আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : শুধু স্বপ্ন নয় - ৩ (মৌচাকে ঢিল )

ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...

শেষবারের মতো ব্যাগের ভেতরটা ভাল করে দেখে নেয় লাবণী। দু জোড়া জামা, তোয়ালে, কিছু টুকিটাকি আর গয়নার বাক্সটা। ক্যাশ টাকা খুব বেশী যোগাড় করা যায়নি। কিন্তু বাবার ক্যাশ বইটা নিতে পেরেছে। বাবার স্বাক্ষর খুব ভালই নকল করতে পারে সে।



বাদল পই পই করে বলে দিয়েছে, জামা-কাপড় বা এইসব হাবিজাবি দিয়ে যেন ব্যাগ ভারী করে না ফেলে। বরং গয়না-গাটি, আংটি, টাকা- এগুলো বেশী করে নিতে। টাকা হাতে থাকলে বাকী সব জিনিস যোগাড় করা কোন ব্যাপারই না।

ব্যাগের চেইন টেনে তালা মেরে দেয় লাবণী। ছোট হাত ব্যাগে রাখে চাবিটা।

হাত ব্যাগটা বিছানায় বালিশের কাছেই রাখে। যে সালোয়ার-কামিজ সকালে পড়বে সেগুলোও চেয়ারের উপর রাখে যাতে সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। সকালে, মানে- ভোরে। আসলে ভোরেরও আগে। চারদিক অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়তে হবে, ফজরের আযান শুনে নামাযীরা ঘরের বাইরে বের হওয়ার আগেই - বলেছে বাদল।

বাদলের পরামর্শমতোই শরবতের সাথে ঘুমের ওষুধ গুলে বাড়ির সবাইকে খাইয়ে দিয়েছে লাবণী। সবাই মানে - বাবা, মা, বড় ভাই, ভাবী আর সমবয়সী এক খালাতো বোন। খালাতো বোনটা ওদের সাথে থাকে না। আজ রয়ে গেছে পরশুর অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যেই। রাতে শুতে চেয়েছিল লাবণীর সাথেই।

কিন্তু ও সাথে থাকলে গল্পে গল্পে আর ঘুম ভালমতো হবে না - এই অজুহাত দেখিয়ে মাকে দিয়ে ওকে গেস্ট রুমে শুতে পাঠিয়েছে লাবণী।

পরশু লাবণীর বিয়ে। পাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবসায়ী। লাবণীর চেয়ে বয়সে আট বছর বড়। বাড়ি একই জেলায়, ভিন্ন উপজেলায়।

পাত্রের বাবার চালের আড়ত, রাইস মিল, আলুর গুদাম আছে। অনার্স পাস করে বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করে পাত্র। লাবণীর বাবাও রাইস মিলের মালিক। এই গ্রামের মোটামুটি ধনবানদের মধ্যে একজন। ছেলে-মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা রুম সহ পাকা একতলা বাড়ি করেছেন।

বাবার রেখে যাওয়া জমিজমার পরিধি বাড়িয়েছেন। নিজে এসএসসি পাস হলেও ছেলেকে মাস্টার্স পাস করিয়েছেন, মেয়েকেও পড়াচ্ছেন। ব্যবসায়িক সূত্রে পাত্রের বাবার সাথে তার পরিচয় ছিল আগে থেকেই। সেই সূত্র ধরেই ছেলে-মেয়ের বিয়ের আলাপ।

লাবণীর অমতে হচ্ছে এই বিয়ে।

তবে, এই অমত লাবণীর মনে মনেই। প্রকাশ্যে কখনো বলেনি। তার কোন ওজর-আপত্তি বাবা শুনবেন না - ভালো করেই জানে সে। জানে, মা-ভাই-ও বাবার বিপক্ষে যাবে না। মাস খানেক আগে রেখে-ঢেকে বাদলের কথা তুলেছিল মা-এর কাছে।

মা তুলেছিলেন বাবার কানে। তার ফলাফল - দুদিন ঘর-বন্দী, মোবাইল ফোন হাতছাড়া, কলেজ যাওয়া বন্ধ হওয়ার হুমকি। মনের কথা মনে চেপে প্রকাশ্যে বাবা-মার কাছে নতি স্বীকার করে লাবণী। বাদলের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না আর- প্রতিজ্ঞা করতে হয় মা-এর হাত ধরে। এর পরই বাবা উঠে পড়ে লাগেন লাবণীর জন্য পাত্র খুঁজতে।

মেয়ের বিপথগামিতা ঠেকাতে এইচএসসি পরীক্ষার আগেই তাকে সুপাত্রস্থ করবেন স্থির করেন। সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে ঠিকও করে ফেলেন পাত্র।

ঘটনাপ্রবাহে তাল মিলিয়ে চলে লাবণী। গোপনে যোগাযোগ থাকে বাদলের সাথেও। প্রাথমিক আলাপ থেকে পান-চিনি পেরিয়ে আজকের গায়ে হলুদ পর্যন্ত প্রকাশ্য আগ্রহের সাথেই অংশগ্রহণ করে সে।

বাবা-মার বিশ্বাস অর্জনের ফলস্বরূপ মোবাইল ফোনটা থাকে নিজের অধিকারেই, কলেজ যাওয়ার বাধাও দূর হয়। সেই সুযোগে বাদলের সাথে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলে।
শুয়ে শুয়ে আরেকবার মনে মনে পরিকল্পনাটা ঝালাই করে নেয় লাবণী। আজ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে মায়ের ছড়া থেকে আলমারীর চাবিটা সরিয়ে কিছু ক্যাশ বের করে নিয়ে চাবিটা আবার রেখে দিয়েছে যথাস্থানে। বাড়ির মূল দরজার দুটো চাবির একটা, যেটা মায়ের কাছে থাকে, নিয়ে রেখেছে নিজের কাছে।

অনুষ্ঠান শেষে দাওয়াতীরা সবাই চলে যাওয়ার পর বাবা-মা-ভাই-ভাবী আর খালাতো বোনকে ওষুধ-মেশানো শরবত খাইয়েছে। লাবণী যখন বাসা থেকে বের হবে, ওষুধের প্রভাবে তখনো ওরা থাকবে গভীর ঘুমে।

ঘুমানোর আগে শেষবারের মতো বাদলের সাথে মোবাইলে কথা বলে নেয় লাবণী। বাদল জেলা সদরে এক হোটেলে থাকবে আজ রাতে। সেখান থেকে লাবণীদের বাসা মটর সাইকেলে পনের-বিশ মিনিটের পথ।

মোবাইলে নিচু সিংগল টোনের সাথে ভাইব্রেশন মোডে অ্যালার্ম দিয়ে পেটের সাথে বেধে রাখে লাবণী। আর অ্যালার্ম মিস হলেও বাদল তো ফোন দেবেই সাড়ে চারটার সময়। লাবণী বের হবে ভোরের কাক ডাকারও আগে। .....

কর্কশ কা-কা শব্দেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে লাবণী। বুকের ভেতরটায় ধুকপুকানি টের পায়।

মোবাইলটা চোখের সামনে নিয়ে এসে দেখে অ্যালার্ম বাজতে তখনো মিনিট পাঁচেক বাকী। এতো ভোরে তো কখনো কাক ডাকতে শোনেনি লাবণী।

না কি কাক ডাকে এ সময়টায়, কিন্তু কখনো ভোরে ওঠা হয়নি বলে শোনা হয়নি?

‘কা-কা’ শব্দে আবার ওষুধের প্রভাবই না কেটে যায়- শংকা হয় লাবণীর। মশারি সরিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নামে। পা ফেলতেই কচ করে একটা শব্দ হয়।

মোবাইলে আলো জ্বেলে পায়ের কাছে ধরতেই গা গুলিয়ে ওঠে লাবণীর। থেঁতলে পায়ের নিচে সেঁটে গেছে একটা তেলাপোকা, নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে। পা ঝাড়া দিয়ে দ্রুত বারান্দার দিকে এগোয়। অন্ধকারে চোখে পড়ে না, কিন্তু আওয়াজ শুনে বোঝা যায়, উঠোনে কাপড় শুকানোর দড়িটার উপর দাঁড়িয়ে আছে কাকটা। চাপা স্বরে হুস হুস করে হাত নেড়ে কাকটাকে তাড়াতে চেষ্টা করে লাবণী।

কাকের কর্কশ আওয়াজ বন্ধ হয়। পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে লাবণী। অন্ধকার চোখে কিছুটা সয়ে আসার পর বুঝতে পারে, কাকটা চলে যায়নি, পাশেই পেয়ারা গাছটার উপরে গিয়ে বসে আছে। তবে আর কোন আওয়াজ করে না কাকটা।



‘টিক’ করে একটা শব্দের পর হাতের মধ্যে মোবাইলটা নড়তে শুরু করায় তৎপর হয় লাবণী। ঘরের ভিতর ফিরে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালায়। মা-কে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিটায় আরেকবার চোখ বুলায়। চতুর্থ লাইনে একটা ভুল বানান চোখে পড়ে। কলম দিয়ে কেটে সেটা ঠিক করার সময় মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।

স্ক্রীনে ভেসে ওঠে - ‘স্বপ্ন’। বাবার কাছ থেকে মোবাইলটা ফেরত পাওয়ার পর বাদলের ফোন নম্বর এই নামেই সেভ করে রেখেছে সে। ভেবে রেখেছিল, কেউ কখনো ফোন চেক করে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে- সহপাঠীর নাম। কিন্তু তার প্রয়োজন পড়েনি কখনো।

একবার রিং শেষ না হতেই ফোন রিসিভ করে লাবণী।

ওপাশ থেকে বাদল বলে- ‘উঠছো?’

চাপা গলায় উত্তর দেয় লাবণী- ‘হ্যাঁ। ’

‘আমি রওনা দিলাম। ’

‘পনের মিনিট পরে সামনের মোড়ে থাকবা। এসে ছোট্ট একটা মিস কল দিবা। ’

দ্রুত তৈরী হয়ে নেয় লাবণী।

মিস কল পেতেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। মূল দরজাটা বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়। এই তালার আরেকটা চাবি থাকে বাবার কাছে। কাউকে ডেকে তালা খুলে নিতে পারবে সহজেই।
সামনের মোড় বাসা থেকে এক মিনিটের হাঁটা দূরত্ব।

কাঁপা কাঁপা পায়ে যেন অনেকক্ষণ পেরিয়ে সামনের মোড়টায় পৌঁছতে পারে লাবণী। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকে - এই বুঝি কেউ দেখে ফেললো, এই বুঝি কেউ পেছন থেকে ডাক দিল। মোড় ঘুরে বট গাছটার নিচে বাদলকে দেখতে পেয়ে অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ব্যাগটা বাদলের হাতে দিয়ে মটরসাইকেলের পেছনে চড়ে বসে সে।

বাদল চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে - ‘গয়না সব আনছো?’

লাবণীও চাপা স্বরেই বিরক্তি প্রকাশ করে- ‘হ্যাঁ বাবা, কালকে রাত্রেই তো বললাম।



‘টাকা?’

‘হ্যাঁ, যতটুক পারছি। আর ক্যাশ বই আছে বাবার। এখন কথা না বইলা টান দাও। ধরা খাবো তো!’

মটর সাইকেল স্টার্ট দেয় বাদল। পরম নির্ভরতায় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখে লাবণী।



চুপচাপ কিছুটা সময় চালিয়ে যায় বাদল। গায়ের সীমানা পার হওয়ার পর মুখ খোলে লাবণী - ‘কতক্ষণ লাগবো তোমার বাসায় পৌঁছতে?’

‘প্ল্যান একটুখানি চেঞ্জ হইছে। আপাতত হোটেলে থাকমু কিছুক্ষণ। আমার মাল-সামানা ঐখানে। এত সক্কাল সক্কাল বাসায় যাওয়া যাবো না।

সবাই ঘুমায়া থাকবো। বেলা একটু বাড়লে যামু। সদর থাইকা হোন্ডায় আরও এক ঘন্টা। ’

জেলা সদরে মহিলা কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনটা একটুখানি কেমন করে ওঠে লাবণীর। আর কি কখনো এই কলেজে পড়া হবে না তার? বাবা-মা বাদলকে মেনে নিলে সব আগের মতোই হয়ে যাবে, কিন্তু মেনে না নিলে? বাদল বলেছে- তখন অন্য কোনো কলেজে ভর্তি করে দেবে তাকে।


পার্কটাও পেরিয়ে যায় ওরা। মোবাইল ফোনে বেশ কিছু দিন কথা বলার পর প্রথম বাদলের সাথে দেখা হয় এই পার্কেই। এর পরও কয়েকবার ওরা দেখা করেছে পার্কে। অবশ্য এই পাঁচ মাসের সম্পর্কে ওরা ফোনেই কথা বলেছে বেশী, দেখা হয়েছে কমই।

সদরের এক প্রান্তের এক হোটেলে উঠেছে বাদল।

অত ভোরে সঙ্গে একটা মেয়েকে নিয়ে ঢুকতে দেখে টুলে বসে ঢুলতে থাকা দারোয়ান কেমন চোখে তাকায়। তবে কিছু বলে না। বাদল ওর হাতে একশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। হোটেলে আর কারো জেগে থাকার আওয়াজ পাওয়া যায় না।

রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই বাদল জড়িয়ে ধরে লাবণীকে।

সারা শরীর কেমন ঝিম ঝিম করে ওঠে লাবণীর। অবশ হয়ে নেতিয়ে পড়তে চায়। এত কাছে তার স্বপ্ন ! একদম হাতের মুঠোয় যেন ! পার্কের ঝোপের আড়ালে আগেও তাকে জড়িয়ে ধরেছে বাদল, ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে। কিন্তু এই অবশ করা ভাল লাগার অনুভূতি কখনো হয়নি। কেউ দেখে ফেলার ভয় আর তাড়াহুড়োয় চুম্বন-আলিঙ্গনের প্রকৃত উষ্ণতা কখনো অনুভবই করেনি লাবণী।



আরো এগোয় বাদল। লাবণী একবার শুধু বলে - ‘বিয়ের আগে...?’

বাদল মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে - ‘আমারে বিশ্বাস করো না তুমি?’

ঐ এক প্রশ্নেই ধ্বসে পড়ে লাবণীর মৃদু প্রতিরোধের দেয়াল।

সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা যেন আজ বুঝতে পারে লাবণী। সুখের ভেলায় চড়ে তার স্বপ্নকে জড়িয়ে রাখে অনেকক্ষণ। এক সময় গলায় জড়িয়ে রাখা লাবণীর হাতদুটো সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে বাদল।

ঘুম ঘুম মোহাবিষ্ট চোখে বাদলের দিকে চেয়ে থাকে লাবণী। বাদল মৃদু স্বরে বলে - ‘ব্যাগটা দেখি। ’

ইশারায় হাত ব্যাগটা দেখিয়ে লাবণী বলে - ‘চাবি ওর ভেতর। ’ সুখ সুখ ভাবটা নষ্ট করে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না ওর।

বাদল নিজেই হাত ব্যাগ থেকে চাবি বের করে বড় ব্যাগটা খোলে।

গয়নার বাক্সটা খুলে গয়নাগুলো দেখে নেয়। পাত্রপক্ষ গয়নাগুলো দিয়েছে লাবণীকে বিয়ে উপলক্ষ্যে।

চেক বইটা বের করে উল্টেপাল্টে বাদল বলে - ‘তোমার বাবার স্বাক্ষর নাই তো কোনটাতেই। এই চেক বই তো চলবো না। ’

‘চলবো।

আমি বাপের স্বাক্ষর দিতে পারি। ’

‘বাহ, তাই নাকি? তা আমার শ্বশুরের অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে জানো?’
ঠোঁট উল্টায় লাবণী। জানে না সে।

‘তাইলে ব্ল্যাংক চেক স্বাক্ষর কইরা দাও। আমি ব্যাংকে খোঁজ নিয়া টাকার অংক বসায়া নিমু।



সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় লাবণী - ‘এখনই টাকা তোলার কি হইলো, ক্যাশ তো আছেই!’

বাদল হাসে - ‘আরে পাগলী! তোমার বাপে যখন টের পাইবো ক্যাশ বই নাই, অ্যাকাউন্ট সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ কইরা দিবো না! তখন তো আর টাকা পাবা না। আজকে সকাল সকালই টাকা তুইলা ফেলতে হবো। ’

ঠিক ই তো! এই কথাটা ভেবে দেখেনি লাবণী।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠে বসে সে। বাবার স্বাক্ষর নকল করে বসায় চেকে।



স্বাক্ষর কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বাদল অনিশ্চিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে- ‘তুমি ঠিক জানো এইটাই সাইন?’

‘একদম’- পূর্ণ নিশ্চয়তার স্বরে বলে লাবণী। বাবার স্বাক্ষর করা চেকে সে নিজেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছে বার দুয়েক।

‘তাহলে তৈরী হয়া নাও। ’ বাদল তাগাদা দেয়।

‘এখনই?’ - লাবণী কিছুটা বিস্মিত।

সকাল তো বেশী হয় নাই।

‘অসুবিধা নাই। আমরা যাইতে যাইতে বাড়ির সবার ঘুম ভাইঙ্গা যাইবো। আর তোমারে বাড়িত রাইখা আমার আবার ব্যাংকে আসা লাগবো। ’

উঠে দাঁড়িয়ে বাদলকে জড়িয়ে ধরে লাবণী।

ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে। মৃদু হেসে সরিয়ে দিয়ে বাদল বলে- ‘তাড়াতাড়ি করো। ’

ঠোঁট উল্টে কৃত্রিম অভিমানের ভান করে লাবণী তোয়ালে আর জামা হাতে নিয়ে রুম সংলগ্ন বাথরুমে ঢোকে। দরজা বন্ধ করতে যাবে, এ সময় বাদল বলে - ‘খোলা থাক। ’

দরজাটা আবার খুলে ভ্রƒ কুঁচকে বাদলের দিকে তাকায় লাবণী- ‘কেন?’
বাদলের ঠোঁটে দুষ্টুমীর হাসি।



‘শয়তান’ - আহ্লাদের স্বরে বলে লাবণী দরজা ভেজিয়ে দেয়। কিন্তু ছিটকিনি তোলে না।

বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে সাবান ঘষতে ঘষতে পেছনে দরজাটা খুলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায় লাবণী। পেছন থেকে বাম হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বাদল। আবেশে চোখ বুজে যায় লাবণীর।

বুকে হাত পড়তেই পিছন দিকে হেলে বাদলের উপর শরীরের ভার চাপিয়ে দেয়। বুক থেকে গলা হয়ে হাত উঠে আসে উপরে। মুখের উপর আসতেই আচমকা পেছন দিকে টান অনুভব করে লাবণী, মুখটা উঠে যায় উপর দিকে। হঠাৎ কোথায় কাক ডাকার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। অস্বস্তি নিয়ে চোখ খোলে লাবণী।

চোখ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় সামনেটা ভাল দেখা যায় না। চোখের মণি ঘুরিয়ে নিচের দিকে এনে কোনোমতে আয়নার দিকে তাকায়। দেখতে পায়, তার মুখের উপর বাম হাত চেপে বসেছে বাদলের। আয়নার প্রতিবিম্বে বাদলের দৃষ্টি দেখে লাবণীর অস্বস্তি ভয়ে রূপ নিতে থাকে।

শেষ মুহূর্তে বাদলের ডান হাতটা দেখতে পায় লাবণী - দেখতে পায় হাতে ধরা ছোরাটাও - আয়নায়।



আতংকের তীব্র অনুভূতিটা পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই গলায় ছোরার তীক্ষèতা টের পায়। বিস্ফোরিত চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে আসার আগে আয়নার গায়ে নিজের রক্তের দাগ দেখতে পায় লাবণী।

কর্কশ একঘেয়ে ‘কা-কা-কা’ চলতেই থাকে বিরতিহীন ।
.......

ধড়মড়িয়ে ওঠে বসে লাবণী। ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর।

বুকের ভেতরটায় হৃৎপিন্ডটা লাফাচ্ছে অনির্দিষ্ট ছন্দে। মোবাইলটা চোখের সামনে নিয়ে এসে দেখে অ্যালার্ম বাজতে তখনো মিনিট পাঁচেক বাকী। ঘুমটা ভেঙ্গেছে কাকের ডাকে। স্থির হতে কিছুটা সময় নেয় লাবণী। ডেকেই চলে কাকটা - বিষণœতা মাখা একঘেয়ে ‘কা কা কা’।



মশারি সরিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নামে লাবণী। পা ফেলতেই ‘কচ’ করে একটা শব্দ হয়।

চকিতে হৃৎস্পন্দন একটা মিস হয়ে যায় যেন। আলো না জ্বেলেই বুঝতে পারে পায়ের নিচে ওটা কি। তবু মোবাইলে আলো জ্বেলে পায়ের কাছে ধরে।

মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে লাবণীর - থেঁতলে পায়ের নিচে সেঁটে আছে নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়া একটা তেলাপোকা।

পা ঝাড়া দিয়ে তেলাপোকাটা খসিয়ে দ্রুত বারান্দার দিকে এগোয় লাবণী। অন্ধকারে চোখে পড়ে না, কিন্তু সে ঠিক জানে, উঠোনে কাপড় কাঁচার দড়িটার উপর দাঁড়িয়ে আছে কাকটা। হুস হুস করে অনির্দিষ্ট স্বরে হাত নেড়ে কাকটাকে তাড়াতে চেষ্টা করে। কর্কশ আওয়াজ বন্ধ হয়।

শোনা যায় পাখা ঝাপটানোর শব্দ। কিন্তু লাবণী জানে, কাকটা চলে যায়নি, উড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে বসে আছে পেয়ারা গাছের ডালে - নিশ্চুপ।

কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে লাবণী- ‘টিক’ করে একটা শব্দ, তারপর হাতের মধ্যে মোবাইলটা নড়তে শুরু করার প্রতীক্ষায়।

অ্যালার্মের ভাইব্রেশন শুরু হতেই ঘরের ভিতর ফিরে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালায়। বাংলা বইয়ের ভেতর থেকে মাকে লেখা চিঠিটা বের করে।

প্রথমেই তাকায় চতুর্থ লাইনটায়।

ভুল বানানটা চোখে পড়ে চতুর্থ লাইনেই। পাশে পড়ে থাকা কলমটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লাবণী। বুকের ভেতর ড্রাম পেটানোর শব্দ, মুখ-গলা শুকিয়ে কাঠ, বাতাসের তৃষ্ণায় ফুসফুস যেন সংগ্রাম করছে, চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে।

মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে এ সময়।

স্ক্রীনে ভেসে ওঠে - ‘স্বপ্ন’।

স্ত্রীনের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে লাবণী।

নিচু স্বরে মৃদু লয়ের বাজনা একবার বাজে। ..দুবার। ...তিনবার।

....চারবার।

ফোনের দিকে হাতটা বাড়ায় লাবণী। .....

..............................................
'মৌচাকে ঢিল' 'ফাল্গুনী ভালবাসা' সংখ্যায় (মার্চ, ২০১৪) 'স্বপ্নর হাত ধরে' শিরোনামে প্রকাশিত


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.