আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহান মুঘল সম্রাট আকবর

জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেণ। আকবর ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে তার সাম্রাজ্য বিস্তার চালিয়ে যান। আকবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেণ। আকবর তার নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দীন-ই-ইলাহি নামক ধর্ম চালু করার চেষ্টা করেন।

আকবর যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিশৃঙ্খল। হুমায়ুন মৃত্যুর আগে কেবল পাঞ্জাব, আগ্রা ও দিল্লি উদ্ধার করে গিয়েছিলেন, কিন্তু সাম্রাজ্য সুসংহত করে যেতে পারেননি। সম্রাট আকবর প্রায় ৫০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। এর বেশিরভাগ সময় তাকে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। তার রাজত্বকালেই বিখ্যাত হিন্দি কবি তুলসীদাস হিন্দি ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন।

বাদশাহ বিশ্বাস করতেন যে ,সূর্য বাদশাহ গনের অভিবাবক ও হিতাকাঙ্খী। তিনি তাই হিন্দুদের কাছ থেকে সূর্যকে বশীভূত করার মন্ত্র শিখেছিলেন। মাঝরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন। শিবরাতে তিনি যোগীদের আসরে সমস্ত রাত্রি বসে থাকতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে ,ইহাতে আয়ু বৃদ্ধী পায়। সম্রাট আকবর হিন্দুদের পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতেন।

মৃত্যুর পর তিনিও পুনরায় অন্য কোন সিংহাসনে আরোহন করবেন বলে বাদশাহ বিশ্বাস করতেন। ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হত। তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মনে হতো হিন্দুধর্ম। তাই তার নতুন ধর্ম 'দ্বীন-ই-ইলাহির' বেশীর ভাগ উপাদানই গৃহীত হয়েছিল হিন্দুধর্ম হতে। রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আকবর হিন্দুদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন।

রাজস্ব সচিব রাজা টোডরমল এবং সেনাপতি রাজা মানসিংহ তাদের অন্যতম। একদিন আবুল ফজল বাদশাহকে একখানি কেতাব দেখাইয়া বলিলেন,''আপনার জন্য ফেরেশতা ইহা আসমান হতে এনেছেন। সেই কেতাবের একস্হানে একটি আরবি বাক্য লিখিত ছিল,যাহার অর্থ এইরূপঃ ''হে মানুষ তুমি গাভী হত্যা করিও না । যদি কর তবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। ''নিরক্ষর বাদশাহ ইহা বিশ্বাস করিলেন এবং গরু জবেহ করা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিলেন।

কানুন জারী করলেন,কসাই এর সাথে কেউ আহার করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে এমনকি তাহার স্ত্রীও যদি তাহার সাথে আহার করে তবে তার আঙ্গুল কাটা হবে। এই নুতন ধর্মে গরু,উট,ভেড়া প্রভৃতি জন্তুর গোশত হারাম বলিয়া ঘোষিত হল। পক্ষান্তরে বাঘ ভাল্লুকের গোশত হালালের মর্যাদা লাভ করে। মোট কথা সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতা করাই ছিল দিন-ই-ইলাহির মূল উদ্দেশ্য। বঙ্গদেশ ও বিহারের মুসলমাননের নিকট যখন বাদশাহ আকবরের এই পথভ্রষ্টতার সংবাদ পৌছল তখন তারা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পরলেন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- "আকবর শাহের মাতৃভক্তি অত্যন্ত প্রবল ছিল। এমন-কি, এক সময়ে যখন তাঁহার মা পালকি চড়িয়া লাহোর হইতে আগ্রায় যাইতেছিলেন, তখন আকবর এবং তাঁহার দেখাদেখি অন্যান্য বড়ো বড়ো ওমরাওগণ নিজের কাঁধে পালকি লইয়া তাঁহাকে নদী পার করিয়াছিলেন। সম্রাটের মা সম্রাটকে যাহা বলিতেন তিনি তাহাই পালন করিতেন। কেবল আকবর শা মায়ের একটি আজ্ঞা পালন করেন নাই। সম্রাটের মা সংবাদ পাইয়াছিলেন যে পর্টুগিজ নাবিকগণ একটি মুসলমান জাহাজ লুঠ করিয়া একখণ্ড কোরান গ্রন্থ পাইয়াছিল, তাহারা সেই গ্রন্থ একটি কুকুরের গলায় বাঁধিয়া বাজনা বাজাইয়া অর্মজ শহর প্রদক্ষিণ করিয়াছিল।

এই সংবাদে ক্রুদ্ধ হইয়া সম্রাটমাতা আকবরকে অনুরোধ করিয়াছিলেন যে একখণ্ড বাইবেল গাধার গলায় বাঁধিয়া আগ্রা শহর ঘোরানো হউক। সম্রাট তাহার উত্তরে বলিয়াছিলেন–‘যে কার্য একদল পর্টুগালবাসীর পক্ষেই নিন্দনীয় সে কার্য একজন সম্রাটের পক্ষে অত্যন্ত গর্হিত সন্দেহ নাই। কোনো ধর্মের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিলে ঈশ্বরের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হয়। অতএব আমি একখানা নিরীহ গ্রন্থের উপর দিয়া প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করিতে পারিব না। ’ যেকোন মুহুর্তে যুদ্ধযাত্রার জন্য তার মজুত থাকত “পাঁচশত হাতি আর মালবহনের জন্য একশত সারি ঘোড়া আর উট, প্রতি সারিতে দশটি করে।

” আবুল ফযল পাতার পর পাতা বকবক করে গেছেন বর্ণনা দিয়ে যে আকবর বাদশা ছিলেন এক অক্লান্ত নেতা যার অত্যন্ত পেয়ারের বিষয় ছিল শিকার করা আর যার “হৃদয় কখনই একস্থানে বাঁধা পড়ে থাকেনি”। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে আকবর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছেন। ২৭ অক্টোবর ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। আগ্রার অদূরে সেকেন্দ্রা নামক স্থানে আকবরের সমাধি রয়েছে। জয়পুরের রাজকুমারী যোধবাইকে তিনি বিয়ে করেছিলেন।

বিকানের ও জয়সলমীরের শাসকেরাও নিজ নিজ কন্যার সঙ্গে আকবরের বিয়ে দেন। অমুসলমানদের মন্দির নির্মাণ ও নিজ নিজ উৎসব পালনের অনুমতিও দেন তিনি। আকবরের বাবা ছিলেন সুন্নি মুসলমান, কিন্তু তাঁর মা ছিলেন শিয়া। ছেলেবেলায় কিছুকাল তিনি এক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেছিলে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর পুত্র সেলিমকে উত্তরসূরি নির্বাচিত করে যান।

সেলিম ‘জাহাঙ্গির’ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন। ছোট একটা গল্পঃ সম্রাট আকবর একদিন বিকেলে যমুনা তীরে এক প্রাসাদে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রূপসুধা পান করছিলেন, হঠাত্‍ কোত্থেকে এসে হাজির হলো বীরবল৷ বীরবল যথারীতি সস্তা চুটকি ফুটকি শোনাচ্ছিলেন, কিন্তু আকবর কিছুটা আনমনা হয়ে রইলেন৷ শেষটায় বীরবল বললেন, "জাঁহাপনা, আপনি কী নিয়ে চিন্তিত?" আকবর বললেন, "সেলিম বড় বাড়াবাড়ি করছে বীরবল৷ আমি শুনেছি সে ছোটখাটো মনসবদারদের খেপিয়ে তুলছে আমার বিরূদ্ধে৷ কে জানে, হয়তো শিগগীরই ওর বিরূদ্ধে তলোয়ার ধরতে হবে আমাকে৷" বীরবল বললেন, "না জাঁহাপনা! তলোয়ার কেন ধরবেন এই বিজ্ঞানের যুগে? আপনি কি আমাদের হালফ্যাশনের কবীরা গুলতি [১] দ্যাখেননি?" আকবর সন্দিগ্ধ গলায় বললেন, "সগীরা গুলতি [২] দিয়ে ছোটকালে বিস্তর তিতির মেরে পুড়িয়ে খেয়েছি, কিন্তু কবীরা গুলতি আবার কী?" বীরবল মোচে তা দিয়ে মুহুহুহুহু হাসলেন৷ তারপর বললেন, "এ বিজ্ঞানের এক অপূর্ব ফসল জাঁহাপনা৷ বড় দেখে কিছু পাথর জোগাড় করতে পারলেই সব কেল্লা আপনার ফতে হয়ে যাবে!" আকবর বিমর্ষ গলায় বললেন, "কত জিনসি [৩] কত দস্তি [৪] হার মেনে যায় সিপাহসালার এসরকম দক্ষ হলে, আর তুমি কি না বীরবল গুলতির কথা বলো?" বীরবল ইশারায় দ্যাখালেন, "জাঁহাপনা, ঐ যে দেখুন, দূরে যমুনার বুকে একটা নৌকা যাচ্ছে?" আকবর বললেন, "হাঁ, যাচ্ছে!" বীরবল দ্যাখালেন, "ঐ যে দেখুন কেল্লার পাশের মাঠে একটা কবীরা গুলতি রাখা, দেখা যায়?" আকবর বললেন, "হাঁ, দীদার করতে পারছি! বীরবল বললেন, "দুইটা কালো বাঙালি ছাগল [৫] বাজি ধরছি জাঁহাপনা, আমার এই কবীর গুলতির গোলায় ঐ দূরের নৌকা ডুবে যাবে!" আকবর বললেন, "বীরবল তুমি সরে দাঁড়াও, গা থেকে ভুরভুর করে তুরানি শরাবের গন্ধ আসছে!" বীরবল বললেন, "না জাঁহাপনা, বীরবল মদ খেয়ে বাজে বকে না, বাজিও ধরে না৷ আপনি বলুন, এ বাজি খেলবেন কি না!" আকবর বললেন, "খেলবো৷ দাগো তোমার গোলা!" বীরবল একটা সাদা রুমাল তুলে ইশারা করতেই কবীরা গুলতির গুলতিবর্দার গোলা দাগলো৷ বিশাল এক পাথর উড়ে গিয়ে মাঝ যমুনার বুকে এক নৌকাকে ছিদ্র করে দিলো৷ দেখতে দেখতে নৌকা ডুবে গেলো নদীর বুকে৷ বীরবল হেসে বললেন, "কিস্তি মাত! এবার জাঁহাপনা, আমার বাজির ছাগল দুটা ...৷" আকবর বীরবলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, "কাল দরবারে এসে বকরি নিয়ে যাবে! সাবাস বীরবল, সাবাস!" কিন্তু পরদিন দরবারে এক মহিলা বিধবার বেশে এসে কেঁদে পড়লো আকবরের পায়ে৷ "জাঁহাপনা, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে!" কাঁদতে কাঁদতে বললো সে৷ "কোন এক বদমায়েশ গতকাল গোলা দেগে আমার খসমের নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে৷ ডুবে মরেছে আমার খসম! ছোট ছোট পাঁচটা ইয়াতিম বাচ্চা নিয়ে আমি বিধবা আওরাত কোথায় যাই? আমাকে সাহায্য করুন হুজৌর!" আকবর চোখ লাল করে বীরবলের দিকে তাকালেন, বীরবল লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন৷ আকবর বললেন, "হে আওরত, তুমি কোন চিন্তা করো না৷ আমি তোমাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুটা কালা বাংলা ছাগল দিচ্ছি, ওগুলো প্রতিপালন করে তুমি তোমার সন্তানদের লালনপালন করবে!" বিধবা কী বলবে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো৷ তারপর ভাবলো, আকবরদের বোধহয় এ-ই রীতি, মানুষের জীবনের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চায় ছাগল দিয়ে৷ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৬৭ বার     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.