আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুঃখে-কষ্টে গুমরে কাঁদে পুলিশ

পুলিশের দুঃখ-কষ্ট বছরের পর বছর ধরে গুমরে কাঁদছে। অব্যাহত বৈষম্য, চরম অবহেলা, মানসিক নিপীড়ন, অব্যক্ত কষ্ট আর যন্ত্রণার অদৃশ্য শৃঙ্খলে আটকে আছে পুলিশের জীবন। তাদের দিন কাটে রাস্তায় রাস্তায়, রাত কাটে নির্দেশের অপেক্ষায়। চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাত্রা, যথেচ্ছ চলাচল, আরামের ঘুম  সবই হারিয়ে যায়। অধিকাংশ পুলিশ সদস্যকে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়।

তাদের অবকাশ যাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একটানা কাজ করতে গিয়ে অনেকের জীবনীশক্তি ক্ষয়ে যায়, রোগবালাই হয়ে ওঠে নিত্যসঙ্গী। সরকারি অন্যান্য সার্ভিসের কর্মচারীরা যখন ছুটিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ করেন তখনো পুলিশকে রাস্তায় দাঁড়িয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়। হরতালের সময় পুরো অফিসপাড়ায় যখন ছুটির আমেজ, তখন রায়ট গিয়ার পরে পুলিশকে থাকতে হয় মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। বোমা-গুলির শব্দে সবাই যখন জান-মাল রক্ষায় পালাতে ব্যস্ত, তখনও পুলিশকে ছুটে যেতে হয় বোমা-গুলির চরম ঝুঁকির স্থানে।

পুলিশের ঘুমানোর যেমন নির্দিষ্ট সময় নেই, তেমনি আদৌ ঘুমানোর সুযোগ মিলবে কি না তারও নেই নিশ্চয়তা। কয়েক মিনিটে সারতে হয় প্রাকৃতিক কাজ ও প্রাতঃরাশ, এর পরই ছুটতে হয় কর্তব্য পালনে। কনস্টেবল থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত প্রায় অভিন্ন রুটিন বজায় থাকে।

অন্তহীন সমস্যায় বেঁচে থাকা : হাজারো সমস্যার বেড়াজালে যুগ যুগ ধরে বন্দী বাংলাদেশ পুলিশ। আবাসন ও যানবাহন সংকট কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।

ভাড়া করা ভবন ও অন্যের জমিতে চলছে অধিকাংশ থানা, ফাঁড়ি, বঙ্, তদন্ত কেন্দ্রের কার্যক্রম। সেসব স্থাপনায় স্থানাভাবে খুবই ঠাসাঠাসি করে বাস করতে হয় পুলিশ সদস্যদের, চালাতে হয় দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড। ছোট ছোট কক্ষকে বানানো হয়েছে অস্ত্রাগার, হাজতখানা ও কার্যালয়। কার্যালয়ের চেয়ার টেবিল ভাঙাচোরা। সারা দেশে এ ধরনের সাড়ে চার শতাধিক পুলিশ ফাঁড়ি ও ক্যাম্প অরক্ষিত হয়ে আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় আট হাজার পুলিশ সদস্যের আবাসস্থল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। সেখানে কোনো পুলিশ সদস্যের জন্য নির্দিষ্ট বিছানা নেই। এক বিছানাতেই পালা করে একাধিক পুলিশ সদস্য থাকতে বাধ্য হন। একজন ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গেলেও ফিরে এসে আর বিশ্রামের সুযোগ পান না। ততক্ষণে অপেক্ষমাণ অন্য কোনো পুলিশ সদস্য সেই বিছানায় শুয়ে পড়েন।

ছারপোকা আর মশার কামড় তাদের নিত্যসঙ্গী, দিনের বেলায়ও ব্যারাকের রুমে রুমে চলে ইঁদুরের ছোটাছুটি। খাবারের সমস্যা আরও প্রকট। রাজারবাগ লাইন্সে খাবার খেলেও বিল, না খেলেও বিল দিতে হয়। একজন কনস্টেবল নিজেরই একান্ত কথা তুলে ধরে বলেন : 'আমি পুলিশ- প্রজাতন্ত্রের বেতনে জনগণের সেবক। আমার হাত, পা, মুখ বাঁধা-নানা অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেও আমার মুখ খুলতে মানা।

আমি শ্রম আইনের কথা বলতে পারি না, বলি না ওভারটাইমের কথা। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, নিশ্চিত আবাসন, নূ্যনতম বেঁচে থাকার সুযোগ-সুবিধার কোনো কিছু আমি চাইতে পারি না। গোটা বাংলাদেশ আমার কর্মক্ষেত্র- অর্ধাহারে-অনাহারে অমানবিক জীবন ধারণের কথাও আমি বলতে পারি না। '

সরকারি দায়িত্ব পালন করতেও নিজের টাকায় কিনতে হয় মোটরসাইকেল ও জ্বালানি। থানায় আটককৃতদের খাওয়াতে হয় নিজের টাকায়।

সোর্সকে টাকা দিতে হয় নিজের পকেট থেকে। অধিকাংশ মামলার বাদী-সাক্ষীরা গরিব বলে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের চরম অনীহা। তাদের যাতায়াত ভাড়া দিয়ে আদালতে হাজির করার দায়িত্বও পালন করতে হয় পুলিশকেই। লাশ পরিবহনের বিলটাও পরিশোধ করতে বাধ্য হতে হয়। অথচ এসব খাতে সরকারি বরাদ্দ আছে, বিল প্রস্তুত করে মাসে মাসে তাগিদ দিলে বছর শেষে কিছু পাওয়া যায়।

এতসব ঝক্কিতে খাজনার চেয়ে বাজনার দাম বেশি হয় বলে নিজের পকেট থেকেই যাবতীয় ব্যয় মেটাতে বাধ্য হন দারোগারা।

পুলিশ হত্যার বিচার হয় না : প্রিয়জন হত্যার 'বিচার না পাওয়ার' এক জগদ্দল পাথরচাপা কষ্ট-যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয় হত্যার শিকার পুলিশের পরিজনদের। শোকগ্রস্ত এসব পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'রাষ্ট্র ও নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা জীবন হারাচ্ছেন। অথচ আমরা বিচারের সান্ত্বনা পর্যন্ত পাচ্ছি না। ' অভিযুক্তদের কখনো কখনো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেলেও তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না।

২০০৪ সালে রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে পড়েত বাহিনী। ওই হত্যার বিচার হয়নি এখনও। পরিবারের সদস্যদের দাবি, পুলিশের সহযোগিতাও পাচ্ছেন না তারা। ১৯৮৮ সালে মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানা লুটের সময় চরমপন্থিরা খুন করে পুলিশ কনস্টেবল মোশাররফ হোসেনকে। ওই হত্যার তদন্ত প্রতিবেদনটি পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

এভাবেই পুলিশ হত্যা ঘটিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে খুনিরা। ফলে দিন দিন পুলিশ হত্যা আতঙ্কজনকভাবে বাড়ছে, প্রায়ই আক্রান্ত হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। হরতালকারীদের ইটের আঘাতে থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত সহকর্মীর লাশ ধরে কান্নারত এক কনস্টেবল বলে উঠেন, 'আমরাও রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, অথচ আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল, গুলি, বোমা ছুড়লেও পাল্টা জবাব দিতে পারি না। আমার সহকর্মীকে চোখের সামনে ইট দিয়ে থেতলে নৃশংসভাবে হত্যা করলেও আমার কিছু বলার অনুমতি নেই। আমার হাতে মারণাস্ত্র, তপ্ত বুলেট নলে ঢুকানো_ তবু উপরের নির্দেশ ছাড়া আমি ট্রিগারে চাপ দিতে পারি না।

আমি হাত বাঁধা পুলিশ। মানুষের ভালোবাসা থেকে কিছুটা নিচে আমার স্থান, কেবলই ঠাট্টা আর তাচ্ছিল্যের প্রাণী আমরা...'

ঝুঁকির মূল্য ২৯০ : পুলিশ বাহিনীতে বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ ধরনের কোনো ভাতার ব্যবস্থা নেই। প্রতি বছর থোক বরাদ্দের ভিত্তিতে কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাদের মাসিক ৪৩০ টাকা করে ঝুঁকিভাতা দেওয়া হয়। বরাদ্দ না থাকলে আরও কমে যায় টাকার পরিমাণ। গত কয়েক মাস ধরে বিনা ঘোষণায় ১৪০ টাকা কমিয়ে এখন ঝুঁকিভাতা দেওয়া হচ্ছে ২৯০ টাকা।

র্যাবের সব সদস্যকে মূল বেতনের ৭০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা দেওয়া হয়। সার্বক্ষণিক কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা থেকে বাদ পড়ছেন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। পুলিশ ইন্সপেক্টরদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্যাডার থেকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করার অজুহাতে বন্ধ করা হয়েছে তাদের ঝুঁকিভাতা। কিন্তু ইন্সপেক্টরদের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন বন্ধ হয়নি মোটেও। ইন্সপেক্টর পদমর্যাদা প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করাটা রীতিমতো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাদের পোশাক ভাতা দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে।

ছুটি যেন সোনার হরিণ : সরকারি চাকরির সব ক্ষেত্রেই কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা আছে। এ সুবিধা থেকে বরাবরই বঞ্চিত শুধু পুলিশ। কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে ওভারটাইমের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে বহুবার পুলিশের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এ সুপারিশ কখনই আমলে নেওয়া হয়নি।

পুলিশের অমানবিক কর্মঘণ্টা নিয়ে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও টুঁ শব্দটি করেন না। পুলিশ সদস্যদের কাছে 'ছুটি' যেন সোনার হরিণ। পাওনা ছুটি চাইতে গেলেও পুলিশ সদস্যদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। টাকা ছাড়া ছুটি মেলে না তাদের। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের এক কনস্টেবল বলেন, 'ছুটি চাইলেই স্যারেরা ক্ষেপে যান।

তা ছাড়া ছুটির ফরম পূরণ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠতে হয়। প্রথমে এলসি (লার্নড কনস্টেবল), পরে সিএইচএম (কোম্পানি হাবিলদার মেজর), সবশেষে সিসির (কোম্পানি কমান্ডার) অনুমতি নিতে হয়। ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, এত কিছুর পরও দিনপ্রতি ছুটির জন্য এলসিকে ১০০ টাকা না দিলে ছুটির কথা কল্পনাও করা যায় না। মেয়ের কাছে এক পুলিশ অফিসার বাবার পাঠানো ম্যাসেজ- 'মা আমার। আজ আর তোমার কাছে পেঁৗছানো হলো না।

আমি অনেক চেষ্টা করেছি। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো_ আর অপেক্ষা করো না। তোমার আম্মু আর বন্ধুদের নিয়ে কেক কাটো, মজা কর। তোমরা সবাই একসঙ্গে হ্যাপি বার্থ ডে বলে আমাকে শোনাও-মোবাইল ফোন কানেই ধরে আছি। আমি দুর্গম চরের ভয়াল অভিযানস্থল থেকেই তোমার জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চাই।

পাপা, সকাল থেকে তুমি বারবার জানতে চেয়েছো আমি রওনা করেছি কিনা, পাজামা-পাঞ্জামি ঠিক ঠিক মতো ইস্ত্রি করিয়েছি কি না, ব্যাগটা কি গোছানো হলো? তখনও আমি ছুটির জন্য ছুটোছুটি করছিলাম, শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই যেতে না পারায় এখন অনেক বেশি খারাপ লাগছে। তুমি বড় হলে বুঝবে- তোমার বাবা মানুষ না, শুধুই পুলিশ। যখন তখন তারা ছুটি পায় না। অনেক অনেক সুন্দর একটি সন্ধ্যা কাটুক এই কামনা করছি। এ তো আর কদিন, আসছি পাপা! অনেক দিনের জন্য তোমার কাছেই চলে আসছি।

'

 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।