আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরে এলাম নিঝুম দ্বীপ (ভ্রমণের সব আপডেট তথ্যসহ)



(আমাদের ভ্রমণটা ছিল এ বছরের ১৩-১৭ ফেব্রুয়ারী। এই লেখায় আমাদের ভ্রমণ কাহিনীর পাশাপাশি নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে আগ্রহীদের জন্য সব আপডেট তথ্য দেয়ারও চেষ্টা করব। )

Life is Beautiful. Bangladesh is Super Beautiful. -শুরুটা এভাবেই করলাম। পরের কথাটা বই-পুস্তকের কিতাবি ভাষার মত শোনাবে, তবুও বলি- সত্যিই আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। এমন সব অসাধারণ প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের জায়গা আমাদের দেশে আছে যে সে সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।

শুধু খুঁজে নিয়ে কাছে গিয়ে মন থেকে একবার দেখে নিয়েন সত্য কিনা।

অনেকদিন যাবৎ হ্যাংআউটে বের হওয়া হচ্ছিল না, একটা রিফ্রেশমেন্টের খুব প্রয়োজন ছিল। হঠাৎ করেই ৩ বন্ধু মিলে ঠিক করলাম বৃহষ্পতিবার পরীক্ষা শেষ হতেই আমরা 'নিঝুম দ্বীপ' ট্যুরে যাব এবং রীতিমত এডভেঞ্চার করব।
নিঝুম দ্বীপ সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারণা দিয়ে রাখি--- নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে নোয়াখালি জেলার অন্তর্গত উপজেলা হাতিয়া দ্বীপের পাশে (হাতিয়া থেকে ৬০ কি.মি. দক্ষিণে) অবস্থিত মাত্র ৬৩ বর্গমাইল আয়তনের একটি ছোট দ্বীপ। এখানে সরকারি হিসেবে ৬ হাজার ভোটার আছে, আর জনসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।

এটা বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ যেখানে আপনি একইসাথে কক্সবাজার এবং সুন্দরবনের স্বাদ নিতে পারবেন। অর্থাৎ এ দ্বীপের দক্ষিণে আছে ১২ কি.মি. জুড়ে বিশাল সমুদ্র সৈকত, আবার আরেক পাশে আছে ম্যানগ্রোভ বন, যেই বনে আছে ৩৫ প্রজাতির পাখি আর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার হরিণ। আছে বনের পাশে সাগরের দিকে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, নিউজিল্যান্ডের মত সে মাঠে শত শত গরু-মহিষ চড়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় অভয়ারন্য হিসেবেও ঘোষণা করেছে।

তো, সমুদ্রের পাড়ে ক্যাম্প করে থাকা থেকে শুরু করে অনেক অনেক প্ল্যান করে ফেললাম।

২ দিনের মধ্যে ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বৃহষ্পরিবার পরীক্ষা শেষ হতেই রওনা হয়ে গেলাম। বাসে করে চলে আসলাম সদরঘাট।
সদরঘাট থেকে হাতিয়া পর্যন্ত ৩টি লঞ্চ আছে- এমভি ফারহান-৩, এমভি ফারহান-৪, এমভি পানামা। বিকেল ৫:৩০ টায়। কিন্তু সাবধান! লঞ্চ দিনে একটাই ছাড়ে এবং একদমই সময়মত।

লঞ্চের ভাড়াঃ ডেক- ৩৫৬ টাকা, সিঙ্গেল কেবিনঃ ১২০০ টাকা, ডাবল কেবিনঃ ২২০০ টাকা। আরও সাবধানতা যে, ডেকে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে ২টার ভিতরেই লঞ্চে এসে পড়বেন, নাহলে আর জায়গা পাবেন না। :\
আমরা উঠলাম এমভি ফারহান-৩ এ। বিশাল লঞ্চ, ডোবার সম্ভাবনা খুবই কম। সদরঘাট থেকে ঠিক সাড়ে ৫টায় লঞ্চ ছেড়ে দিল।

লঞ্চের সর্বশেষ গন্তব্য- হাতিয়া দ্বীপের তমরুদ্দিন ঘাট। আমরা ওখানেই যাব। জার্নিটা ছিল মোট ১৭ ঘন্টার। রাতে চাঁদের আলোতে লঞ্চের ছাদে উঠেছিলাম, ছাদের সে আড্ডায় আমাদের খাঁচা ছাড়া মনের কথাগুলো জোছনার মত ঝরছিল। মাঝে পরিচিত হয়েছিলাম লঞ্চের ক্যাপ্টেন বজলুর রহমান খানের সাথে, তিনি আমাদেরকে যথেষ্ট সমাদর করলেন, এই রুটের বিভিন্ন ঘাট এবং নদীর পানির গতিবিধি সম্পর্কে বললেন, লঞ্চ চালানো দেখালেন।

ভোর হয়েছিল বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার মোহনায়, ভোলা আর মনপুরার মাঝামাঝি। সকালে মনপুরাতে মালামাল নামাতে লঞ্চ থামল প্রায় ১ ঘন্টা। আমরাও টুপ করে নেমে গেলাম মনপুরা দ্বীপে, সকালের নাস্তাটা সেখানেই সেরে ফেললাম। ৯টার দিকে আমরা পৌছলাম আমাদের গন্তব্যে- হাতিয়া দ্বীপের তমরুদ্দিন ঘাটে।

নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে হাতিয়া দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে হয়।

যাওয়ার উপায় ২টি- সরাসরি বাইকে, সেক্ষেত্রে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০-৩০০ টাকা। অথবা, তমরুদ্দিন ঘাট থেকে জাহাজমারা ঘাট পর্যন্ত বেবি ট্যাক্সিতে (ভাড়া- জনপ্রতি ১০০ টাকা), এরপর জাহাজমারা থেকে মোক্তারিয়া ঘাট/নিঝুম দ্বীপ ঘাট পর্যন্ত বাইকে (জনপ্রতি ১০০ টাকা)। বলে রাখি- তমরুদ্দিন ঘাট থেকে সরাসরি বেবি ট্যাক্সি নিবেন না, কেননা জাহাজমারারও কিছুদূর পর পর্যন্ত পাকা রাস্তা, কিন্তু এরপরের রাস্তা এতটাই খারাপ যে, বেবিট্যাক্সি প্রায় সময়ই উল্টে যায়। মোক্তারিয়া ঘাট থেকে নদী পার হতে হবে ইঞ্জিন নৌকায়, নদী পার হতে লাগে ৫/৬ মিনিট, ভাড়া জনপ্রতি ১৫ টাকা। নদী পার হলেই আপনি চলে আসবেন স্বপ্নের সেই নিঝুম দ্বীপে।

আমরা নিঝুম দ্বীপ নেমেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলাম। আমাদের আনন্দ দেখে কাছে আসলেন ঢাকা থেকে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ঘুরতে আসা সৌরভ ভাই। তার সাথে পরিচয় হল, জানালেন- নিঝুম দ্বীপে আসার স্বপ্ন তার ৪ বছরের, আজ তারও স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
আসল গন্তব্য কিন্তু নিঝুম দ্বীপের অপর প্রান্তের নামাবাজার। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের ১৪ কি.মি. পাকা রাস্তা আছে।

আমরা সাথে দ্বীপের সব ধরনের ম্যাপ নিয়েছিলাম, এবং সাথে ছিল কম্পাস। আমাদের প্ল্যান ছিল আমরা এ ট্যুরে সর্বোচ্চ মাত্রায় পরিশ্রম করব, এডভেঞ্চার করব, কম্পাস আর ম্যাপ দেখে দিক বুঝে নিজেরাই ঘুরাঘুরি করব এবং সে হিসেবে দ্বীপে নামার পর ওপ্রান্তে হেঁটেই চলে যাব। কিন্তু, দ্বীপ যে নেহায়েতই ছোটও নয়, রাস্তা যে ১৪ কি.মি.- সে ধারণা ছিল না। বন্দরটিলা বাজার পার হয়ে অনেক দূর আসার পর যখন শুনলাম নামাবাজার আরও ১১ কি.মি. দূরে, তখন আমরা পাথর বহনকারী একটা লরি ভ্যানে উঠলাম, লরিটি আমাদেরকে পাকা রাস্তা শেষের প্রায় কাছাকাছিতে নামিয়ে দিল এবং আমাদের থেকে কোন ভাড়াই নিল না। মাঝের কিছু অংশ রাস্তা বনের ভিতর দিয়ে গেলেও বাদ বাকি পুরো রাস্তার ডান পাশে ছিল বন আর বাম পাশে ছিল সমুদ্র।

এরপরের ৩ কি.মি. রাস্তা এখনও কাঁচা, তবে রাস্তা পাকাকরণের কাজ চলছে দেখে এসেছি। বাকি রাস্তা আমরা হেঁটেই চলে আসলাম। অবশেষে লঞ্চ ছাড়ার ২১ ঘন্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টায় আমরা আমাদের প্রকৃত গন্তব্য নিঝুম দ্বীপের নামাবাজারে এসে পৌছলাম।

সেখানে সৈয়দ চাচার খাবার হোটেলে দুপুরের লাঞ্চ সেরে বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম পাশেই পুলিশ ফাঁড়িতে, আমাদের বনে ঘোরার এবং রাতে সমুদ্রের পাড়ে ক্যাম্প করার ব্যাপারে অনুমতি নিতে। আমরা শুনেছিলাম পুলিশের অনুমতি পেতে অনেক বেগ পেতে হবে, স্টুডেন্টশিপের সত্যতা প্রমাণ দিতে হবে...হেন তেন।

কিন্তু সেখানে সম্পূর্ণই ভিন্ন অভিজ্ঞতা হল। আমরা যখন বললাম- রাতে ক্যাম্প করে থাকতে চাই, তখন পুলিশ কনস্টেবল বললেন-
পুলিশ কনস্টেবলঃ অবশ্যই থাকবেন। (ঐত-তেরি)
আমরাঃ এখানে সিকিউরিটি কেমন?
পুলিশ কনস্টেবলঃ কোন সমস্যা নাই।
অপর এক কনস্টেবলঃ বনে গাইড ছাড়া ঢুইকেন না, তাছাড়া এখানে কোন সমস্যা নাই। তবে, রাতে ক্যাম্পে একটু সাবধানে থাইকেন, বুঝেনই তো- দ্বীপ অঞ্চল।

অনেক ডাকাত এখানে আত্মগোপন করে।
আগের কনস্টেবলঃ কে বলেছে? নাহ, কোন সমস্যা নাই, কোন ডাকাত নাই। সমস্যা হইলে আমাদেরকে বলবেন। আমার নাম্বার নিয়ে যান।

........অতিরিক্ত তোষামোদ সন্দেহজনক।

তার নাম্বার নিয়েই চটজলদি চলে আসলাম। তবে নিঝুম দ্বীপে লোকজনের কাছে শুনেছি- ২/৩ বছর আগেও সন্ত্রাসী, ডাকাতরা এখানে আসত। কিন্তু এখন সম্প্রতি যৌথ অভিযানে সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন আর কোন সমস্যা নেই।
গ্রামের মানুষজন সম্পর্কে বলি- ঠিক এপাড়ের হাতিয়ার মানুষ থেকে নদীর ওপাড়ের নিঝুম দ্বীপের মানুষ সম্পূর্ণই ভিন্ন।

নিঝুম দ্বীপের সাধারণ মানুষ একদমই সাদামাটা ও সরল।

হরিণ থাকে বনের একদম ভিতরের দিকে। হরিণ বের হয় বনের ডান পাশের নদীর দিকে। আরও একটা কথা, হরিণ বের হয় শুধুমাত্র আছরের পর। অর্থাৎ হরিণ দেখার সময় আছর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত- এইটুকু।

প্ল্যান করলাম, হেঁটে বনের ভিতর দিয়ে ওপাশে চলে যাব। বনে ঢুকতেই টের পেলাম, একা একা বনে যাওয়া সহজ কথা না। যতই ম্যাপ আর কম্পাস থাক, শ্বাসমূল ভরা বনে প্রচুর রাস্তা- ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন তা মনে রাখা দুষ্কর তো বটেই, এর থেকেও বড় সমস্যা বনের মাঝের খালগুলো, যেগুলো পারাপারের কোন সাঁকো নেই, একমাত্র উপায় ট্রলার/নৌকা। অবশেষে একটা নৌকা ভাড়া করলাম ৭০০ টাকা দিয়ে। ট্রলার/নৌকার ভাড়ার কোন নির্দিষ্ট হিসেব নেই, মানুষের পরিমাণ এবং গন্তব্যের হিসেবে ভাড়া চায় ওরা।



নদী হয়ে ঘুরে বনের ওপাশে 'চৌধুরীর খাল' দিয়ে বনে ঢুকলাম। খালে ঢুকতেই একদম কাছ দিয়ে এক পাল বন্য মহিষ খাল পার হয়ে গেল। বনের ভিতরে একটু ঢুকতেই দেখা পেয়ে গেলাম সোনার হরিণের। নেমে পড়লাম বনে। এত দূর থেকে ক্যামেরায় হরিণের ছবি তোলা মোটেও সম্ভব না।

আস্তে আস্তে কাছে যেতে লাগলাম। কিন্তু, সমস্যা হল- সমস্ত বনে শুকনা পাতা বিছানো, চলার পথে এগুলোতে পাড়া পড়বেই, আর শব্দ হলেই হরিণ চলে যাবে। হরিণ অনেক দূর থেকে শুনতে পায়, তাই আস্তে কথা বলাও নিষেধ। সম্পূর্ণ ইশারায় আমরা ৩ জন ও মাঝি ২ জন তিন দিক থেকে ৩টি ডিজিটাল ক্যামেরা (সিকিউরিটির ভয়ে ডিএসএলআর নিয়ে যাওয়া হয়নি) নিয়ে ভিতরে ঢুকতে লাগলাম। বিশ্বাস করেন, প্রেমিকার কাছে প্রেম নিবেদনের সময় যেমন হার্টবিট বেড়ে যায়, তেমনি হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল।

হয়ত একটু অসর্তকতায় পাতার উপর পা চলার শব্দে হরিণ চলে যাবে, আমার ভুলে অন্য তিন জনেরও হরিণের ফটো তোলা হবে না। গেরিলা হয়ে মাটি ঘেঁষে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল- হার্টবিটের শব্দেই বুঝি হরিণ চলে যাবে। কিন্তু না, হরিণ চলে গেল পাখির শব্দে। হঠাৎ গাছের পাখিরা এমন চিচির মিচির শব্দ করা শুরু করল, সে শব্দেই হরিণ ভাইয়া সিগনাল পেয়ে গেল। কিছুক্ষণ গাছের আড়ালে আমরা মাটিতে গামছা বিছিয়ে শুয়েও ছিলাম, এই আশায় যে আধঘন্টা/১ ঘন্টা পর হরিণ ঠিকই আসবে, তখন কাছ থেকে ফটো তোলা যাবে।

কিন্তু, কিছুক্ষণ পর টের পেলাম এ দিকে যেহেতু টের পেয়ে গেছে, এ দিকে হরিণ আর আসবে না। বনের ভিতরে ঢোকা শুরু করলাম। বেশ খানিক যাওয়ার পর দেখলাম- এক পাল হরিণ হেটে হেটে চলে যাচ্ছে, পাশের হরিণ শাবকও লাফাতে লাফাতে চলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বনের একদম মাঝামাঝিতে চলে আসলাম, কিন্তু আর হরিণ দেখা হয় নাই, ফটোও তোলা হয় নাই। হরিণের ফটোগ্রাফি করতে প্রয়োজন ধৈর্যের, রীতিমত সেখানে ডালপালা দিয়ে ক্যাম্প করে পুরো একদিন থাকতে হবে সেক্ষেত্রে।



ফেরার পথে বন থেকে শুকনো কাঠ নিয়ে আসলাম প্রচুর- রাতে ক্যাম্পে ফায়ারিং করব বলে। ফেরার পথে সন্ধ্যায় যখন নদীর ধারের সবুঝ মাঠে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আকশে উঠল পূর্ণিমার লালচে চাঁদ। নৌকায় করে যখন ফিরে আসছিলাম সমুদ্র সৌকতের দিকটায়, তখন জীবনের অন্যতম এক অভিজ্ঞতা হল। স্বচক্ষে দেখলাম 'লাইফ অফ পাই'। অন্ধকারে নদীতে নৌকার বৈঠা পানির নিচের অংশ নীল হয়ে জ্বলতে লাগল।

আমি লাকড়ির একটা অংশ পানিতে ডুবালাম, চলন্ত নৌকার বেগে পানিতে লাকড়ির ডুবন্ত অংশও নীল হয়ে গেল। আমাদের বন্ধু ইমতিয়াজ আনন্দে উল্লসিত হয়ে হামু দিয়ে নিজের হাতখানাই পানিতে ডুবিয়ে দিল, ইমতিয়াজের হাতও পানিতে নীল হয়ে জ্বলতে লাগল। মাঝিরা বলল, রাত আরও অন্ধকার হলে নাকি মাছগুলাও জ্বলতে থাকে। বন্ধু জাহিদ তো এ দৃশ্য দেখে মনের আনন্দে গলা ছেড়ে গান ধরে বসল। এরপর নৌকার জাল দিয়ে (জেলেদের সহযোগিতায়) ধরে ফেললাম মাছ।

একটা ইলিশ নিয়ে চলে আসলাম (অবশ্য সেজন্যে কিছু পয়সাপাতিও খরচ করতে হয়েছে)।

সৌকতে নেমে লাকড়ি ফেলে কাছেই বাজারে গিয়ে সৈয়দ চাচার দোকান থেকে রাতের খাবার খেয়ে আসলাম। ফিরে এসে প্রথমেই আমাদের ক্যাম্প করে ফেললাম। ক্যাম্প বানাতে স্বেচ্ছায় সাহায্য করলেন গ্রামের এক চাচা। এমনকি কেরোসিন দেয়ার পরেও যখন লাকড়িতে আগুন ধরছিল না তখন চাচা পাশের এক খেজুর গাছে উঠে শুকনো ডাল পেড়ে আনলেন।

আগুন জ্বলল। আগুন শেঁকতে গ্রামের অনেকজন আসল। তাদের সাথে গল্প-গুজব করতে করতেই আমরা ইলিশ মাছের বারবিকিউ করে ফেললাম। ইলিশ মাছ কাটা থেকে শুরু করে আগুনের উপরে ধরা পর্যন্ত গ্রামের মানুষজন সাহায্য করল। চাচা পুরোটা সময় পাশেই ছিলেন, কিন্তু সবাই মিলে মাছ খাওয়ার সময় দেখি- কখন জানি চাচা উঠে চলে গেছেন।

নিঃস্বার্থ ভালবাসা দিয়ে ঋনী করে চলে গেলেন।
ইচ্ছা ছিল- পূর্ণিমার রাতে একই সাথে জোছনাস্নান ও সমুদ্রস্নান করব। কিন্তু, খেয়ালই ছিল না- রাতে ভাটা থাকে। সেসময় সমুদ্রে নামা যায় না। আমরাও পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিলাম।

গ্রামের মানুষজনের সাথে কিছুক্ষণ গল্প-গুজব-গান করার পর আগুন নিভিয়ে আসতেই শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতের পর হঠাৎ প্রচন্ড আলোতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি- চাঁদের আলো এত তীব্র, এত তীব্র হয়েছে যে, আমাদের ক্যাম্পের ত্রিপল ভেদ করে চোখে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আর থাকতে পারলাম না, তাবু থেকে বের হয়ে আসলাম। দেখি- চাঁদের আলোতে সত্যিই বাঁধ ভেঙ্গেছে।

চারপাশ একদম দিনের মতই পরিষ্কার। চাঁদটা এতই বড় লাগছিল, যেন সে প্রেগনেন্ট! :p সে আলোয় আমরা সমুদ্র পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। সমুদ্রপাড় থেকে ফিরে আসতেই ফজরের আজান দিয়ে দিল। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর ভোর হতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাজারে আসলাম সকালের নাস্তার জন্য। রাতে শীতটা ভালই লেগেছিল, ঘুমও ভাল হয়নি, ক্লান্তও ছিলাম, সাথে আমাদের ক্যাম্প করে থাকার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে- তাই পরের রাতটা হোটেলেই থাকাই ঠিক করলাম।



নিঝুমদ্বীপে ব্যক্তি মালিকানায় হোটেল, জেলা পরিষদ, রেড় ক্রিসেন্ট ও বন বিভগের ৫ টি বাংলোয় যে কেউ থাকতে পারেন। ভাড়া সহ্যসীমার ভিতরেই। তাছাড়া সস্তা মানের মসজিদের বোর্ডিং এ সিঙ্গেল বেডে খরচ পড়বে ২৫০ টাকা, ডাবল বেডে ৪০০/৫০০ টাকা। আর খাবারের হোটেলগুলো দেখতে পরিপাটি না হলেও খাবারের মান ভালই। সৈয়দ চাচার দোকানে ফ্রিজও আছে।

ভাল কথা- নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু ব্যাটারি আর সৌরবিদ্যুতের আলোয় কোন সমস্যা নেই। এখানে ভাড়ায় মোবাইল, ক্যামেরা চার্জ দেয়ারও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু, আমরা জানতাম না বলে দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণে চার্জবিহীন ক্যামেরায় কোন ছবিই তুলতে পারিনি। :'( আরও একটা কথা- এই সৈয়দ চাচার সাথে সুসম্পর্ক রাইখেন। মানুষটাও ভাল, এবং এলাকায় বেশ পরিচিতও।

সেই আপনাকে কম মূল্যে ট্রলার থেকে শুরু করে বাইক ম্যানেজ করে দিতে পারবে।

সকালের নাস্তার পর হোটেলে উঠেই দিলাম বিশাল এক ঘুম। এক ঘুমেই দুপুর। ঘুম থেকে উঠেই চলে আসলাম সৈকতে। সৈকতে সমুদ্রস্নানের পর পাড়ে বসে বিশ্রাম নিলাম।

ঘুড়ি বানিয়ে ঘুড়ি উড়ালাম অনেকক্ষণ। হরিণ দেখা তো হয়েছেই, শুধু ফটো তোলা হয়নি। কিন্তু, ক্যামেরায় তো চার্জ নেই। তাই আর বনে না গিয়ে দ্বীপটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গ্রামের লোকজনের সাথে কথা হল।

রাতে ফানুশ উড়ালাম। এরপর উঠলাম সৌকত থেকে বের হওয়া খালে থাকা মাঝধরা ট্রলারে, তাদের সাথে গল্পগুজব করলাম। এখানে না আসলে বুঝতে পারতাম- এরা ঠিক কি ধরনের জীবন যাপন করে। যেখানে আগের রাতে কম্বল-কাথা মুড়ি দিয়েও আমরা কাঁপছিলাম, সেখানে দেখি একেকজন স্রেফ একটা পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়েই শুয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করলাম- শীত করে না? 'শীত লাগবে ক্যান, কাঁথা আছে না?'- এমনভাবে উত্তর দিল যে শীত আবার কি জিনিস!! খুব কাছ থেকে পদ্মা নদীর মাঝি- কুবের দের দেখে আসলাম।


হাতিয়া থেকে ঢাকার লঞ্চ ছাড়ে সাড়ে ১২টায়। তাই, পরদিন ভোরে উঠে নাস্তা সেরেই রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। ভাল মত ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম, বার বার চেক করে নিলাম সবকিছু ঠিকঠাক মতন নিয়েছি কিনা। কিন্তু তারপরেও নিঝুম দ্বীপ ছেড়ে চলে আসার সময় থেকে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে- কি যেন নিয়ে আসিনি, কি যেন ফেলে এসেছি, কি যেন রেখে এসেছি!

[বিঃদ্রঃ ২ দিন ধরে অনেক চেষ্টার পরেও কেন জানি ব্লগে একটা ফটোও দিতে পারছি না। এজন্যে অনেক মন খারাপ আছে।

]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.