আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যখন সাঙ্গ হয় সব ভবের রঙলীলা

আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে। গ্রামের বাজার সন্ধ্যা নামতেই চারিদিক নিসতব্ধ হয়ে যায় । শুধু দুএকটা দোকান ছাড়া আর কিছুই খোলা থাকেনা। তবে মজিদ মিয়ার হোটেল খোলা থাকে অনেক রাত অবধি। সেখানে বসে একের পর এক আড্ডার আসর বসে ।

সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় গ্রামের তরুণদের আড্ডা তারপর বুড়োরা এসে ভিড় করে । মজিদ মিয়ার তাতে করে এতটুকুও বিরক্তি আসেনা । কারন তার ব্যাবসা চলে রমরমা । ভালই রোজগার হয় এই সুবাধে। আর কিছু না হোক চা আর ডাল পুরি বিক্রি চলে তা যত রাতই হোক।

লোকজন আড্ডা দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে চা আর পুরি খাবেই । ঘরে একা সুন্দরী বউ আছে । মাঝে মাঝে মিজদ ভুলেই যায়। এক মাসও হয়নি মজিদ বিয়ে করেছে । এরই মাঝে এমনটা হবার কথা নয়।

সাধারনত নতুন বিয়ে হলে মানুষ নতুন বউ নিয়ে মেতে থাকে অনেক দিন। কিন্তু মজিদ মিয়ার ক্ষেত্রে তার উলটোটাই ঘটেছে । মজিদ মিয়াকে আসলে টাকার নেশায় পেয়েছে। এই নিয়ে গ্রামে বেশ কানাঘুষা চলে কিন্তু মজিদ সেসব পাত্তা দেয় না । কদিন হল মজিদের বউ বায়না ধরেছে বাপের বাড়ি যাবার।

কিন্তু মজিদ তাতে কোন শ্বায় দেয়না । সে মনে করে আরে বউ চলে গেলে তাকে ভাত রান্না করে কে খাওয়াবে। সোনালি মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। গরীব কৃষক রইসুল। তার অভাবের সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে।

গ্রামের এক সামান্য বর্গা চাষি। কিন্তু গেল বছর তেমন ফলন না হওয়ায় এবছর বর্গাজমি পায়নি সে। তার তিনটি মেয়ে আর এক ছেলের সংসার নিয়ে ভীষণ বেকায়দায় পরতে হয়। বড় মেয়ে সোনালি। অসম্ভব রূপবতী একটা মেয়ে হয়েছে তার ।

তাই এই মেয়েকে নিয়ে চিন্তার অন্ত নাই রইসুলের। গ্রামের অনেক মানুষের বদ নজর পরেছে তার এই মেয়েটির উপর। অগ্যতা কোন উপায় না দেখে মজিদের কাছে বিয়ে দেয় রইসুল। বিনিময় কিছু টাকা পায় সে। মেয়েকে বিদায় দিতে পেরে যেন মাথার উপর থেকে বিরাট এক বোঝা নেমে যায়।

এবার ভালয় ভালয় বাকি দুই মেয়ে কে বিদায় দিতে পারলেই বেঁচে যায় সে। রইসুলের ছেলেটি খুব ছোট। কিন্তু ছোট হলেও এই ছয় বছরের ছেলেটি সংসারের হাল ধরতে চায়। তাই গ্রামের একটু অদুরে রেল স্টেশন আছে। সেখানে একটা চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছে সে।

নাম তার আজগর। কিন্তু লোকে তাকে আদর করে আজু ডাকে। আজ আজু ভেবেছে ফেরার পথে বড় বোনের সাথে দেখা করে যাবে। যাবার পথে কিছু কিনে নিয়ে যাবে। এই বয়সে এমন চিন্তা ধারা আশা করা যায় না ।

কিন্তু আজুর ভিতর সেইসব প্রেজুডিস ভাল ভাবেই আছে। হয়ত অভাবের সংসার তাকে শিখিয়েছে জীবন বোধ। আপা তুমি কেমন আছ । ভালা। আপা আমি ঠিক করছি শহরে যামু, শুনছি সেইখানে মেলা কাম আছে।

আমি কাম কইরা বাবার অভাব ঘুসামু। কি কইতাছস এই সব তুই কি পাগল হইলিনাকি। তুইত অনেক ছুডু এহন তুই কাম করতে পারবিনা । কেদা কইছে ! আমিত এহন কাম করি একটা চায়ের দোকানে। এই দেহ আমি তোমার লাইগা আমার কামাইয়ের টাকা দিয়া তোমার লাইগা চুরি কিন্যা আনছি।

পাগল ভাই আমার। সোনালির চোখে পানি চলে এসেছে। পাছে তার ছোট ভাইয়ের মন খারাপ না হয়ে যায় তাই সে কান্নাকে আড়াল করে বলল তা তুই কেমনে শহরে যাবি? আমার মহাজনে কইছে হেয় আমার কাম দেইখা অনেক খুসি হইছে। হের এক ভাই শহরে হোটেল দিছে। অইহানে আমারে একটা কাম দিব।

কাইল জামুগা আপা আমার লাইগা দোয়া কইর আর আজান আর মায়ের দিকে খেয়াল রাইখ। সোনালি মাথা নাড়িয়ে শ্বায় দিল। কিন্তু তার মন জানে যে তার স্বামী তাকে যেতে দিবেনা। তাই বাবা মার খেয়াল রাখা তার হবেনা। মেয়েদের জীবনটা এমনি হয়।

বিয়ের পর স্বামীই সব কিছু । বাবা মা তখন আর আপন থাকে না । মন হাজার কাঁদলেও কিছু করার আর থাকেনা। বাব মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আজু শহরে চলে আসে। প্রথম প্রথম হোটেলে ঘুমাতে একটু কষ্ট হত।

কিন্তু বাকিদের সাথে মিশে একটা বন্ধুত্ত হয়ে গেছে আজুর। এখন সবাইকে খুব আপন লাগে আজুর। হোটেলের মহাজন খুব ভালো লোক বলেই আজুর মনে হয়। মাসে যে টাকা বেতন পায় তার পুরোটাই সে তার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এক রাতে মহাজন সবাইকে বাইরে বের করে দিল।

হোটেলে সাথে করে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে সে। আজু বাইরে যেয়ে তার বয়সে বড় এক জনের কাছে জানতে চায় আচ্ছা মমিন ভাই মেয়ে টা কে যে মহাজন তারে নিয়ে এসে আমাদের এভাবে বের করে দিল । এগুলো হইল রঙলীলা তুই বড় হইয়া নে দেখবি কত লীলা করতে মন চাইব তখন। এসব কিছু আজুর মাথায় ঢুকেনা আজুর। শুধু ভাবে তার গ্রামের কথা।

তার বোন সোনালির কথা। বিদেশ থেকে গ্রামের মেম্বারের ছেলে ফিরে এসেছে । নাম সুমন । মজিদ মিয়ার হোটেলে বসে চা খাচ্ছে। মজিদ মিয়া জীবনে ভালো মতন বাইচা থাকতে হইলে দরকার প্রচুর টাকার।

তাত ঠিকই। কিন্তু এত টাকা কামামু কেমনে? আরে কি কও মিয়া। আমি বিদেশে থাকি। সেইখানে একটা ব্যাবস্থা কইরা দিমুনে। সত্য কইতাছ সুমন ভাই ! তাইলে আবার কি কই।

তোমার লগে আমি মস্করা করমু নাকি মিয়া। তাইলে একটা ব্যাবস্থা কইরা দেও ভাই। শোন আমি যেইখানে থাকি সেইখানে মেয়েছেলেদের চাকরী পাওয়া সহজ। ওইখানে পোলারা গিয়া তেমুন কিছু করতে পারেনা। তুমি চাইলে ভাবি সাহেবারে পাঠাইতে পার।

কি কও এই সব ! মাইয়া মানুষ বিদেশ যাইব তাও ঘরের বউ ! আরে মিয়া এহন আর হেই যুগ আছে নি। আমাগর দেশের প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলীয় নেত্রী দুইজনে দেহনা মেয়েছেলে। উনারা যদি মাইয়া মানুষ হইয়া দেশ চালাইতে পারে তাইলে তোমার বউ বিদেশ যাইয়া টাকা কামাইতে পারবনা কেন কও। আর তুমি দুই নেত্রীরে নির্বাচনের সময় ভোট দিছনা। হ দিছি।

তাইলে তোমার বউরে বিদেশ পাঠাইতে পারবানা কেন কও দেহি ? কিন্তু মাইন্সে কি কইব ! হুর পাগল মাইন্সে কি কইব। একবার পাঠাও দেখবা তোমার বউ যখন অনেক টাকা পাঠাইব তহন তোমারে আর পায় কে । তুমি তহন চেয়ারম্যান নির্বাচন কইরা এই গেরামের চেয়ারম্যান হইতে পারবা। আর কিছু না ভেবে মজিদ তার বউকে সুমনের হাতে তুলে দেয় বিদেশ যাবে বলে। সুমনের সাথে সোনালি চলে আসে শহরে।

কিন্তু সোনালির জীবনে অপেক্ষা করছিল এক অন্য রকম কালো অধ্যায়। সুমন আসলে বিদেশ যাবার নাম করে সোনালিকে বিক্রি করে দেয় এক পতিতা পল্লীতে। যেখানে এসে ভিড় করে প্রতিদিন নানা শ্রেণীর মানুষ। এরা নাকি সমাজের এক একজন মাথা। এরা সমাজ চালায় আবার সময় পেলে এসবের বিরুদ্ধে করে গলাবাজি।

আজ আজুদের ছুটি। সবাই মিলে ওরা ঘুরতে গেছে। মমিন খুব আয়েস করে গাঁজার একটা কল্কি সাজাল খাবে বলে। মমিন ভাই এইটা কি ? এইটা হইল আরেকটা রঙলীলা। তুই খাবি।

খামু। মমিন কল্কিতে একটা দম নিয়ে টান দেয় । তারপর ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। মমিন ভাই আমি বাজানরে এই জিনিষ খাইতে দেখছি মেলা। নে তুই এখন একটা টান দে ।

আজু ঠিক তেমনি দম নিয়ে টান দেয় কল্কিতে। কিন্তু ধোঁয়া বের হবার আগেই কাশতে থাকে আজু। শোন প্রথম প্রথম এমন একটু আধটু কাশী আসে পরে সব ঠিক হইয়া যাইব । নে ধর টান দে। এইবার আজু টানে।

মমিন ভাই আমার কিমুন জানি লাগতাছে। মনে হইতাছে আমার বইনে আমার সামনে খাড়ায়া আছে। ধুর পাগল চল ভালা কইরা চিনি দিয়া একটা চা খাইগা দেখবি সব ঠিক লাগতাছে। কিন্তু চা খাওয়ার পর আজুর নেশা আরও বেড়ে যায় । সে শুধু তার চোখের সামনে তার বোন আজুকে দেখতে পায়।

আর যতই সে এমন করে মমিন ততই বোঝায় আরে বোকা এইখানে তোর বইনে আইব কেমনে ? হেয়ত থাকে গেরামে। এইসব হইল তোর মনের ভুল। আর এই রঙলীলা খাইলে এমনি হয়। আজু বুঝতে পারে আসলেই সে নেশায় পরেছে । এই দেখ আজু আমি আমার জোসনা রে দেখতে পাইতাছি।

মমিই ভাই এই জোসনাটা আবার কে ? পরে একসময় তার কাহিনী তরে কমুনে । আপাতত জাইনা রাখ আমি আমার প্রান পাখি ময়নারে একবার টাকার লভে পইরা বিদেশ পাঠাই ছিলাম। পরে জোসনা আমার বিদেশ থিকা ঠিকই ফিরল কিন্তু তার জোসনা আর জোসনা রইলনা হইয়া গেল অমাবস্যা রাইত। রাত হয়ে এসেছে । চারিদিকে বৃষ্টি পরছে ।

এই বৃষ্টিতে ভিজতে আজুর আজ খুব অন্য রকম লাগছে। গ্রামে এর আগেও সে বৃষ্টিতে ভিজেছে। কিন্তু আজ বৃষ্টিতে ভেজার আসল অনুভূতি সে পাচ্ছে। বৃষ্টি যে এই ভাবে উপভোগ করা যেতে পারে সেটা আজুর বোঝা ছিল না । আজু চল আরেকটা কল্কি বানাই তারপর দুইজনে খাইয়া একটা বেশী কইরা চিনি দিয়া চা খাইয়া ফিরা যাই ।

আজু শ্বায় দেয় মমিনের সাথে। হোটেলে যখন ফিরে আসে দেখে মহাজন আজো একটা মেয়ে নিয়ে এসেছে। তাই অগ্যতা তাদের বাইরেই দাড়িয়ে থাকতে হয়। যখন রঙলীলা সাঙ্গ হল মেয়েটি বেড়িয়ে যেতে নেবার সময় আজুর চোখে চোখ পরতেই মেয়েটি আঁচলে মুখ ঢেকে দৌড়ে চলে যায়। সেই চলে যাওয়ার দিকে আজু তাকিয়ে থাকে অনেক ক্ষণ ।

তার কেবলই মনে হয় তার সামনে দিয়ে যে দৌড়ে গেল সে তার বড় বোন সোনালি। কিন্তু নেশায় আছে বোলে মনে করে মনকে সান্তনা দেয় আজু। কিন্তু এক অজানা শঙ্কা এসে যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদে আজুর বুকের ভেতর। আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৭০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।