আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আইডিন্টিটি, আইডিয়ালিজম ও ইশ্বর বিষয়ক চিন্তা ভাবনা

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র ১ আধুনিক বাঙালি মুসলমান মাত্রই 'আইডিন্টিটি ওভার আইডিয়ালিজম' সিনড্রোমএ আক্রান্ত। পুজিবাদী গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিনিয়ত ইসলামী আইডিয়ালিজম বিপন্ন এবং আক্রমনের স্বিকার, মৃতপ্রায়। সেটা নিয়া তাদের কোন মাথা ব্যাথা নাই। সেটা হইতে পারে, কেননা পুজিবাদী আইডিয়ালিজমএর প্রতি আনুগত্ব তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, যৌনতা এবং স্ট্যাটাস নিশ্চিৎ করে, ইসলামী আইডিয়ালিজমতো তারে এগুলা দিবেনা। কিন্তু ইসলামী আইডিন্টিটির উপরে সামান্যতম হামলা হইলেই তারা ধর্মযুদ্ধে নাইমা পরে, পুজিবাদী জাইঙ্গা পইরা হুঙ্কার ছাড়ে, 'নারায়ে তকবির'।

২ বাঙলা ব্লগ ও ফেসবুকে বেশ কয়েকজন নাস্তিক মিশনারি আছেন যাদের ধর্ম সমালোচনা বিশেষ করে ইসলাম সমালোচনার তরিকাগুলা মূলত খ্রীষ্টান ডানপন্থি এবং মৌলবাদি হিন্দু প্রচার ও প্রভাবদুষ্ট অথবা তা থেকে আমদানি করা। যেইরকম মৌলবাদী মুসলমানদের বিবর্তনবাদ সমালোচনা আমদানি করতে দেখা যায় খ্রিষ্টান বাইবেল নির্ভর ক্রিয়েশনিস্টদের কাছ থেকে। এই দুই গোছের মিশনারিই যতোনা নাস্তিকতা অথবা মুসলমানিত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন তার চেয়ে অনেক বেশি করেন কলোনিয়াল জ্ঞানতত্ত্বের। ৩ পলিটিকাল ইসলাম বাঙালির কাছে ফরেন জিনিস। কারন বাঙালির ইসলামের ইন্টারপ্রিটেশন আর আরবদের ইসলামের ইন্টারপ্রিটেশন এক না।

পলিটিকাল ইসলামএর জন্ম ও বিকাশ আরব ভুখন্ডে। এর কারন আরবরা সবসময়ই ইসলামকে পার্থিব এবং অপার্থিব এই দুই স্বার্থের অনুকূল ধর্ম হিসাবেই গন্য করেছে। পলিটিক্স যেহেতু পার্থিব স্বার্থের বিষয় তাই তাদের ইন্টারপ্রিটেশনে পলিটিক্স ইসলামএর জরুরি অঙ্গ। পার্থিব স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার তাদের কাছে বক ধার্মিকতা না, কিন্তু বাঙালির কাছে বক ধার্মিকতা। এর কারন বাঙালির 'ধর্ম' শব্দটা সম্পর্কে ধারনা।

বাঙালির ধর্ম চর্চার প্রধান উদ্দেশ্য পার্থিব স্বার্থ ত্যাগ করে নির্মোহ হয়ে উঠা, সেই গৌতম বুদ্ধের আমল বা তার আগে থেইকাই। বাঙালি এই কারনে নবি রাসুলদের ইন্টারপ্রেট করে পার্থিব স্বার্থহীণ হিসাবে। আরবদের কাছে মোহাম্মদ একজন রাজনৈতিক নেতা, অন্যদিকে বাঙালির কাছে তিনি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অপার্থিব জ্ঞানসম্পন্ন মহাপুরুষ। বাঙলার ইসলামে কি তাইলে পলিটিক্স নাই? আলবৎ আছে। তবে সেই পলিটিক্স এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের জাত পাত অসাম্প্রদায়িকতা বিরোধী পলিটিক্সএর সাথে একাকার হয়ে গেছে, তার ধারাবাহিক বিকাশ হয়ে গেছে।

একটা উদাহরণ দিয়া বুঝাই, মজনু শাহ, মুসা শাহ কিংবা করিম শাহ এর রাজনীতি হইলো বাঙালি মুসলমানএর রাজনীতি যেটারে পলিটিকাল ইসলাম বলার উপায় নাই। কারন মজনু শাহ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের চেষ্টায় রানী ভবানির কাছে যেই চিঠী লিখছিলেন তাতে স্পষ্ট দেখা যায় যে তিনি হিন্দু রানীরে নিজের শাসক মাইনা নিছেন। আবার করম শাহ এবং তার পোলা টিপু শাহ যেই পাগলপন্থা তরিকা এবং রাজনীতি করেছে ব্রিটিশ রাজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে তাতে দেখবেন যে হিন্দু, মুসলিম, আদিবাসী একাকার হয়ে গেছে এবং এদের ধর্ম বিশ্বাসও মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। অন্যদিকে তিতুমির হইলেন পলিটিকাল ইসলামিস্ট, তিনি আরব থেইকা এটা শিখে আসছেন। মজনু শাহ কিংবা করিম শাহ খ্রিষ্টান বলে ব্রিটিশদের বিরোধীতা করে নাই, করেছে তাদের শোষনএর কারনে।

কিন্তু তিতুমির ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রাজনীতি করতে গিয়া এই শাসনরে 'দারুল হারব' বা বিধর্মীর শাসন বলে চিহ্নিত করেছেন, এবং সেই সুবাদে এর বিরোধীতা করেছেন। ৪ নাস্তিকের ধর্মকথা "নাস্তিক হয়েও যেসব কারণে মুহম্মদ সা: কে খুব শ্রদ্ধা করি" নামক লেখায় এবিষয়ে লিখেছিলেন। কোরআনে অমুসলিমদের হত্যা করা বিষয়ক বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বিষয়ক যেসকল আয়াত আছে তার বেশিরভাগই বদর যুদ্ধের সময়ে নাজিল হওয়া, এবং সবই তৎকালিন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতএর প্রেক্ষিতে। যেকোন বিচারে এইসব অতীতএর বিষয়। কিন্তু কোরআনকে শ্বাসত ধরে এসব আয়াতকে বর্তমানের বিবেচনা করাটা একেবারেই রাজনীতির বিষয়।

এইটা প্রথম ইতিহাসে সালাহ আল দিন, যিনি সালাদিন নামে সমাধিক পরিচিত, তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদে অনুপ্রানিত করতে করেছিলেন বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, সালাদিনএর সমকালেই পকেট কোরআনএর আবির্ভাব হয়েছিল যার ফলে কোরআন জনসাধারনের জন্যে সহজলভ্য হয়। বাঙলায় ব্রিটিশ আমলে ওয়াহাবিজমএর প্রভাবে এসব আয়াতএর বর্তমানের রাজনৈতিক প্রয়োজনে এবং জিহাদএর ডাকে ব্যাবহার শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। যদিও তার উল্লেখ্যযোগ্য কোন টেক্সট নাই, এবং আজ অবধি বাঙলার মুসলমানদের কাছে এসব আয়াত রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে নাই, কোরআনের এসব আয়াতএর সমসাময়িক রাজনৈতিক ইন্টারপ্রিটেশন বাঙলার মুসলমানএর কাছে জনপ্রিয়ও হয়নাই। গত শতাব্দিতে এসব আয়াতএর রাজনৈতিক ব্যাবহার তালেবান এবং আল কায়েদা করেছে।

তবে তার চেয়ে বেশি করেছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠিগুলা তাদের সাম্রাজ্যবাদী অপতৎপরতা জায়েজ করতে গিয়া। এসব আয়াতকে বর্তমান এবং শ্বাসত হিসাবে হাজির করা গেলে এবং সালাদিন, তালেবান ও আল কায়েদার কোরআনিক ইন্টারপ্রিটেশনকে প্রকৃত কোরআনিক ব্যাখ্যা এবং তাদের ইসলামকে প্রকৃত ইসলাম হিসাবে প্রচার করা গেলে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের গনতান্ত্রিক বৈধতা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অনেক নাস্তিককেও বুঝে অথবা না বুঝে অথবা শ্রেফ তর্কের প্রয়োজনে বিভিন্ন ইংলিশ সাইট থেকে এসব আয়াতকে বিচ্ছিন্ন ভাবে কোট করে ইসলামএর এইসব আয়াতকে শ্বাসত এবং বর্তমানের বলে প্রচার করতে দেখা যায় এবং তালেবান ও আল কায়েদার ইসলামকে প্রকৃত ইসলাম হিসাবে প্রচার করতে দেখা যায়। এইক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিকভাবে এই দুই গোষ্ঠিকেই লাভবান করছে বলে মনে হয়। কোরআনকে কেন্দ্র করে শরিয়া আন্দোলন বাংলাদেশে হচ্ছে, হবে।

একে ডিল করতে হবে। আমরা দেখেছি যে এসব আন্দোলনে আমিনির মতো যারা নেতৃত্ব দেয়, কোরআন হাতে রাজপথে মিছিল করলেও তারা দেশের অধিকাংশ মানুষএর সহানুভুতিই পায়না। জনসাধারণ এদেরকে ইগনোর করার মাধ্যমে ডিল করছে। কিন্তু লাদেন এবং আমিনি যারে প্রকৃত ইসলাম বলে, সাম্রাজ্যবাদীরা যাকে প্রকৃত ইসলাম বলে, বাঙলার অনলাইন নাস্তিককূলও যদি তাকে প্রকৃত ইসলাম বলে, তাইলে আমিনি এবং সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নাইলে বুঝা যায়। কিন্তু নাস্তিকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি? ৫ কোরআন শরীফ এর অবমাননা করা নিয়া অনেককিছুই হলো।

মানুষএর ঘর পুড়লো। মুর্তি ভাঙা হলো। যারা ঘর পুড়িয়েছেন তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগে লোকজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসব অবমাননা ফেসবুকে করা হয়েছে।

ফেসবুকে ঠিক কিভাবে কোরআন শরীফএর অবমাননা হয় বিষয়টা বুঝা দরকার। কোরআন শরীফ শব্দটা শুনলে চোখের সামনে যেই দৃশ্যটা আমার চোখে ভেসে উঠে তা হলো রেহালএর উপরে রাখা মোটা কাভারএর মোটা একটা বই। বইটা বেশিরভাগ সময় একটা কাপড়ের কাভারে মোড়ানো থাকে। বাঙালি মুসলমানের ঘরে বইটা থাকে, কাভারে মোড়ানো, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই ধুলি জমা। ধুলি কাভারে লাগে, কোরআনের গায়ে লাগেনা, তাই এর অবমাননা হচ্ছেনা বলে ধরা হচ্ছে।

আমার মতো অধিকাংশ বাঙালিই আরবি বুঝেনা, অনেকেই আমার মতো আরবি বানান করে সূর করে পড়া শিখেছেন কোরআন খতম দেয়ার জন্যে, কিন্তু অর্থ শেইখেনাই। অর্থ ছাড়াই ভাষা শিক্ষার মতো আজব একটা বিষয় বাঙালি মুসলমানএর কালচারে আছে, সেটা কোরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে। কোরআনকে সংবিধান জ্ঞান করে মধ্যযুগে আরব দুনিয়ায় নানান রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হয়েছিলো। এইসব রাষ্ট্রে কোরআন বলতে মোটা কাভারএর মোটাসোটা বই ভাবা হতোনা। এইসব রাষ্ট্রে কোরআন হোল জীবন্ত আল্লাহর বানী, শরীয়তএর ভিত্তী, খোদায়ী আইন।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কোরআনকে কোন সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করেনাই। এইটা করা হইছে পশ্চিমা সেকুলার ভাবাদর্শে উজ্জিবিত হয়ে। এতে বাঙালির তেমন কোন সমস্যাও হয়নাই। কারন বাঙালি মুসলমানের কালচার মুর্শিদ নির্ভর কালচার। মানুষএর মুখের বানী এবং আল্লাহর মুখের বানীর ফারাক এখানে কখনোই খুব বেশি ছিলনা।

মানুষএর লেখা সংবিধান তাই এই রাষ্ট্রের ভিত্তি হওয়ায় বাঙালি মুসলমানের কোন সমস্যা হয়নাই। কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কোরআনকে গ্রহণ না করলেও তা বর্জন করেনাই। তাকে অন্তত কাভারে পেচানো মোটা কাভারএর একটা বই হওয়ার মর্যাদা দিয়েছে যা অযু করে হাত দিয়ে ধরতে হবে, মাটিতে পরে গেলে বা পা লাগলে সালাম করতে হবে এবং মাঝে মাঝে না বুঝে তোতাপাখির মতো তা আবৃতি করতে হবে। কেউ যদি এই বইএ লাথি দেয়, ফেসবুকে লাথি দেয়ার ছবি দেয় অথবা পুড়িয়ে দেয় বা ফেসবুকে পোড়ানোর ছবি দেয় তাহলে এই বইটির অবমাননা হয় এমনটা বাঙালি মুসলমান ধরে নিয়েছে, কোরআনকে সংবিধান হিসাবে অস্বিকার করে একটা বই হিসাবে মাননা এবং অবমাননার এই বাড়তি সুবিধাটা বাংলাদেশ রাষ্ট্র দিয়ে থাকে। এখন বেশ প্রবল ভাবেই দিচ্ছে তা ফেসবুকে কোরআন অবমাননার অভিযোগে লোকজনকে আটক করার ঘটনায় বুঝা যায়।

এইখানে নানান শ্রেনীর মধ্যকার ক্ষমতা সম্পর্ক, তাদের মধ্যকার বিরোধ এবং আপোষএর নানান কাহিনী আছে। কোরআন যে রাষ্ট্রে খোদায়ি আইন হিসাবে সংবিধান হয়ে উঠবে সেই রাষ্ট্রে নারীর সিটিজেনশীপ নাই। শেখ হাসিনা অথবা খালেদা জিয়া সেই রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। কোরআনকে তাই তারা খোদায়ি আইন হিসাবে সংবিধানএর মর্যাদা দিতে রাজি না। তাদের দলের লোকজনও এতে রাজী হবেন না।

এরা যেহেতু সবাই পুজিবাদী সমাজে বাস করে, তার সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে, সূদ নির্ভর অর্থনীতি যেহেতু তাদের শাসক শ্রেণীতে অধিষ্টিত করেছে তাই কোরআনকে খোদায়ি আইন হিসাবে সংবিধান এর মর্যাদা দেয়া সম্ভব না, সেটা তাদের শ্রেণী চরিত্র বিরোধী হবে। মধ্যবিত্ত্ব লুম্পেন বাঙালি মুসলমানএর মাঝেও তার শাসকশ্রেণীর এই চরিত্র বর্তমান। এমনকি তার প্রতিনিধিত্বকারী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাও এই একি চরিত্র বহন করে। কারন মুখে এরা কোরআনকে খোদায়ি আইন হিসাবে সংবিধান হিসাবে স্বিকৃতি দিলেও নারী নেতৃত্ব মেনে নেয়, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। এরা মাঝে মাঝে কোরআন হাতে নিয়ে বিক্ষোভ করে।

এই সময় এদের হাতের কোরআন মাটিতে পরে যায়, এরা নিজেরা কোরআন হাতে মাটিতে পরে যায়, এবং কোরআন দিয়ে পুলিশের বাড়ি ঠেকায়। ধরে নেয়া হয়যে এতে কোরআন অবমাননা হয়না। এই যে কোরআন অবমাননা হওয়া বা না হওয়া বিষয়ে বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্যমত গড়ে উঠলো সেই সমঝোতা ও ঐক্যমতের ভিত্তি কি? কোরআন কি জিনিস এবং এর অবমাননা কিভাবে হয়? অবমাননা হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিভাবে করতে হয়? সেই প্রতিবাদে যে সন্ত্রাস থাকে তাকে কিভাবে এবং কি ধরনের সন্ত্রাসী বলতে হয়? মুক্তমনা নাস্তিক প্রগতিশীলরা ঠিক কোন ভাষায় এইসকল সন্ত্রাসী প্রতিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন? এই পুরা বিষয়টা ঘিরে যেই রাজনীতি সেই রাজনীতি সবশেষে বাঙালি মুসলমানকে কোথায় নিয়ে যায় সেইটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সমাজে জন্ম নেয়া যারা প্রগতিশীল, মুক্তমনা কিংবা নাস্তিক পরিচয় শীরধার্য করেন বাঙালি মুসলমান সমাজএর সাথে তার রাজনৈতিক সম্পর্কটা কেমন হয় সেইটা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সমঝোতা ও ঐক্যমতের ভিত্তি পশ্চিমের কাছে তার মানসিক দাসত্ব।

সে ইসলাম শিখতে চায় পশ্চিম থেকে, গণতন্ত্রও পশ্চিম থেকে শিখতে চায়, এবং প্রগতিশীলতাও। তার মতে ইসলাম থাকে মদিনায়, মদনগঞ্জে ইসলাম নাই। সুতরাং মদনগঞ্জের নাম পরিবর্তন করে মদিনানগর অথবা ইসলাবাদ বানালে সেখানে ইসলাম আসবে। কোরআন তার কাছে একটি আরবি লেখাওয়ালা বই যেইটা কাভারে মুড়িয়ে রেখে দিতে হয় এবং অযু ছাড়া ধরা যায়না এবং পা লাগলে পাপ হবে তাই সালাম করে পাপ মোচন করতে হবে। প্রগতিশীলতা বলতে সে বুঝে কোরআনকে চটি বই বলা এবং কোরআন থেকে তালেবানদের মতো সন্ত্রাসের পক্ষের আয়াত খুজে বের করা।

কিন্তু কোরআনকে গ্রহণ বর্জনএর বিষয়টা, তার সংজ্ঞায়ন, খোদায়ি বানীর স্বরূপ ইত্যাদি বিষয়ে বাঙালি মুসলমান তার নিজস্ব চিন্তা জগতে অনেক আগেই গুরুত্বপূর্ণ দর্শনগত মোকাবেলা করেছে। খোদায়ি বানী আর মানুষএর বানীতে যে ফারাক নাই, মানুষ ছাড়া খোদার যে কোন প্রকাশ্য রূপ নাই, আর মানুষএর মুখে নিসৃত খোদার কালাম তো ১৪০০ বছর আগের অতীতএর বিষয় না, তা প্রতিদিন নাজিল হচ্ছে জীবন্ত মুরশিদএর মুখ থেকে। সেই মোকাবেলা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। সেই ধারায় থাকলে এখন কোরআনকে গ্রহণ বর্জনএর প্রশ্ন উঠতো না। একাত্ত্বরের পরে মানব লিখিত সংবিধানই খোদায়ি বানীর মর্যাদা পাইতো তাইলে।

সেটা হয় নাই। কারন একাত্তরের আগে উপনিবেশ, পরে নয়া উপনিবেশ। উপনিবেশ আমাদের তাবৎ গোজামিল, অবক্ষয়, নোঙরামি আর সুবিধাবাদী সমঝোতা এবং ঐক্যমতের মূল ভিত্তি। উপনিবেশের কারনে আমাদের ইসলাম মদিনায় থাকে আর প্রগতিশীলতা থাকে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স বা সোভিয়েত রাশিয়ায় এবং কারো কারো জন্যে ওয়ালস্ট্রিটে। ৬ ধর্ম পরিচয়, জাতি পরিচয়, রাজনৈতিক মতাদর্শগত পরিচয় এইরকম কোন আইডেন্টিটিতেই আগ্রহি নাই আজকাল অনেকেই।

গেলো শতকে এইটা পশ্চিমে শুরু হইছিল। এই শতকে পরিচিত বন্ধু বান্ধবের অনেকেই এমন দাবি করে আসছেন। তবে নিজ নিজ 'ব্যক্তি পরিচয়ের আইডেন্টিটি' নিয়া এদের সবার বোধ খুবি টনটনা। ঐ আইডেন্টিটিটুকু ছাড়বেনা তো বটেই, উলটা 'ব্যাক্তি সাতন্ত্রের' নামে সেইটার জয়গান গাইবে। কিন্তু 'আমি'রে বিসর্জন দেয়ার ইচ্ছা না থাকলে নানা ধরণের 'আইডিন্টিটি'রে গালি দিয়া লাভ কি? ইনফ্যাক্ট 'আমি'রে ডিফাইন করতে গিয়াই ধর্ম, জাতি, রাজনৈতিক মতাদর্শগত পরিচয়গুলার উদ্ভব হয়, এইটা তারা যত তারাতারি বুঝে ততো দ্রুত মঙ্গল।

৭ আমি কখনো নিজেরে মুক্তমনা দাবি করিনাই, নিজেরে মানবতাবাদী বলিনাই, আমি অহিংশায় বিশ্বাসী নই, আমি সাম্যবাদী নই, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করার কোন আগ্রহ আমার নাই। এই বিষয়গুলার সাথে কেউ আমারে যুক্ত করে থাকলে ভুল করবেন। আমি মুক্তমনা হওয়ার চেষ্টা করি (যদিও আপাত অসম্ভব বিষয় বলে মনে হয়), মানুষের ইবাদত করার চেষ্টা করি (সেইটা করার মতো ভক্তি এখনো আয়ত্ব করতে পারিনাই), মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের সাম্যবাদী সম্ভাব্যতা ও তার মডেল নিয়া চিন্তা করি, এবং একমাত্র আমার নিজের একনায়কতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন একনায়কতন্ত্র কায়েমে আমার কোন আগ্রহ নাই তবে আমার এই 'নিজ' এর পরিধী একেবারেই 'আমি' নির্ভর না, বর্তমানে এই 'নিজ' এর পরিধী পরিবার, শ্রেণী, ধর্ম ও জাতের গন্ডী পার হয়ে সার্বভৌম 'জাতি'র আকাড়ে বিরাজমান এবং ভবিষ্যতে 'আমি'র সম্পুর্ণ বিলুপ্তির মাধ্যমে বিশ্বরূপ ধারণ করা যায় কিনা সেটা নিয়া আশাবাদী চিন্তাভাবনা করি। ৮ আল্লা হইলো মানুষের ক্ষমতা আকাঙ্খা আর নৈতিকতার মডেল এর মিলঝুলে গইড়া উঠা একটা সত্ত্বা, আল্লার কাছে আত্মসমর্পন মানে 'ব্যক্তি আমি'রে বিসর্জন দিয়া এই আকাঙ্খিত মডেলের কাছে আত্মসমর্পন করা। সবাই নিজের নিজের আল্লা বানায়, কিন্তু তার কাছে আত্মসমর্পন করার বদলে 'ব্যক্তি আমি' নিজেই আল্লা হইয়া উঠতে চায়।

অন্যেরে লম্পট বইলা একদিন সেও লম্পট আখ্যা পায়, অন্যরে চোর বইলা নিজেও চুরির অভিযোগে পরে আবার অন্যরে হিপোক্রেট বইলা নিজেও হিপোক্রেসির দায়ে পরে, অন্যরে ভন্ড বইলা দিনশেষে নিজেই ভন্ড হইয়া যায়। নিজের যেই আকাঙ্খিত মডেল বা আল্লা তুমি বানাইছো, যেই মডেলরে তুমি নিজের চেয়ে বেশি দাম দেও, তার কাছে আত্মসমর্পন করো, 'ব্যক্তি আমি'রে কুরবানী দেও। লম্পট, চোর, হিপোক্রেট ভন্ড তুমি তখন নাই হইয়া যাইবা, থাকবো খালি ন্যায়পরায়ন আল্লা। আর যদি 'ব্যক্তি আমি'রে কুরবানী দেওনের লোভ না সামলাইতে পারো, তাইলে তুমি যেমুন অন্যেরে ভন্ড বলো, অন্যরাও তেমনি তোমারে ভন্ডই বলবে। ৯ মানুষের ইতিহাসে ইশ্বর বহুবার কথা বলেছেন।

এই কথা তিনি সাধারণত মানুষের মুখ দিয়ে বলেন। নীতি নৈতিকতা, আইন কানুন, ভালো-মন্দ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং চলতি নানান সমস্যার সমাধান দিতে গিয়া তিনি মানুষের মুখ দিয়া বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন, বলেন। তিনি সাধারণত নবি, কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি গোছের মানুষের মুখ দিয়া কথা বলেন। এই কারনে ইশ্বর কখনো নবি থেকে কবি আবার কখনো দার্শনিক থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হন। কথা কইতে গিয়া এহেন রূপান্তর হইলো ইশ্বর মওলার আলেকবাজি।

মুহাম্মদএর মুখ দিয়া ইশ্বর যখন মক্কায় কথা কইছেন তখন তিনি নবি ও কবি ছিলেন, কিন্তু যখন মদিনায় কথা কইছেন তখন তিনি রাজনীতিবিদ হয়া গেছেন। কিন্তু ঝামেলা হইলো যে মুহাম্মদের মুখ দিয়া ইশ্বর কইছেন যে মুহাম্মদই শেষ নবি, যারে আমরা বলি 'খতমে নবুয়্যাত'। অর্থাৎ, নবির মুখ দিয়া ইশ্বরএর কথা কওয়ার দিন শেষ, কোন নবির মুখ দিয়া তিনি আর কখনো কথা কইবেন না। এতে ইশ্বর এবং নবির অনুসারীরা সাধারণত ব্যাপক ফাপড়ে পরে থাকেন। কারন ইশ্বর যেহেতু কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদএর মুখ দিয়া কথা কওয়া বন্ধ করে নাই, তাই দুনিয়া থাইমাও থাকেনাই।

কারন ইশ্বর যদি বলেন 'কুন' তাইলেই তা হইয়া যায়। ইশ্বরএর 'কওয়া' এবং 'হওয়া' একি জিনিস। সুতরাং ইশ্বর যখন কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদদের মুখ দিয়া কথা কওয়া চালায়া যান তখন দুনিয়াও চলতে থাকে। আর দুনিয়া যখন চলে মানুষের তখন নীতি নৈতিকতা, আইন কানুন, ভালো-মন্দ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং চলতি নানান সমস্যার সমাধানএর দরকার পরে। এই ফাপরে পরে ইশ্বর এবং নবির অনুসারীরা তখন কোরআনের নানান মানে করতে থাকেন।

এই কারনে ক্রুসেডারদের মোকাবিলা করতে গিয়া সালাদিন কোরআন হইতে যেই জিহাদ তত্ত্ব আমদানি করেন একবিংশ শতকে সেই জিহাদ তত্ত্ব অস্বিকার করতে মডারেট মুসলিমরা কোরআনের নতুন মানে তৈরি করেন। আবার হারুন ইয়াহিয়া, জাকির নায়েক এবং আমাদের মাপুজবাই কোরআনের 'সহিহ সায়েন্টেফিক' সার্টিফিকেট সম্পন্ন মানে তৈরি করে থাকেন। ইশ্বরএর অনুসারীদের হাত দিয়া তাই ইশ্বর কাগুজে কিতাবের 'মানে' ছাড়া আর কিছুই তৈয়ার করতে পারেন না। কিন্তু ইশ্বর সর্বশক্তিমান, তিনি যদি খালি কিতাবের 'মানে'ই তৈরি করেন তাইলে তিনি ইশ্বর থাকেন কিরূপে? অনুসারীদের ইশ্বর তাই বোবা, কালা, লুলা এবং নিৎসের ঘোষনা অনুযায়ী 'মৃত'। অনুসারীর ইবাদত অথবা অভিযোগ কিছুই তিনি শোনেন না এবং তার বিপরীতে কিছুই তিনি করেন না।

কিন্তু ঐ যে কইলাম, ইশ্বর শুধু নবির মুখ দিয়াই কথা কন না, তিনি কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদদের মুখ দিয়াও কথা কন। কবি, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদদের মুখ দিয়া কথা কইতে কইতে তিনি 'কাজ' করতে থাকেন এবং সেই কাজ নতুন নতুন নৈতিকতা, আইন এবং বস্তু ও সম্ভাবনা উৎপন্ন করতে থাকে চলতি সমস্যার মুকাবিলা করতে করতে। এই কাজরে আমরা তাই বলি প্রগতি। খতমে নবুয়্যাত যেহেতু হইয়াই গেছে এবং আর কোন নবি যেহেতু আসবেইনা সুতরাং ইশ্বরএর সাথে নিজেদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার জন্যে নবির মুখে দেইয়া কওয়া ইশ্বরএর কথার নানান মানে তৈয়ার করা বাদ দিয়া নবির অনুসারীদের এখন কবি, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদদেরই অনুসরণ করা উচিৎ। নাইলে নতুন নতুন নৈতিকতা, আইন এবং বস্তু ও সম্ভাবনা উৎপন্ন করতে এবং চলতি সমস্যার মুকাবিলা করতে করতে তারা সক্ষম হবেনা।

১০ আমি যখন নিহিলিজমে পতিত হই তখন জীবন ও জগতের তাবৎ অর্থময়তাকে অস্বীকার করেই নিহিলিস্ট হয়েছিলাম। পরে যখন নিহিলিজমকে অতিক্রম করতে চেয়েছি তখন জীবন ও জগৎএর 'অর্থ' না খুঁজে বরং 'অর্থ' দেয়ার চেষ্টা করেছি। এইভাবে একসময় নিজের দেয়া 'অর্থ' অনুযায়ী জীবন ও জগতএর অর্থে বিশ্বাস করে ফেলেছি। অথচ এই বাস্তবতার শানে নুযুল এতদিন পরে বুঝেছি যে, "অর্থময়তার মাওলা একমাত্র মানুষ"। সুতরাং আমি যদি বলি জীবন ও জগৎ এর অর্থ আছে তো আছে, যদি বলি নাই তো নাই।

তবে আমাদের সবার উচিত জীবন ও জগৎকে অর্থময় করে তোলা। সবশেষে গুরু নিৎসের একটা অত্যন্ত জরুরি বয়ান স্মরণ করি। তার মতে "প্রকৃতি থেইকা সংস্কৃতির উদ্ভব হইলেও প্রকৃতি সয়ম্ভু না। প্রকৃতির সীমাবদ্ধতা আছে আর এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে গিয়েই প্রকৃতি সংস্কৃতির উপরে নির্ভরশীল"। এই বয়ান পড়েছি অনেক আগে, কিন্তু প্রকৃতির সীমাদ্ধতা আসলে কি সেই প্রশ্নের উত্তর পাই নাই।

আজ এতদিন পরে মনে হচ্ছে, প্রকৃতির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে যে সে সংস্কৃতির মাতা হইলেও 'অর্থ' তৈরি করতে পারেনা, কিন্তু সংস্কৃতি পারে। নিজেরে অর্থময় করার খাতিরেই প্রকৃতি সংস্কৃতির জন্ম দিছে। আর তাই আমাদের সবার উচিত জীবন ও জগৎকে অর্থময় করে তোলা। ১১ বাঙলায় একদিন গৌতম বুদ্ধের পুনর্জন্ম হবে। গোপাল আবার নির্বাচিত হয়ে শক্ত হাতে ভুখন্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবেন, মাৎসন্যায়ের কাল তখন শেষ হবে।

৮৪ সিদ্ধারা গণমানুষের মাঝখানে আবার বোধিসত্ত্ব রূপে জীবনযুদ্ধে লড়াই করে নির্বানের জীবনবাদী রূপরেখা তৈরি করবেন। বাঙলার আকাশে সেইদিন যেই সূর্য উঠবে সেই সুর্যের আলোয় তাবৎ দুনিয়ার ভোগ, পূজি আর নিহিলিজমের অন্ধকার দূর হবে। ১২ আইডেন্টিটি গ্রহণ করা মানুষ হওয়ার প্রসেসে অবসম্ভাব্যি হয়ে যায়। নাম, জাতীয়তা, ধর্ম, বংশ ইত্যাদি নানান ভাষায় নির্মিত আইডিন্টিটির কারনেই সে মানুষ। আমি বাঙালি এটা নেহায়েতই দৈব ঘটনা।

আমি আফ্রিকাতেও জন্ম নিতে পারতাম। (পোস্টটি প্রিয় ব্লগার বাদ দেন'কে উৎসর্গ করলাম) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.