আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“ নিজের মা-বাবা কে ভালবাসেন? তাহলে আমাদের সবার মা-বাবার চোখের জল মুছে দেন! ”

বড় ধরনের স্বপ্নবাজ এক নিঃসঙ্গ পথচারী! তখন আই ওয়ার্ডচলছিল। সময় বাচানোর জন্য হাসপাতালের পিছনের গেইট দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। গেইটে ঢুকার মুখেই গাছের নিচে বসে একজন বৃদ্ধা কাঁদছিলেন। হাতে একটা পুরানো পানির বোতল, গামছা জড়ানো! গামছার একটা পাশ ভেজা, বোতলের পানিতে নাকি চোখের জলে এই সিক্ততা, সেটাজানতে পারি নি! মনটা হু হু করে কেঁদেউঠেছিল। আহারে...... তার কোন প্রিয়জন কি তাকে একলা করে না ফেরার দেশে চলে গেল? হঠাৎ থমকে দাড়াতে হল, বৃদ্ধা কি যেন বলতে চান! ক্রন্দনরত কোন মানুষের ডাক উপেক্ষাকরবো, সেই শক্তি কোথায় আমার? কাছে গেলাম।

“বাবা,তোমাদের হাসপাতালের মানুষ এত খারাপ ক্যান?”,বৃদ্ধার এই কথায় চমকে উঠলাম! তাকে বিস্তারিত বলতে বললাম। বৃদ্ধার কাছে ঘটনা শোনার পর, রাগে-দুঃখে-হতাশায় ভিতরে ভিতরে একেবারে ভেঙ্গে পড়লাম!মানুষ এতটাও নিচে নামতে পারে! ঘটনা অনেকটা এরকম : “এই বৃদ্ধার স্বামীর হার্নিয়ার চিকিৎসার জন্য তিনদিনআগে তারা এই হাসপাতালে আসেন লাকসাম থেকে। তাদেরএকমাত্র ছেলে তাদের কোন খোজ রাখে না, বহু কষ্টে তাদের সংসার চলে। সার্জারি ওয়ার্ডেবেড না পাওয়ায়, মেঝেতেই ঠাই হয়েছিল ঐ বৃদ্ধ লোকের। দুইদিন পরেই বৃদ্ধর অপারেশনহওয়ার ডেট! কাল রাতে এক লোক এসে নিজেকে পরিচয় দেয় হাসপাতালেরলোক হিসেবে।

তাদেরকে বলে, সরকারের তরফ থেকে দরিদ্রমানুষদের জন্য একটা ১০০০০ টাকার সাহায্যের ব্যবস্থা আছে! এটা সবাই জানে না, তবেতারা চাইলে সে সেটার ব্যবস্থা করে দিতে পারে! সেই সাথে ওয়ার্ডে সিটের ব্যবস্থা এবংঅপারেশনের ডেট এগিয়ে আনার ব্যবস্থাও সে করে দেবে! তবে এজন্য সামান্য কিছু টাকা খরচ করতে হবে,মাত্র এক হাজার টাকা হলেই সে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিতে পারবে! সরলমনা গ্রাম্য এই বৃদ্ধ বৃদ্ধা, সরকারীসাহায্যের প্রত্যাশায় তাদের শেষ সম্বল আটশ টাকা তুলে দিয়েছেন ঐ লোকের হাতে। বলাবাহুল্য, ঐ লোক আর ফিরে আসেনি। বৃদ্ধা ভয়ে বৃদ্ধকে কিছু জানায় নি এই ব্যাপারে, এমনিতেই তারশরীর খারাপ, পাছে টেনশনে আরও ভেঙ্গে পড়ে! এখন কিভাবে তাকে বলবেন, কিছুই ভেবেপাচ্ছেন না উনি! ঐ লোক আসবে কিনা, এটাও উনি বুঝতে পারছেন না!!!” এমন অবস্থায় তাকে কি বলবো, নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। নিজে নিঃস্বমানুষ, তাই অভাব কি জিনিস, ভালই বুঝি। আবেগে গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না।

কোনমতে অল্প কথায় তাকে বুঝালাম, সরকারী হাসপাতালের দালাল কি জিনিস! কিন্তু সবহারানোর পর আর বুঝিয়ে লাভই বা কি হল তাদের! পকেটে ২২০ টাকার মত ছিল, দুইশ টাকা জোর করে গুজে দিলাম তারহাতে। নিতে চাইলেন না কিছুতেই! গরীব হতে পারেন, কিন্তুআত্মসম্মানবোধ হারিয়ে যায় নি অর্থের সাথে সাথে! বহু কষ্টে টাকাটা দিতে হল তাকে। তার সাথে গিয়ে বৃদ্ধকেও দেখে এলাম। নিচের এত ঘটনার কিছুই তখনওবৃদ্ধ জানেন না, তবুও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন, আবার আসতেবললেন! বিকেলে আসব, এই কথা দিয়ে ওয়ার্ডে চলে গেলাম। মিজান স্যার এর চোখ বিষয়ক কোনবক্তব্যই সেদিন আমার মাথায় ঢোকে নি! সারাক্ষন মাথায় ঘুরছিল, এদের এখন কি হবে? বিকেলে আমি সামান্য কিছু টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তুতাদের আর পাই নি! সিস্টার কে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, তারা পরে আবার আসবে বলেচলে গেছে লাকসাম।

আহারে...... ঐ দালালের কারনে, চিকিৎসা না নিয়েই ফিরতে হল বুঝি তাদের! আর কি কখনও আসা হবে? নাকিচিকিৎসার অভাবেই, ঘরের অন্ধকার কোন কোণে শুয়েথেকে, এই জগতের উপর বিতৃষ্ণা নিয়ে চলে যাবেন তারা? এটা ছিল এই হাসপাতালে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া শত শত এমন ঘটনার একটি মাত্র! জানিনাপ্রতিদিন এমন কতজন অভাবী মানুষ পুরোপুরি নিঃস্ব হচ্ছে দালালদের খপ্পরে পরে! এখানে চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগ মানুষই নিম্নবিত্তশ্রেণীর। কয়েকদিনের রাহাখরচ জোগাড় করতে এদের কাউকে হয়তোশখের লাল মোরগটি বিক্রি করতে হয়, কাউকে হয়তো সর্বশেষ সম্বল একজোড়া পাতলা সোনারচুরি বন্ধক রাখতে হয়! অথচ এদেরকেই কিনা প্রতিনিয়ত জোঁকের মত শোষণ করে চলেছে দালালনামের এক শ্রেণীর অমানুষ! একপাতা প্যারাসিটেমল এর দাম এদের কাছ থেকে রাখা হয় একশ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত!এদের সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এদের বিরুদ্ধে কিছু করতেগেলে, পুরো হাসপাতালই অচল করে দেয় এরা! তাই এদের বিরুদ্ধে সরকারী একশন আশা করে বসেথাকলে, কাজের কাজ কিছুই হবে না! তাই বলে আমাদের কি কিছুই করার নেই? অবশ্যই আছে! না, আমি বলছি না আমরা তাদের লেভেলে নেমে গিয়ে তাদের সাথে তর্ক করবো কিংবা মারামারিকরবো। আমরা যা করতে পারি তা হল, সবাই মিলে দালালদের ব্যাপারে রুগীদেরসতর্ক করা। প্রতিদিন আমরা হাসপাতালে যাই,অনেক রুগীর সাথেই আমাদেরকে কথা বলতে হয়। আমরা অন্যান্য কথা বলারপাশাপাশি, তাদেরকে দালালদের ব্যাপারেও সতর্ক করে দিতে পারি।

তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে পারি যে, দালালরা হাসপাতালের কেউ নয়। তাদের কাছ থেকে অনৈতিক কোন সুবিধা আদায় করাও সম্ভব নয়। হাসপাতালের বেড, অপারেশনের ডেট, ওষুধ ইত্যাদি যে কোন ব্যাপারেযেন তারা কোন ডিউটি ডাক্তার অথবা সিস্টার এর সাথে কথা বলে। ওষুধ কিনলে যেন, হাসপাতালের ভিতরের দোকান, অথবান্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কেনে। আর বাইরে থেকে কিনলেও যেন কয়েকটা দোকান যাচাই করে কেনে।

কোন ওষুধ বা অন্যান্য যন্ত্রপাতির দাম অস্বাভাবিকলাগলে যেন সিস্টার অথবা ডাক্তারের পরামর্শ নেয়। বাইরে থেকে স্বেচ্ছায় সাহায্য (!!!) করতে আসা এসব লোকদের যেন কোনমতেইকোন সুযোগ না দেয়! নিজেরা সচেতন হবার পাশাপাশি, অন্য রুগীদেরও যেন তারা সতর্ক করে দেয়, এটাও তাদেরবলতে হবে। এভাবে সবাই মিলে কাজ করলে, আশাকরি দালালদের কবল থেকে আমরা এই হাসপাতালকে মুক্ত করতে পারবো। অন্তত অনেক মানুষইনিঃস্ব হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। নিজেদের বাবা মা এর চোখের পানি আমরা সহ্য করতে পারি কি? পারি না! যাদের সন্তান তাদের মা বাবার খবর রাখে না, আমরা কি তাদেরসন্তান হয়ে তাদের চোখের জল মুছে দিতে পারি না? অন্তত কিছুক্ষনের জন্য? (ফেসবুকে : https://www.facebook.com/tawfirhasan ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।