আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৫৭'র সূর্যাস্ত



১৭৫৭ খৃস্টাব্দের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ওপলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না। নবাব বুঝতে পারলেন, সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।





বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মিরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা বাদ দিলেন।

তিনি মিরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মিরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মিরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।





২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। ১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষ্মবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন।

বাগানের উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মিরমদন ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন।

মিরমদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মিরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মিরমদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজদ্দৌলার গোলা বারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মিরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন।

কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মিরমদন মৃত্যুবরণ করেন।





গোলান্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজদ্দৌলা মীরজাফর ও রায় দুর্লভকে তাঁদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তাঁর নির্দেশ অমান্য করলেন। তাঁদের যুক্তি হলো গোলন্দাজ বাহিনীর আশ্রয় ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েক শ গজ।

.........................

তারপরও নবাবের অনুগত কিছু সংখ্যক সেনাপতি তাদের সৈন্য সহ ইংরেজদের তীব্র মোকাবেলা করতে থাকে। ইংরেজর বাহিনী এই তীব্য হামলায় টিকতে না পেরে অন্য পন্থা খুঁজতে থাকে এবং মীর জাফরকে কোন উপায় বের করতে গোপনে সংবাদ পাঠায় যুদ্ধক্ষেত্রে। মীর জাফর তখন নবাবকে সৈন্যরা যুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠেছে এই মিথ্যা কথা বলে যুদ্ধ বিরতির জন্য বুদ্ধি দেয়। কিন্তু নবাবের অনুগত সেনাপতিরা মীর জাফরের এই সিদ্ধান্ত মেনে না নিতে অনুরোধ করে। তারা যুদ্ধের পরিস্থিতি তুলে ধরে নবাব বোঝায় যে তাদের এই অবস্থায় আর এক ঘন্টাও ইংরেজরা তাদের সাথে টিকতে পারবে না।

তখন দুপুর, নবাব মীর জাফরকে বিশ্বাস করে সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এবং তার শেষ চুড়ান্ত ভুলটিই করে। সৈন্যরা তখন ছাউনি তে ফিরে আসে। ঠিক এমন মুহুর্তে মীর জাফর ইংরেজদের তাৎক্ষণিক হামলার জন্য আহ্বান করে। ইংরেজরা এই অপেক্ষায়ই ছিল, এবং দেরি না করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্য বাহিনীকে অপ্রস্তুত অবস্থায় হামলা করে। সৈন্যরা সম্পুর্ণ অপ্রস্তুত থাকায় একরকম বিনা বাধায় ইংরেজরা নবাবের সৈন্যদেরকে কব্জা করে ফেলে।

নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজদের পক্ষে সাতজন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়। নবাবের অনুগতরা নবাবকে রাজধানীতে পালিয়ে যেতে বার বার অনুরোধ করে। তীব্র অনিচ্ছা সত্বেও কোন উপায় না দেখে সিরাজদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি।


নবাব মধ্যরাতে মুর্শিদাবাদ পৌঁছে সভার আহ্বান করলে কেও কেও তাঁকে আত্মসমর্পন করতে, কেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আবার কেও তাঁকে পালিয়ে যেতে উপদেশ দেয়।



সিরাজদ্দৌলা তাঁর সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে পরদিন (২৪জুন) সকাল ১০টায় রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাধিনায়ক মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন।
২৪জুন মধ্যরাতে মীর জাফর সিরাজকে ধরতে লোক পাঠায়। ২ জুলাই সিরাজ রাজমহল পৌঁছেন এবং এক পরিত্যাক্ত বাগানে আশ্রয় নেন।

কিন্তু তিনি শীঘ্রই তাঁর অধিনস্ত সেই এলাকার শাসকের হাতে ধরা পড়েন যিনি মীর জাফরের ভাই, যাকে এক সময় সিরাজ তার কুকর্মের জন্য শাস্তি দেন।
এক সময়ের বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বন্দি অবস্থায় মীর জাফরের চালিত সভায় হাজির করলে মীর জাফর তার পুত্র মীর মিরনকে সিরাজের মৃত্যু দন্ডের দায়িত্ব দেন এবং ওই রাতেই সিরাজকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া হয় এবং আলীবর্দি খানের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয় বলে কথিত আছে।

মীর জাফর এবং ইংরেজদের মধ্যকার দেনা পাওনা অনুযায়ী ভাগ বাটোয়ারা করে। জগৎশেঠ এবং রায় দুর্লভ ২৯ জুন সিরাজের সম্পত্তির অর্ধেক আদায় করে নেয়। উমিচাঁদ বুঝতে পারে যে শেষ পর্যন্ত সে কিছুই পাচ্ছে না- এই উপলব্ধি হলে সে তার কর্মকান্ডের জন্য পাগল হয়ে যায় (অথবা তাকে পাগল করা হয়)।





বাংলার এই জয়ের পর ১৭৫৯ সালে ইংরেজরা ফরাসীদের বড় একটা বাহিনী মসুলিপটমে পরাজিত করলে ফরাসীদের বাংলায় প্রভাব প্রায় শেষ হয়ে যায়। মীর জাফর পরিশেষে তার ইংরেজদের মণিবগিরী সহ্য করতে না পেরে ডাচদেরকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্ররোচিত করে। ১৭৫৯ সালের শেষে ডাচরা ৭টি বড় যুদ্ধ জাহাজ এবং ১৪০০ সৈন্য ইন্দেনেশিয়ার জাভা থেকে বাংলায় পাঠালে ইংরেজরা তাদের থেকে অপেক্ষাকৃত বড় ডাচদের ফৌজ কে ১৭৫৯ সালের ২৫ নভেম্বর চিনশুরাতে পরাজীত করে। ইংরেজরা মীর জাফরকে সরিয়ে মীর কাশিমকে বাংলার নবাব করে।


………………… পরবর্তীতে মীর কাশিম ইংরেজদের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষার ব্যার্থ চেষ্টা করে এবং বাংলার ৫৭’র সু্র্য অস্তমিতই থেকে যায়।



(উইকিপিডিয়া হতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।