আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জল মিশে যায় জলে-৩

মেয়েটা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। রোজ যেমন থাকে।

ছেলেটা হেঁটে যায়। রোজ যেমন যায়। নির্বিকার।

স্বাভাবিক। ৫ মিনিট লেট হলেই ট্রেন মিস। রুপাতলি বড় দূরের পথ। সময় মত না পৌঁছালে বিপদ। গঞ্জের মাল এসে পৌঁছাবে আড়তে।

তাকে তার আগেই যেতে হবে। আড়তের ঝাঁপ খুলতে হবে। নদীর পাড়ের কুলিদের ডেকে আনতে হবে। চালের বস্তা প্রতি ভাড়া ঠিক করতে হবে। ক'মণ পাট উঠবে তাও।

মালিক আড়তে আসার আগেই গুছিয়ে ফেলতে হবে সব। তারপর ছুটতে হবে গঞ্জে। সেখানে দিনভর নানান হিসেব নিকেশ। চালের পাইকারি দাম কত বাড়ল? কিংবা কমলো? তেল, পেঁয়াজ, আটা নুনের দাম? আগে ভাগে কিনে রাখা ভালো?

নাকি লোকসান?

এই হিসেব নিকেশ গত ছ'বছর ধরে চলছে। আর কতদিন চলবে কে জানে?

ছেলেটা সন্ধ্যেয় গঞ্জ থেকে আবার রুপাতলি ফেরে।

আড়তে। আড়তের মাল গোছায়। কুলি মজুরদের বিদেয় করে। মালিকের কাছে দিনের হিসেব নিকেশ জমা দেয়। মালিক তার কাঁধে হাত রেখে বলে, 'তুই মাশাল্লাহ, কাজের পোলারে মানিক।

তোর দুঃখ আর কয় দিন? আমার ব্যবসাডা আরেকটু ভালো হউক। তোরে আমার পারমানেন ম্যানেজার করুম। তহন তোর বেতন যেমুন বাড়বো। দামও। তোরে তহন আর বাড়িরতন কষ্ট কইরা রুপাতলি আইতে হইব না।

এইহানেই তোর থাকার ব্যবস্থা করুম। আর এমুন ডেইলি ডেইলি গঞ্জেও যাওন লাগব না। আলাদা মানুষ রাখমু তহন। তুইই তো তহন এই আড়তের আসল মালিক। বুঝছস মানিক? আরেকটু মন দিল লাগাইয়া কাজ কর।

তোর ভাগ্য ফেরতে কতক্ষন?'

আসলেইতো, মানিকের ভাগ্য ফিরতে কতক্ষণ? গত ছ'বছর ধরেই মানিক এই কথা শুনছে। আজকাল আর তার আলাদা কিছু মনে হয় না। অভ্যেস হয়ে গেছে। ছ'বছর আগে এক সন্ধ্যায় যখন বাবা মারা গেলো, তখন সব কিছুতেই তার কেমন কষ্ট হত। এখন আর হয় না।

বহুদিন থেকেই হয় না। শুধু যে কষ্ট হয় না, তা না। তার কোন আনন্দও হয় না। মাঝে মাঝে যে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার কথা সে ভাবে নি, তা না। অনেক ভেবেছে।

কিন্তু মা-কে কি করবে সে? মানুষ কেন বাঁচে?

মরে যাওয়ার জন্যইতো। তাই না?

এই প্রশ্নের অনেক উত্তরও সে খুঁজেছে। পায় নি। আবার পেয়েছেও। তার মনে হয়েছে, মানুষ আসলে মরে যাওয়ার জন্যই বাঁচে।

আজ, কাল অথবা পরশু, কিংবা আরও কিছু সময় পর। মানুষ আসলেই মরে যাওয়ার জন্যই বেঁচে থাকে। তার মা-ও। পার্থক্য হচ্ছে, তার মার মৃত্যুটা খুব সুনির্দিষ্ট, খুব কাছেই। সময় নির্ধারিত।

এই বাঁচাটা আরও কষ্টের। প্রতিটি দিন মৃত্যুর জন্য বেঁচে থাকা। কিন্তু কেমন চুপিচুপি, ডাক্তারের তিন মাসের মেয়াদ কাটিয়ে, ক্যান্সারটাকে বুকে চেপে রেখে মা দিব্যি বেঁচে আছেন। গত তিন বছর। কিন্তু এই বেঁচে থাকা মৃত্যুর চেয়েও কষ্টের।

মানিক মা-কে ফেলে কোথাও যাবে না। সে বরং রোজ কাক ভোরে ঘুম থেকে উঠবে। মায়ের বিছানা গোছাবে। খাবার বানাবে। ওষুধ খাওয়াবে।

ব্যথা কমার ওষুধ। তারপর মাকে আবার শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরুবে। হেঁটে যাবে স্টেশনের দিকে। তারপর ট্রেন। তারপর রুপাতলি।

তারপর সেই আড়ত, কুলি, মজুর, গঞ্জ। হিসেব নিকেশ। তার মালিক, মালিকের তার কাঁধে হাত রেখে বলা...। তারপর আবার ট্রেন, আবার সেই ঘর, মায়ের ক্লিষ্ট মুখ। ঘুম।

আরেক ভোর, আরেক দিন। আর কিছু?

মানিক আর কিছুর কথা ভাবে না। সে সেই জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। নির্বিকার স্বাভাবিক। ওই বুঝি ট্রেন আসলো।

সে হেঁটে যায়। রোজ যেমন যায়। মেয়েটাও জানালায় দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েই থাকে। রোজ যেমন থাকে।

গভীর রাত কিংবা কাক ভোরে।

আজ হঠাৎ রুপাতলি থেকে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতেই বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমক। প্রবল ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায় ঘন বন।

ট্রেনের তীব্র সাইরেন যেন শীস কাটে ভেজা গাছেদের গায়ে। কোথাও প্রকাণ্ড ডাল ভেঙ্গে পড়ে। তীব্র চিৎকার কোথাও। তারপর ট্রেনের গতি থেমে আসে ধীরে। থেমে যায়।

মানিকের কি হয় সে জানে না। মাঝরাস্তায় সে নেমে পড়ে ট্রেন থেকে।
তারপর ছুটতে থাকে। ছুটতেই থাকে। মায়ের যদি কিছু হয়!!

সে সেই জানলাটার সামনে দিয়ে হেঁটে যায়।

নির্বিকার। স্বাভাবিক। তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কপালের সামনে থেকে আলতো হাতে চুলগুলো সরায়। তারপর খুব ধীরে মাথা তুলে তাকায়।

জানালায়। কেউ নেই। কেউ না। মানিক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে, এক চিলতে বিদ্যুৎ চমকের অপেক্ষায়। ওখানে ওই অন্ধকারে, জানলায়, একটু আলোতে সে তাকাবে।

নিশ্চয়ই কেউ একজন আছে। কেউ একজন।

কিন্তু ওখানে কেউ নেই, কেউ না।

মানিক সেই বৃষ্টিতে ভিজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিঃশব্দ।

বুকের ভেতর কোথাও কেমন শিরশিরে হাওয়া বয়। ঝড়ে ভাঙ্গা শুন্য ঘরের মতন ক্লান্ত প্রান্তর। একা। মানিকের বুকের ভেতর কোথায় কেমন ব্যথা হয়। চিনচিনে ব্যাথা।

সে ধীর পায়ে হাটে। তার পায়ের নিচে বৃষ্টির জলে ছপছপ শব্দ হয়। মানিক কিছু টের পায় না। সে হেঁটে যায়।

ছোট্ট ঘরের ভেতর কেরোসিনের কুপিখানা নিভে গেছে।

মানিক অন্ধকারে দিয়াশলাই খোঁজে। কেউ একজন রিনরিনে গলায় বলে, 'এত রাত করে ফিরলে হয়? মানুষটা যে ঘরে একা!'

মানিক চমকায় না। যেন সব স্বাভাবিক। সে নির্বিকার গলায় বলে, 'ট্রেনটা হঠাৎ মাঝরাস্তায় বন্ধ হয়ে গেলো যে!'

- কিন্তু ভাঙ্গা চালে বৃষ্টির জল ঝরছিল! অন্ধকারে বাতি জ্বালানোরও কেউ ছিল না। অসুস্থ মানুষটা ঘরে একা'।



মানিক গায়ের জামা খুলে পানি চিপরায়। তারপর গামছায় মাথা মুছতে মুছতে বলে, 'এতটা পথ তাই হেঁটে এসেছি। অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছিল'।

রিনরিনে গলার মানুষটা আবার বলল, 'রান্নাঘরে বালতিতে গরম পানি আছে। গা-টা ধুয়ে নিলে ঠাণ্ডাটা বসে যাবে না হয়তো'।



মানিক কোন জবাব দেয় না। সে রান্নাঘর থেকে গরম পানির বালতি নিয়ে কলতলায় যায়। ছপাত ছপাত জলের শব্দ তুলে গোসল করে। তার কিছুই অবাক লাগে না। তার মনে হতে থাকে, রোজ ওই রিনরিনে গলার মেয়েটা এই ঘরের ভেতরই ছিল।

চুপটি করে সব দেখত, সে যখন থাকতো না, তখন তার মা'কে দেখত। চুপচাপ শুধু দেখে যেত। নিঃশব্দ। কেবল আজই সে কথা বলল। মানিকের হঠাৎ কি মনে হল, সে গোসল রেখে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।

তারপর নিচু গলায় বলল, 'মা কি ঘুমাচ্ছে?'

রিনিরিনে গলাটা বলল, 'হ্যা, কেন?'

মানিক বলল, 'বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে'।

অন্ধকার থেকে মেয়েটা বলল, 'আমার ঠাণ্ডার ধাত আছে, আমি বৃষ্টিতে ভিজতে পারি না যে'।

মানিক বলল, 'বালতিতে গরম পানি আছে। হয়তো পরে গা টা একটু ধুয়ে নিলে ঠাণ্ডাটা আর বসে যাবে না'।

মেয়েটা বলল, 'কিন্তু আপনার সাথে আমি বৃষ্টিতে কেন ভিজব?'

মানিক এই কথার কোন জবাব দিল না।

সে বৃষ্টির ভেতর চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল। কেউ একজন জলের ভেতর ছলছল শব্দ তুলে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। আলতো হাতে তার কাঁধ ছুলো। তারপর গাল চেপে ধরল বাহুতে।

সেখানে উষ্ণ জলের ছোঁয়া।

বৃষ্টির জল থেকে আলাদা।

সেই উষ্ণ জলের নাম কি?
কান্না?
--------------------------------------------------------
জল মিশে যায় জলে-৩/ সাদাত হোসাইন
০২.০৪.২০১৪ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।