আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোহ কি ভাঙল প্রথম আলোর ??????????? যাই হোক, ধন্যবাদ.।.।.।।।খুনি দের পক্ষ না নেয়ার জন্য., এবং এটা প্রকাশ করার জন্য।

হাতে চাপাতি, শার্টে ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্তে সেই চাপাতিরই চিহ্ন। চোখেমুখে জান্তব ক্রোধ। খুনের নেশায় উন্মত্ত সেই যুবকদের সামনে আর্তনাদ করে নুয়ে পড়া আরেক যুবকের ছবি। তিনি বিশ্বজিৎ দাস। আগের দিন রাতে বিশ্বজিৎ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয়ের উৎসব করেছেন।

চাপাতি হাতের যুবকদের আঘাতে আঘাতে তিনিই লুটিয়ে পড়েছেন মৃত্যুযন্ত্রণায়, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। দিনের আলোয় রাজধানীর রাজপথে পুলিশ আর বহু মানুষের সামনে। কিল-ঘুষি খেয়ে, পদদলিত হয়ে, চাপাতির আঘাতে আঘাতে, নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে তাঁকে অবশেষে মৃত্যুর অন্ধকারে বিলীন হতে হয়েছে। উল্লাস থেকে আর্তনাদের এই কয়েক ঘণ্টার অভিযাত্রায়, স্বপ্নেও কি এমন কিছু ভাবতে পেরেছিলেন বিশ্বজিৎ! কী অপরাধ ছিল বিশ্বজিতের! তাঁর একমাত্র অপরাধ, তিনি বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন। তিনি বিশ্বজিৎ হতে পারেন।

তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না-ও হতে পারেন। তিনি একদম নির্দোষ হতে পারেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন। এখানে হুতু-তুতসি বিরোধ নেই, ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি নেই, তালেবান-কারজাই নেই; কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি আছে। আছে রাজপথে যুদ্ধের দামামা, হননস্পৃহা ও রক্তপিপাসা।

এমন যুদ্ধের দিনে বিশ্বজিৎ রাস্তায় বের হলেন কোন সাহসে। মৃত্যুই তো প্রাপ্য ছিল তাঁর! বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের জনকদের সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছে ডেইলি স্টার। টেলিভিশনে কিছু পশুর উন্মত্ত আচরণ দেখেছেন তাঁরা। বিশ্বাস করতে পারছেন না, এই পশুরা তাঁদেরই সন্তান। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে নিজেদের সন্তানদের মানুষ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন তাঁরা।

কোনো দিন ধারণাও করতে পারেননি, সেখানে এসব কী শিখেছেন তাঁরা! নিজেদের চোখে সব দেখে চোখ মুছেছেন লজ্জা আর গ্লানিতে। সন্তানের বিচার আর শাস্তি চেয়েছেন নিজেরাই। কিন্তু বিশ্বজিতের বাবা বা সহোদর সাহস পান না মামলা করতে। তাঁরা বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছেন পরকালের বিচারকের হাতে। তাঁরা তবু ভাগ্যবান, বিশ্বজিৎ বশির বা বায়েজিদ হয়ে জন্ম নেননি।

নিলে বিশ্বজিৎকে নির্ঘাত জামায়াত-শিবির বানিয়ে দেওয়া হতো। বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের বানানো হতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীরসেনানী। মন্ত্রী আর নেতারা গর্বে বুক ফুলিয়ে বলতেন, জনগণ প্রতিরোধ করেছে হরতালকারীদের। কিছু লেখক, আলোচক, বুদ্ধিজীবী গণপিটুনিকে স্বাগত জানাতেন। বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা দ্রুতই বড় নেতা হয়ে উঠতেন।

কোনোমতে পড়াশোনা শেষ করতে পারলে কোনো মন্ত্রীর এপিএস হতেন। কোনো দিন এই রাষ্ট্রের মন্ত্রীই হয়তো! বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের কপাল খারাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবুবকর হত্যা থেকে শুরু করে জাহাঙ্গীরনগরে জুবায়ের হত্যা পর্যন্ত বহু নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের সহকর্মীরা। কারও শাস্তি হয়নি এখনো। কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের রেহাই নেই।

টিভি আর পত্রিকার ক্যামেরায় লাইভ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন তাঁরা, কীভাবে এখন রক্ষা পাবেন! নাহিদ-লিমন, রাজন-রফিকুল—যিনিই হোন না কেন তিনি, তাঁকে এবার ধরা পড়তে হবেই। যেভাবে পত্রপত্রিকা ছেঁকে ধরেছে, খুব দ্রুত জামিনও তাঁরা পাবেন না হয়তো। তবে বিশ্বজিতের খুনিদের বেশি ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একদিন যখন আরও বিশ্বজিৎ খুন হবেন, আরও ভয়াবহ কোনো তাণ্ডব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন সাংবাদিকেরা, সবার অলক্ষ্যে তাঁরাও জামিন পেয়ে বের হয়ে আসবেন। তারপর যদি বিচার হয়, সাজাও হয়, বিশ্বজিতের খুনি বীরসেনানীর হতোদ্যম হওয়ার কারণ নেই।

এই রাষ্ট্রে খুনের আসামি হাইকোর্টের বিচারক হন, শততম ধর্ষণ উদ্যাপনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান, বাথরুমে বেঁধে জীবন্ত মানুষকে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা নরপশু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা লাভ করেন। কাজেই বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদেরও সুদিন আসবে একদিন। তাঁরা তো দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই না রাজপথে বিএনপি আর জামায়াত-শিবির প্রতিরোধ করতে গিয়েছিলেন। মির্জা ফখরুলের ‘নির্দেশে’ তো আবর্জনাবাহী গাড়ির চালককে মারতে যাননি! মির্জা ফখরুল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৩৭টি মামলার আসামি হয়েছেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।

বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের অন্তত এতটা ভোগান্তি সইতে হবে না। বিরোধী দলের মহাসচিবের চেয়ে নিজ দলের খুনির মর্যাদা এখনো বেশি আছে এই রাষ্ট্রে! ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে হয়তো একই রকম ঘটনা ঘটবে। দুঃখ শুধু হয় বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের পরিবারদের জন্য। তাঁরা আসলেই মানুষ করতে চেয়েছিলেন সন্তানদের, পশু বানাতে নয়। এখন তাঁরা কে জামায়াত-শিবির; হত্যাকারীদের বাবা, ভাই, মামা ও চাচা কে কোন মাদ্রাসায় পড়তেন, কে কখন জামায়াত-শিবির বা বিএনপি করতেন—এসব শুনতে হচ্ছে তাঁদের।

সেও আবার খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। তাঁরা সাধারণ মানুষ। তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। বৈবাহিক সূত্রে হোক, জন্মসূত্রে হোক, এই রাষ্ট্রের অধীশ্বর আর তাঁর পারিষদের পরিবারে কি রাজাকার নেই? জামায়াত-শিবির নেই? তাঁদের প্রশ্ন করার সুযোগ নেই, হত্যাকারীরা নিজেরা কোন ছাত্রসংগঠন করতেন? কেন নানা অপরাধে তাঁদের আগে কোনো বিচার করেনি সরকার? কেন তাঁদের কেউ কেউ আগেই বহিষ্কৃত হওয়ার পরও ছাত্রলীগের বড় নেতারা মিছিলের সামনে তাঁদের রেখে বীরদর্পে স্লোগান দিয়ে গেছেন এত দিন? কেন পত্রপত্রিকা ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তাঁদের গ্রেপ্তার করার কোনো আগ্রহ দেখায়নি সরকার? তাঁদের মামা-চাচারা জামায়াত বলে? আমরা আমজনতা এসব প্রশ্ন বাদ রাখলেই অবশ্য ভালো। আমরা বরং পশুদের বিচার নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

প্রত্যক্ষদৃষ্ট খুনিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বিচারও হবে। আমরা বরং মুগ্ধ হয়ে তার উদ্যাপন করি। কী অসাধারণ রাষ্ট্র! কী অসাধারণ রাজনীতি! এই রাজনীতি হলে সিট পেতে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল করতে শেখায়, হলে সিট অব্যাহত রাখতে জোর করে মিছিলে গিয়ে দুই নেত্রীর বন্দনা করতে শেখায়, চাকরি-ব্যবসা পেতে হলে বা বড় নেতা হতে হলে লুটেরা বা খুনি হতে শেখায়। এই রাজনীতি ক্লাসরুম বাদ দিয়ে রাজপথ শেখায়, বই বাদ দিয়ে দরপত্র পড়া শেখায়, প্রেমিক না হয়ে ধর্ষক হতে শেখায়! মানুষ না, পশু বানানোর দীক্ষা দেয়! পশু বানানোর এই কারখানা নিয়েও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমাদের সান্ত্বনা হোক এই যে এই কারখানার মালিক যাঁরা, এই রাষ্ট্রের অধীশ্বর যাঁরা, তাঁদের সন্তান তো মানুষ হচ্ছেন! তাঁরা হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডে পড়ে উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন, সভ্য মানুষের দেশে বিবাহ বা সম্পত্তি সূত্রে বসবাস করছেন, আমাদের চালানোর জন্য হাতে বেত আর বুকে সন্দেহ নিয়ে দিবানিশি সতর্ক থাকছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে, আদালতে, পত্রিকায়, পুলিশে তাঁদের সেনারা আছেন। আমরা যাঁরা পশু, আমাদের যে সন্তানেরা পশু, আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে তাঁরা লেলিয়ে দিয়েছেন হুতু-তুতসি বানিয়ে। আমরা নিজেরা মারামারি করি। প্রভুদের বন্দনা করি। তাঁদের সম্পদ আর ক্ষমতার পাহারাদার হই।

নিজের সন্তানদের অনিশ্চয়তা আর মৃত্যুর অন্ধকারে রেখে প্রভুর সন্তানদের ভালোবাসি। তাঁদের অনাগত দিনের জন্য তোরণ আর মালা নিয়ে অপেক্ষা করি। আমাদের কেউ কেউ বোকার মতোই হয়তো ভাবি, এই পোড়া দেশে কখন আসবে সুদিন! এই দেশেই না এসেছিল বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর আর নব্বই! আমরা এই ভাবনার কথা বলি। আছে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের ভয় আর শিবিরের তাণ্ডব, আছে জেল-জুলুমের হুমকি, গুম হওয়ার শীতল আতঙ্ক! আছে বিশ্বজিতের নির্বোধ আকুতির মুখচ্ছবি! তবু আমরা হারব না!  আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লিঙ্ক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।