আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝ'রে গেলে, ম'রে গেলে পাতার সবুজ, বিস্মৃতির কলম তাকে গল্প নামে ডাকে

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া... ওজুর পানি হাতে নিয়েই মেজাজটা গরম হয়ে গেলো সালাম সাহেবের। পানি ঠান্ডা। চিৎকার করে কটাই মিয়াকে ডাকতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। নিজের মনকে নিজেই শাসন করলেন। নাহ! এখন মেজাজ গরম করার সময় নয়।

চারিদিকের বাতাস এখন গনগনে হয়ে আছে, এখন নিজেকে ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ঠাণ্ডা পানি দিয়েই ওজু সেরে নিলেন। জায়নামাজে দাঁড়ানোর আগে খোঁজ নিলেন বাচ্চারা কি করছে; ঘর ভর্তি মানুষ - নিজের কারখানা, দোকানের ২০/২৫ জন কর্মচারী, চারটা ছোট ছোট মেয়ে, পাড়ার ৩টি আশ্রিত হিন্দু পরিবার, এদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিনা খবর নিলেন। নামাজের সময় হ'য়েছে। মনটা কেমন খচখচ করে আজকাল! কূডাক ডাকে নাকি? নাউজুবিল্লাহ! কূডাক আবার কি? মানুষ কি আগে থেকে ভবিষ্যত বলতে পারে! নামাজে দাঁড়ালেন।

কিশোরী বড় মেয়েটি ও আহত বড় ছেলে ভাগ্নের বাসায় রয়েছে, ওদের জন্য মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকলো। আল্লাহের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করে নামাজে মন দিলেন। কিছুক্ষন পরেই দিন-দুনিয়া ভুলে গেলেন। "আব্বা, মাস্টর চাচা আইছুইন!" - কাঁচা মিয়ার কথায় মগ্নতা ভেঙ্গে জায়নামাজ থেকে উঠে পড়েন তিনি। এতোক্ষন কি ভাবছিলেন নিজেই জানেন না।

বাইরের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, " নয়ানি বুড়িকে চা নাস্তা দিতে বল। কিহে মাস্টার! আজ এতো সকালে? সব খবর ভালো তো?" - "আমার খবর তো ভালোই, ডাক্তার! তোমার নিজের খবর কিছু রাখো? - "আরে ভাই, যা সময় এখন, নিজের খবর নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার সময় কি আছে, বল? কেন? হ'য়েছে কি?" - "তোমার পাড়ার উকিলটা যে খুব বাড়াবাড়ি করছে, জানো কিছু? ব্যাটা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছে শুনেছো তো? তোমার বাড়ীর দিকে কিন্তু এখন শকুনের দৃষ্টি!" - "আমার বাড়ীর দিকে দৃষ্টি মানে? কি বলো তুমি!" - অবাক গলায় বলেন সালাম সাহেব। "আমি কি করেছি? নিজের সংসার, রুগী নিয়েই তো আমি দিশেহারা!" - "দুনিয়াদারির দিকে একটু তাকাও, ডাক্তার! তুমি যে পাড়ার কয়েকটা হিন্দু পরিবার নিজের বাড়ীতে রেখেছিলে, বকুলবাবুকে দিয়ে ওদের ইন্ডিয়ায় পাঠিয়েছো, তোমার ছেলে গুলিতে আহত, এসব নিয়ে কিন্তু সে ঘোট পাকাচ্ছে"। মমতা ভেজা নরম চোখে বন্ধুটির দিকে তাকালেন সালাম সাহেব। এই দুর্দিনে বন্ধুর কথা ভেবে ছুটে এসেছে! এটা মাষ্টারের উত্তারাধিকার সুত্রে পাওয়া।

উনার দাদা এহিয়া সাহেব জিতু মিয়া নামেই বেশী পরিচিত। দেশের-দশের সেবার জন্য আজো মানুষ এক নামে তাঁকে চেনে। সেই বংশের ছেলে এমনটি হওয়াই যেন স্বাভাবিক! মাষ্টারের দু'হাত ধরে ভেজা গলায় বললেন, - " তুমি কোনো চিন্তা কোরোনা। আল্লাহ আছেন। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি! পাড়ার প্রবীন হিসেবে, প্রতিবেশী হিসেবে আমার কর্তব্য, দায়িত্ব আমি পালন করার চেষ্টা করেছি মাত্র।

কতটুকু পেরেছি তা মাবুদই জানেন। জোয়ান দুটো মেয়ে নিয়ে ঐ বুড়ো কবিরাজ কেমন বিপদে পড়েছিলো তা তো তুমি শুনেছো? আগুনের খাপরা মেয়েদুটোকে পাড়ার বদমাশ ছেলেগুলোই জ্বালিয়ে খেতো তার মাঝে এই হার্মাদদের ভয়। বুড়ো এসে আমার কাছে কেঁদে পড়লো। কি আর করা! বললাম থাকো! অমলা আছে। - ঐ যে আমার ভাগ্না বউএর বড় বোন? ওতো ব্রাম্মন! ওই রান্না-বান্না করে দেবে।

আর কি? পরে যখন বকুল ইন্ডিয়া যাওয়ার সময় তার ষ্টুডিওর ক্যামেরাগুলো আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে এলো তখন তাকে বললাম, -"বাবারে তুমি যখন যাচ্ছো, তখন এই মেয়েগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে যাও"! এখানে আমার দোষের কি হলো? মানুষ মানুষের জন্য করবেনা? তোমার দাদা, পরদাদা, তোমরা করনি? করছোনা? আর আমার ছেলে কি ঐ জানোয়ারদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে গুলি খেয়েছে? আরে! তোরাই তো বিনা অপরাধে আমার নিস্পাপ ছেলেটাকে গুলি করলি! তোদের অত্যাচারে তার চিকিতসা পর্যন্ত করা গেলোনা। ঐ ফেরেশতার মত ডাক্তার সহ হাসপাতালের ডাক্তার রুগী সবাইকে মেরে ফেললি! এই কি আল্লাহের দুনিয়ার নিয়ম??? গুলি না লাগলে তাকে আমি ধরেও রাখতে পারতাম না। ঠিকই যুদ্ধে যেতো। উত্তেজিত সালাম সাহেবের হাত দুটো চেপে ধরে মাষ্টার কিছুক্ষন চুপ করে থেকে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, -" তুমি যে মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ-পত্র, টাকা-পয়সা দিচ্ছো এটাও ওরা টের পেয়েছে। সাবধানে থেকো ডাক্তার! তোমার কিছু হলে তোমার এই ছোট ছোট বাচ্চাদের কি হবে"? সকাল আটটায় সব সময় সালাতুল হাজত আদায় করেন সালাম সাহেব।

আজও জায়নামাজে বসে আত্তাহিয়াতু পড়ার সময় কয়েক-জোড়া বুটের শব্দ কানে এলো। সালাম ফেরাতে গিয়ে নজরে পড়লো ঊনার চারিদিক ঘিরে রেখেছে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। ঘাবড়ে না গিয়ে জায়নামাজে বসেই জিজ্ঞাসা করলেন, - " কি ব্যাপার? আপনারা"? উত্তরে উনার পিঠে প্রচন্ড জোরে লাথি দিয়ে একজন কর্কশ স্বরে বলে উঠলো, "শালা উর্দু জাবান চালাতে হো? গাদ্দার কাহিকা"! রক্ত গরম হয়ে উঠলেও নিজেকে সংযত করে শান্ত স্বরে বললেন, " উর্দু বলা কি দোষের? আর আমি গাদ্দারি কি করেছি? টেনে-হিচড়ে উনাকে জায়নামাজ থেকে তুলে ওরা হ্যাচকা টানে দরজার সামনে নিয়ে বল্লো " তুমি কি করেছো তার হিসেব হবে, চলো আমাদের সাথে"। বাচ্চা ও বাড়ীরপিঠেদিয়ে পিপিঠে পিঠে বন্দুকের বাট দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজায় বাইরে ছিটকে ফেলে তাঁকে। কোমরে একটি লাথি মেরে খিঁস্তি করে বল্লো, আবে বাহেনচোত, চাল----!!! লজ্জায়, অপমানে, ঘৃনা, অক্ষম আক্রোশে সালাম সাহেবের দুচোখ ভিজে গেলো।

এককালের মুগুরভাজা শরীর আজ বার্ধক্যের কাছে নত। চোখ মুছে কোনো মতে বললেন, - " আমার ছোট বাচ্চাগুলোর সঙ্গে দেখা করতে দাও। আর পারে চপ্পলটা পড়তে দাও"। কুত্তার আবার জুতা পায়ে দেয়া - আরে! কুত্তাকা ইতনা জুতা পেহনেকা শাখ কিউ বে!!! কটুক্তি করে টেনে-হিচড়ে তাকে নিয়ে জীপে তুল্লো। জীপে উঠার পরই উনার চোখ কালো কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেধে দিলো।

পিছনে উচ্চস্বরে কান্নার রোল ফেলে জীপটি এগিয়ে গেলো। গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। না, সালাম সাহেবকে ওরা মেরে ফেলেনি। আরো অসংখ্য বাঙ্গালীর সংগে বন্দী করে রেখেছিলো শহর থেকে অনেক দূরে একটি স্কুল ঘরে।

প্রতিদিন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সিরিঞ্জ দিয়ে শরীরের রক্ত বের করে নিয়েছে অনেকেরই। বৃদ্ধ বলেই হয়তো সালাম সাহেবের বেলায় এটা ঘটেনি। মাস দুয়েক পরে কয়েক জন বাঙ্গালীর সঙ্গে সালাম সাহেবকেও ছেড়ে দেয়া হলে পরে তিনি জানতে পারেন, তার মুক্তির জন্য ভাগ্নে সামসুদ্দীন সালাম সাহেবের ছোট ছোট মেয়েগুলোকে নিয়ে পাকসেনাদের দপ্তরে হত্যে দিয়ে পরে থেকেছেন, দরখাস্ত করেছেন, কাকুতি মিনতি করেছেন। ভগ্ন মন, ভগ্ন শরীর নিয়ে সালাম সাহেব ভেবে কুল পেলেন না কী তাঁর অপরাধ ছিলো? অতঃপর দেশ স্বাধীন হলো।

ঘর ছাড়া মানুষ ঘরে ফিরে এলো। সালাম সাহেব আরেক পরীক্ষার সম্মুক্ষিন হলেন। একদিন অস্ত্র হাতে একদল তরুনদের নিয়ে পাড়ার কিছু মানুষ এসে উপস্থিত। মুক্তিযোদ্ধারা ঘোষনা করলো, পাড়ার এই লোকগুলির অভিযোগঃ সালাম সাহেব তাদের জিনিস-পত্র লুটপাট করেছেন, পাকিস্তানী সেনাদের সাহায্য করেছেন। পাকসেনাদের অত্যাচারে অসুস্থ সালাম সাহেব তাকিয়ে দেখলেন তাঁর সেসব প্রতিবেশীদের মুখ।

শান্ত স্বরে বললেন,- " ঠিক আছে! আমার ঘরে যদি তোমাদের কিছু থেকে থাকে তবে নিয়ে যাও"! তারা সিলিং ফ্যান খুলে নিলো, আলমারী থেকে মেয়েদের জন্য গড়িয়ে রাখা সামান্য অলঙ্কারগুলো বেধে নিলো। সেলাই মেশিনটা ঘর থেকে বের করতেই কটাই মিয়া হুঙ্কার দিয়ে এগিয়ে এসে সেটার রিসিট সবার সামনে মেলে ধরলো। মেশিন ফেলে তারা বাউন্ডারী ওয়ালের উপরের টিন ধরে টানা-টানি করতে লাগলো। তখন ছুটে এলেন দেশবার্তা পত্রিকার মালিক। হুঙ্কার দিয়ে বড় ভাইকে নিবৃত করে বললেন, -" এগুলো মোটেই আমাদের টিন নয়।

ক্যানো আপনি এই সম্মানিয় মানুষটিকে অসম্মান করছেন"! সালাম সাহেব বিমুঢ়ের মত চেয়ে থাকলেন। তিনি বুঝতে পারলেন না, কোনটা সম্মান, আর কোনটা অসম্মান! যারা দেশকে মুক্ত করতে ঝাপিয়ে পড়েছিলো তিনি তাদের পাশে ছিলেন। এ অপরাধে বৃদ্ধ বয়সে পাকসেনাদের পদাঘাত, অপমান সহ্য করেছেন। আর আজ স্বাধীন দেশের মাটিতে সেই মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে লুটেরা, পাকিস্তানের দালাল বলে অপমান করছে সেটাও সহ্য করতে হচ্ছে। আর গোলাম জিলানীর মত রাজাকারদের কিছুই হচ্ছেনা।

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন এখনো অনেক শকুণ পাক খেয়ে উড়ছে! *** লেখাটি অনেকদিন ধরে ড্রাফট বন্দী হয়ে ছিলো। ভাইয়া ব্লগার বাপী হাসান এতো সুন্দর শিরোনাম দিয়ে এটাকে অলংকৃত করেছেন, ও অন্যান্য দিকও দেখে দিয়েছেন। এ জন্য উনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা!!! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।