আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বই হোক নিত্য সঙ্গী



জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন করা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল। স্বাধীনতার পর এই বিষয়টিকে লক্ষ্য করেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু না আমরা সে লক্ষটিকে সামনে রেখে পথ চলতে পারিনি। সে পথটা লাল গালিচায় মোড়া ছিল না। ছিল না সবুজ চাদরে মোড়া গ্রামীণ কোনো পথ।

সে পথটি ছিল কন্টকাকীর্ণ। সে পথে চলতে শুধু বাধা আর প্রতিরোধ। আমি বলছিলাম বাংলাদেশের পথচলার কথা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে দেশী এবং বিদেশী অনেক বড় ষড়যন্ত্রই মোকাবেলা করতে হয়েছে। না পারার কারণটা এখানে আলোচনা করলে বিষদ আলোচনা হয়ে যাবে।

হয়তো মূল লেখা থেকে মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাবে। তাই এখন বাদ রাখলাম। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর স্বাধীনতার পর অব্যবহিত দেশের সরকারগুলোকেই আমরা এর জন্য প্রধানত দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। কেননা আমরা জানি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাতিই পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, করছেও। আর এ কথা সত্য যে বই বিমূখ জাতি কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি সাধন করতে পারেনা।

পৃথিবীর বুকে করতে পারেনা মর্যাদাপূর্ণ আসন। চীন, জাপান, আমেরিকা, মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে এ বিষয়টি আমাদের সামনে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যাবে। চীনে-ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে বই পড়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনোযোগী করে তোলা হয়। তারা তাদের আগামীর প্রজন্মকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলোর জন্য বিশেষ কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে।
এ কথা আমরা সবাই জানি, বর্তমানের শিশু-কিশোরা আগামীর নাগরিক।

তাদের হাতেই এক সময় সমাজ এবং দেশের চাবিকাঠি থাকবে। আর এরা যদি নিজেদেরকে দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম না হয় তাহলে সে প্রজন্ম থেকে জাতি বিশেষ ভালো কিছু আশা করতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে একটি বিষয় আশঙ্কাজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আমাদের তরুণ-তরুণীরা ধীরে ধীরে যেন বই বিমূখ হয়ে যাচ্ছে। তারা ফেসবুকে যতটা সময় ব্যয় করছে তার সিকি ভাগ সময়ও তারা বই পড়ায় ব্যয় করছে না। এক সময় আমদের তরুণ-তরুণীরা রাত জেগে বই পড়ত।

এখন তারা রাত জেগে নাটক সিনেমা আর ইন্টারনেটে আজেবাজে দৃশ্য দেখে সময় নষ্ট করছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশী জাতী হিসেবে-এক সময় সংস্কৃতিগতভাবে আমরা যে পঙ্গুত্ব বরণ করবো এ ক্ষেত্রে কোনোই সন্দেহ নেই। জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটি খুবই ভাবনার বিষয়। এর থেকে পরিত্রাণ না হলে আমরা একদিন ধ্বংসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবো। কেউ আমাদেরকে সে অন্ধকার গুহা থেকে উদ্ধার করতে আসবে না।

না ভারত না পাকিস্তান। না মার্কিন মুল্লুক না রাশিয়া।
বই না পড়লে মানুষের ভেতর মানবিকতা বোধ, দায়িত্ববোধ, মমত্ত¡বোধ জন্ম নেয় না। তৈরী হয় না আবেগ অনুভূতির মত নিখাদ নিঃস্বার্থ ভালবাসা। সৃষ্টি হয় না দয়া মায়া আর সহযোগীতার মনোভাব।

একমাত্র বই-ই পারে মানুষের ভেতর ভালবাসা তৈরী করতে। আবেগ জন্ম দিতে। মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বই পড়ার বিকল্প নেই। বইয়ের ছোঁয়ায় মানুষের জীবন আমূল পাল্টে যেতে বাধ্য। বই পাঠ মানুষের ভেতর নতুন নতুন চিন্তা আর বোধ জাগ্রত করতে পারে।


বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যেতে পারে। প্রিয়তমা বিগত দিনের সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারে কিন্তু বই কখনো তার পাঠককে ভুলে যায় না। বই তার পাঠককে ভুল পথে পরিচালিত করে না। বই সব সময় একজন মানুষকে সঠিক পথেই পরিচালিত করে। সঠিক পথের পতাকাবাহী হয় বই-ই।

বই পাঠ মানুষকে সত্য কথা বলতে, সত্য পথে চলতে, মানবতার কল্যাণে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। বই সুখের সময় মানুষের পাশে থাকে দুঃখের সময় মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে।
বই আমাদের মনের পরিধি বাড়াতে সাহায্য করে। মনের পরিধি ছোট হওয়ার কারণে মানুষ একে অপরকে সম্মান জানাতে কার্পণ্য করে। মানুষের ভেতর এক ধরণের রহস্যময় প্রবণতা আছে যে, মানুষ সব সময় নিজের দোষ অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চায়।

শুধু জ্ঞানের জন্যই নয়, বই পড়ার কারণে মানুষের মন এত বড় হয় যে, যেখানে অন্যোর মতামত নিতে কোনো রকমেরই অসুবিধা হয় না।
বই পাঠ অনাবিল এক আনন্দের বিষয়। সে বই পাঠকে অনেক লেখক-সাহিত্যিক বৃষ্টির অবারিত ধারায় স্নান করার সাথে তুলনা করেছেন। যে বই পাঠ করে অক্ষরের বৃষ্টিতে ভিজে তার মন। অক্ষরের ভালবাসায় তার হৃদয় জমিন উর্বর হয়।

তার নিরানন্দ মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বই পাঠে গতিহীন মানুষ জীবনের গতি ফিরে পায়। যারা বই ভালবাসে, কবিতা ভালবাসে, উপন্যাস ভালবাসে, বাংলার শ্যামল প্রান্তর ভালবাসে, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, রাখালি, পল্লীগীতি ভালবাসে তাদের জীবনে অনবরত সোনা ফলতে থাকে।
প্রতি বছর পহেলা ফেব্রয়ারী বাংলা একাডেমি ভাষা শহীদদের স্মৃতির স্মারক স্বরূপ অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে থাকে। বইমেলা তো বাংলাদেশী মানুষের মর্মসঙ্গীত।

বইমেলা মানে আধুনিকতার প্রথম সূর্যোদয়, যে সূর্য কখনো অস্তমিত হবার নয়। এ যেন এক অনিঃশেষ ফাল্গুন, অনিঃশেষ বসন্ত, অনিঃশেষ বর্ষা, অবারিত সবুজ যা কখনো শেষ হবার নয়।
এ দিনের কথা সেদিনের কাছে পৌঁছে দেবার উৎকৃষ্ট পন্থা বা অবলম্বন হলো বই। এখন পর্যন্ত জ্ঞান লাভের মোক্ষম উপায়। বরীন্দ্রনাথের কথা এ ক্ষেত্রে স্বরণ করা যেতে পারে, ‘শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বেঁধে, ‘সঙ্গীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আতœার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে’ কাগজে মুড়ে পাঠকের করমকলে পৌঁছিয়ে ‘মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী’ করেছে আর ‘অতলস্পর্শ কাল সমুদ্রের ওপর সাঁকো বেঁধে দিয়েছে’।

আর বই সংরক্ষণের জন্য লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আমাদের প্রত্যেকের উচিত ব্যাক্তিগত উদ্যোগে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করে স্ব-শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। পরিশেষে, বই হোক আমাদের পথ চলার পাথেয়। বইকে সাথে নিয়েই আমাদের জীবনের সামনের দিনগুলো অতিবাহিত হোক। বই হোক আমাদের নিত্য সঙ্গী।


লেখক:
সুহৃদ আকবর
সাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।