আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১ মার্চ জেলের তালা ভেঙে বের হই

১৯৭১ সালের ১ মার্চ আমি জেলের তালা ভেঙে বের হই। সে সময় আইয়ুব সরকারের সামরিক কোর্টের রায়ে আমি ১৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। জেল ভেঙে চলে আসি ইকবাল হলে (এখন জহুরুল হক হল)। এরপর আসি আহসানউল্লাহ হলে। জেল ভেঙে বের হওয়ার সময় পায়ে আঘাত পাই।

এরপর মণি ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ কয়েকজন নেতা আমাকে জানান সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দেশ একটা যুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে। আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। হলে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আমরা ধানমন্ডি স্কুলে থাকা কিছু রাইফেল সংগ্রহ করলাম। তার আগে '৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় মতিউর রহমান যেদিন মারা যায় সে সময় পাকিস্তানের মন্ত্রী সুলতান আহমেদ চৌধুরীর বাড়িতে ফুল আনতে গিয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতারা বেশকিছু রাইফেল ছিনিয়ে আনে।

ওই অস্ত্র ছিল আমি ও কামরুল আলম খসরুর নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগ অফিসে বসে আবদুর রাজ্জাক ভাই ও বোরহান উদ্দিন ভাই আমাকে বিশেষ দায়িত্ব দিলেন। তাদের কথামতো আমরা ট্রেনিং দেওয়া শুরু করলাম। তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্টেরে সুবেদার রফিককে নিয়ে গেলাম প্রশিক্ষক হিসেবে ন্যাকেসবাগ গ্রামে। একটি রাইফেল নিয়ে শুরু হলো প্রশিক্ষণের কাজ।

নদীর আশপাশের গ্রামগুলোকে বেছে নেওয়া হলো প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। এরই মধ্যে সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তখন মানুষের মনোবল ছিল তুঙ্গে। এর আগেই রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তখন থেকেই গোটা জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সে সময় ছাত্রলীগ জাতির ভ্যানগার্ড হিসেবে পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যারাতে আমরা মণি ভাই, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ ছাত্র নেতারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। দেশের অবস্থা দেখে আমাদের ভালো মনে হলো না। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করলাম বাড়িতে না থাকতে। কিন্তু তার উক্তি ছিল ওরা (পাক বাহিনী) যদি আমাকে বাড়িতে না পায় তাহলে পুরো ঢাকায় আগুন জ্বালিয়ে দেবে।

তোমরা সাবধানে থাক, প্রস্তুতি নাও। তবে জানিয়েছিলেন, তিনি যদি বের হন তাহলে দৌলশ্বর গ্রামের হামিদুর রহমানের বাসায় যাবেন। সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রাত ১০টার দিকে আমি এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় এসে মাকে জানাই- 'মা, আমাদের ওপর হামলা হতে পারে। এ ছাড়া আমার বাড়িতে হামলা হবেই কারণ আমি জেল থেকে পালিয়ে এসেছি।

' রাতে আমরা কেরানীগঞ্জ চলে যাই। ২৬ মার্চ ভোররাতে আমরা কেরানীগঞ্জ থানা ঘেরাও করতে গেলাম। পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক আমরা থানা আক্রমণ করি। সেখানে ২০টি রাইফেল পেলাম। ৩টি রিভলবার।

আমাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল থানায় বাংলাদেশি পতাকা ওড়ানোর। সকাল ৬টায় তারা বিউগল বাজিয়ে পাকিস্তানের পতাকা ওঠায়। অস্ত্র হাতে নেওয়া এবং পুলিশকে আত্দসমর্পণ করাতে আমাদের প্রায় ৬টা বেজে গেছে। এমন সময় বিউগল বাজিয়ে আমরা বাংলাদেশি পতাকা ওড়ালাম। এখানের অনেক পুলিশ ছিল যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাইল।

আবার কেউ কেউ চলে গেল। কিন্তু দুজন ছিল পাকিস্তানি। এ দুজনকে আমরা ধরে একটি বাড়িতে আটকিয়ে রাখলাম। কেরানীগঞ্জে ২৬ মার্চে প্রথমে এলেন সিরাজুল আলম খান ভাই। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, আবদুর রাজ্জাক ভাইসহ জাতীয় নেতারা।

কেরানীগঞ্জে যেই-ই আসুক তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল আমার। মূলত আমাকে ও গগন ভাইকে ঢাকা জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২৬ তারিখ সকালে আমার কাছে মণি ভাই এলেন। জিজ্ঞেস করলেন দৌলশ্বর গ্রাম কোথায়। তাকে সঙ্গে নিয়ে জমির আইল দিয়ে ১৭-১৮ কিলোমিটার পথ মোটরসাইকেলে গেলাম দৌলশ্বর গ্রামে।

সেখানে গেলে হামিদুর রহমান আমাদের দেখে হতবাক। মণি ভাই তাকে জানালেন, যদি বঙ্গবন্ধুর কোনো খবর পাওয়া যায় তাহলে যেন আমাদের খবর দেওয়া হয়। ২ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কেরানীগঞ্জে হত্যাকাণ্ড চালায়। সেদিন প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার লোক মারা যায়। পর দিন আমরা তাদের দাফনের ব্যবস্থা করি।

এক কবরে ১৫-২০ জনকে মাটি দেওয়া হয়।

এপ্রিলের আগেই রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই, মণি ভাই সবাই কুষ্টিয়া হয়ে মুজিবনগরে চলে যান। এরপর নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আমি ৩-৪ এপ্রিল কেরানীগঞ্জ ছাড়ি। তারপর রাজবাড়ী হয়ে কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুর চলে গেলাম। মুজিবনগর ক্যাম্পে গিয়ে আমরা দুই দিন না খেয়ে ছিলাম।

কলকাতায় থিয়েটার রোডে পেলাম তাজউদ্দীন আহমদকে। তারপর চলে আসি মুজিবনগরের ভবেরপাড়া ডোমপুুকুর। ভারতের ডেরাডুলে সেনাক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে আমরা কলকাতা হয়ে আগরতলা গেলাম। এরপর ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। ৪০ জন সদস্য সঙ্গে ছিল।

১৫ ডিসেম্বর ভোররাতে জিঞ্জিরা থেকে ঢাকায় ঢুকি। নিউমার্কেট, যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমাদের অভিযান চলে। ডেমরায় কিবরিয়া নামে আমাদের একজন সঙ্গী শহীদ হন। আর পাক বাহিনীর মারা যায় সাত-আট জন। মালিবাগ, চকবাজারে সেনাবাহিনীর গাড়ির ওপর হামলা চালানো হয়।

সেলিমকে আমরা জেলখানা ভেঙে মুক্ত করি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।