আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এটা হল ঘাতকদের শেষ ডিসেম্বর!!!

বাঙালীর বিজয়ের মাস ডিসেম্বর একাত্তরের ঘাতকদের দল জামায়াতে ইসলামীর জন্য কখনও এত আন্দনঘন ছিল না, যেমনটি এবার দেখা যাচ্ছে। এজন্য তারা তাদের অন্যতম প্রধান মিত্রদল এবং নবজীবন দানকারী বিএনপিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিকভাবে জামায়াত-মুসলিম লীগের মতো ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করার পর ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার নামে জামায়াতকে আবার রাজনীতি করার লাইসেন্স দিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন।

কিন্তু এত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও তারা ডিসেম্বর ও মার্চ মাসে ধূর্ত শিয়ালের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকত জনরোষের ভয়ে, কারণ এই দু’টি মাস একান্তভাবে একাত্তরের বিজয়ী বাঙালীদের। এই দুই মাসে বাঙালী তার একাত্তরে সৃষ্ট গৌরব গাথা চর্চা করে, তার শৌর্যবীর্যের কাহিনী শোনায়, তার ত্যাগ-তিতিক্ষা আর দুঃখ-বেদনার কথা বলে, তাঁর স্বজন হারানোর স্মৃতি রোমন্থন করে। এই দু’মাসে পরাজিতদের জন্য কোন স্থান নেই এবং ছিল ও না। এই বছর তাঁর ব্যতিক্রম হলো আর তার অন্যতম কারণ এইবার জামায়াত তার অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুুখি হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের নয় জন শীর্ষস্থানীয় নেতার বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে।

রায়ে দ-িত হলে তাদের অপরাধের জন্য কারও কারও মৃত্যুদ-ও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুতরাং তাদের এখন বাঁচা-মরার লড়াই। এখানে আর মাস-সন তারিখ বিচার করলে চলছে না। আর সঙ্গে যখন বিএনপির মতো একটি বড় দল রয়েছে তাহলে আর ভয় কিসের ? যদিও আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি অন্যতম অঙ্গীকার ছিল তথাপি মূল বিচারকার্য শুরু হতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল, কারণ এই ধরনের বিচারকার্য বাংলাদেশে এই প্রথম । প্রস্তুতি পর্ব তো একটু দীর্ঘ হবেই।

তবে এটা ঠিক, জামায়াত কখনো ভাবেনি একাত্তরের অপরাধের জন্য তাদের কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। যাদের গাড়িতে এই ক’দিন আগে বেগম জিয়া বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন তাদের আবার বিচার করে কে? শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের চাপেই হোক আর নির্বাচনী অঙ্গীকারের কারণেই হোক সত্যি সত্যি যখন বিচার পর্বটি শুরুই হলো তখন জামায়াত বুঝে গিয়েছিল এবার তাদের একাত্তরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সময় হয়েছে। কিন্তু জামায়াত তা কী আর বসে বসে হজম করবে? এই বিচার বানচাল করার প্রচেষ্টাটা শুরুটা করেছিল তাদের মিত্র বিএনপিকে দিয়ে এটি বলিয়ে যে, তারাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, কিন্তু তা হতে হবে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ। বিচার হবে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন দেশের উচ্চ আদালত হতে।

বিচারকাজ প্রকাশ্যে চলবে এবং তা গণমাধ্যমের জন্য উন্মূক্ত থাকবে। আদালতে অনুমতি নিয়ে দেশী-বিদেশী যে কোন পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এই যখন ব্যবস্থা তখন আর বিএনপির স্বচ্ছতার দাবি হালে পানি পেল না। জামায়াত বলে কথা। কথায় বলে জামায়াতকে যারা চেনেনি তারা তাদের জন্মদাতা পিতাকেও চেনেনি।

জামায়াতের অর্থ আর লোকবলের কোনটিরই ঘাটতি নেই। তাদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হতে জামায়াত বছরে কমপক্ষে বারো হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে বলে গবেষক আবুল বারাকাত দেখিয়েছেন। তার উপর তাদের পুনর্জন্মের পর হতে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সহায়তায় হাজার হাজার বাচ্চা আলবদর তৈরি হয়েছে। এদের অনেকে পরবর্তী তিন দশকে দেশের সামরিক বেসামরিক প্রশাসনে প্রবেশ করেছে এবং বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। এরা আবার সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পেশাদার বর্ণচোরের মতো আনুগত্য বদল করে।

কিন্তু তাদের আসল আনুগত্য যে জামায়াত সেটা অনেক সময় বোঝা যায় না। জামায়াত অন্যান্য দলের মতো কোন কাজে আনাড়িপনা প্রদর্শন করে না। এই যেমন ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে হরতালের নামে বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করা। প্রথমবারের মতো জামায়াত এককভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের নেতাদের মুক্তি দাবি করল। বর্তমানে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন করছে।

জামায়াত সেই দাবিকে দুই নম্বরে নিয়ে এসে তাদের নিজস্ব দাবিকে এক নম্বরে নিয়ে আসল আর সকলকে অবাক করে দিয়ে তাদের দাবির পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য ডাকা হরতালে বিএনপি নৈতিক সমর্থন দিল। হরতালের আগের দিন হতে জামায়াত যখন পুলিশের ওপর আক্রমণ, গাড়ি ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ শুরু করে দিল তখন বিএনপি বলল এই সবের দায়িত্ব তারা নেবে না। নৈতিক সমর্থন দেবেন আর দায়িত্ব নেবেন না তা তো হয় না । আবার যখন বিএনপি ১৮ দলীয় জোটের ব্যানারে হরতাল আহ্বান করল অন্য দলগুলো না থাকলেও নতুন প্রজন্মের আলবদররা (ছাত্র শিবির) ঠিকই মাঠে থেকে সমানে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে গেছে। জামায়াতের ডিসম্বর মাসের কর্মকা- সেখানেই থেমে নেই।

তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য দেশে এবং বিদেশে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। এরই মধ্যে তারা ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের ই-মেইল আর ব্রাসেল্সে অবস্থানরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মানবতাবিরোধী অপারধ গবেষক ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তার স্কাইপের (এক ধরনের ইন্টারনেটভিত্তিক ফ্রি টেলিফোন) কথোপকথনে আড়ি পেতেছে এবং তা টেপ করেছে যা একটি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ। সেটি তারা আবার ব্রিটেন হতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকার কাছে সরবরাহ করেছে। ধরে নেয়া যায় এর জন্য তারা ইকোনমিস্টকে কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। মনে করিয়ে দেয়া ভাল, ইতোমধ্যে জামায়াত এই সব কাজে ব্যয় করার জন্য ২২৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে।

ইকোনমিস্ট প্রাথমিকভাবে তা প্রকাশ না করলেও পরে তা তারা প্রকাশ করতে থাকে আর তার বরাত দিয়ে জামায়াত-বিএনপির মূখপত্র দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক আমার দেশ তা নিয়মিত প্রকাশ করেÑ যদিও সেই সব কথোপকথনে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছুই ছিল না। শুধু ছিল নিজামুল হক ড. জিয়াউদ্দিনকে বলছেন সরকার থেকে তাকে বলা হচ্ছে মামলার রায় যেন তাড়াড়াড়ি দেয়া হয়। এই দাবি তো শুধু সরকারের নয় এই দাবি তো দেশবাসীর। ইকোনমিস্ট স্বীকার করেছে রায় সম্পর্কে সরকার বিচারপতি নাসিমের ওপর কোন চাপ সৃষ্টি করেনি। বিচারপতি নাসিম বেশ শক্ত পেশাদার দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন।

এই সব নিয়ে জামায়াত এবং তাদের পোষ্য বুদ্ধিজীবীরা চারদিকে হৈ চৈ ফেলে দিল। যেহেতু এই ধরনের বিচার বাংলাদেশে এই প্রথম; তাই রায়কে সব বিতর্কের উর্ধে রেখে তাকে আন্তর্জাতিকমানের করার জন্য ট্রাইবুনালের প্রধান যে কোন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করতেই পারেন। আর ট্রাইব্যুনালে তিন জন বিচারপতি থাকেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের সিদ্ধান্তে বিচার হয়। তারপরও ট্রাইব্যুনালকে সকল বিতর্কের উর্ধে রাখার জন্য বিচারপতি নিজামুল হক তার পদ থেকে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন।

এটি তার সৎ সাহসের পরিচয়। এর জন্য তাকে অভিনন্দন জানাতে হয়। ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ছয় ধারায় আছে ট্রাইব্যুনালের কোন বিচারপতি যদি কোন কারণে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পরিচালনা করতে অপারগ হন তা হলে তার স্থলে অন্য বিচারপতি নিয়োগ করা হবে এবং বিচারকাজ যেখানে ছিল সেখান হতেই চলবে। অথচ বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ জামায়াতের আইনজীবীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছেন বিচারকার্য আবার প্রথম হতে শুরু করতে হবে। অনেকটা মামা বাড়ির আবদারের মতো।

এগুলো শ্রেফ মতলববাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকার ইতোমধ্যে নিজামুল হকের স্থলে নতুন শুরু বিচারপতিই নিয়োগ দেননি দুটি ট্রাইব্যুনালকেই পুনর্বিন্যাস করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সকল মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যে সকল সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি জড়িত ছিল তাদের বিচার হয়েছিল ন্যুরেমবার্গ শহরে সামরিক আদালতে। এই আদালতে প্রাথমিক পর্যায়ে ২৩ জন অভিযুক্তকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। আদালত বিচারকার্য শেষ করতে সময় নিয়েছিল দশ মাস।

এই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের কোন সুযোগ ছিল না। তবে তাদের পক্ষে কিছু জার্মান আইনজীবী অংশ নিয়েছিলেন তাদেরও পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার হয়েছিল। আদালত সকলকে হয় মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেছিল। তবে সব অপরাধের মূল হোতা এডলফ আইখম্যান সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে ১৯৪৫ সালে সুদূর আর্জেন্টিনায় পালিয়ে গিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ষাট লাখ মানুষ হত্যার অভিযোগ ছিল।

১৯৬০ সালে তাকে ইসরাইলের গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ আর্জেন্টিনা হতে ধরে এনে জেরুজালেমের এক বেসামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করে। সংক্ষিপ্ত বিচারে আইখম্যানকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, যা ১৯৬২ সালের ৩১ মে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়। আইখম্যান ছিল নাৎসী পার্টির গোলাম আযম। সপ্তাহিক ইকোনমিস্ট স্কাইপের আড়িপাতা অথবা ই-মেইল হ্যাক করার সঙ্গে নিজেকে জড়িত করে শুধু ব্রিটিশ প্রেস কোডই (আইন) ভঙ্গ করেনি, একটি চরম নীতি বহির্ভূত কাজ করেছে। কিছুদিন আগে একই অপরাধে ব্রিটেনের সর্বাধিক প্রচারিত টেবলয়েড পত্রিকা নিউজ অব দ্য ওয়ার্লড প্রকাশের ১৬৮ বছর পর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে এবং এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা সকলেই জেলে গেছেন।

তার রাজপরিবারসহ ব্রিটেনের অনেক রাজনীতিবিদদের টেলিফোনে প্রায় ছয় বছর ধরে আড়ি পেতেছিল। সুতরাং এই ডিসেম্বর মাসে একাত্তরের ঘাতক আর তাদের দোসররা যতই লম্ফঝম্ফ করুক তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। ইকোনমিস্টও স্বীকার করেছে, জামায়াতের সমর্থন ছাড়া সামনের নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং যে কোন মূল্যে তাদের জামায়াতকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। সরকার যদি তার লক্ষ্যে অবিচল থাকে এবং ২০০৮ এর মতো জনগণের সমর্থনকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারে এই ডিসেম্বরই হবে জামায়াতের উল্লাস নৃত্যের শেষ বছর।

সকলকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। ব্লগসূত্র: প্রফেসর আব্দুল মান্নানে'র লেখা থেকে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।