আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মামলা ও বিতর্কের জালে বিএনপি

আইন, মামলা ও বিতর্কের জালে আটকা পড়েছে বিএনপি। আইনের দীর্ঘ মারপ্যাঁচ খোদ দলটির চেয়ারপারসনকেই জড়িয়ে ফেলছে নানা স্পর্শকাতর ঘটনায়। একই সঙ্গে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে ঘিরে আইনগত হুমকিতে রয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ছাড়া হাজার ত্রিশেক মামলার বেড়াজালে পড়েছে দলটির কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশের নেতা-কর্মীরা। তবে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সম্প্রতি আদালতের দেওয়া রায় বিএনপিকে চরমভাবে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি দলটির জন্য কঠিন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষকদের মতে, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার তদন্ত ও বিচারের রায়ে এটি স্পষ্ট যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পুরো ঘটনাই জানতেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি। সব দেশের অপরাধ আইনেই অপরাধের সঙ্গীকে বিচারের সম্মুখীন করার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও সে ঘটনার প্রতিকার করেননি_ এ জন্য খালেদা জিয়াকেও অভিযুক্ত করা যায় বলে মনে করছেন তারা।

উল্লেখ্য, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার দীর্ঘ তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়া শেষে ১৪ জনের ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত। আদালত তার রায়ের পর্যবেক্ষণে ঘটনার সঙ্গে হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারও শেষ পর্যায়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১০ বছর আগেরকার এ দুটি ঘটনার সঙ্গে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য এবং পুলিশ ও গোয়েন্দাদের হর্তাকর্তারা ছিলেন জড়িত। অস্ত্র উদ্ধার মামলার রায়ের পর বেগম খালেদা জিয়ার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি প্রশ্ন উঠেছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষণার আগেই।

এ কারণে দুটি ঘটনাই বিএনপির শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে নতুন করে যেমন ভাবিয়ে তুলেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে নানা বিতর্কেরও।

জানা গেছে, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া এবং আদালতের ঘোষিত রায়ে খালেদা জিয়ার অবহিত থাকার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। সূত্র জানায়, অস্ত্র আটক মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় আদালতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) সাদেক হাসান রুমী এবং তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী (যিনি এই মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি) যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাতে বেগম খালেদা জিয়ার অবহিত হওয়ার বিষয়টি রয়েছে। নিজামী তার সাক্ষ্যে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে অস্ত্র আটকের বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। খালেদা জিয়া ঘটনাটি জেনেছেন, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযুক্ত ও সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের স্থানীয় পুলিশ এ নিয়ে থানায় মামলা করে। পরে মামলাটি গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা এ নিয়ে কার্যত কিছুই করেনি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেই কমিটির কোনো প্রতিবেদনও জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি বা কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

উল্টো পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার সর্বাত্দক চেষ্টা করা হয়। আর এসব ঘটনায় যারা জড়িত ছিলেন এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা : ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার রায়ের পাশাপাশি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়েও অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি। দলটির নেতৃবৃন্দের আশঙ্কা, এ মামলার রায় দলটির অস্তিত্ব সংকটে ফেলবে। এদিকে সরকারও চায় মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে।

মামলার তদন্তে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট স্মরণকালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। তেমনি বিচার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন আসামি ও সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যেও তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। সরকারপক্ষের আইনজীবীদের মতে, মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, আবু তাহের, তাজউদ্দিন, মাজেদ বাটসহ জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারান।

আহত হন পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি। চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও একটি কানের শ্রবণশক্তি হারান তিনি। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিশেষ এজলাসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার চলছে। ২০১২ সালের ১৯ মার্চ তারেক রহমান, হারিছ, মুজাহিদসহ জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতা এবং বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতা-কর্মীসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বিচার শুরুর পর গত ২১ মাসে বাদীসহ ৭৩ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, শীঘ্রই এ মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ৫২ আসামির মধ্যে সাবেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৫ জন আসামি কারাগারে আটক আছেন। এ ছাড়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জন আসামি রয়েছেন পলাতক।

অন্যদিকে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বঙ্ চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম জামিনে রয়েছেন।

মামলা আর মামলা : মামলার জালে বন্দী হয়ে পড়েছে বিএনপি। বিগত মহাজোট সরকার আমলে হাজার হাজার মামলা হয়েছে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিএনপির একটি সূত্র দাবি করেছে, সারা দেশে এ মামলার সংখ্যা হবে প্রায় ৩০ হাজার। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই তিন হাজারের মতো মামলা হয়েছে।

আর এসব মামলার আসামি দুই থেকে আড়াই লাখের মতো। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা রয়েছে। এদিকে মামলার কারণে সারা দেশের বিএনপির নেতা-কর্মীদের থাকতে হয় গ্রেফতার আতঙ্কে। গ্রেফতার এড়াতে শীর্ষ নেতারাও কখনো কখনো চলে যান আত্দগোপনে। পুলিশের ভয়ে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা তাদের বাসাবাড়িতে থাকেন না।

এমনও সময় চলে আসে, যখন নেতারা কে কোথায় আছেন, কে কোথায় থাকছেন- তার কোনো ঠিকানা নেই। নেতারা একজন জানতে পারেন না আরেকজনের খবর। হাতের মোবাইল ফোন রাখেন বন্ধ। ভিন্ন নম্বরে তারা যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এর পরও কেউ কারও মোবাইল ফোন রিসিভ করেন না।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতা-কর্মীরা ফেরার জীবন কাটাচ্ছেন।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.