আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আপন আলোয় সুখ

আমার 'কলম' আজো আছে আমার সাথে, আমার কষ্টের সঙ্গী হয়ে,আমার সুখের ভাগ নিয়ে দেনা-পাওনা চুকিয়ে,এক চিলতে হাসি হয়ে... ঘড়িতে বাজে সাড়ে ১১টা। এই মুহুর্তে কিচেনে যাওয়া ঠিক হবে নাকি নিজের রুমে!চিন্তার বিষয়....!১টার মধ্যে দুপুরের খাবার টেবিলে দিতে হবে,আম্মা-আব্বা এই সময়ই খেতে বসেন,দেরি হলে তাদের জন্য অপেক্ষা করা কষ্টকর। আসলে এই বয়সে এসে অপেক্ষা করার ধৈর্য্য খুব একটা থাকে না। বাসার বাকিরা ঘড়ি ধরে ১টার মধ্যেই যে খেতে বসবে তা না,তবে তিনটার মধ্যেই সবার খাবার শেষ হয়ে যায়,সো...সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কিচেনে যাবার সিদ্ধান্তই নিল মায়া। আসলে সকালের নাস্তার ঝামেলা শেষ করে ঘর গুলো গুছাতে গুছাতে ১১টা বেজে গেছে কখন টেরই পায়নি!শ্বশুড় কে চা দিয়ে ভেবেছিল নিজের ঘরে যেয়ে চা খেতে খেতে একটু বাসায় ফোন করবে,২দিন আগে আম্মুর সাথে কথা হয়েছিল আর হয়নি!গতকাল নাকি নানি এসেছেন বাসায়,তার সাথেও এখনো কথা হয়নি! হায়রে!একেই কি বলে সংসার জীবন!আসলে ২মাস হয়ে গেলেও এখনো এ বাসায় পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারেনি মায়া,পাখীর মতো তাই ছটফট করতে থাকে, কখন মায়ের বাসায় যাবে!কখন ফোনে আম্মু-আব্বু,বোনদের সাথে কথা বলবে! কিন্তু আজ আর সময় নেই,দুপুরের খাবার রেডি করতে হবে,তাই আর রুমে না যেয়ে ফ্রিজ থেকে শাক-সবজি বের করে ডায়নিং এ বসল।

হঠাৎ চা খেতে যেয়ে কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় এমন ভাবে চমকাল যে গরম চায়ে মুখ পুড়ে ফেলল!! 'এইরে সেরেছে!আজ তো সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি,কে কখন বাসায় ফিরবে?দুপুরে-রাতে কে কি খাবে?!!হায় আল্লাহ!এখন কি হবে??'' কিছুক্ষন পর স্বাভাবিক হয়ে চা খেতে খেতে চিন্তা করতে লাগল,'আজ কি কি আইটেম রান্না করবো?ডাল তো কম্পলসারি,সাথে সবজি ভাজি কিন্তু কয় রকমের?!আর তরকারী?সেটাই বা কয় রকমের হবে?আচ্ছা এই বাসায় সবাই এত্ত রকমের আইটেম কেন খায়?আব্বা খাবে একটা আম্মা খাবে একটা,মহান জ্ঞানী দেবর আশিক-আসিফ খাবে এক রকম আর আরিফ সাহেব!তিনিও খাবেন আরেক রকম...হুহ!এদের মা এতো বছর ধরে এদের কে কেন যে আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে এতো রান্না করে খাইয়েছেন...!দুইটার জায়গায় খুব বেশি হলে তিনটা আইটেম হতে পারে,এক বেলাতে পাঁচ আইটেম!!উফফ!এখন সব পড়ছে আমার উপর!'' চা শেষ করে কাপ রাখতে ডায়নিং এ এসে একটু অবাক হলেন হেলেনা বেগম! বেশ কিছু শাক-সবজি সামনে নিয়ে তার নতুন বউটা মনে হয় লটারী করছে!ব্যাপার কি?! --কি ব্যাপার?কি এতো ভাবছ? শাশুড়ির কথা শুনে চমকালো মায়া! --ইয়ে না মানে আম্মা আসলে ঠিক করছিলাম,কি কি রান্না করবো দুপুরের জন্য... --সকালে জিজ্ঞেস করে রেখেছিলে ওদের কে? --নাহ,ভুলে গিয়েছিলাম! সে জন্যই তো চিন্তা করছি!কি করব... !কেন যে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম!আচ্ছা,এখন কি সবাইকে ফোন দিবো? --এখন জনে জনে ফোন করে জিজ্ঞেস করলে,রান্না করবে কখন?কাল থেকে ভালো করে খেয়াল রেখো,দরকার হলে রাতেই জিজ্ঞেস করে রাখবে। আর এক কাজ করো,ডাল রান্না করো,আর দু'রকমের সবজি ভাজি,সাথে তরকারী এক রকমের হলেই হবে,আর হ্যাঁ যেকোন ভর্তা আইটেম রেখো,আশিকের আবার ভর্তা হলে আর কিছু লাগে না,ঠিক আছে? মায়া চোখ বড় বড় করে বলল, --জ্বী আম্মা,ঠিক আছে। এবার হেসে ফেললেন শ্বাশুড়ি,আসলে এতো রান্না একসাথে করা মায়ার জন্য কষ্টকরই বটে! --আরে মেয়ে এতো চিন্তার কি আছে,ঠিক আছে,তুমি সবজি কেটে রেডি করো আমি আসছি... শ্বাশুড়ি চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো মায়া! যাক,এখন সে টেনশন ফ্রি,আম্মা যেহেতু পাশে আছেন সো কোন ভুল হলে তিনি ধরিয়ে দিবেন,আর যাইহোক,লবন-তেল কম বেশি হওয়ার ঝামেলা থেকে তো বাঁচা যাবে! এ বাসার মানুষজন কথা বলে খুব কম,কেমন যেন শান্ত একটা পরিবেশ থাকে সব সময়,বিয়ের পর গত ২মাসে মায়া তা ভালো ভাবেই বুঝেছে,অবশ্য প্রথম প্রথম খুবই বিরক্ত হতো সে!এ কেমন বাড়ি?সবাই থাকে সবার মতো!কথা বলার তেমন মানুষ নেই...!সবচেয়ে বেশি ফিল করেছে বোনের অভাব। ইশ,কেন যে এ বাসায় একটা ছোট বোন নেই!থাকলে তো অন্তত তার সাথে একটু গল্প করা যেতো! কিন্তু এখন আর খুব একটা খারাপ লাগে না,তবে কিচেনে একা একা কাজ করতে করতে মায়া প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠে,মাঝে মাঝে একা একাই বলে উঠে,''ইয়া আল্লাহ,আম্মু একা একা বাসায় কিভাবে কিচেনে কাজ করে!এবার যেয়ে মাইশা কে ভালো করে বলে আসব যেন আম্মুকে কিচেনে হেল্প করে...''কথা গুলো ভেবে আবার হাসিও পায়,বিয়ের আগে খুব একটা কিচেনমুখী ছিল না সে,পড়াশুনা-বন্ধু,আর নিজের সৌখিন কাজ কর্ম নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো। এ জন্য মরুব্বীদের কম বকা যে শুনেনি তা না,তবে মাঝে মাঝে শখের বসে এটা সেটা রান্না করতো,সবাই অবশ্য ভালোই হয়েছে বলতো,।

আসলে মায়ার একটা গুন ছিল যে কাজটা করতো তা খুব মনোযোগ দিয়ে ভালোভাবেই করার চেষ্টা করতো। তারপরেও মায়ার নানি যতোবার ওদের বাসায় আসতেন,ওকে দেখলেই রান্না করার কথা বলতেন,তিনি খুব চিন্তায় থাকতেন,তাঁর এই নাতনি বিয়ের পর না জানি কি করে সংসার করবে! আবারো হাসলো মায়া,ঠিক করলো,নানি কে একদিন এ বাসায় দাওয়াত করে নিয়ে আসবে,তারপর ওর হাতের রান্না খাইয়ে তাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে তার এই নাতনি শ্বশুড় বাড়িতে এসে ভালোই রান্না করতে পারে...! দুপুরে খাওয়া আর গোছানো শেষ করে নিজের রুমে এসে চুল আঁচড়াতে বসল মায়া,আরিফ আজ দুপুরে খেতে আসেনি,লাঞ্চের দাওয়াত আছে নাকি... কিছুটা ক্লান্তি লাগলেও শোয়ার ইচ্ছে নেই,তাই পানি নিয়ে বারন্দায় আসল গাছে দেবার জন্য,এ বাসায় গাছের শখ একমাত্র ওর দেবর আসিফের,কিন্তু সে খুবই ব্যাস্ত,তাই মায়া গাছ পছন্দ করে শুনে ওর বারান্দায় সব গুলো গাছ রেখে গেছে,গত সপ্তাহে ছোট বোন মাইশা দুটো ক্যাকটাস দিয়ে গিয়েছে। পানি দিতে দিতে হঠাৎ করেই খুব মন খারাপ হয়ে গেল মায়ার! পানি দেয়া রেখে বাইরে তাকালো...অসম্ভব অসহায় মনে হলো নিজেকে...! এই মুহুর্তে কেন জানি,আগের জীবনে ফিরে যেতে খুব ইচ্ছে করছে!সেই সাত সকালে উঠে ক্লাসে যাওয়া,দুপুরে ফেন্ডরা মিলে ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ করা,বিকেলে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরা,সন্ধ্যায় আব্বুর জন্য চা আর বাসার সবার জন্য নাস্তা রেডি করা,পড়া শেষ করে মাইশা-মালিহার সাথে বসে টিভি দেখা...খুব সুন্দর কিছু সময়ের ছবি যেন...অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে... আজ কতো দিন হয়ে গেছে,সন্ধ্যায় আব্বুর জন্য লুচি-ভাজি বানায় না...এ বাসায় সন্ধ্যায় তেমন কেউ নাস্তা করে না,আর তৈলাক্ত খাবার এরা কমই খায়। মায়ার খুব ইচ্ছে হয়,রোজ সন্ধ্যায় আব্বুর জন্য লুচি-ভাজি,চা তৈরী করতে,আব্বু খুব চা খান,তাই একটু পর পরই মায়াকে বলতেন, --বড় মা,চা আছে না? খুব বিরক্ত হতো মায়া তখন!একটু পর পর শুধু চা...উফফ!আর এখন...? জীবন কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর ভাবেই বদলে যায় বলা চলে...!অনেকটা এক ঝাটকায় পুরোনো সব কিছু বদলে যায়! আসরের আযানের শব্দে বাস্তবে ফিরে আসে মায়া। নামায শেষ করে,চুলায় চা বসিয়ে,ফ্রিজ থেকে ফল বের করে কাটার জন্য,ট্রে সাজিয়ে শ্বশুড়ের রুমে দিয়ে এসে,আবারো কিচেনে যায়,ময়দা বের করে,আজকে কেন জানি লুচি-ভাজি থেকে খুব ইচ্ছে করছে বানানো শেষ করে ভাজছিল,এমন সময় কিচেনের পাশে দেবর আসিফের গলা শুনতে পায়, --ভাবি,কি করছো? কিচেন থেকেই মায়া উত্তর দেয়, --লুচি বানিয়েছি,ওটা ভাজছি এখন,কিছু লাগবে তোমার? --ভাবি!এতো অয়েলি খাবার খেলে তো কয়দিনেই তুমি মোটা হয়ে যাবা! মায়া কিছু না বলে বিড়বিড় করে,'আমি মোটা হলে তোমার কি?আসছে আমার কাজে বাগড়া দিতে!পন্ডিত!' --ভাবি,যেটা বানাচ্ছো,সেটা প্লিজ আমাকে আবার খেতে বলো না,ওকে? --হুম,ওকে।

আসিফ চলে গেলে,একাই হাসল...হায়রে!এই বান্দা মোটা হওয়ার ভয়ে নাকি অয়েলি খাবার খায় না,তো রান্না করা তরকারী কেন খায়?কাঁচা সবজি খেলেইতো পারে!হিহিহি। সন্ধ্যায় আরিফ ফিরলে ওকে চা দিয়ে নিজের নাস্তা নিয়ে বসে,আরিফ সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো! --এহেম,এহেম,ঘটনা কি? মায়া ঘাড় বাঁকালো, --ঘটনা?কই কিছু না তো! --অবশ্যই ঘটনা...আমি কি খাচ্ছি,আর তুমি কি খাচ্ছো? --ও...না মানে,আমি আজকে আমার পুরোনো খাবার খাচ্ছি,আর তুমিও তোমার পুরনো খাবার খাচ্ছ,সিম্পল... আরিফ এবার এসে মায়ার পাশে বসলো, --ম্যাম,আমি আজকে আপনার খাবার খাবো,ওকে? মায়া অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, --শোন,আসিফ বলেছে,অয়েলি খাবার খেতে না,খেলে মোটা হয়ে যাবা!তুমি বরং ফ্রুট আর চা খাও,আমি আমার খাবার খাই...ওকে? আরিফ মুচকি হেসে মায়ার প্লেটের দিকে হাত বাড়াতেই মায়া প্লেট সরিয়ে ফেলল,আসিফ এবার উঠে যেয়ে হাত থেকে প্লেটটা ছাড়িয়ে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসল,মায়া চোখ ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল, --তোমার কবিরাজ দেবর কি বলেছে সেই কথা আমাকে শুনিয়ে তো লাভ নেই,আমি আজকে এই লুচি ভাজিই খাবো,আফটারঅল আমার বউ বানিয়েছে বলে কথা!তুমি বরং তোমার দেবরের কথা মতো ফ্রুট খাও! মায়া চেঁচিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল,ঠিক তখনই দরজার ওপাশে আসিফের গলার আওয়াজ পেয়ে চুপ হয়ে গেলো!আরিফ সেদিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, --কিরে আসিফ,কিছু বলবি? আয়... --ইয়ে ভাবি,ঐ তুমি জানি তখন কি বানাচ্ছিলা? মায়া নিঃশ্বাস ফেলে বলল, --লুচি-ভাজি --ওহ,হ্যাঁ,তো ওটা আরো আছে?থাকলে প্লিজ,আমার সাথে শেয়ার করোনা,একটূ টেস্ট করে দেখতাম আর কি...! এবার আরিফ হো হো করে হেসে উঠলো,মায়াও আর হাসি চেপে রাখতে পারল না,সেও মুখে হাত চেপে হাসতে লাগল... কিন্তু বেচারা আসিফ কিছু না বুঝে একবার ভাইয়ের দিকে একবার ভাবির দিকে তাকালো...! 'এইভাবে দু'জনের হাসার কি হলো?তাও একই সাথে...!!' [সেদিন এক ম্যারিড বান্ধবীর মুখে তার শ্বশুড় বাড়িতে এডজাস্ট না হওয়ার অসম্ভব গল্প!!শুনলাম। আমার নিজেরই কেন জানি মনে হয়েছে,সে আসলে আন্তরিক ভাবে চেষ্টাই করেনি,এবং কোন বাড়ি থেকে কারো তেমন উৎসাহ ও পায়নি। আম্মু প্রায়ই বলে,মানুষের জন্য কোন কিছুই তৈরী থাকে না,তৈরী করে নিতে হয়,আর মেয়েদেরকে আল্লাহ এতো গুন দিয়ে পাঠিয়েছেন যে সে চাইলেই তার একটু চেষ্টা দিয়েই যেকোন জায়গায় নিজের অবস্থায় সুন্দর ভাবে করে নিতে পারে। জানিনা,বান্ধবিটার ভাগ্যে কি আছে,গল্পটা ওকেই উৎসর্গ করলাম... ]  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।