আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: অভিমানের সাতকাহন

মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়| বেঁচে থাকলে বদলায়| কারণে অকারণে বদলায়........ আদ্রিতা গটগট করে হেঁটে তার ভাইয়ার রুমে ঢুকল| তার ভাই, তপু একটা ইয়া মোটা গাত্তাগোত্তা বই খুলে কি যেন পড়ছিল খুব মনোযোগ দিয়ে| আদ্রিতাকে এভাবে হেঁটে আসতে দেখে তার দিকে তাকাল, তবে অবাক হল না| স্নেহের সুরে বলল, "কি রে পাগলী, আজ আবার কার সাথে ঝগড়া করেছিস?" আদ্রিতা জবাব দেয় না| অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে রাখে| তপু আবার বলে, "কি? কথা বলবি না আমার সাথে?" আদ্রিতা এবার কান্না কান্না মুখ করে তপুর দিকে তাকায়| "ভাইয়া, আমি ঠিক করেছি, আমি আত্মহত্যা করব|" এমন ভয়ানক সিদ্ধান্ত শুনে অবাক তো হলই না, আরো কৌতুক ঝড়ে পড়ল তপুর চোখ থেকে| "আচ্ছা, তুই শিওর তো?" "হ্যা|" "ড্যাম শিওর?" "হ্যা, হান্ড্রেট পার্সেন্ট|" তপু কোলের উপর থেকে সংসদ বাংলা অভিধানটা নামিয়ে রেখে ভৎসর্ণা আর স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাল আদ্রিতার দিকে| তার পনের বছরের এই বোনটি ভীষণ অভিমানী| আর হবে না-ই বা কেন? বাবা, মা ভাইয়ার এত্ত আদর পায় সারাদিন! তার নিষ্পাপ অভিমানের ছোট-বড় টুকরোগুলো প্রায়ই নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের মতো ফুঁসে ওঠে, পরক্ষণেই আবার মেনি বিড়ালের মতো চুপটি মেরে কোল ঘেঁষে বসে আদরের জন্য নাক ঘষতে থাকে| এত আদরের মাখামাখি বলেই হয়তো তার আদরের সাথে মিলিয়ে আদ্রিতা নামটা রাখা হয়েছে| "তো তুই কিভাবে মরবি ঠিক করলি? ছাদ থেকে লাফ দিবি? না গলায় দড়ি দিবি?" আদ্রিতার ভীষণ কান্না পেল| ভাইয়াটা একবার জানতেও চাইল না কেন সে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে? ভাইয়া এত বদ হল কিভাবে? আগে তো এমন ছিল না! নিশ্চয়ই পাশের বাসার সায়মা আপুর সাথে মাখামাখি করতে গিয়ে এমন হয়েছে| পেত্নী একটা! ভাইয়ার সাথে সায়মা আপুর এত কিসের ভাব সে বোঝে না| আদ্রিতা ভাইয়ার কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল| তার বয়সটাই এমন| কারণে অকারণে আত্মহত্যা করতে মন চায়| এই তো সেদিন যখন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ঘরে এল, ভেবেছিল মা একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, "আদ্রিতা মামণির কি হয়েছে? মুখটা এত শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?" এমন কিছুই হল না| মা তাকে প্রচন্ড বকুনী দিল- "এত্ত বড় ধিঙ্গী মেয়ে, ক'দিন পর মেট্রিক দেবে, এখনো বৃষ্টি দেখলে ধেই ধেই করে নাচে! তুমি কি এখনো বাচ্চা আছো আদ্রিতা? যে হুটহাট করে যখন তখন অসুখ বাঁধিয়ে ফেলবে? তোমার টেস্ট পরীক্ষা সামনে, আজ বৃষ্টিতে না ভিজলে হত না?" আদ্রিতা অভিমানে ফুলে উঠল| মনে মনে নিজের মৃত্যু কামনা করল| তার আজকাল কথায় কথায় মরে যেতে ইচ্ছে হয়| মৃত্যু যেন প্রজাপতির ডানায় ভর দিয়ে তাকে যখন তখন ছুঁয়ে দিতে চায়| মৃত্যুর কথা ভাবলেই এক ধরণের রোমাঞ্চ হয় আদ্রিতার| সে ভাবার চেষ্টা করে সে মারা গেলে কার কি প্রতিক্রিয়া হবে| ভাইয়াটা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাবে! রাস্তায় বসে বসে দিনের বেলায় আকাশের তারা গুনবে আর বলবে, "পাগলী, তুই কোন তারায় থাকিস?" আব্বুটা হয়তো বেশ কয়েকদিন চুপচাপ থাকবে| তারপর বাইরে বাইরে দেখাবে যেন সব ঠিক আছে| ভিতরে ভিতরে পুডে মরবে| কারো সাথে কথা বলবে না ঠিক মতো| ডায়াবেটিকসের ঔষধগুলোও খেতে মনে থাকবে না| ভিতরে ভিতরে সে নেই হয়ে যাবে| আর মা? বলা যায় না| সারাক্ষণ যেভাবে বকাঝকা করে ওকে, হয়তো হাফ ছেড়ে বাঁচবে| বলবে, "বাঁচলাম, আর কেউ টেস্ট পরীক্ষার আগে আগে জ্বর বাঁধিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ফেলবে না|" আবার বলা যায় না, কান্নাকাটিও করতে পারে| মা-ই তো! আর 'সে'? 'সে' কি করবে? ভালবাসার মানুষকে হাড়িয়ে 'সে'-ও কি আত্মহত্যা করবে?স্বর্গলোকে এসে আদ্রিতাকে পাওয়ার জন্য? নাকি দেবদাসের মতো লম্বা চুল দাড়ি রেখে বৈরাগী হয়ে পথে পথে ঘুরবে? আসলে এই 'সে'-টা যেকে, সেটা আদ্রিতা নিজেই জানে না| তার সঙ্গে এখনো ওর দেখা হয়নি| কোন একদিন হয়তো হবে| এখন সে নিজের মতো করে 'সে'-কে কল্পনা করে নেয়| আদ্রিতার জ্বরের কথা মনে পড়ল আবার| জ্বরের দিন বাবাও তাকে হালকা বকা দিয়েছিল| পঁচা বাবা! আর ভাইয়াটা এসে স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে বলেছিল, "কিরে পাগলী, জ্বরটা বাঁধিয়েই ফেললি?" ভাইয়া আসলে ডাক্তার| পাস করেছে গত বছর| ইন্টার্নী করছে এখন| ভাইয়াই তার ঔষধগুলো আনিয়ে দিয়েছিল| তিন দিন পর রাত তিনটার দিকে আদ্রিতার যখন গা ঘামিয়ে জ্বর ছাড়ল, তখন শহরটা ডুবে ছিল বিচ্ছিরি লোডশেডিংয়ে| অন্ধকারে ভয় পেয়ে আদ্রিতা চেচিয়ে উঠেছিল| তার আবার ভয়ের শেষ নেই| ভূত-প্রেত-ভ্যাম্পায়ার থেকে শুরু করে তেলাপোকা-টিকটিকি-মাকড়সা কোনটাই বাদ নেই তার ভয়ের সিলেবাস থেকে| আদ্রিতার চিৎকার শুনে তার মা নিজের রুম থেকে ছুটে এসেছিল আদ্রিতার কাছে| আইপিএস চালু করে লাইট জ্বালিয়ে সহানুভূতির সুরে বলল, "কিরে আদ্রিতা, কি হয়েছে?" মায়ের প্রতি আদ্রিতার জমে থাকা অভিমানগুলো তখন চুপসে গেল| আদ্রিতার ভীষণ ইচ্ছে হল মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়তে| "কিছু না মা, অন্ধকারে ভয় পেয়েছিলাম|" "দেখি, জ্বর আছে কিনা.....কই,নেই তো! জ্বর নেমে গেছে|" আদ্রিতা দু'হাত মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "মা, একটু আদর করোনা!" "বারে, জড়াজড়ি করলেই বুঝি আদর হয়? আমি যে তিনদিন ধরে না ঘুমিয়ে তোমার মাথায় পানি ঢেলে দিলাম, কপালে পট্টি বাঁধলাম, এগুলো বুঝি আদর না?" "এগুলো তো কাজের আদর, একটু অকাজের আদর করো না!" "হয়েছে, আর ঢং করতে হবে না| ঘুমিয়ে পড়ো|" বলতে বলতে মা নিজেই আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দিল| তারপর তপুর সুর নকল করে বলল,"পাগলী একটা!" কিন্তু, আজ হঠাৎ করে কি হল যে আদ্রিতা আত্মহত্যা করতে চাইছে? ঘটনাটা বিকেলের|আদ্রিতার হারমোনিয়ামটা ভেঙে গিয়েছিল| আদ্রিতা বাবা-কে বলেছিল নতুন হারমোনিয়াম কিনে দিতে| বাবা সেই যে দেব বলে খালাস, আর খবর নেই| নিশ্চয়ই ভুলে গেছে! আদ্রিতার লজ্জাই লাগছিল আবার হারমোনিয়ামের কথা বলতে! চাওয়ার আগেই যখন সব পেয়ে যায়, তখন একটা হারমোনিয়ামের জন্য দু'বার বলাটা প্রেস্টিজের ব্যাপার| তাই আকার ঈঙ্গিতে বুঝানোর জন্য সে বিকেলে ভাঙা হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসেছিল| অমনি মা এসে বলল, "আদ্রিতা, আবার এই অসময়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছ?" "মন ভাল নেই মা!" "একদিন মন ভাল নেই, একদিন শরীর ভাল নেই, এভাবে করলে পড়াশোনা কখন করবে?" ব্যাস! আর কই যায়! আদ্রিতা মন খারাপ করে উঠে গেল| নাহ, কেউ তাকে ভালবাসে না তাকে| একদিন সে ঠিকই মরবে! তখন সবাই বুঝবে! কিন্তু এই কথাগুলো ভাইয়া জানতে চাইল না কেন? ভাইয়া কি ভেবেছে আদ্রিতা দুষ্টমী করছে? ঠিক আছে, দেখা যাক| "কি রে আদ্রিতা, বললি না কিভাবে মরবি?" আদ্রিতা চোয়াল শক্ত করে অপুর দিকে তাকিয়ে বলল,"ভাইয়া, তুই না ডাক্তার| আমাকে কয়েকটা কডা ডোজের ঘুমের ঔষধ দে না! আমি ওগুলো খেয়ে মরব|" তপুর চোখে এখনও ব্যঙ্গ| সে হাসিমুখেই বলল,"ঠিক আছে দিচ্ছি, তবে তুই শিওর তো ঘুমের ঔষধ খাবি? আমার ঔষধগুলো কিন্তু অনেক দামী| শুধু শুধু নষ্ট করিস না|" আদ্রিতার রাগ হল,খুব দুষ্টমী হচ্ছে, না? ভেবেছে তার খাওয়ার সাহস নেই? এখনি দেখা যাবে! "হ্যা ভাইয়া, খাব|তুই দে তো|" তপু ব্যাগ থেকে এক পাতা ট্যাবলেট বের করে পানিতে গুলিয়ে আদ্রিতার দিকে বাড়িয়ে দিল| একটুও দ্বিধা না করে আদ্রিতা ঢকঢক করে পুরো গ্লাসটা খেয়ে নিল| তারপর তপুর বিছানাতেই শুয়ে পড়ল চোখ বন্ধ করে| তপু এবার চোখ বড় বড় করে তাকাল! আড়চোখে সেটা দেখে তৃপ্তির হাসি হাসল আদ্রিতা| হ্যা, এবার তোরা সারাজীবন বসে বসে কাঁদ| আদ্রিতা ঘুমিয়ে পড়ল| *** *** *** পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল আদ্রিতার| সে বেঁচে আছে এখনো? আজব তো! আদ্রিতা তারাতারি বিছানায় উঠে বসল| টেবিলের উপর রাখা গতকালকের ট্যাবলেটের প্যাকেটগুলো দেখে তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল| ভাইয়া তাকে কতগুলো সিভিট গুলিয়ে খাইয়েছে! রাগে গা কাঁপতে লাগল আদ্রিতার| ভাইয়া কি তাকে এতই বোকা ভাবে? জোড়ে জোড়ে পা ফেলে মায়ের রুমে গেল আদ্রিতা| "মা, ভাইয়া কোথায়?" "কি জানি, কাল তো তুমি ওর রুমেই ঘুমিয়ে পড়লে| তারপর ও আমাকে এসে বলল তোমাকে বকা-টকা দিয়েছি কিনা! তোমার রুমে গিয়ে কি যেন তন্নতন্ন করে খুঁজল,আজ আবার একদম সকাল সকাল বাইরে বেরিয়ে গেল! কি হয়েছে বলো তো?" আদ্রিতা জবাব দেওয়ার আগেই বাসার কলিংবেলটা বেঁজে উঠল| আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে খুলে দিল দরজা| ওমা! তপু এসেছে, হাতে ঝকঝকে তকতকে নতুন একটা হারমোনিয়াম! "ভাইয়া! তুই....তুই কিভাবে বুঝলি যে আমি হারমোনিয়ামের জন্য...|" "আগে বল একটা হারমোনিয়ামের জন্য এত্ত নাটক না করলে হতোনা? এত অভিমান করলে চলে? ড্রামাকুইন কাঁহিকা|" তপু ছোটবোনের মাথায় হালকা চাটি মারল| আদ্রিতা আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরল ভাইয়াকে| "থ্যাংকিউ ভাইয়া|" মা ওদেরকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে কৃত্রিম রাগের সুরে বলল, "নাহ তপু, তুই মেয়েটার মাথা নষ্ট করেই ছাড়বি|" (সমাপ্ত) *** *** *** (ছোটবোনের জন্মদিনে লিখেছিলাম গল্পটা। ছোটবোন বড় হলে পড়তে দেব। )

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।