আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খুব খুশি

সুখীমানুষ বিফল কবিরা নাকি সফল গল্পকার হন। ঘটনাতো সত্যিই মনে হচ্ছে। কবিতা লেখছি বহু বছর ধরে। কবিতায় কিছু পাইনি বলতে পাঠকও পাইনি। কিন্তু গল্পকবিতা ডট কম এ একটা ছোটগল্প লেখে দেখি দ্বিতীয় হয়ে গেছি! সাথে পাওয়া ১০০০ টাকাই হবে সাহিত্যকর্ম থেকে পাওয়া আমার প্রথম ইনকাম।

অবশ্য পত্রিকায় লেখালেখি করে টুকটাক পাচ্ছি কয়েক বছর ধরেই। গল্পটা ছিলো... Click This Link নৃ কারিগর ******* তুমি কিছু বলবে? গতদিনও আনোয়ার খেয়াল করেছে লোকটাকে। আজ আবার সে কলেজের গেইটে এসে দাড়িয়েছে। গতদিনও আনোয়ারের মনে হয়েছে লোকটা তাকে কিছু বলতে চায়। আজও মনে হলো।

লোকটার বয়স প্রায় চল্লিশের মত হতে পারে। লুঙ্গি পড়া, ভাদ্র মাসের ভাপসা গরমেও একটা চাদর গায়ে জড়ানো। আন্দাজ করা যাচ্ছে চাদরের নীচে হাতাওয়ালা গ্যাঞ্জি পড়া। আনোয়ারের বয়স পয়েত্রিশ। এরপরেও বয়সে সামান্য বড় হবে আন্দাজ করার পরেও মুখ দিয়ে কেন তুমি শব্দটা আসলো তা ভেবে আনোয়ার একটু বিব্রত।

একবার ভাবলো আপনি করে বলবে। কিন্তু লোকটার ভাবভঙ্গি এতটাই সরল যে এই তুমি কে তাচ্ছিল্যের তুমি মনে হলো না আনোয়ারের কাছে। সন্ধা হযে আসছে। আনোয়োরের সামনে লোকটা কিছুটা মাথা নীচু করে দাড়িয়ে আছে। আনোয়ার আবার জিজ্ঞাসা করলো, কিছু বলবে? - স্যার আপনের বাসায় আমারে কামলা রাখবেন? - আমার বাসয়তো কামলা রাখার মত কোন কাজ নাই! তোমার নাম কী? - ওজির - ওজির, এখন কামলা রাখার যুগও নাই।

অনেক বছর আগে খেতে খামারে যখন কাজ ছিলো তখন কামলার দরকার ছিলো। গত বহু বছরে আমি কোথাও কামলা নিতে দেখিনি। আর আমি শিক্ষক মানুষ, ছোট সংসার আমার কামলা লাগবে না। ওজির মাথা কিছুটা নত করে আগের মত দাড়িয়ে থেকেই একটু সড়ে দাড়ালো। এর মানে হলো, ঠিক আছে আমার আরজি নাকচ হয়েছে আমি তা বুঝতে পেরেছি।

আর আটকে রাখবো না। আনোয়ার পাশ কেটে বের হযে এলো। কলেজ গেইটে রিক্সা দাড়ানো থাকে। গ্রামের কলেজ। রিক্সাওয়ালাও এখানে সীমিত আর রিক্সায় চড়া মুখগুলোও সীমিত।

সামনে যে রিক্সা এলো তাতেই চড়ে বসলো। কিছু বলার প্রয়োজন নেই। রিক্সাওয়ালারা প্রফেসর সাবকে চিনেন। আনোয়ার এই কলেজে লেকচারার হয়ে যোগ দিয়েছিলো। পাঁচ বছর পরও তাই আছে।

গ্রামের মানুষ কলেজের শিক্ষক মানেই প্রফেসর মনে করে। তাই এদের ভুল ভাঙ্গাতে যাওয়া বৃথা। দুই কিলোমিটার পথ। হেটেই যাওয়া যায়। তবু রিক্সায় চড়তে হয়।

বিনুর কড়া হুশিয়ারী, ছোটলোকের মত হেটে ফিরবে না। রিক্সায় বসেই লোকটার কথা বারবার মনে পড়ছে। ঘটনা কী? এখন যে যুগ পড়েছে এতে সবাই স্বনির্ভর। আর কামলা রাখা মানে তো সেই বাৎসরিক হিসাব। উন্নত দেশে সাপ্তাহ শেষে বেতন নেয়।

আর বাংলাদেশ আরো উন্নত হয়ে যাচ্ছে। কাজ করালে প্রতি দিনের টাকা প্রতি দিন দিয়ে দিতে হয়। এই যখন অবস্থা তখন কি না এই লোক আসলো কামলা থাকতে। লোকটা যে সহজ সরল তা চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। আচ্ছা লোকটার চোখ কি আনোয়ার দেখেছে! মাথা নীচু করে ছিলো।

আচ্ছা নাম বলার সময় কি একটু করে মাথাটা উঁচু করেছিলো? চোখ না দেখে তার মাথায় কেন ঢুকবে যে সে চোখ দেখেছে? এবং এ ও কেন মনে হবে যে চোখ দেখেই বুঝা যায় লোকটা সহজ সরল? কোথাও কি লোকটার প্রতি সে সিম্পেথি ফিল করছে? আনোয়ারদের বাড়ীতে অনেক আগে একজন কামলা ছিলো। সহিদ নাম। সহিদ ছিলো বছর মুনি। এক বছর থাকবে। ঘুম ছাড়া বাকী সময়টুকু একটা পরিবারের যত কাজ থাকে সব করবে।

বছর গেলে এক মুঠে বেতন পাবে। বছর ত্রিশেক আগে সহিদের বেতন ছিলো পাঁচ হাজার টাকা মাত্র। আনোয়ারকে সহিদ এতটাই আদর করত যার কোন সীমা ছিলো না। লম্বা আলু দুই ধরণের হয়। লাল আলু আর সাদা আলু।

সাদা আলুটা আনোয়ারদের এলাকায় ফলতো না। কিন্তু এই সাদা আলু কয়লার আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া ছিলো রীতিমত বেহেস্তি খাওয়া। সহিদ কোত্থেকে যেন এই আলু কয়দিন পর পর যোগড় করে সুন্দর করে পুড়িয়ে আনোয়ারকে খাওয়াতো। কাধের উপর উল্টা করে আনোয়ারকে শুইয়ে সারা বাড়ী ঘুরে বেড়াতো। পুরনো সেই স্মৃতিতে কি সে কাতর হলো? আচ্ছা ওজির কি শুধু তাকেই কামলা নিতে বলেছে নাকি কলেজ গেইটে যাদের সাথে দেখা হয়েছে সবাইকে বলেছে? বাসায় ঢুকে মনে হলো বিশাল একটা ভুল হয়েছে।

বিনু তো বোনের বাড়ী বেড়াতে গেছে। ওজিরকে সাথে করে নিয়ে আসলেই হতো। অন্তত যে কয়টা দিন বিনু না আসে এ কয়টা দিন টুকটাক কাজে দিতো। লোকটারও কিছু উপকার হতো। খাওয়ার মত কিছু নাই, রান্না করতেও ইচ্ছা হলো না।

একটু কাত হয়ে শুয়েই আনোয়ার ঘুমিয়ে গেলো। ঘুমের মধ্যেই দেখতে লাগলো, সে নীচের দিকে পড়ছে তো পড়ছেই। পড়ার গতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন এত স্পিডে যাচ্ছে যে কানের মধ্যে কেমন যেন ভু ভু শব্দ করছে। তীব্র অন্ধকারের মধ্যে মাঝেমাঝে ওয়েভ আকারে ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে।

এই আলো দেখতে সূতার মত। নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়। এমন ঘোরের মধ্যেই আনোয়ার হারকা করে শুনতে পাচ্ছে - স্যার ভয় পাইয়েন না। আমি আছি। - তুমি কে? প্রশ্নটা করার সাথে সাথেই বুঝতে পালো এই লোকটাকে আনোয়ার চিনে।

এর নাম ওজির। এর গায়ে একটা চাদর জড়ানো। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে চাদরের নীচে হাফ হাতা গেঞ্জি পড়া। আনোয়ারের বাবার এই গেঞ্জি পছন্দ ছিলো। আনোয়ারের কাছে এখন আর স্বপ্ন মনে হচ্ছে না।

আনোয়ার নিজেকে একটা মার্বেলের মত আবিষ্কার কালো। এতে অস্বস্তি লাগলো না। ঠিকইতো আছে, সে তো মার্বেলেরই মত! অবাক হওয়ার কী আছে? একটা ধাক্কার মত খেয়েই আনোয়ার এখন ঘুরতে শুরু করলো। তার আসে পাশে আরো তিনটি মার্বেল। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলো ভিতরে দু’টি মার্বেল।

এরা সবাই ঘুরছে। এদের কেন্দ্রেটা দেখতে খুব সুন্দর। ওজিরকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তার কণ্ঠ শুনা যাচ্ছে। - স্যার কেন্দ্রটা দেখতেছেন? - হুম - এন নাম নিউক্লিযাস।

ডায়ামিটার কত হবে মনে হয়? ২ থেকে ৩ ফেমটোমিটার হবে না স্যার? - হুম - স্যার সব খেলা কিন্তু এর ভিতরেই। ভিতরে দেখেন ৬ টা মার্বেলের মত বস্তু দেখা যাচ্ছে। - হুম - আর একটা যদি এখন ঢুকায়ে দেন তাহলে কিন্তু শক্ত কার্বন দেখবেন হালকা নাইট্রোজেন গ্যাস হয়ে গেছে। কি আজব। ৬টা প্রোটনে শক্ত কার্বন আর ৭ টা প্রোটনে নাইট্রোজেন গ্যাস! আনোয়ার শুধু ঘুরছে।

তেমন কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সে যেখানে ঘুরছে যায়গাটা অন্ধকার। একটু পরেই পাশে সাদা একটা বস্তু দেখতে পেলো আনোয়ার। সে ঘুরছে, ঘুরছে। ওজির পাশ থেকে বল্লো, স্যার সাদা বস্তু টা চুনা পাথর।

লাফ দিবেন স্যার একটা? আনোয়ার লাফ দিবে কেন? তারপরেও মনে হলো লাফ দিলে খারাপ হয় না। কিন্তু লাফ দিয়েও লাভ হলো না। একই ভাবে ঘুরতে থাকলো। - স্যার বুঝতেছেন লাফ দিয়ে লাভ হচ্ছে না কেন? - শক্তি পাচ্ছি না। - খারান, শক্তি দিতেছি।

আনোয়ারের এখন ঘুরতে বেশ চনমনে ভাব হচ্ছে। একটা তরঙ্গের মত শক্তি তার পাশ দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তরঙ্গের উপর ধাক্কা খেয়ে খেয়ে সাদা বস্তুটার দিকে যাওয়া যাচ্ছে। লাফ দিয়ে সাদা বস্তুটার কাছে গিয়ে সে দেখতে পেলো তার মতই আরো কতগুলো মারবেল ঘুরছে। সে অন্য একটা মার্বেলের পাশে জায়গা করে নিলো।

আগের মত অন্ধকার লাগছে না। একটা ধূসর পরিবেশে সে ঘরতে লাগলো। - স্যার ঘটনা বুঝলেন? দুই হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড টেম্পারেচার দেওয়াতে কার্বন কিন্তু এখন কেলসিয়াম কার্বাইড হয়ে গেছে চুনা পাথরের সাথে মিশে। আনোয়ার আবার ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতেই খুব তৃষ্ণা লাগছে।

হঠাৎ করে ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গা আর এতক্ষণের স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না আনোয়ার। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে তবু ঘেমে একেবারে নেয়ে ওঠেছে যেন। বিছানা থেকে ওঠে লাইট জালালো আনোয়ার। স্বপ্নের কথা এখনো ¯পষ্ট।

মাথায় ঘুরছে ফেমটোমিটার মানে কি? যাক সকাল বেলা দেখা যাবে। সকাল বেলা আর কিছুই মনে রইলো না। ঘুম ভেঙ্গেই মনে হলো শরীরটা ভালো লাগছে না, বিনুকে একটা ফোন করা দরকার। পরে আবার মনে হলো, থাক বেড়াতে গেছে নিজের মত করে বেড়াক। একটা কাগজে লিখে রাখলো “বিনু, তোমাকে হারাচ্ছি - ১৯ অক্টোবর ২০১২ সকাল ৮ টা”।

বিনু, আই এম মিসিং ইউ না লিখে লিখলো তোমাকে হারাচ্ছি। এর অন্য একটা অর্থ আছে। বিনু জানে। কলেজ গেইটের কাছে গিয়েই ওজিরের কথা মনে পড়লো। ওজিরকে দেখা গেল না।

ওজিরের লিংক ধরে রাতের স্বপ্নের কথা মনে হলো। সকাল বেলা ফেমটোমিটার মানে কি দেখার কথা ছিলো, মনে নেই। আনোয়ার বাংলার শিক্ষক সে এইসবের মানে বোঝার কথা না। কিন্তু মাথায় কিভাবে ব্যাপারটা ঢুকলো? সেলিম সাহেব ফিজিক্সের মানুষ। তাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।

সারা দিন কাজের চাপে কেনদিক দিয়ে সন্ধা হয়ে গেলো তা একেবারেই খেয়াল করেনি আনোয়ার। বাসার উদ্দেশ্যে কলেজ গেইটে এসেই আবার ওজিরের কথা মনে হলো। সে ভেবেই রেখেছিলো ওজিরকে সে দেখতে পাবে এবং আজ বাসায় নিয়ে যাবে। ওজিরকে গেইটে দেখা গেলো না। আনোয়ার কিছুক্ষন গেইটে দাড়িয়ে ভাবলো।

প্রথমে ভাবলো বাড়াবাড়ি হচ্ছে। হয়ত ঠিকই কাজ করা টাইপ মানুষ। কাজের ধান্দায় কোথাও চলে গেছে। পরে আবার মনে হলো, নাহ্ লোকটা আনোয়ারের কাছে থাকতে চাচ্ছে। আনোয়ার আবার কলেজের দিকে রওয়ানা হলো।

করেজ দপ্তরির কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো মানুষটার জ্বর। নাম ধাম কিছুই বলতে পারেনি। কলেজ ক্যাম্পাসের পিছনে ছোট একটা ছাউনির মত আছে, সেখানে অচেতন অবস্থায় পড়ে ন আছে। কোন কারন ছাড়াই আনোয়ার তীব্র একটা মমতা বোধ করলো। ওজিরকে সেই রাতেই থানা স্বাস্থ্য কম্পে­ক্সে ভর্তি করানো হলো।

আনোয়ার আর বাসায় গেলো না। অচেতন অবস্থায় ওজির আস্তে করে গোঙ্গানির মত করে ডাকলো - স্যার। ওজিরের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলো আনোয়ার। আস্তে করে উত্তর দিলো, হুমম। - স্যার, ফেমটোমিটার হইলো এক মিটার এর এক কোটি বার কোটি ভাগের এক অংশ।

১ গুনন টেন টুদি পাওয়ার মাইনাস ফিফটিন। আনোয়ার এর আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। যে ওজির তার বাসায় কাজের লোক থাকতে চায় তার মুখ থেকে এমন কথা বের হচ্ছে কিভাবে? আনোয়ার জ্বিন ভূতে বিশ্বাস করে না। তবু সে নিশ্চিৎ যে আনোয়ার কথাগুলো বলছে না, তার ভিতর থেকে কেউ বলছে। আর সে যে গত দিন রাতে ফেমটোমিটার স্বপ্নে দেখেছে তা ওজিরের জানার কথা না।

আনোয়ার বসে আছে ডাক্তারের রেগী দেখার কামড়ায়। পাশেই একটা বেড এনে দেওয়া হয়েছে ওজিরের জন্য। মফস্বলের হাসপাতাল। ডাক্তারের এই রুমটি ছাড়া অন্য কোথাও বাসার কোন পরিবেশ নাই। আনোয়ার আর ওজির রুমে।

শুনশান নিরবতা। আনোয়ার ভাবছে, কি হচ্ছে এসব? - স্যার - বলো ওজির - স্যার আমার নাম মনে রাখছেন? - তুমি আমার মাথার ভিতর ঢুকে বসে আছো আর আমাকে বলতেছো নাম মনে আছে কি না? - স্যার আমি মনে হয় দুই একদিনের মধ্যেই মারা যাবো। আমার মাথায় একটা বিদ্যা আছে। এই বিদ্যা নিয়ে পড়ছি স্যার মহা যন্ত্রনায়। নিজে এর কিছুই বুঝতেছি না।

কিন্তু এইডা বুঝতেছি, এই বিদ্যা আর কারো কাছে নাই। যে কেউরে এই বিদ্যা দেওন ও যাইবো না। - তোমার বিদ্যা বইবার ভার তো আমারও মনে হয় নাই ওজির। আমি বাংলার শিক্ষক। তোমার বিদ্যা তো মনে হচ্ছে অন্য কিছু।

- ওজির চুপ মেরে রইলো। আনোয়ার ওজিরের মাথায় পানি দিচ্ছে। বিনুকে একটা ফোন করা দরকার। আজ সারা দিন কথা হলো না। কিন্তু এখন ফোন দিলে আবার নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উল্টা ঝগড়া বাধবে।

- স্যার - হুম ওজির। - ছোট বেলায় আমার মা বাপ মারা গেছিলো। এরপর এক বিরাট গৃহস্থ পরিবারে এতটা বছর কাটায়ে দিলাম। যখন যার যা লাগতো ওজিরের ডাক পরতো। তিন বেলা খাওয়া দিতো।

সুখেই ছিলাম স্যার। একদিন বাজার থেকে বড় সাহেব একটা বিশাল বোয়াল মাছ কিনা দিয়া কইলো, ওজির মিয়া মাছটা কাটাইলাম না। আস্ত বাড়িতে নিয়া যা। সবাই মাছ দেইখা টাসকি লাগবো। মাছ নিয়া বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলাম।

কিছু দূর আসার পর দেখি এমন অন্ধকার, হাতের আঙ্গুল দেখা যায় না। একটু একটু ভয় লাগা শুরু করলো স্যার। শুনছি হাতে মাছ থাকলে নাকি খারাপ বাতাসে খুব যন্ত্রনা করে। বাড়ীর কাছে আইসা স্যার হুচট খাইয়া পইরা গেলাম। এমন ভয় পাইলাম! ভয়ে শরীর শক্ত হয়ে গেলো।

এর একটু পর দেখলাম নীল রঙ্গের একটা লাইট আমার চোখ দিয়া, নাক দিয়া, কান দিয়া, মুখ দিয়া ভিতরে ঢুকতে লাগলো। আমি জ্ঞান হারাইলাম। - এর পর? - এরপর স্যার খালি ঝিমানি লাগে। কোন কাজ করতে পারি না। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা হয়।

জ্বরের ঘোরে অস্থির হযে থাকি। আর বাড়ীর লোকজন ভাবলো আমারে জ্বীনে ধরছে। কত রকম কবিরাজ যে আনা শুরু করলো। এরা সবাই খালি মারে। শুকনা মরিচ জ্বালাইয়া নাক দিয়া ঢুকাযে দেয়।

সব মুর্খামী স্যার। আমি আস্তে আস্তে অনেক কিছু বুঝতে শিখলাম। কিন্তু জ্বীন তাড়ানোর নানান যন্ত্রনা সহ্য করার ক্ষমতা আর আমার নাই। একদিন তাই পালায়ে চলে আসলাম। এইখানে ওইখানে ঘুরি আর ভাবি মাথার এইযে বিদ্যা তা আমি কারে দিয়ে যাবো? - তো আমার কথা তোমার মনে হলো কেন? - স্যার পথে পথে ঘুরি, কেউ কিছু দিলে খাই, না দিলে না খাইয়া থাকি।

না খাইয়া থাকার বিদ্যাও শিখে গেলাম। - না খাওয়ার বিদ্যা শিখে গেলে মানে! - স্যার গাছ যদি পারে তো মানুষ কেন পাবো না? - মানুষের শরীর তো সালোক সংশ্লেষণ করার মত উপযোগী না! - স্যার লোহা কি পানিতে ভাসার উপযোগী? লোহা পিটায়ে চেপ্টা করে জাহাজ বানায় নাই মানুষ! আনোয়ার কি বলবে বুঝতে পারছে না। সেই হাইস্কুল লাইফে পড়া সাধারণ বিজ্ঞানের জোড় দিয়ে বেশী কিছু তাল মিলানো যাচ্ছে না। আনোয়ার পরম মমতায় ওজিরর তপ্ত কপাল মুছে যাচ্ছে। মাথার ভিতর কেমন যেন শিরশির করছে।

মনে হচ্ছে মাথার ভিতর চিকন চিকন নালা করে এর মধ্যে হালকা শীতল পানি ঢেলে দিচ্ছে কেউ। - স্যার মাথায় কি অস্বস্তি লাগছে? আনোয়ারের ভয় পাওয়া উচিৎ। কিন্তু সে ভয় পাচ্ছে না। সে টের পাচ্ছে তার মাথার ভিতর কিছু একটা হচ্ছে। এবং এ ও টের পাচ্ছে যে সামনে পড়ে থাকা ওজির নামের লোকটাই তার মাথার ভিতর কড়ি কাঠি নাড়ছে।

তারপরেও আনোয়ারের ভয়, ডর, অভিযোগ কিছুই যেন কাজ করছে না। আনোয়ার খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করলো, ওজির আমি এখন যেই নীল আলো তোমার চোখে দেখছি তুমিও কি এমন আলোই দেখেছিলে? ওজির সামান্য করে হাসলো। কিছু বল্লো না। দু’জনেই চুপচাপ বসে আছে। ওজিরের জ্বর বাড়ছে।

সাপোজিটরি দেওয়া দরকার। এত জ্বর লোকটা কিভাবে সহ্য করছে কে জানে? - ওজির ওঠো, সাপোজিটরি টা দিয়ে আসো। - স্যার, জ্বর নাইমা যাইবো। আর বেশীক্ষন না। আবার চুপচাপ বসে থাকার পালা।

কেউ কিছু বলছে না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে দুজনেই। এতক্ষন আনোয়ার খেয়ালই করে নাই আজ আকাশে এত বড় একটা চাঁদ। আহা এমন চাঁদের আলো মরে যাবো সেও ভালা সে মরণ স্বর্গ সমান। কবির নাম কি? ভালো যন্ত্রনা হলো তো।

আনোয়ারের এমন তো হয় না! কবিতা মনে পড়ছে কিন্তু কবির নাম মনে পড়ছে না। - ওজির কবি’র নাম কি? - কোন কবি স্যার? - তুমি তো আমার মাথায় ঢুকেই আছো। - নাহ স্যার, আমি আর আপনার মাথায় ঢুকতে পারতেছি না। - কেন? - জ্বরতো স্যার মনে হয় নেমে গেছে। জ্বর না ওঠলে স্যার মাথায় ঢুকতে পারি না।

আনোয়ারের হাত এখনো ওজিরের কপালে রাখা। ধীরে ধীরে ওজিরের কপাল বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছে। আর গাঢ় শীতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে আনোয়ার নীজে। - ওজির - তুমি তো অনেক ভালো মানুষ! ওজির টের পাচ্ছে তার মাথার ভিতর আনোয়ার ঢুকেছে। নিউরণের গলি গলি ঢুকছে আর ওজিরও বাধা দিচ্ছে না।

দেখুক। - ওজির - স্যার - রতœাকে কেন বল্লে না? তোমার এমন গভীর ভালোবাসা তো সে ফিরিয়ে দিতো না! - স্যার, ভয় হইতো যদি দূরে সরে যায়! - পরে যখন মাথায় ঢুকতে পারতে তখনওতো তুমি ঢুকে দেখোনি! - স্যার হালকা একটু হাসি, একটু অধিকার খাটানোর ইচ্ছা এইসব অনেক বড় আমার কাছে। মাথায় ঢুকি নাই যদি ঢুকে দেখি আমার জন্য আলাদা কোন অধিকার খাটানোর কিছু নাই, সবার জন্যই তার একই আচরণ, তখন? - ভালোবাসার কাছে কি তবে সব কিছুরই পরাজয় হয়? - স্যার জয় মানেইতো বুদ্ধির খেলা। - ভালোবাসায়তো বুদ্ধির খেলা খেলা যায় না। এক অর্থে সমর্পণের অপর নামই তো ভালোবাসা।

আনোয়ারের খুব ক্লান্তি লাগছে। তা ও ওজিরের মাথার ভিতর যা যা দেখছে সব শিখে নিচ্ছে। বাহ এইতো সেল রিজেনারেট মেকানিজম। আনোয়ারের ডান হাতের একটা আঙ্গুল সেদিন নখ কাটতে গিয়ে অনেকটাই কেটে গেছে। আনোয়ার তার হাতের আঙ্গুলের কোষগুলোর সাথে কথা বলতে পারছে।

নিউক্লিয়াসের ভিতরে যে ক্রোমজম আছে তার মধ্যে অসংখ্য জিন। সব জিনের মধ্যেই আছে প্রাণের চঞ্চল্য। সবাই পদার্থ। কিন্তু এর মধ্যে খেলে যাচ্ছে প্রাণের তরঙ্গ। গত রাতে আনোয়ার যখন কার্বনের পরমানুর ইলেক্ট্রন হয়ে ঘুরছিলো তখন হঠাৎ করেই সে একটা তরঙ্গ পেয়েছিলে।

যে তরঙ্গে ভর করে পাশের সাদা কেলসিয়ামের আর একটা ইলেক্ট্রনের সাথে বন্ধুত্ব করে ঘুরতে শুরু করেছিলো। সেই তরঙ্গ ছিলো তাপ। আর আঙ্গুলের সামনে কোষের ভিতর যে জিনগুলো আছে তার মধ্যেও ইরেক্্রন ঘুরপাক খাচ্ছে। আর প্রতিটি ইলেক্ট্রনের পাশ দিয়ে যাচ্ছে তরঙ্গ। প্রাণ-তরঙ্গ।

আনোয়ার এখন জানে এদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়। আনোয়ার একটি কোষের জিনের যে মুক্ষম তরঙ্গটি আছে তার মধ্যে একটা ইনফরমেশন টেগ করে দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই কাটা অংশটা রিপেয়ার হয়ে গেলো। আনোয়ার অবাক হয়ে খেয়াল করলো, তার হাতের কাটা দাগটাও আর নাই। - ওজির! - স্যার - বুঝতে পারছো? - স্যার অনেক দিন ধইরাই বুঝতেছিলাম এইটা দিয়া কিছু করা যাবে।

কিন্তু কি করা যাবে তা বুঝতেছিলাম না। স্যার আপনে পারবেন এই বিদ্যা কাজে লাগাইতে। ভোর রাতের দিকে আবার ওজিরের জ্বর হলো। এবারের জ্বরে আর ঝিম ধরে বসে থাকলো না ওজির। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো।

আনোয়ার এখন ওজিরের মন পড়তে পারছে। তার মন ব্যাকুল হয়ে ভাবছে, এক জীবনের সমস্ত ভালোবাসা দিয়েও অন্য একটা মানুষকে কাছে পাওয়া যায়না। অথচ বিনা ভালোবেসেই এই মানুষটাকে অন্য একজন পাশে পায়। এর কোন মানে হয়? বিশ্বস্ততার শিকড়বাকড় গড়ে বটবৃক্ষ ভালোবাসা গড়লো। মায়ার পাতায় ভরিয়ে দিলো সেই বৃক্ষ।

পাখী আকাশে ওড়ে। মনে মনে বটবৃক্ষ বল্লে, রতœাপাখী বৃক্ষে এসে একবার বসো। পাখী আসেনি। পাখী গিয়ে বসেলা ... । আনোয়ার ঠিক করলো সকাল হলেই সে রতœার উদ্দেশ্যে বের হবে।

সে গিয়ে অন্তত বলবে একবার হাত ধরে যাও ভালোবেসে। কি হয় একবার হাত ধরলে? এত ভালোবাসা দিয়ে যদি একটাবার হাত ধরা না যায় তাহলে ভালোবাসার কোন অর্থ হয় না। এতএত যন্ত্রপাতি, এত এত আবিষ্কার কিন্তু মানব মন বুঝার কোন দায় নেই কারো। আনোয়ারের মাথায় যে জ্ঞান আজ এসে জমা হয়েছে তা দিয়ে কি করা যায় তা সে পরে দেখবে। এই জ্ঞানের কতটুকু মানব সভ্যতায় দিয়ে যাওয়া যাবে তাও সে পরে দেখবে।

জ্ঞানের তীব্রতা মানুষ কোনদিন সহ্য করতে পারেনি। পরমানুর ভীতরের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরী হয়েছে? অথচ পারমানবিক বোমায় কত মানুষের মৃত্য হলো! যে ইউরেনিয়ামের জন্য এখন দুনিয়া পাগল হয়ে আছে। এই ইউরেনিয়াম দিয়ে পারমানবিক চুল্লি হয়, বোমা হয়। আনোয়ার এখন জানে কিভাবে প্রোটন ও ইলেক্ট্রনকে রি এরেঞ্জ করে হাইড্রোজেন দিয়েও ইউরেনিয়াম বানানো যায়। যে কোন পদার্থের নিউক্লিয়াসে ঢুকে প্রোটন নিউট্রন কমিয়ে বাড়িয়ে সে এখন অন্য যে কোন পদার্থ বানানোর উপায় জানে।

কিন্তু তা কি সে বলবে? ভেবে দেখতে হবে। পারদ থেকে একটা প্রোটন সরিয়ে স্বর্ণ বানানো এখন কোন বিষয়ই না। কিন্তু সবার আগে সে খুঁজে বের করবে রতœা নামের সেই মেয়েটিকে যে নিজে জানলেইনা তার জন্য এক আকাশ সমান অসীম ভালোবাসা লুকিয়ে আছে এই মানুষটাতে। যে মানুষটি হয়ত আর বেশী দিন বাঁচবে না। আনোয়ার তার ব্রেইনে রাখা জ্ঞান তন্য তন্য করে খুঁজছে।

তার দেখা দরকার এই ওজির নামের মানুষটি আর কতক্ষন বেঁচে থাকতে পারবে। সে জানে কোষ নতুন করে তৈরী করা যায়। কিন্তু কোন কোষ তৈরী করবে সে? প্রান নামের পাখী কোন কোষে বসে আছে? ওজিরের অবস্থা সকাল নাগাদ আরো খারাপ করলো। ডাক্তার বল্লো, ঢাকা নিয়ে যান। সময় মনে হয় প্রায় শেষ।

আনোয়ারের হাতে তিনটা কাজ। ওজিরের দেওয়া জ্ঞান ঘেটে দেখতে হবে ওজির আর কতক্ষন বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু কোথায় কি আছে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক অনেক মূল্যবান জ্ঞান মাথায় কিন্তু কোথায় যে কি আছে তা এখনো দেখা হয়নি। এরই মধ্যে কিছুতেই ওজির মরতে পারে না।

কিছুটা সময় দরাকর। একটু সময়। কিছুটা সময় অবশ্যই দরকার। ডাক্তার তাড়া দিচ্ছে, কি হলো আনোয়ার ভাই, রোগীর অবস্থা ভালো না, ঢাকা নিয়ে যান। আনোয়ার জানালার গ্রিল ধরে ঠায় দাড়িয়ে আছে।

চোখ বন্ধ করে দ্রুত ভাবছে কোনটা আগে করা দরকার? সময়, একটু সময় দরকার। আনোয়ার বুদ্ধি করে ডাক্তারকে বল্লো রোগী কাউকে দিয়ে ঢাকায় পাঠাতে। আনোয়ার জানে এই অধিকার ডাক্তারের উপর তার আছে। আনোয়ার বের হলো রত্নার উদ্দেশ্যে। মৃত্যু এত পাষাণ হওয়া উচিৎ না।

কি হয় একটা হাত একটু রাখলে? রত্না কি রাখবে না মৃত্যুপথযাত্রী এক প্রেমিকের বুকে হাত? মৃত্যুর আগে কি একটা জীবন পূর্ণতার স্বাদ নিযে অবসান হবে না? আনোয়ার হন্যে হয়ে রত্না বাড়ী খোঁজছে। রত্নার সামনে দাড়িয়ে সে ভাবলো এত সুন্দর, মানুষের চোখ হয়! এত সুন্দর! এমন সময় ফোন বেজে ওঠলো, ডাক্তার ফোন করেছে। পরিশেষে: বাংলাদেশ থেকে বাংলার এক প্রফেসর পর পর দুইবার চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পেয়েছেন। সবার ধারনা এবারও তার অবদানের জন্য তিনি ৩য় বারের মত নোবেল পাচ্ছেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।