আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই বেলা তোর ঘরের খবর নে রে মন



কুষ্টিয়া বাসস্ট্যান্ড নামলাম আমরা। রিকশা নিলাম। দবির মোল্লা রেলগেট পেরিয়ে দ্রুত পৌঁছলাম ছেঁউরিয়া, লালন শাহর আখড়ায়।
আখড়ায় ঢোকার মুখেই তোরণ একটা, বেশ বড়সড়ই। তোরণ পেরোলে পাতাবাহারে সাজানো কংক্রিটের পথ।

মসৃণ সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে লালন শাহর অতীত নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম আমরা।
আজ থেকে অনেক বছর আগে, ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লালন শাহ। অতি শৈশবেই পিতার অকালমৃত্যু লালনকে গতানুগতিক জীবনধারার স্বাভাবিক ছন্দ থেকে বিচ্যুত করলেও মায়ের কথা ভেবে সে সময় সংসার ছাড়তে পারেননি তিনি!
একেবারে ছোটবেলা থেকেই গান গাইতেন লালন- তাঁর কণ্ঠে সুর যেমন ছিল, গায়কিতেও ছিল ভিন্নতা!
সে সময় হরিশপুরের আশপাশে গানের চর্চা ছিল ব্যাপক। সেই সব গানের আকর্ষণ লালনকে বাঁধা দিত ঘরমুখী হতে!
লালনের এই ঘরবিমুখিনতা স্বজনদের অপছন্দের কারণ ছিল! স্বজনদের এই অপছন্দ থেকেই অশান্তির সূত্রপাত হলো সংসারে। ঠিক সে সময়ই লালনের মায়ের মৃত্যু হলো!
অশান্তির আগুন থেকে পরিত্রাণ পেতে এইবার বাস্তবিকই সংসার ছাড়লেন তিনি, মানসিক শান্তির আশায় আঁকড়ে ধরলেন গানকে!
এই গান লালনকে নতুন পৃথিবীর সন্ধান দিল, পরিচয়ের নতুন সুরে বেঁধে দিল ফকির সিরাজ শাহর সঙ্গে!
ফকির সিরাজ শাহ লালনকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন, নিজের সাধ্যানুযায়ী দীক্ষিত করলেন ফকিরিতে।

কিন্তু ১৭৯৮ সালে সিরাজ শাহ এবং অল্পদিনের ব্যবধানে সিরাজ-পত্নীর দেহান্তর লালনকে আবার বহির্মুখী করে তুলল! এবার তিনি পথে নামলেন, ঘুরে বেড়ালেন নানা তীর্থে, মানুষের মিলনমেলায়!
রাজশাহী জেলার প্রেমতলীতে অনুষ্ঠিত বিখ্যাত বৈষ্ণব মেলায় লালনের পা পড়ল একদিন। এই মেলা সাধারণ্যে পরিচিত ছিল খেতুরীর মেলা হিসেবে। এক মাস স্থায়ী এই মেলায় চমৎকার সময় কাটিয়ে লালন একটি নৌকায় উঠলেন। আরও কিছু যাত্রীর সঙ্গে যাত্রা করলেন দক্ষিণে।
কিন্তু যাত্রাপথে লালন আক্রান্ত হলেন সংক্রামক ব্যাধিতে! নিজেদের প্রাণের মায়ায় মরিয়া যাত্রীরা তখন অসুস্থ লালনকে ফেলে যেতে বাধ্য হলো কালীগঙ্গা নদীর একটি চরে!
যে চরে লালনকে ফেলে গেলেন যাত্রীরা, সেই চরের খুব কাছেই কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়া গ্রাম।


ছেঁউরিয়া গ্রামের মলম কারিগর বিপন্ন লালনকে উদ্ধার করলেন এই অবস্থা থেকে। পুত্রজ্ঞানে শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুললেন তাঁকে! সুস্থ হয়ে লালন বেছে নিলেন সাধনমার্গের পথ- বৈচিত্র্যপূর্ণ এই পথের অন্যতম মাধ্যম গান- গানের মাধ্যমে স্রষ্টার আরাধনা; স্রষ্টার সঙ্গে অন্তরের সংযোগ স্থাপনের ব্যাকুল সাধনা!
পরবর্তী সময়ে মলম কারিগর সাধক লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ তো করলেনই, অধিকন্তু ছেঁউরিয়ায় নিজস্ব ষোলো বিঘা জায়গার ওপর একটি আখড়া তৈরি করে দিলেন লালন শাহর সংগীত সাধনার জন্য!
কারণ এই সংগীত নিছকই সংগীত নয়, এই সংগীত যে অন্তরাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মহামিলনের এক সার্বজনীন পথ!
সেই পথের খোঁজেই আষাঢ়ের অপরাহ্ণে আমরা পা রাখলাম ছেঁউরিয়ায় লালন শাহর আখড়ার মূল প্রাঙ্গণে।
নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা সেই পুণ্য-প্রাঙ্গণের খোলা অংশে লালনের প্রথম ভক্ত শীতল শাহ ফকির, সাঁইজির নিজ হস্তে মুরিদ ছেঁউড়িয়ায় তাঁর আশ্রয়দাতা পালক পিতা মলম শাহ, কুসুম ফকিরানি, কামিনী ফকিরানি, প্যারীনেছা ফকিরানি, ভোলাই শাহ ফকির, মহিম শাহসহ সর্বমোট বারো জনের সমাধি।
খোলা সেই প্রাঙ্গণ অতিক্রম করলেই তাজমহল সদৃশ্য গম্বুজাকৃতি স্থাপনা। সেই স্থাপনাটির বারান্দায় লালনের সাধনসঙ্গিনী বিশাখা ফকিরানির সমাধি ছাড়াও আরও তিনটি সমাধি।

বারান্দা পেরোলেই সাদা জাফরি কাটা জানালা আর এক দরজাবিশিষ্ট একটি কক্ষ। সেই কক্ষের অভ্যন্তরে পালক মাতা মতিজান ফকিরানির ঠিক পাশেই সমাধিস্থ সাঁইজি স্বয়ং।
আখড়ার অন্যতম প্রধান এই স্থাপনাটির পাশেই খোলা চত্ত্বরে আরও কিছু সমাধি সাঁইজির বিশিষ্ট মুরিদদের। কাছাকাছি লালন একাডেমির চারতলা ভবন। এই ভবনের নিচে একাডেমি পরিচালিত জাদুঘর।


জাদুঘরের প্রথম কক্ষেই লালন শাহর প্রমাণাকার একটা ছবি। এই ছবিতে যে স্কেচটি ব্যবহৃত হয়েছে, ১২৯৬ বঙ্গাব্দের ২৩ বৈশাখ শিলাইদহ-বোটে বসে সেটি এঁকেছিলেন রবীন্দ্রভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
লালনকে সুধীসমাজে পরিচিত করানোর কৃতিত্বের অনেকটাই প্রাপ্য ঠাকুর পরিবারের। বিশেষত এই পরিবারের অন্যতম রত্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন উদ্যোগ এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
১৩২২ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় লালনের গান প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম লালনকে তুলে ধরেন কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক মহলের সামনে।


১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানচেস্টার কলেজে হিবার্ট ট্রাস্টের বক্তৃতামালায় মরমি কবিদের সংগীতে যে বিম্বিত দর্শনের উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ করেন, সে দর্শনের উৎস লালন শাহের ‘মনের মানুষ’।
আখড়ায় বেড়াতে আসা শিলা বৈদ্যের সঙ্গে কথা হলো আমাদের। লালনভক্ত শিলা বৈদ্যের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একাডেমি ভবনের পাশেই বিশাল অডিটোরিয়ামের উন্মুক্ত পরিসরে প্রবেশ করলাম আমরা। সেখানে একতারা, হারমোনিয়াম, খোল, খঞ্জনি নিয়ে লালন শাহর দেহতত্ত্বের গান গাইছিলেন একজন অচেনা বাউল! মধুমাখা কণ্ঠ তাঁর! মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার দল বসে আছে তাঁর চারপাশ জুড়ে!
আমরাও বসলাম তাদের পাশে! শুনলাম গান- ‘এই বেলা তোর ঘরের খবর নে রে মন-’
গান শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হলাম আমরা! ঘরের খবর নেওয়া দূরে থাক, অজান্তেই ভুলে গেলাম ঘরের কথা, ভুলে গেলাম ফেরার কথাও!।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।