারকম অনুমান নির্ভর গল্প আর গুজব তো আছেই।
এক কথায় একটা অস্বাভাবিক ঘটনা গ্রামে যেন একটা উতসবের আমেজ তৈরী করে। বেনু এক চৈত্রের বিকালে খালি পায়ে একটা পরনের আটপৌরে শাড়ি আর আঁচলে বাঁধা চব্বিশটি টাকা সম্বল করে শশুর বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পালিয়ে এসে গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে বেশ জোরালো একটা ঢেউ বইয়ে দিল।
সে যখন সড়ক দিয়ে গ্রামে এসে ঢুকল তখন তাকে কেউ লক্ষ্য করেনি। গ্রামের রাস্তায় সাধারন ছাপা সুতির শাড়ি পড়া ঘোমটা দেয়া মহিলাকে আলাদা করে খেয়াল করার আসলে কিছু নেই। ক্লান্ত পায়ে সে যখন তার বাপের বাড়িতে ঢুকল তখন তার মা মাটির দাওয়ায় বসে কলিমের দাদির সাথে গল্প করছে আর শাক বেছে বেছে ঝুড়িতে রাখছে।
বেনু মাকে দেখে থমকে দাঁড়ায় আর ভাবে এক আশ্রয় ছেড়ে সে আর এক আশ্রয়ে এসেছে, এখানে কি টিকতে পারবে না যেতে হবে অন্য কোথাও। মাথায় কাপড় থাকায় তার মা প্রথমে তাকে চিনতে পারেনা। বলে ওঠে,কিডা গো?কিডা দাঁড়া রইছে অই জাগা?বেনু মাথার আঁচল সরিয়ে জবাব দেয়,আমি বেনু। ওর মা হতবাক হয়ে মেয়ের মুখের পানে চেয়ে থাকে। কি মেয়ে কি হয়েছে।
শ্যামলা রঙ হয়েছে কুচকুচে কালো। বাইম মাছের মত পুষ্ট চকচকে শরীর হয়েছে শুকনো খড়ির মত। পড়নের কাপড়খানি ময়লা,তেলহীন চুল যেন পাটের আঁশ। মা মেয়ের দিকে তাকিয়েই যেন অনেক কিছু বুঝে যায়। নরম গলায় বলে,আয় এখেনে বস।
বেনু দাওয়ার বাঁশের খুটি ঘেষে বসে পড়ে। বেনুর মা উঠে যায় মেয়ের ভাতের ব্যবস্থা করতে। কলিমের দাদি এতক্ষন তাকে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছিল এবার সে জিগাসা করে,
কিরে বেনু কোন থে আইলি এমুন ভুতের লাহান মুখ কইরি?তোর ছাওয়াল মিয়া কোনে?মার বাড়ি আইছিস তো একখেন ভাল শাড়িও পইড়ি আসতি পারিসনি?
মলিন মুখ করে বেনু জবাব দেয়,আমি কি আর মানুষ দাদি?আমি হলাম গিয়ে ভুতেরও অধম। স্বামীর বাড়ি থি চইলি আইছি। ছাওয়াল মিয়া কি আমার দাদি যে আনব।
সবই তারে। খালি আমিই হলাম গিয়ে পর। তাই আমার উপরই সব অইত্যাচার। জানে আর সইয্য হয় না তাই চইলি আলাম সব লাত্থি মাইরি। এখন তুমরা যদি আশ্রয় না দেও তো আমার গলায় দড়ি দিতি হবি।
কলিমের দাদি বলে,ধুর পাগল। সংসার করতি গেলি কতরকম কিছু হয়। তাই বইলি কি ঘর ছাইড়ি চইলি আসা যায় নাকি গলায় দড়ি দেওয়া যায়?একটু ধইয্য সইয্য কইরে না থাকলি কি সংসার করা যায়?
বেনুর চোখে এবার অশ্রু দেখা দেয়,সে বলে, সইয্য কি কম করিছি?সেই যে ছোটকালে বিয়ে হইল তারপর কত মাইর খালাম কত কথা শুনলাম তাও ঘর ছাড়িনি। শাউড়ি বিয়ে হয়ে পরযন্ত কোনোদিন একটু মুখের মিষ্টি কথা বইললো না। সেবা যতন তো কম করিনি তারে।
তিন তিনডা সন্তান জন্ম দিছি। তাও বাড়ির কোনো জিনিসের উপর একটা অধিকার পালাম না। এখন তো শাউড়ি মারে ,ননদ মারে, ভাতারও মারে। ঠিক মত ভাত খাতি দেয় না। আমার প্যাটের মিয়াও হইছে আমার শত্তুর।
দেখ দুইডা পাকা কলা লুকায়ে খাইছিলাম বইলি ওর দাদি আর বাপেক কয়ে দিয়ে কি মাইর আমাক খাওয়াইছে। ওর বাপ আমার বাপমা তুইলি গাল দিয়ে চুলের মুঠি ধইরি কত লাত্থাইছে। কাইল রাইত থে খাতি দিই নি আবার বিড়ির আগুন দিয়ে গায়ে ছ্যাঁকা দিছে। রিনা কাপড় তুলে পেটের কাছে দগদগে ক্ষত দেখায় আর বলে। এবার কউ দাদি আর কতদিন এমুন সইয্য করা যায়।
আগে গতরে জোর ছিল মাইর খাইয়ে হজম করতি পারতাম এখন আর সইয্য করতি পারি নে।
বেনুর মা চুলায় ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে এসে মেয়ের কথা শুনছিল। মেয়ের গায়ে স্বামীর অত্যাচারের চিহ্ন দেখে সে আর চোখের পানি সামলাতে পারে না। নিজের পেটের মেয়ে না হোক বিয়ের পর কোলে পিঠে করে মা মরা মেয়েটাকে তো সেই মানুষ করেছে। দাদি বুড়ির চোখেও পানি আসে।
সে বিড় বিড় করে বেনুর পাষন্ড স্বামী,শাশুড়িকে অভিশাপ দিতে থাকে। বেনুর বড় ইচ্ছা হয় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে চিতকার করে কেঁদে ভাসাতে যেন অশ্রুর বন্যায় তার দু;খ অর্ধেক কমে যায়। কিন্ত সে তা করতে পারে না। কম তো কাঁদেনি সে। কই কষ্ট কমলো কই।
এ পাষান ভার এত সহজে কমার নয় তা সে জানে। এখানে সবাই পোড় খাওয়া মানুষ। তারা জীবনে বহু দুঃখ কষ্ট দেখেছে,সয়েছে তাই আবেগের অতিশয্য দেখায় না কেউ,কেউ শান্তনা দিয়ে আলিঙ্গন করে না। শুধু তার মা ট্রাঙ্ক থেকে একটা ধোয়া সুতির শাড়ি বের করে তার হাতে দিয়ে পুকুর থেকে গোসল করে আসতে বলে।
বেনুর মা তড়িঘড়ি করে ভাত রেঁধে একটা হাঁসের ডিম ভেজে দেয়।
দুপুরের ডাল দিয়ে মেয়ে তাই গোগ্রাসে খেয়ে উঠে। বেনুর মায়ের বড় মায়া হয় কিন্ত মনে মনে একটা দুর্ভাবনাও তাকে পেয়ে বসে। সংসারে একটা মুখ বাড়লে তো টানাটানি পড়ে যাবে, সে ভাবে। বেনুর বাপ মরে যাওয়ার পর বহু কষ্টে টেনেটুনে সে সংসার চালাচ্ছে। তার দুটি ছেলে মেয়ে।
ছেলে তাও কামলা খেটে আর এটা সেটা করে কিছু আয় করে। ১৪ বছরের ছেলে আর কতই বা করবে। অল্প যেটুকু জমি আছে তার ধান দিয়ে বছর পা্র হয় না। মেয়ে স্কুলে যায় আর বাড়ির কাজ করে। সে নিজে মাঝে মাঝে এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে তবেই সংসারে সবার মুখে ভাত আসে।
যাই হোক ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে এই ভরসায় সে নিজেকে দেওয়ার চেষ্টা করে। হয়ত জামাই এসে সব মিটমাট করে বউ নিয়ে যাবে। আর যদি না যায় তো কিছু একটা করে দিন কেটে যাবে কিন্ত অসহায় মেয়েটাকে রাস্তায় তো ফেলে দেয়া যাবে না।
পলাশপুর গ্রামের শুরুর দিকে সব উচ্চ আয়ের মানুষের বাস। আর নিম্ন আয়ের লোকেরা বাস করে গ্রামের শেষ ভাগে।
এই অংশে অল্প জায়গায় গায়ে গায়ে লাগা ছোট ছোট ঘর। বেশিরভাগই মাটির কিংবা বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দেয়া। টিনের বাড়ি তেমন একটা নেই,যেমন নেই পাকা দালান। শুধু দু একটা ইঁটের গাথুনি দেয়া ঘর মাথায় টিনের চাল নিয়ে প্লাস্টারের অভাবে দাঁত ভেংচে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে কেউ প্রবেশ করলে দেখতে পাবে সংকীর্ন উঠান ঘিরে নানা আকারের ঘর তার পাশেই গোয়াল কিংবা রান্নাঘর।
একটু পেছনে গেলেই হয়ত পাওয়া যাবে ছোট পুকুর বা এঁদো ডোবা। উঠানের একধারেই হয়ত মাটির চুলা বানিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করেছে কেউ কেউ। এটুকু জায়গায় অনেক মানুষের বাস তাই চলতে ফিরতে এটা ওটা নিয়ে অষ্টপ্রহর কলহ লেগে থাকে শরীকদের মধ্যে। কলহ মানেই জঘন্য খিস্তি আর গালাগালি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তবেই পেটের ভাত জোগায় এসব লোক তাই জীবনের হিসাব এখানে সরল।
মেজাজ খারাপ হলে এখানে কেউ ভদ্রতার ধার ধারেনা,হয়ত হাতই তুলে বসে অন্যের গায়ে আবার তারাই বিপদে পড়লে তা্দের সাহায্যে ছুটে যেতে এক মুহুর্ত দ্বিধা করেনা।
বেনু গ্রামের এই অংশের বাসিন্দা। চার বছর বয়েসে যখন সে মাকে হারালো তারপরই বাবা আরেকটা বিয়ে করল। বলতে গেলে সে তার সৎ মায়ের হাতেই মানুষ হয়েছে। সৎ মা ছোটকালে কিছুটা যত্ন করলেও সৎ ভাইবোনের জন্মের পর টান পড়েছিল তাতে।
সে এ বিষয়ে খুশিও ছিল না আবার অখুশি ছিল না। বেশ খেয়ে পড়ে দিন কেটে যাচ্ছিল তাতেই সে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্ত তার আপন বড় বোন খাদিজার বিয়ের বছরই বেনুর বাবার মৃত্যু হয়। তখন বেনু কেবল বারো পেরিয়ে তেরোতে পড়েছে। তারপর চৌদ্দ না পেরোতেই বাবার বাড়ির পাট চুকিয়ে দিয়ে ভিন গাঁয়ে তার বিয়ে হয়ে গেল।
এখন তার বয়স সাতাশ বা আটাশ হবে। লম্বা আর পুরুষ্ট দেহের গঠন তার। মুখ খানি নিটোল,চোখ দুটো টানা টানা। লম্বা চুল কোমর ছাড়িয়েছে। এক খানি ভাল ছাপা শাড়ি পড়িয়ে যদি চুল ছেড়ে তাকে কোনো পুকুর ঘাটে বসিয়ে দেয়া যায় তো দিব্বি সে শিল্পীর ছবি আঁকার সাবজেক্ট হতে পারে বা কোনো কবির কবিতা লেখার প্রেরনা।
ঐ শ্যামলা মুখটি একটু ঘষামাজা করে একটা ভাল শাড়ি আর কিছু সোনার গহনা পড়িয়ে দিলে তাকে ভাল ঘরের বউ হিসাবে বেশ মানিয়ে যাবে। তবে কিনা ভুল করে তার জন্ম হয়েছে নিভৃতপল্লীর নিম্ন আয়ের এক লোকের ঘরে তাই তাকে নিয়ে কেউ কবিতা লিখতে আসেনি বা ঘরের লক্ষী করে শাড়ি গহনায় সাজিয়ে পুজার আসনে বসায়নি। তবে এখনও যে তার নিটোল গড়ন,পুরুষ্ট ঠোট,উজ্জ্বল আঁখি পুরুষের মনে দোলা দেয় তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
বেনুর ফিরে আসার খবর মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলে আসেপাশের বাড়ির বউঝি একে একে তাকে দেখে গেছে। সকলেই তার কাহিনী শুনতে আগ্রহী।
স্বামীর নির্যাতনের কাহিনী বলতে বলতে সে হাঁপিয়ে উঠে তবুও আগ্রহী শ্রোতাকে নিরাশ করে না। সকলের সমবেদনায় তার মনটা ভিজে ওঠে। সে বরাবরই বড় স্নেহের কাঙ্গাল। মায়ের স্নেহ ভাল করে অনুভব করার আগেই তাকে হারিয়েছে। তারপরে থেকেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে তার একটু স্নেহ পাওয়ার আশায়।
বাপটা মরে গেল,বড় বোনটাও তেমন দরদ করেনা তাকে। ভেবেছিল স্বামীর ভালবাসা পাবে সে আশাও মেটেনি। তার এমনই পোড়া কপাল যে পেটের ছেলে মেয়েও আজ নিজের না। মনের ভেতরকার শুন্যতা নিয়েই সে সৎ বোনের বিছানার একধারে শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ধকলের পর অল্প ব্যবধানে দুইবার পেট পুরে খাওয়া হয়েছে তাই কিছুতেই সে তার চোখ খোলা রাখতে পারছে না।
তিন
গ্রামে ফেরার পর প্রায় একমাস কেটে গিয়েছে বেনু এখনও বাপের বাড়িতে আছে। অন্যরা প্রথম প্রথম ভেবেছিল কিছুদিন পরেই তার শশুড়বাড়ির লোক এসে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে নিয়ে যাবে বা মাথা ঠান্ডা হলে সে নিজেই ফিরে যাবে। কিন্ত এই এক মাসে তার কোনো নামগন্ধ দেখা যায়নি। এদিকে বাড়িতে বসে বসে বেনুও অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেছে। কাছেই তার বড় বোনের বাড়ি।
তার একটা ছোট হাঁস মুরগীর খামার আছে তাছাড়াও এটা ওটা কতরকমের ফন্দি করে সে সংসার চালায়। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে সে বোনকে সাহায্য করে কিন্ত তাও মনটা ভাল হয় না। বেনু বুঝতে পারে সৎ মায়ের পরিবারে সে একটা বোঝার মত হয়ে গিয়েছে। প্রথমে তার ক্ষীন আশা ছিল যে ওপক্ষ থেকে কেউ এসে তাকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্ত এই একমাসে বুঝে গেছে তা বোধ হয় আর হবে না।
তার নিজেরও সেখানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা তা সে বুঝতে পারে না। তবে মেয়ে মানুষের ইচ্ছার উপর তো আর দুনিয়া চলে না। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতেই যা কিছু অধিকার মেয়েদের। বাবার বাড়ি তো আর অধিকারের জায়গা না তখন। আর যদি আপন বাপ মা বেঁচে না থাকে তো সৎমা আর ভাইবোনের উপর কি দাবী করা চলে?সৎভাইটা তাকে একেবারেই দেখতে পারে না তা সে ভালই বুঝতে পারে।
প্রথম দিকে কিছু না বললেও এখন সুযোগ পেলেই কথা শোনায়। এই তো সেইদিনকার ছেলে ,বেনুই তো কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। তার কোলে উঠলে আর নামতে চাইতো না। জোর করে নামিয়ে দিলে চিতকার করে সে কি কান্না কাঁদত!মায়ের মারের ভয়ে তাই কোমর ব্যাথা হয়ে গেলেও কোলে করে রাখতে হতো তাকে। সেই ছেলে আজ বাড়ির রুজি রোজগারের দায়ীত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছে।
এখন কত হিসাবি সে!বড়বোন বসে বসে অন্ন ধ্বংস করবে তা আর তার সহ্য হয় না।
বেনু কয়দিন থেকেই ভাবছিল নিজের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। সে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে গ্রামের স্কুলে। তাই দিয়ে যদি একটা চাকরি পাওয়া যেত!কিন্ত এই অজগাঁয়ে মাত্র এইট পাশের বিদ্যা নিয়ে কে তাকে চাকরি দেবে?সে বড় ভাবনায় পড়ে যায়। তাই যখন ফুলির মা তাকে এক বাড়িতে তার কাজে সাহায্য করার জন্য ডাকে তখন সে রাজি হয়ে যায়
।
সেদিন সকালে ফুলির মা তাকে ডেকে বলে, ও বেনু বাড়িত আছিস নাকি?
বেনু ঘর থেকে বের হয়ে এসে জবাব দেয়,আছি। ডাইকছো কি জন্যি?
ফুলির মা বলে,জামোই কি তোক নিতি আসবি না?
বেনু বলে,ক্যা?তারা নিতি আসবি ক্যা?তারে আর বউ দরকার নি। তারে হাউস মিটি গেছে। এখন ডাইকছো ক্যা সেডি কউ।
ফুলির মা বলে,সরকার বাড়িত আইজ মেলা কাম আছে।
একখ্যান কামের লোকের দরকার আমি একা সব সামলাতি পারছিনি। তুই ও চল।
বেনু এই গ্রামেরই মেয়ে। এখানে জন্মেছে,বড় হয়েছে কিন্ত গরীব হলেও কারো বাড়িতে কাজ করেনি। আর ফুলির মা হচ্ছে সরকার বাড়ির বাঁধা কাজের লোক।
বেনুর কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগতে থাকে। ছোটবেলায় সরকার বাড়িতে শিউলী ফুল কুড়াতে যেত মাঝে মাঝে। এখন কাজ করতে যাওয়ার সংকোচ সে কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। ফুলির মা ই একটা ধমক দিয়ে তাকে বের করে আনে।
বাড়িতে ঢুকেই বেনু দেখল আগের তুলনায় সেটা অনেকটা বদলে গেছে।
সে শিউলী গাছটাও আর নেই। এখানে আজ কাজের লোক দরকার পেঁয়াজ বাছার জন্যে। উঠানের একধারে পালা করে রাখা হয়েছে ক্ষেতের পেঁয়াজ। সেগুলোর পাতা কেটে,আলগা খোসা ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। তারপর সেগুলো মাচা ঘরে (গুদাম ঘর) ঠিক জায়গা মত ছড়িয়ে রাখতে হবে।
সারা বছর ধরে সে পেঁয়াজ খাওয়া হবে। বেনু আর ফুলির মা দুইটা বটি নিয়ে কাজে বসে যায়। কাজ শেষ হতে হতে আজ সাঁঝ লেগে যাবে বলেই তাদের মনে হয়।
সরকার বাড়ির কর্তা এবং গৃহিনী দুজনেই গত হয়েছেন দুবছর আগে আটমাসের ব্যবধানে। বাড়িতে এখন তাদের মেজ ছেলে বউ আর দুই মেয়ে নিয়ে থাকেন।
স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে তাই তাদের বেশ স্বচ্ছল পরিবার। মেজ বউ নিজেও রান্নার ফাঁকে ফাঁকে তাদের সাথে কাজ করছিল। কাজ করতে করতেই মেজ বউ বেনুর সম্পর্কে প্রশ্ন করে সব জেনে নিল। আচরন দেখে বেনুর মেজ বউকে বেশ হৃদয়বতী মহিলা বলেই মনে হচ্ছিল। দুপুর হলে মেজবউ তাদের দুজনকেই সিম ভাজি,ডাল আর এত বড় বড় মাছের পিস দিয়ে পেট পুরে ভাত খেতে দিল।
শেষ কবে বড় মাছের পিস দিয়ে ভাত খেয়েছে তা মনে করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হল সে। বউটার রান্নার হাতও খুব ভাল। খুবই তৃপ্তি করে খেয়ে উঠে সে ভাবছিল যে স্বামীর বাড়িতেও মাঝে মাঝে ভাল মাছ আসত বটে কিন্ত তার পাতে এক পিস মাস দিত না দজ্জাল শাশুড়ি। মাঝে মাঝে কত লোভ হতো তার কিন্ত কিছু করার ছিল না চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া। সে সবচেয়ে অবাক হয়ে গেল তখন যখন কাজ শেষে মেজবউ তার হাতে ষাট টাকা আর দুই কেজি পেঁয়াজ ধরিয়ে দিল।
মাত্র আধাবেলা অল্প খাটুনির কাজ করে যদি এতকিছু পাওয়া যায় তাহলে তো ভালই। সে জানে সাধারনত গ্রামে এমন কাজের এত মজুরি দেয়া হয় না। নিমেষেই মেজবউকে তার খুব বেশি ভাল লেগে গেল।
বাড়ি ফেরার পথে ফুলির মা বলে,ভাল কইরি শোন আমার কথা ঐ হারামজাদার মুখে লাত্থি মাইরি আইছিস ভাল হয়ছে কিন্ত এম্মা বাড়িত বইসি থাকিসনি। গতরডা একটু খাটা।
এই গিরামে কামের লোকের আকাল। লোকের বাড়িত কাম কইরি প্যাটের ভাত যুগাতি পারলি এখেনে টিকতি পারবি নাইলে ভাবছিস তোর মা মাগী তোক ভাত দিবি? আর কয়ডা দিন গেলিই দূর দূর কইরি খেদা দিবি। এই বউডা ভাল আছে। এর বাড়িত পিরাই সুময়ই লোক আসে তখন আর আমি একা সামলাতি পারিনি। মাঝে মদ্যি আমার সাথে আইসি কাম করিস।
ভাল খাতি পড়তি পারবি।
বেনু চুপ করে শোনে ফুলির মায়ের কথা। কথাগুলো তার মনে ধরে। একটু চুপ করে থেকে ফুলির মা বলে। এই টাকা কয়ডা সামলায়ে রাখিস।
মনুর হাতে যেন পড়েনা। যে ষাঁড়ের লাহান ছাওয়াল বানাইছে তোর মা,কারোক ভয় করেনা।
বেনু বলে,রাখবোনে। ঐ বাড়িত আর কাজ থাকলি আমাক বইলো।
বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে পেঁয়াজ তুলে দেওয়ার পর মায়ের প্রসন্ন মুখ দেখে বেনু যেন অ্কূল পাথারে একটা কূলের আভাস পায়।
সে একা মানুষ। সে এতিম। কে তার দায়ি্ত্ব নেবে, কে তাকে খাওয়াবে?এভাবে যদি আয় করা যায় তাহলে তো নিজের দায়িত্ব সে নিজেই নিতে পারে। তাহলে আর কারো কালো মুখ দেখতে হয় না। অন্যের বাড়িতে কাজ করতে তার লজ্জা করবে বটে কিন্ত এছাড়া তো আর উপায়ও নাই।
সে তো নিজের বোনের বাড়িতেও কাজ করে দিয়েছে কিন্ত তার বোন তার বদলে একথালা ভাত খেতেও দেয় না সবসময়। তাহলে খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য কাজ করা মন্দ কি?সে নিজেকে বোঝায়। আজ যেন একটা অদ্ভুত সাহসের সঞ্চার হয় বেনুর মনে। তার মনে হয় স্বামীর আশ্রয় ছাড়াও সে ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।