আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিরকুটের আফ্রোদিতি

...

তখনও বিজলি এসে পৌঁছায়নি। পরিবেশ নিয়ে এত কচকচানিও শুরু হয়নি। পিলসুজে বাতির যুগ। মানুষ ছিল আলোর মতোই সরল। গাছেদের স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর হার ছিল বেশ ভাল।

আমার কষিটানা খাতাতেও গজিয়ে উঠতো নানান ইচ্ছের প্রেমপত্র। তখনও মনের কথাটা গুছিয়ে বলা শিখতে পারেনি আমাদের প্রজাতি । স্যাঙাৎ তো লাগবেই,ব্যাটম্যানের যেমন রবিন। মাউসের নাম কেউ শোনেনি। তাই মেয়েদেরও সেসব খোয়াবনামা পড়ার সুযোগ ছিল।


আফ্রোদিতি, কেমন আছ তুমি ?
ছবিটা দেখেই তোমায় চিনতে পেরেছি। তারপর চোখের তারায় কত শর্বরী কাবার করে নকশিঁ কাঁথার বিনুনিতে মনে মনে রেখা ও রংয়ের সঙ্গমে যেন পুর্নজন্ম ঘটালাম তোমার ! জড়ানো যামিনী পটের স্মৃতির ভাঁজ খুলতে খুলতে আমি কেবল ভাবছি, আর মুখবইয়ে লিখে চলছি মিথ্যের ফুলঝুড়ি। আফ্রোদিতি আমি জানি,প্রত্যাখাত অক্ষরগুলো ফের লেখা যায়না। কিন্তু মনকে যতই ভুজং-ভাজং বোঝাই না কেন, সে তো বেলতলায় যাবেই !
ওই যাহ ! তোমাকে আবারও আফ্রোদিতি ডেকে ফেললাম। আমার কী দোষ? তুমিই তো এমন এক আগুন রাঙা পলাশ ফোটার বিকেলে ভালবাসার খরস্রোতে ভাসিয়েছিলে আমাকে।

ফাগুনের রক্তিম সকালে রক্ষনশীলতার চৌকাঠ টপকে আমাকে চিলেকোঠায় টেনে নিয়ে চুমু খেতে খেতে শিখিয়েছিলে,আর শিখিয়েছিলে কোনকিছুতে বুঁদ হয়ে থাকার সময় বড় নাম কোন আহ্বলাদী উচ্চারণে ছোট্ট করে ডাকতে হয়!
ওটাই আমার প্রথম কোন মেয়ের ওষ্ঠজয়। কম বেশি সব বাঙালির-ই প্রথম চুমু খাওয়া হয়তো এই অসহ্য ফালগুনে। আফ্রোদিতি এখন কোথায় তুমি ?
ফাইনাল ইয়ারের পর আর যোগাযোগ রাখতে চাওনি বলে এড়িয়ে চলতে জানি। তাই তোমার বাসার ঠিকানাও আমার কাছে অজানা। ঠিকানা জানলে বারান্দা থেকে তোমার ছুঁড়ে দেয়া থুতু ঠিকই আমার গায়ে এসে পড়তো, তা জানি।

মুখ বইয়ের কল্যাণে সেদিন ফিরে পেলাম তোমায়। কত বদলে গেছ তুমি! ভ্রমর চোখে উধাও সেই চাহনি। উধাও, তোমার জোৎস্না নেভানো আলো! লাউডগা চিবুকে এখন বইছে একইরকম কিন্তু অচেনা লালির অদৃশ্য স্রোত,প্রসাধনীমাখা ত্বকে লেমিনেটেড জৌলুস! হয়তো আমার দেখার ভুল। অথবা আমার চোখ দুটি বদলে গেছে একদা বৃস্টিস্নাত সাহারা থেকে আজকের বিরান মরুভূমির মতো।
কেমন আছ, তার উত্তরটা তো দিলে না আফ্রোদিতি? তুমি তো জানো লোক-লৌকিকতার বালাই আমি কোনওদিনও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি।

তোমার দুজনকে পাশাপাশি মানিয়েছে খুব । বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় কোথায় গিয়েছিলে, পাহাড়ে? নাকি হারিয়ে খোঁজা সেই সময়ের প্রতিজ্ঞা পূরণে ফুলশয্যার রাতেই একশো চুম্বন এঁকেছো হঠাৎ দখল নেয়া মানুষটির গালে ? বলতে পারো কোনটা ভাল ? পাহাড় নাকি শিমুলতলীর ছায়া নিবিড় আমবনে চুড়ান্ত বালখিল্যের সাক্ষী হয়ে থাকা সেই গাছটার কোল ? একবার যমুনার বালি চিকচিক পাড়ে দু’জনে কত ছবি তুলেছিলাম, ভুলে গেছ বুঝি ? বোবা ফোল্ডারটা এখনও আমার বৃদ্ধাশ্রমে বন্দী। প্রতিদিনই দেখভাল করি। তবু আঁশ মেটেনা।
কি ডানপিটে মেয়েই না ছিলে তুমি ! সবাই বলতো তোমাকে এড়িয়ে চলতে।

তুমি তোন জানোই, ওহি শোনার মতো ধৈর্য্য আমার কোনকালেই ছিলনা, সেই তোমার সঙ্গে স্কুল পালিয়ে একবার...না থাক,তুমি হয়তো ওসব ভুলেই গেছ...শরৎবাবুই তো বলেছেন, অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রক্ষা করার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই। তবুও বলছি, ক্লাসটিচারের সই নকল করে পালিয়েছিলাম। তুমিও যেন কী একটা করেছিলে ? ওহ, মনে পড়েছে। গলার ভেতর হাত চালিয়ে প্রচুর বমি করেছিলে। ছুটি পেতে আর কোন সমস্যা হয়নি।


একবার রাত সাড়ে এগারোটার সময় ঈদের চাঁদ দেখার কথা মনে আছে তোমার ? আমি ভুলতে পারিনি। সে এক বয়স ছিল ! ঈদের আগে থেকেই শুরু হতো প্রস্তুতি, তোমরা মেয়েরা যেমন শাড়ি,ব্লাউজ আর ম্যাচিং করে গয়না কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে, আমরা ছেলেরাও। পাঞ্জাবির সঙ্গে এঁটো জিন্স নাকি ঢিলে পাজামা ? শতভাগ বাঙ্গালিয়ানা নাকি বারো পাড়ার চৌদ্দ রকম মাল-মশলায় মেশানো আধুনিকতা ? বিকেলে কী পরব সেই নিয়েও মনে মনে ড্রেস রিহার্সালটা সারা থাকতো ! আর এতক্ষণে সেই সব চোগা-চাপকান চাপিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় শুরু হয়ে যেত র‌্যাম্পের মডেল হওয়ার মিথ্যে কসরত। কি কামিনীকাঞ্চন ডাহুকের দৃষ্টিতেই না আমায় দেখতে তুমি !
অধিকার ছেড়ে দিয়ে অধিকারের পিছু ছোটার মতো মানুষ আমি হতে পারি, কিন্তু তুমি নও.। তাই কি হৃদয় গহনে সুপ্ত আগ্নেয়গিরিকে ফের জাগাতে চাওনি ? মাঝে-মধ্যে কি উথাল-পাতাল ঢেউয়ে তছনছিয়া বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পাওনা ? হারিয়ে ফেলা নীলপদ্মের খোঁজ করতে,মনটা কি একছুটে বেরিয়ে পড়তে চায় না ?
শহরের বাতাসে এখন হলদে পাঞ্জাবি আর বাসন্তি শাড়ীর তুমুল প্রেমের আভাস।

তোমাকে লিখতেই চোখ চলে গেল গেল অদূরের মাঠে। আলতুশি রোদ গড়িয়ে পড়ছে দিব্যি। এই সময়টায় আমার গ্রামের মাঠে সর্ষেফুলে ছেয়ে যেত আলের পর আল। যেন হলুদের ইন্দ্রজাল ! তারই মাঝখানে এক বাসন্তিক বিকেলে শেষ কথা হয়েছিল আমাদের। তুমি বলেছিলে- ‌'আমায় স্বপ্নে মনে রাখিস'
আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে।

দিনের আলোর লজ্জাচুরির এই শেষলগ্নে জানো আফ্রোদিতি, বুকের মধ্যে মনখারাপের হাওয়া বইছে। দখিনা সময়ে এ কোন উত্তুরে হাওয়া ? ঠিক সেই ফুল-চন্দন আর শরীরী ভুর ভুর গন্ধের ওপারে তোমার পাট ভাঙা শাড়ির আড়ালে পা গুটিয়ে বসে থাকার মতো। তোমার ভিজে চুলে বাসমতীর সুবাসে অপুর্ব কালবৈশাখী দেখে আমার মন কেমন করত। নিমগ্নতায় সম্মিলিত ঠোঁটের চুড়ান্ত অরাজকতার পর দুজনেই তাই উদাস হয়ে যেতাম!
লেখা থামিয়ে তেমন করে উদাস হতে ইচ্ছে করছে আফ্রোদিতি। ইচ্ছে করছে, এই সন্ধ্যার মুগ্ধতায় দুরের পানে তাকিয়ে থাকি।

এখন এমনি করে তাকিয়ে থাকতেই দিন কাটে। হয়তো সয়ে গেছে। যাই এখন। নামটা ভুলে যেও না।
ভাল থেকো।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।