আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথে পথে বিশ্ববিদ্যালয়

রাজধানীর অলিগলিতে-পথেঘাটে মানহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। অভিজাত স্থান গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ছেড়ে এখন মোহাম্মদপুর পর্যন্ত ছড়িয়েছে আইন লঙ্ঘনকারী এসব প্রতিষ্ঠান। বিশাল আকারে স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে না তুলে বরং শিক্ষার্থী ধরার টার্গেট করেই ফ্লোর ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। আইন না মেনে মার্কেটের ভেতরে, আবাসিক হোটেলের নিচতলায়, রেস্টুরেন্টের ওপরে, বাসস্টেশনে, এমনকি কারওয়ানবাজারের মাছের আড়তের সামনে পর্যন্ত গড়ে উঠেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে গড়ে ওঠা একাধিক ক্যাম্পাসের মালিকও স্বতন্ত্র।

আশ্চর্য হলেও সত্য, এসব অবৈধ শাখা ক্যাম্পাসের পরিচালকদের রয়েছে জয়েন স্টকের মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের কাগজ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীরবতা আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কাগুজে বাঘে পরিণত হওয়ায় ধরার কেউ নেই তাদের। ফলে উচ্চশিক্ষার নামে প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। প্রশ্ন আর বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণকারীদের।

সরেজমিন বনানী ঘুরে দেখা গেছে, এখানে রয়েছে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

এর মধ্যে ৯টিই কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ এলাকায়। সব প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে মাত্র আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। কয়েকটির রয়েছে বহুতল ভবন। সেই ভবনগুলোর নিচতলায় দোকান, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ তলায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অফিস এবং পঞ্চম তলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম। কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো অতীশ দীপঙ্কর, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি), এর দক্ষিণ পাশে প্রাইম এশিয়া, সাউথইস্ট, সাউথ এশিয়া, রয়েল ও প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।

এগুলোর মধ্যে একই এলাকায় কয়েক গজ দূরত্বে এআইইউবির ছয়টি, সাউথইস্টের পাঁচটি ও প্রাইম এশিয়ার তিনটি বহুতল ভবন রয়েছে। ১৭ নম্বর সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, প্রাইম এশিয়ার তিনটি ভবনের মধ্যে দুটির অবস্থান একই সড়কের দুই পাশে মুখোমুখি। পাশেই সড়কের দুই পাশে এক সারিতে এআইইউবি এবং প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি। ১০ নম্বর সড়কে রয়েছে রয়েল ইউনিভার্সিটি। এভিনিউয়ের উত্তরে ৪ নম্বর সড়কের দুই পাশে অতীশ দীপঙ্কর ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি।

১৪ নম্বর সড়কে এআইইউবি এবং সাউথ এশিয়া। এ ছাড়া উত্তরে সাউথইস্ট ও এআইইউবির একাধিক ভবন প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মী, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ এলাকায় একটি মাত্র ভবন ছাড়া বাকি সবগুলো ভাড়া নিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। ওপরের দুটি তলা ছাড়া ১০ তলা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এখানে পরিচালিত অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যত্র রয়েছে নিজস্ব ভবন।

অন্যদিকে ধানমন্ডি এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ২ নম্বর সড়কের শুরু থেকে জিগাতলা হয়ে ২৭ নম্বর পর্যন্ত প্রধান সড়কে সাতটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি ক্যাম্পাস রয়েছে। আশপাশের অলিগলিতে রয়েছে আরও বেশকিছু ক্যাম্পাস। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এ আবাসিক এলাকার ভাড়াবাড়িতে। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিড়। এর মধ্যে গড়ে উঠেছে বিচিত্র নামের ঘন ঘন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস।

ফলে এলাকাটি পরিণত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিড়িয়াখানায়। এসব অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচে মার্কেট, ব্যাংক, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা মেডিকেল সেন্টার। আর ওপরে একটি কিংবা দুটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে পপুলার হাসপাতালের পাশে ছয়তলা নিজস্ব বাড়িতে রয়েছে দারুল ইহ্সান ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব বিজনেস স্টাডিজ। জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে খানিক সামনে এগোলেই একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

ধানমন্ডি ৪/এ সড়কের ১৪৯/১ নম্বরে ছয়তলা বাড়ির পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক। বিপরীত পাশে একই ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের ক্যাম্পাস। ধানমন্ডি লেক থেকে খানিক এগিয়ে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের ক্যাম্পাস। এরপর মাত্র দুটি ভবন ও একটি রাস্তা পার হয়ে নিজস্ব ভবনে গড়ে উঠেছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। শংকর পার হয়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মাথায় নিজস্ব ভবনে রয়েছে স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস।

এভাবে ধানমন্ডি পার হয়ে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় মোহাম্মদপুর-মিরপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ জাতীয় সংসদে পাস হলেও তা মেনে চলছে না কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিষ্ঠান মালিকদের আইনের দিকে নজর না থাকলেও শিক্ষাবাণিজ্যের দিকে বরাবরের মতোই নজর রয়েছে। তারা ভোলেননি বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঢঙে রংবেরঙের সাইনবোর্ড ঝোলাতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বছর দুয়েক আগে এসব শিক্ষা ব্যবসায়ী ও উচ্চশিক্ষার গলাকাটা দোকানগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুতি নিলেও তা যেন থামিয়ে দিয়েছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি।

বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। এদিকে দখল ও দীর্ঘদিন ধরে মামলায় জড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থান জানিয়ে মূলধারায় ফিরে আসতে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও ২০ মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। ফলে হিড়িক পড়েছে এ সময়টা কাজে লাগিয়ে শিক্ষাবাণিজ্য করতে অবৈধ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৮টি। এখন পর্যন্ত ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপন করেছে।

এর মধ্যে তিনটি সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া। আর প্রতিষ্ঠার পর সাত বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়া ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় যেতে পারেনি নিজস্ব ক্যাম্পাসে। এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১০ বছর আগে। প্রতিষ্ঠার পর সাত বছর অতিক্রান্ত না হওয়ায় বাকি ২৩টির নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ বিষয়ে বলেন, 'আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।

কঠোর হওয়ার কারণেই অনেক প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ক্যাম্পাসে নিতে পেরেছি। এক বছরের মধ্যে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাবে বলে জানিয়েছে। বেশকিছু অবৈধ আউটার ক্যাম্পাসও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বারবার সময় দেওয়া হচ্ছে, তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। এরপরও নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে না পারলে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল করা হবে।

তখন তারা আর শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে না। '

নিজস্ব ক্যাম্পাস যাদের : শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সূত্রমতে, আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপন করা ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় হলো নর্থসাউথ, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাক, প্রিমিয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট চট্টগ্রাম (নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকলেও আদালতের রায় নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে অননুমোদিত ক্যাম্পাস চালাচ্ছে), জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনূস আলী বিশ্ববিদ্যালয় ও রণদাপ্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়।

নির্মাণাধীন ক্যাম্পাসে চারটি : এই শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নির্মাণাধীন নিজস্ব ক্যাম্পাসে আংশিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। এগুলো হলো শান্ত-মারিয়ম ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অব সায়েন্সেস ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি।

ফাউন্ডেশনের জমিতে পাঁচটি : নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা না করে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ফাউন্ডেশনের নামে কেনা জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল, দি মিলেনিয়াম, পিপলস ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি।

নির্মাণাধীন ক্যাম্পাস চারটির, নকশা তিনটির : চারটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্মাণ করছে। এগুলো হলো আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, লিডিং ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এ ছাড়া নকশা করলেও নির্মাণ শুরু করেনি গ্রিন, ওয়ার্ল্ড ও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি।

জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে যারা : আটটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত পরিমাণ জমি কিনলেও ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে নকশার অনুমোদন পায়নি।

জমি ব্যবহারের অনুমতিও অর্জন করেনি তারা। তবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ছয় মাস আগে এসব প্রতিষ্ঠানকে এক বছরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন, ইউনাইটেড, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, রয়েল ও উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়।

নকশা প্রণয়ন করেনি নয়টি : নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত পরিমাণ জমি কিনেছে।

তবে জমি ব্যবহারের অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেনি এবং ভবন নির্মাণের জন্য নকশা প্রণয়ন করেনি। এই শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি, প্রাইম এশিয়া, বাংলাদেশ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, আশা ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ডেল্টা, সাউদার্ন ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি।

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।