আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাই অটিজম সচেতনতা ও অটিস্টিক শিশুদের আনন্দময় জীবন



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অটিস্টিক শিশুরা আমাদের বোঝা নয়। তারা আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। তাদের মেধা কাজে লাগাতে হবে। 'বাংলাদেশে প্রতি ৫০০ জনে একজন অটিস্টিক শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে ২.৫ লাখ শিশু অটিস্টিক।

ইন্ডিয়াতেও ৫০০ জনে একজন, আমেরিকায় প্রতি ১০,০০০ জন শিশুর মধ্যে ৪.৫ জন শিশু অটিস্টিক। অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে ১৯৯০-২০০০ সালের মধ্যে। বাংলাদেশের আনুমানিক ৮ শতাংশ শিশু অটিস্টিক এবং দুর্ভাগ্যজনক যে সমাজ ও পরিবার তাদেরকে সামাজিক ও আর্থিক বোঝা মনে করে। অটিস্টিক শিশু বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লজ্জা, বিচ্ছিন্নতা, বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার অপ্রতূলতা।

অটিজম সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালকে ‘অটিজম বছর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সি.ডি.সি. আমেরিকার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী এখনো পযর্ন্ত সারা বিশ্বে প্রতি ৮৭জন শিশুর মধ্যে ১জন অটিজম আক্রান্ত ও প্রতি ৫৪জন ছেলে শিশুর মধ্যে ১জন অটিজম আক্রান্ত। উত্তর কোরিয়াতে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ৩৯জন শিশুর মধ্যে ১জন অটিজম আক্রান্ত। আক্রান্তের এই ভয়াবহতাকে জাতিসংঘ মহামারী রূপে চিহ্নিত করেছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে ২০০৭ সালে ২রা এপ্রিল কে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসাবে উৎযাপনের জন্য ঘোষণা করেছে।

অটিজম সংক্রান্ত ধারণা:
অটিজমের ব্যাপারে প্রথম ধারণা দেন হেনরি মোস্লে নামে একজন ব্রিটিশ সাইকিয়াট্রিস্ট ১৮৬৭ সালে।

পরবর্তীতে লিও ক্যানার, একজন আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট, ১৯৪৩ সলে এই অসুখের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন এবং এর নাম দেন ইনফেনটাইল অটিজম । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) শিশুর অটিজম কে সুস্পষ্টভাবে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার সাংকেতিক নম্বর এফ ৮৪.০। অটিজম কোন সাধারণ রোগ নয়। এটি শিশুদের একটি মনোবিকাশগত জটিলতা বা মস্তিষ্কের বিন্যাসগত সমস্যা যার ফলে সাধারণত ৩টি সমস্যা দেখা দেয়া।

যেগুলো হচ্ছে- প্রথমতঃ মৌখিক কিংবা অন্য কোনো প্রকার যোগাযোগ সমস্যা, দ্বিতীয়তঃ সমাজিক বিকাশগত সমস্যা, তৃতীয়তঃ খুব সীমাবদ্ধ ও গণ্ডিবদ্ধ জীবন-যাপন ও চিন্তা-ভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ এছাড়া অতি চাঞ্চল্য (Hiper Activity), জেদী ও আক্রমণাত্মক আচরণ (Aggressiveness), অহেতুক ভয়ভীতি, খিচুনী ইত্যাদি ও থাকতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সংকেত দেখে অটিজম হতে পারে সন্দেহ করা যায়। ১. ৬ মাস বয়সে যদি কোন শিশু ভাল ভাবে আনন্দ প্রকাশ করতে না পার। ২. ৯ মাস বয়সে যদি কোন শিশু শব্দ বা ডাক শুনে যথাযথ সাড়া না দেয়। ৩. ১২ মাস বয়সেও কথা বলতে না পারা এবং কোন রকম চাহিদা প্রকাশ করতে না পারা।

৪. ১৬ মাস বয়সের মধ্যে কোন চাহিদা প্রকাশ করতে না পারা। ৫. ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই শব্দের অর্থপূর্ণ বাক্য বলতে না পারা। ৬. বলতে পারা কথা বন্ধ করে দেওয়া।

অটিস্টিক শিশু কিশোররা যে সব ব্যবহারিক সমস্যা করে থাকে সেগুলোকে প্রধানত চারটি ভাগে করা যায়। যেমন- ১. অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয় : থুথু ছিটানো, কান্না করা, শব্দ করা ইত্যাদি।

২. অন্যের জন্য ক্ষতিকর : কাউকে আঘাত করা, কামড় দেয়া, খামচি দেয়া, চুল টানা, জিনিস ভাঙ্গা ইত্যাদি। ৩. নিজেকে আঘাত করা : হাতে কামড় দেয়া, মাথায় আঘাত দেয়া/করা, মুখে হাত দিয়ে খামচি দেয়া ইত্যাদি। ৪. নিজেকে উজ্জীবিত করা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করা : একই তালে, একই ছন্দে, একই ভাবে কিছু কাজ করতে থাকে। যেমনঃ হাতে কিছু রাখা বা নাড়ানো, আঙ্গুল নাড়ানো, মুখে কিছু রাখা, শরীর দোলানো, জিনিস ঘোরানো, নিজে ঘোরা, একই কাজ বার বার করা ইত্যাদি। এই কাজগুলো করার কারণ হচ্ছে তারা পারিপাশ্বিক জগৎ থেকে নিজেদের বিনোদনের বিষয়গুলো কম গ্রহন করতে পারে।



অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধিতে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা:
অটিস্টিক শিশুদের অবহেলার পরিবর্তে সৃজনশীল ও মেধাবী হিসেবে অবদান রাখার মতো করে গড়ে তুলতে বিশ্ব সম্প্রদায় এখন অটিজম সমস্যার ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হয়ে উঠলেও এ বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আরো নজর দেয়া প্রয়োজন। অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধিতে শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রাখতে পারে।

১.অভিভাবকদের সচেতন করা: শিক্ষার্থীরা অটিস্টিক শিশুদের অভিভাবকদের সচেতন করতে পারে। শিশুটির যথাযথ পরিচর্যায় সতর্ক করা। যেমন: তাকে কখনোই একা থাকতে দেবে না।

তার সাথে খেলা করবে, শারীরিক স্পর্শ জাতীয় খেলা যেমন- লুকোচুরি, কাতুকুতু, ছোঁয়াছুঁয়ি। এ ছাড়াও দেয়ানেয়া খেলা যেমন- বল, গাড়ি দিয়ে খেলা। শিশুটিকে চোখে চোখে তাকাতে উৎসাহিত করা। তার সাথে বড় বাক্যে অনেক কথা না বলে ছোট ছোট স্পষ্ট বাক্য বলা। শিশুর যেকোনো অস্বাভাবিক খেলা বা আচরণ দেখলে তার মনোযোগ সেটি থেকে অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া।



২. অটিজম বান্ধব পরিবেশ গড়ায় সচেতনতা বাড়ানো: অটিস্টিক শিশুদের পরিবর্তনের জন্য আমাদের নিজেদেরকেও পরিবর্তিত হতে হবে। তাদের সহজভাবে জীবনযাপনের ব্যবস্থা আমাদের-ই করতে হবে। তাদের জন্য অটিজম বান্ধব বাড়ি, পরিবেশ ও সমাজ আমাদেরকেই গড়ে তুলতে হবে।

৩. চিকিত্সার জন্যে আথিক সাহায্য : প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিলে চাঁদা তুলে দিতে পারে। অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ চার থেকে ৬ বছর বয়ষের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ্য হয়ে ওঠে।

এবং সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে লেখাপড়া করতে পারে। আরো ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে লেখাপড়া করতে পারে না। তারা বাসায় থাকে অথবা তাদের জন্য দরকার হয় বিশেষায়িত স্কুল ও বিশেষ প্রশিক্ষণের। বাকি ৬০ শতাংশ অটিষ্টিক শিশুরা সহায়তা পাওয়ার পরও স্বাধীন বা এককভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। তাদের জন্য প্রয়োজন হয় অন্যের উপর নির্ভরতা দীর্ঘদিন অথবা সারা জীবনের জন্য।

বিশেষ আবাসন, নার্সিং কেয়ারের প্রয়োজন হয় তাদের।

৪.ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি:অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারে না। সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। এরা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আচারণে সমস্যা দেখা দেয়।

হঠাত্ করে রেগে যায়। একই কাজ বারবার করতে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কথা বলতে একটি বাক্য শুরু করতে দেরি করে ফেলে আবার বাক্য শুরুর পর তা শেষ করতে পারে না। একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করতে থাকে।

এরপরও তাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করে তাদের সাথে ইতিবাচক আচরণ করতে হবে।

৫. সময়দান ও সঙ্গদান:অটিজমের সঙ্গে প্রায়ই সে সমস্যাগুলো দেখা যেতে পারে, তা হলো- অতি চঞ্চলতা ও অমনোযোগিতা, হঠাত্ অতিমাত্রায় রাগ করা, খিঁচুনি, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, নিজেকে আঘাত করা, ঘুমের সমস্যা, খাদ্যাভ্যাসজনিত সমস্যা ইত্যাদি। একই আচারণ বারবার করতে থাকে। শব্দ বা আওয়াজ পছন্দ করে না। দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলতে ভালবাসে।

রুটিনের বত্যায় ঘটলে খুব মন খারাপ করে। কোন কারণ ছাড়াই হঠাত্ রেগে যায় এবং ভয়ার্ত হয়ে ওঠে। এরপরও এদেরকে সময় দিতে হবে, সঙ্গ দিতে হবে।

৬. চিকিত্সকের কাছে নেয়ার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি: যে সমস্যাগুলো দেখাদিলে অবিলম্বে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। শিশু যদি এক বছরের মধ্যে মুখে অনেক আওয়াজ (ব্যবলিং) না করে।

কিংবা আঙুল দিয়ে বা অঙ্গভঙ্গি করে কোন কিছু না দেখায়। ১৬ মাসের মধ্যে যদি যদি এক শব্দের বাক্য না বলে। দুই বছরের মধ্যে যদি দুই শব্দের সংশিশ্রণে বাক্য না বলে। শিশুর কথা ও সামাজিকতা যদি হঠাত্ হারিয়ে যায়।

৭.অটিজম নিয়ে বিভ্রান্তি দূরীকরণ:অনেকে ভুল ধারণা পোষণ করে এটাকে স্বাভাবিক বলে থাকেন।

আরও বলেন, কোন চিকিত্সার দরকার নেই এমনিতে ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু এ রোগের চিকিত্সার জন্যও রয়েছে নানা রকম বিভ্রান্তি, কেউ বলেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের দেখাতে কেউ বলেন, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আবার কেউ বলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কে দেখাতে। অনেকে মনে করতে পারেন, কথা শিখতে দেরি হওয়া মানে অটিজম, এটা ঠিক নয়। অনেকে ধারণা করে থাকেন, অটিজম আছে এমন শিশুদের চিকিত্সার দরকার নেই। কেউ বলে থাকেন, পরিবারে বাবা বা মা তাদের শৈশবে অনেক দেরিতে কথা বলতে শিখেছে, সে ক্ষেত্রে তাঁদের কোন সমস্যা হয়নি বলে সন্তান দেরিতে কথা বলতেই পারে, এটাও ভুল ধারণা।

অনেক সময় বাবা-মায়েরা শিশুর অটিজমের জন্য নিজেদের দ্বায়ী করেন। কিন্তু এটার জন্য কোনোভাবেই বাবা-মা দায়ী নন। আবার অনেকে মনে করে থাকেন, আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী হয়। অথচ মাত্র শতকরা ১০ জন অটিজম আক্রান্ত শিশু ছবি আঁকা, গান, গণিত কিংবা কম্পিউটারে প্রচন্ড দক্ষ হয়। অটিজম নিয়ে থাকা এসব বিভ্রান্তি দূর করতে হবে।



৮.অটিস্টিক শিশুকে বিরক্ত না করা: অটিস্টিক শিশু পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তন পছন্দ করে না। যেমনঃ ঘরের আসবাবপত্র পুনর্বিন্যাস করলে সে অস্থির হয়ে পড়ে। একই রুটিন মেনে চলতে পছন্দ করে । একই কাজ বার বার করে। যেমনঃ শরীর বার বার সামনে পিছনে দোলানো, বার বার হাত তালি দেয়া, একই জায়গায় দাড়িয়ে ঘুরা, বারবার হাতের আঙুল মোচড়ানো।

একই ধরনের খেলা করে, যেমন লাইন ধরে জিনিস সাজানো। যা দিয়ে খেলার কথা নয় তা দিয়ে দীর্ঘক্ষন খেলা বা কাছে রাখা। যেমনঃ ছোট এক টুকরো কাগজ। কল্পনাযুক্ত খেলা খেলতে পারে না। ঘুর্নীয়মান খেলনা পছন্দ করে।

একই খাবার পছন্দ করে। একই পোষাক বারবার পরতে চায়। কোন খেলনার একটি বা দুটি অংশ নিয়ে খেলতে বেশি পছন্দ করে, পুরো খেলনাটি নয়। কখনো কখনো খেলনার একটি অংশ দিয়ে সারাক্ষন খেলতে থাকে। অটিস্টিক শিশুর স্বভাব প্রকৃতি বুঝে তাকে বিরক্ত না করা উত্তম।



অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সচেতনতা ও সহযোগীতা। সরকার, পরিবার, অভিভাবক, চিকিৎসক, শিক্ষক, সহপাঠিসহ সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে অটিস্টিক শিশুরা সমাজের মূলস্রোতে সহজেই নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে। সকল সচেতন মানুষের সহযোগীতার হাত ধরে এগিয়ে যাবে অটিস্টিক শিশুদের অবারিত আনন্দময় যাপিত জীবন।






সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।