আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: ইনফিউজ :: এ ট্রিবিউট টু হুমায়ূন আহমেদ

inside you're ugly ugly like me ১ গত তিনদিন ধরে টানা ঘুম উত্সব চলছে। ঠিক উত্সব বলা চলে না। ব্যাপারটাকে ঘুম বিলাস বলাই ভাল। কারন আমি একাই ঘুমিয়ে যাচ্ছি। ঘুমের ফাকে ফাকে পাচ দশমিনিটের জন্য উঠে পানি আর সিগারেট তারপর আবার ঘুম।

ও হ্যা ঘুম উত্সব শুরুর আগে এক প্যাকেট সিগারেট বালিশের ডান পাশে রাখার নিয়ম। কোন ধরনের নেশা জাতীয় বস্তু ছাড়াও যে এভাবে ঘুমানো যায় ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারি কলেজে পড়ার সময়। শুরুতে একটু কষ্ট হলেও চব্বিশ ঘন্টা পার হলেই বিষয়টা অনেক সহজ সয়ে যায়। এক ধরনের ঘোরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যায়। চারদিক কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়।

এইতো আমি এখন স্পষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পাচ্ছি। আমার চেয়ারে কে যেন বসে আছে, কম্পিউটারের পর্দায় চোখ। আমি বুঝতে পারছি না কে বসে আছে। রুম শেয়ার করে থাকার ঝামেলা আছে। সম্ভবত রুমমেটের গেষ্ট।

আমার ঘুম ভাঙ্গার পর কিছুক্ষন তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে। নাহ চিনতে পারছি না। এই সময়ই সে আমার দিকে তাকিয়ে সুর করে জিজ্ঞাস করল "ভাই কি খবর?" এখন তাকে চিনতে পারলাম আমার রুমমেট। বাড়িতে গিয়েছিল। কখন আসল কে জানে।

আমি তার কথার কোন জবাব না দিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। উত্সবের এক একটা সেকেন্ড ও মূল্যবান। কিছুক্ষন চেষ্টা করে দেখলাম ঘুম আর আসছে না। আধশোয়া হয়ে একটা সিগারেট জালাতে গিয়ে দেখলাম ম্যাচ নাই। যথাসম্ভব কঠিন গলায় তাকে জিজ্ঞাস করলাম, "ম্যাচ কি তুই নিসছ? ম্যাচ দে।

" সে আমার দিকে একটা লাইটার ছুড়ে মারল। এমনিই ঘুম আসছে না, টেনশানে আছি এর মধ্যে নতুন টেনশান, ম্যাচটা গেল কই। এর মধ্যেই রুমমেট গ্রামের কিছসা কাহিনী শুরু করে দিল। আমি মুগ্ধ মুগ্ধ একটা চেহারা করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে যে কেউ যেকোন কথা শেয়ার করেই তৃপ্তি পায়।

কারন আমি এমনভাবে তাকিয়ে থাকি যেন আমি এই কথাগুলা শুনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আসলে দেখা যায় অর্ধকেরও বেশী কথার একটা লাইনও আমি শুনি না। আমার রুমমেট দুইজন। দুইজনের বাড়ি ই বাগেরহাটে, সমূদ্রপকূলবর্তী এলাকা। আয়োডিনের অভাব থাকার কথা না।

কিন্তু এদের দেখলেই মনে হয় আজীবন আয়োডিনের অভাবে ভূগছে। একজনের নাম শিপলু। হাইট এভারেজ বাংগালীর চেয়ে অনেক বেশি। বাচ্চা বাচ্চা চেহারা। দুই ধরনের ছেলেদের সাথে মেয়েরা মিশতে চায় না এক. যাদের চেহারায় গুন্ডা গুন্ডা ভাব থাকে।

দুই. যাদের চেহারা নিতান্তই আলাভোলা টাইপ। আমার রুমমেট দ্বিতীয় দলে । দল যাই হোক সে অতি অল্পদিন আগেই এক ক্লাসমেটের প্রেমে পড়েছে। এবং একর্ডিং টু নিউটনস থার্ড ল মেয়েটাও তার প্রেমে পড়েছে। দে আর ইন রিলেশনশিপ।

স্বাভাবিকভাবে এই যুগে যা হয়, রিলেশনশীপে গেলেই ফেইসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেইন্জ হয় কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেল পুরা উল্টা। রিলেশানে যাবার পর দুইজনই সকল ধরনের অনলাইন এক্টিভিটিজ থেকে বিদায় নিল। মেয়েটার নাম রাইছা, অসম্ভব রুপবতী। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল কিন্তু একদিন দেখলাম ঐ আইডিটা ডিএক্টিভ করা। মানব মনের রহস্য বড়ই জটিল।

আমি এতক্ষন এইসব চিন্তা করতে করতে হাতের সিগারেট শেষ হল। শিপলুকে জিজ্ঞেস করলাম, এত তাড়াতাড়ি চলে আসলি যে ভার্সিটি কবে খোলা। -কালকে থেকে। অবশেষে আমার সুখের দিন ফুরাল। এরপর জিজ্ঞেস করলাম জনি কবে আসবে? জনি আমাদের রুমের ৩য় সদস্য।

কালকে আসতে পারে। ২ চারদিন পরে গোসল করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। কেমন অদ্ভূত রকমের একটা ভাললাগা চেপে বসল। এরমধ্যে আবার শিপলু রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দিল। ও হ্যা শিপলুর গানের গলা ভাল।

পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে গানটা তার গলায় এত সুন্দর মানায় যে বলে বুঝানো যাবে না। কিন্তু একটা সমস্যা, গান গাওয়ার সময় মাঝখানে ভুলে যায়। একবার থার্টি ফার্স্টের রাতে ভার্সিটিতে ছিলাম। ভার্সিটি একটি আদর্শ গ্রামের ভিতরেই বলা যায়। শীতের রাত।

আমরা ৫ জন হাটতে হাটতে বাঁধের উপরে চলে গেলাম। কিছুক্ষন বসে থাকার পরেই শিপলু গান শুরু করল। হঠাত্‍ করেই গানের মাঝখানে এসে বলল, পরের লাইনটা যেন কি? সন্ধ্যা পর্যন্ত শুয়ে বসে কাটানোর পরে ভাবলাম স্টুডেন্টের বাসায় একটু ঢু মারা দরকার। যা দজ্জাল মহিলা আঠারো দিন গুনে টাকা দেয়। টাকা দেয়ার সময় আমার সামনে প্রতিমাসেই একটা বিরাট হিসাবের ফর্দ নিয়ে বসে ৩ তারিখ ১ঘন্টা২মিনিট ৪ তারিখ ৫৯মিনিট ৭ তারিখ ১ঘন্টা৫মিনিট খুবই বিরক্তিকর মহিলা।

ইচ্ছা করে একদিন বলি আন্টি সেকেন্ডের হিসাবটাও পরের মাস থেকে লিখে রাখবেন। কিন্তু চাইলেইতো আর বলা যায় না। আমি বিনম্র বদনে তাকিয়ে থাকি। টাকা দেয়ার পরে আবার কিছু ফ্রি এডভাইসও দিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পরপরই স্টুডেন্টের বাসার গিয়ে হাজির হলাম।

আন্টি আমাকে দেখেই জিজ্ঞাস করল বাবা তুমি গত চারদিন কোথায় ছিলা? -হাসপাতালে। -বল কি? অসুস্থ ছিলা? এমন একটা ভাব যেন আমি হসপিটালে বেড়াইতে গেছিলাম। -অল্প অসুস্থ। এখন আপনাদের দোয়ায় ভালই আছি। স্টুডেন্ট পাইছি একখান মাশাল্লাহ।

তার মস্তিষ্কের মোটামুটি দেড়শ পার্সেন্টই এখনো অব্যবহৃত। কিছুক্ষন ঝাড়িঝুড়ি মাইরা নাস্তা শেষে এককাপ চা খেয়ে বিদায় নিলাম ঐখান থেকে। আসার আগে আন্টি গতমাসের টাকাটা হাতে গুজে দিলো। এইমাসে কেন জানি আর কোন হিসাব নিয়ে বসল না। ভাবতেছি এখন থেকে প্রতি মাসেই হসপিটালের নাটক করতে হবে।

বের হয়ে দেখি কারেন্ট নাই। হুমায়ূন আহমেদ সাহেব হলে এখানে অবধারিতভাবে চাঁদের আলো নিয়ে আসতেন। বাস্তবে এমন হয় না বরং খানাখন্দে ভরা রাস্তাটা দিয়ে খুব সতর্কভাবে হাটতে হচ্ছিল। কিছুই দেখা যায় না। পুরা এলাকা অন্ধকার।

শহরের এই জায়গাটা এখনো তেমন উন্নত না। বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি। তবে পানি কোন সমস্যা না, পানিতে জোঁক হাটাহাটি করে। কি জঘন্য একটা প্রাণী। বিচ্ছিরীভাবে দৌড়াদৌড়ি করে পানিতে।

তখন এইসব পানিতে পা ফেলতেও গা ঘিনঘিন করে। এখন অবশ্য পানির সমস্যা নাই। কিন্তু শীত আসি আসি করছে। এখন আরেক নতুন উত্‍পাত, রাস্তায় সাপ দেখা যায়। এক ছোটভাই টিউশনিতে যাওয়ার জন্য বের হইছে রাস্তায় সাপ দেখে আবার মেসে চলে গেছে।

এই সাপের গল্প ঐদিন যাকে সামনে পাইছে তাকেই বলছে। যতবার বলছে ততবারই সাপের আকার একটু একটু করে বাড়ছে। আজীব অবস্থা। ঐদিন রাতে আমি ঘুমানোর পর স্বপ্নে দেখলাম হাউজিংয়ের রাস্তায় সাপ খেলাধূলা করতেছে। ভয়ানক অবস্থা।

আজকে পকেট ভর্তি টাকা। কিন্তু এমন একটা অবস্থায় আছি যে চাইলেও এখন টাকাটা দিয়ে যা খুশি তা করা যায় না। মেসের ভাড়া দেয়া হয় নাই। গতমাসে ভাড়া দিতে দিতে ২৪তারিখ পার হয়ে গিয়েছিল। মেস ম্যানেজারের মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল হারামজাদারে জুতা দিয়া পিটাই।

এখন আমি মোটামুটি সেইফ জোনে। গলিটার শেষ মাথায় কয়েকটা দোকান। একটা বাজারের মত পরিবেশ চলে এসেছে এখন। দুই তিন বছর আগেও এমন ছিলনা। শহরতলীতে যে রকম টাইপ হোটেল থাকে এইরকম দুইটা হোটেল।

হিন্দু বাবুর্চি বলে একটা হোটেল প্রায় চলে না বললেই হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু লোক এসে হিন্দু হোটেল খুজে। একদিন এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাত ৯টার মত বাজে। তখন হিন্দু হোটেল বন্ধ।

একজন লোক আমাকে জিজ্ঞেস করল ভাই এদিকে কোথাও হিন্দু হোটেল আছে? -হোটেলের আবার হিন্দু খ্রিস্টান কি? লোকটা প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছে এমন ভঙ্গি করে বলল, আমার মা হসপিটালে। উনি নিরামিষ খায় তো তাই। আমি আর কিছু না বলে হাঁটা দিলাম। কত বিচিত্র লোক এই যুগেও আছে। আমার এক বন্ধু, তার সবই ঠিক আছে কিন্তু পূজা মন্ডপে যাবে না।

নামাজ রোজা নিয়া কোন টেনশন নাই কিন্তু পূজা দেখতে যাওয়া বিরাট পাপ। অদ্ভূত। গলিটার শেষে ডানদিকে একটা সেলুন। একেবারে কানা একটা গলির শেষ মাথায়। ঐদিকে হাঁটা দিলাম।

দেখি নাপিত অলরেডী দোকানের ঝাপ নামিয়ে দিয়েছে। নাপিত আমার পরিচিত। কিন্তু নাম জানি না। আমাকে দেখেই বলল, খোকন ভাই আজকে মনে মনে কৈতাছিলাম আপনে আইবেন। -মনে মনে কৈয়াও দোকান বন্ধ কৈরা দিলা? -একটু মেলায় যামু ভাবছিলাম।

থাক আইজ আর যামু না। -গেলে যাও। আমার আর্জেন্ট কিছু নাই। তাও দোকান খুলে দিল সে। আমিও গিয়ে বসে পড়লাম।

মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। কতদিন আয়না দেখি না মনে নাই। মেসে অবশ্য আয়না আছে। কিন্তু কি এক অদ্ভূত কারনে এটাতে কোন রিফ্লেকশন হয় না। শিপলু অবশ্য একটা কায়দা বের করছে।

তবে তার জন্য ৫ফুট ১০ হাইট থাকা বান্ছনীয়। তাই আমার আর চেহারা দেখা হয় না। সেলুনই ভরসা। নাপিত সাহেব এর মধ্যে গান ছেড়ে দিল। পুরান আমলের হিন্দী গান।

এই গান এখন হিন্দুস্তানের লোকেরাও শুনে কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। -বুঝলেন ভাইজান গান ছাড়া কামে হাত দিতে পারি না। কেমন জানি হাত কাপে? -সর্বনাশ। তুমি তাইলে গানের ভলিউম বাড়াইয়া দাও। কখন কি হয় আল্লা মালুম।

মুখে অপারেশন শুরু হল। ক্রীম ভর্তি মুখ নাড়াতেই কেমন যেন লাগে কথা বলা তো দূরের কথা। কিন্তু নাপিত সমানে বকবক করেই যাচ্ছে। আমি কেবল হু হা করছি। দাড়ি কাটার পর চেহারা কেমন জানি হয়ে যায়।

নিজের কাছেই কেমন অচেনা লাগে। সাধারনত কৈশোরে প্রথম শেইভ করার পরে এমন অনুভুতি হয়। পরে আস্তে আস্তে একসময় ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আমার বোধহয় ঠিক হতে একটু সময় লাগবে। একমাস পূর্ণ না হলে কখনোই আমি সেলুনমুখী হই না।

ঝামেলাও বাচল, টাকাও বাচল। সোজা হিসাব। একশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। -কত রাখমু ভাইজান? -রাখো ইচ্ছামত। টাকা ফেরত দেয়ার পর গুনেও দেখলাম না।

এমনিই পকেটে রেখে দিলাম। ওখান থেকে বের হয়ে দেখলাম আর তেমন কোন কাজ নাই। অথচ বাজে মাত্র সাড়ে আটটা। টং দোকানে বসার আদর্শ সময়। চা আর বিড়ি এই সময় স্বর্গীয় মনে হয়।

সমস্যা একটাই এখানে কোন হুরপরী থাকেনা। তার বদলে থাকে ডাইনী টাইপ মশা। দুনিয়ার স্বর্গে একটু আধটু সমস্যা থাকবেই। এ নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত না। ৩ সকাল আটটায় ক্লাস।

ঘুম থেকে উঠার পর ঘড়ি দেখলাম। ১১টা ৪০। এই সময় অধৈর্য হলে চলে না। বরং ঠান্ডা মাথার চিন্তা করতে হয়। ক্লাস যেহেতু মিস, ঘুম মিস করাটা অন্যায় হবে।

বিরাট অন্যায়। মাঝে মাঝে অন্যায় করা ভাল। যদি বিকালে ক্লাস থাকে তাহলে করা যাবে এই ভেবে ভার্সিটির দিকে রওয়ানা দিলাম। দুপুর দুইটা। ডিপার্টমেন্টে কেউ নাই।

স্যারদের রুমে উকিঝুকি মারলাম। আমার প্রিয় একজন শিক্ষক দেখলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন পড়ছে। ভার্সিটিতে দুই ধরনের টিচার থাকে ১.দুর্নিতীবাজঃ ইহারা ক্লাসের চেয়ে বিভিন্ন কমিটির প্রতি বেশী মনোযোগী। যেমন শিক্ষক কমিটি, প্রক্টর প্যানেল ইত্যাদি। ২. যারা দুর্নিতীবাজ না।

এই শ্রেনীর টিচাররা শুধু ক্লাস করায়। ক্লাস না থাকলে বসে বসে বই পড়ে। আর নিতান্তই বোরিং হয়ে গেলে ল্যাপটপ ওপেন করে টম এন্ড জেরী টাইপ কার্টুন দেখে। এই স্যার দ্বিতীয় ক্যাটাগরীর। স্যারের চেহারাটা কেমন যেন বাচ্চাদের মত।

কপালের উপর দিকের অল্প কিছু চুল সাদা। তাও কেমন যেন বাচ্চাদের মত দেখায়। বুড়া বাচ্চা। এই স্যারের সাথে একবার ভয়াবহ রকমের বেয়াদবি করেছিলাম। তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।

স্যার আমাদের স্টুডেন্ট কাউন্সেলর। একদিন স্যারের রুমের ভিতরে গিয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। স্যার নাম ধাম ব্যাচ জিজ্ঞেস করল। এরপর জানতে চাইল কেন এসেছ? আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। আরেকদিন বলব বলে বের হয়ে আসলাম।

তার পরের দিন একগাদা টপিক্স ঠিক করে নিয়ে গেলাম। আমি কোন কথা গুছিয়ে বলতে পারিনা। আমি প্রচুর মিথ্যা বলি। আমি রিসেন্ট ছ্যাকা খাইছি এই টাইপ কথাবার্তা। স্যার বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনার পর বললেন পরেরদিন দেখা করতে।

তার পরেরদিন গেলাম। যাওয়ার পরে স্যার বললেন গতকালকে তুমি বেশীরভাগ কথাই মিথ্যা বলেছ। -জ্বি স্যার। -আর কখনো এমন করবে না। -আচ্ছা।

-যাও। ভাবলাম স্যারের সাথে কিছুক্ষন খোশগল্প করে আসি। আসল উদ্দেশ্য চা। স্যারের রুমে ঢুকা মানেই এককাপ চা বরাদ্দ। এই স্যার ক্লাসে অনেক সুন্দর সুন্দর জোকস বলে কিন্তু কেউ হাসে না।

একদিন একটা জোকস বলল এইরকম, "অফিসের এক পিয়ন তার স্যারকে প্রায়ই তেল মারে। তো একদিন তেল মারতে গিয়ে বসকে বলে বসল, স্যার আপনে আমার মা বাপ আর আমি হৈলাম কুত্তার বাচ্চা" জোকস শেষ। কিন্তু কেউ হাসল না। স্যার ঐদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করলেন না, নিজেই হাসতে থাকলেন। ততক্ষনে সবাই বুঝতে পারছে যে ঐটা একটা জোকস ছিল আর হালকা করে হাসি দিল হা হা হা।

আজকে আর স্যারের চা খেতে ইচ্ছে করছে না। ক্লাস হবে কি না খোজ নেয়া দরকার। ৪ শফিক সাহেবের আজ খুব দুখের দিন। তেরো বছর আগের এই দিনে তার স্ত্রী মারা যান। কিন্তু শফিক সাহেবের স্মৃতিতে বোধহয় এতদিনে ধূলার স্তর অনেক পুরো হয়েছে।

তাকে যতটা দুঃখিত হওয়া উচিত তিনি ততটা দুঃখিত নন। বরং অন্যান্য দিনের চেয়ে তাকে আজ একটু বেশীই ফুরফুরে মনে হচ্ছে। তার সামনে একটা খবরের কাগজ। এ বাড়িতে সাধারনত খবরের কাগজ রাখা হয় না। কিন্তু বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে আনানো হয়।

যেমন পহেলা বৈশাখ, এক জানুয়ারি ইত্যাদি। কাগজ পড়ার মত কেউ নাই বলেই রাখা হয় না। আরো একটা উপলক্ষে খবরের কাগজ আনা হয়। তা হল প্রাইজবন্ডের ড্র। শফিক সাহেবের কাছে ২১৬টা প্রাইজবন্ড আছে।

প্রত্যেকবার ড্রয়ের পর এগুলো তিনি মিলিয়ে দেখেন। এই সময়টাতে তার চোখ চিকচিক করতে থাকে। দেখা পর্ব শেষ হয়ে গেলে তিনি গোমড়া গোমড়া মুখ করে বসে থাকেন। কোন নাম্বার মিললো নাকি জিজ্ঞেস করলে আলতোভাবে মাথা নাড়েন। যেন প্রাইজবন্ডের নাম্বার না মিলাতে তার বিরাট পাপ হয়ে গেছে।

এই সময় নিতু বলে, মন খারাপ করো না বাবা। দেখো পরেরবার ঠিকই মিলবে। নীতু শফিক সাহেবের বড় মেয়ে। তার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নীতুর শরীরে ভয়ংকর একটা অসুখ বাসা বেঁধেছে।

ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও অসুখটা ধরতে পারছে না। তবে শফিক সাহেবের ধারনা অসুখটার নাম নীতু ঠিকই জানে। তার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে। খোকাও জানার কথা। কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারণে খোকা তার বাবার সাথে কথা বলে না।

তের বছর আগে এই দিন থেকে আজ পর্যন্ত খোকা একটিবারের জন্যও শফিক সাহেবের সাথে কথা বলেন নি। কারণটা যে কি শফিক সাহেব একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছেন। শফিক সাহেব খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন। কিন্তু এত মনোযোগ দিয়ে দেখার মত কি আছে কে জানে? আজকে কি প্রাইজবন্ডের রেজাল্ট আসছে? নীতু চা নিয়ে এলো। -অত মনোযোগ দিয়ে কি পড় বাবা? -নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।

-ও আচ্ছা। শফিক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে রাখলেন। যেন এমন জঘন্য চা কখনো খান নি। নীতুর অবশ্য তাতে কোন ভাবান্তর হল না। কারণ এইটা শফিক সাহেবের ডেইলি রুটিনের একটা অংশ।

প্রতিদিনই এমন দেখে নীতু একদিন ইচ্ছা করেই খুব বাজে চা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। চিনির বদলে চায়ে ছিল হালকা লবণ। আশ্চর্যের ব্যাপার ঐদিনই শফিক সাহেব খুব তৃপ্তি করে চা খেলেন। এরপর থেকে এই নিয়মে চা বানানোর নির্দেশও জারি করা হয়েছিল। কোন এক অজ্ঞাত কারনে ঐ নির্দেশ আর বাস্তবায়িত হয় নি।

সব বাবারাই মেয়ের বানানো চা খুব তৃপ্তি করে খায়। শফিক সাহেবই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র বাবা যার কাছে মেয়ের হাতের চা খুব জঘন্য মনে হয়। -বাবা বাসায় বাজার নাই। তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে। চা শেষ করে বাজারের দিকে রওয়ানা দিলেন শফিক সাহেব।

মুখ থেকে বিকৃতভাবটা তখনো যায় নি। পথে দেখা হল এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে। এই টাইপ লোকেদের মধ্যে কোন ভ্যারিয়েশন থাকে না। সবগুলো একই রকমের খারাপ হয়। কেউ বেশী খারাপ আবার কেউ তার চেয়ে আরেকটু বেশী খারাপ।

পার্থক্য এতটুকুই। কিছুদিন আগে এই চেয়ারম্যান নীতুর জন্য একটা বিয়েয় সম্বন্ধ নিয়ে আসে। বর চেয়ারম্যানের ভাগিনা। নীতু অসুস্থ জেনেও তারা নীতুকে ঘরের বউ করে নিতে চায়। তাদের চাহিদা সামান্য।

চার লাখ টাকা আর একটা মোটর সাইকেল। এরপর থেকে চেয়ারম্যানকে এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করে একরকম। কিন্তু আজকে একেবারে সামনে পড়ে গেল। চোখাচোখি হল কিন্তু কোন এক কারণে কেমন আছেন, ভাল আছি ছাড়া আর কোন কথা হলো না। বাজার থেকে ফেরার পরই নীতুকে ভালোমতন রান্নাবান্না করতে বলা হলো।

শফিক সাহেবের ধারণা, আজ মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী হিসাবে খোকার একবার আসা উচিত। ৫ অনেকদিন পর আজকে চন্দ্রোদয় দেখলাম। দেখলাম বললে ভুল হবে, ব্যাপারটা খেয়াল করলাম। বরাবর পূর্ব দিকে গাঢ় লাল চাঁদ। এই টাইপের চাঁদের কি কোন সাহিত্যিক নাম আছে? থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে।

এই সময় চাঁদটাকে দেখলেই কেমন জানি কষ্ট লাগে। মনে হয় অনেক যন্ত্রনায় লাল হয়ে গিয়েছে। সূর্য় ডোবার সময় যেরকম লাল হয় ঠিক একই রকম লাল। আচ্ছা সূর্য ডোবার সময় লাল দেখায় কেন? আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটা ব্যাপার আছে এইখানে। লাল রংয়ের চাঁদের ব্যাপারেও বোধহয় একই কথা।

ধুর চাঁদের চিন্তা বাদ। এই জিনিসের বিষয় সামনে আসলে অবধারিতভাবে রোমান্টিসিজম চলে আসে। ছ্যাক খাওয়া বেকার যুবকদের রোমান্টিক হওয়া নিষেধ। এই অধিকার তাদের দেয়া হয় নাই। সবগুলো অশুভ ঘটনা কেন জানি একই দিনে ঘটে।

একই বছরে না হলে প্রতি বছর একই দিনে ঘটবে নিশ্চিত। যেমন প্রতি বছর জানুয়ারির এক তারিখেই আমাদের স্কুলে ক্লাস শুরু হত। শৈশবে এটা আমার জন্য এক বিরাট অশুভ ঘটনা। সব স্কুল খোলা সাত আট তারিখ কিন্তু আমারটা এক তারিখেই খোলা। এইসব অশুভ ঘটনা ঘটা নিয়ে অবশ্য মারফি সাহেবের কিছু সূত্র আছে।

তবে সূত্র যখন জানতাম না তখনো দেখতাম অশুভ ঘটনাগুলো এক সুতোতেই থাকত। সূত্র না থাকলেও হয়তোবা এরকমই হত। আমাদের স্কুলে এক বন্ধু ছিল "পাগলা হাসান"। বুয়েটে ভর্তি হবার পর এসে একটা সূত্র দিল, মেধা রুপের ব্যস্তানুপাতিক। আর সূত্র কাজ না করলে একটা কমন ডায়লগতো আছেই এক্সেপশান ইজ নট এগজাম্পল।

তবে আশ্চর্যজনকভাবে এই সূত্র প্রায় সবক্ষেত্রেই ফলে যেত। বড়ই অদ্ভূত অবস্থা। তবে এই মুহূর্তে আমি হাসান বিষয়ে চিন্তিত না। আরো কিছু অশুভ বিষয় আছে। এমনি ভয়ংকর চাঁদ উঠা সন্ধ্যায় মীম বলেছিল, বিদায়।

তারচেয়েও বড় ব্যাপার আজ মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। অন্তত আজকের দিনটায় বাড়ীতে যাওয়া উচিত। নীতু বারবার করে বলে দিয়েছে যেন সকালেই চলে যাই। স্টেশনের দিকে হাটতে শুরু করলাম। ধূর আবার বুড়ার দোকানের সামনে দিয়ে যেতে হবে।

দেখলেই বাকী টাকা খুজবে। আরো একটা অশুভ ঘটনা। খুজুক, বাকীতে আরো কয়েকটা সিগারেট নিয়ে হাঁটা দেব। আজকে বাকী পরিশোধ করার কোন মানে নাই। আর আমিতো পালিয়ে যাচ্ছিনা এসে দিয়ে দেব।

সিগারেট ধরিয়ে হাটতে থাকলাম। শেষ ট্রেনটা হয়তো পাওয়া যাবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.