আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে যাওয়া সেই শ্রমিকরাই বলছি

স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্ন হিসেবে রেখে দিতে চাই না , বাস্তবতার আলোয় স্বপ্নগুলো আরো রঙ্গিন করতে চাই । আমরা তাজরীন ফ্যাশনসের আগুনে পুড়ে যাওয়া সেই শ্রমিকরাই বলছি , সবার কাছেই আমাদের প্রশ্ন , "কেন আমাদেরকে এই অসহ্য আগুনে পুড়ে মরতে হল ? আমরা কি বেঁচে থাকার যোগ্য ছিলাম না , নাকি আমরা দেশের বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম ? কেন আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর সৌভাগ্য হল না ? আমাদের জন্য কেন অগ্নিনিরাপত্তার ব্যাবস্থা ছিল না ? কেউ কি আমাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবে ? নাকি আমরা এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর পাবারও যোগ্য না ? " আমরা তো বরাবরই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করেছি ,দেশের জন্য । আমরা তো দিন রাত কারখানায় পরিশ্রম করেছি দেশের জন্য । আমাদের ঘাম জরানো পরিশ্রমেই দেশের পোষাক কারখানা থেকে বিদেশে পোষাক রপ্তানি হয় । দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় ।

আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই তো দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি শক্ত হয় । আমাদের এই ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের পরও আমরা আমাদের প্রাপ্য মজুরি পাই না । তবুও তো আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করে গেছি । সারা বছর কাজ করেও আমরা অনেক সময় ঈদে বোনাসও পাই না , কিন্তু আমরা ঠিকই দিন রাত পরিশ্রম করে গেছি । মানছি আমাদের দেশে শ্রমের মূল্য কম ।

কিন্তু আমরা সাধারন শ্রমিকরা এর চেয়েও কম মূল্য পাই আমাদের শ্রমের । আমাদের কারখানায় যে সকল মেয়েরা সামান্য আয়ের আশায় দিন-রাত কারখানায় কাজ করে ,তারাও লোকমুখে নানান অবজ্ঞার কথা শুনে । তাদেরকে দেখলেই অনেকে অবজ্ঞার সুরে বলে ''ওই দেখ গার্মেন্টসের মাইয়া যায় " যে সকল নারী শ্রমিকরা কারখানায় কাজ করে তাদের কি কোন মূল্য নেই ? আগুনে পুড়ে যাওয়া শ্রমিকের মুখায়ব গুলো আরো কিছু কথা বলতে চাচ্ছে , তারা চিতকার করে তাদের প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছে । আমরা তাদের এই প্রশ্নগুলো শুনতে পাচ্ছি কি ? একজন আগুনে পোড়া মুখায়বের মহিলা বলে উঠল , " আগুন লাগার প্রাথমিক অবস্থায় তৃতীয় তলায় ছিলাম । আগুন লাগার খবর শুনেই আমরা বের হতে চাইলাম ।

কিন্তু ওরা আমাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বাইরে বের হতে দিলনা । গেটের তালা আগের মতই তালাবদ্ধ থাকল । কিন্তু আমাদেরকে কেন এই মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল । এটা কি কোন ষড়যন্ত্র ? এটা কি বাংলাদেশের কারখানা ধ্বংদের ষড়যন্ত্র ? কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের জন্য আমাদেরকে কেন বলি করা হল ? আমার স্বামীও আগুনে পুড়ে আমার পাশেই দাড়িয়ে আছে । কিন্তু আমাদের এগারো বছরের বাবুটার কি হবে এখন ?আমাদের বাবুটা কোন অপরাধের জন্য এই শাস্তি পাবে ।

বাবুটা তিনদিন ধরেই কারখানার সামনে এসে দাড়িয়ে থাকে , তার হাতে থাকে আমার আর তার বাবার ছবি । প্রতিদিনই আমাদেরকে পাবার আশায় সে আসে , কিন্তু ফিরে নিরাশ হয়ে । আরো এক ঝলসানো মানুষের অবয়ব আর্তনাদ করে উঠল ,"আমরা দেশের গরিব শ্রমিক বলেই কি আগুন লাগার খবর সারাদেশে ছড়ানোর পরেও আমরা সর্বোচ্চ সুবিধা পাই নি । নাকি আমাদের দেশের সকল বিশেষ সুবিধা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট শ্রেণীর উচ্চবিত্ত মানুষদের জন্য । বসুন্ধরা শপিং সিটিতে আগুন লাগার সময় তো হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষ উদ্ধার করা হল , হেলিকপ্টার দিয়ে আগুন নেভানোরও চেষ্টা করা হয়েছে ।

কই আমরা তো সেই সুবিধা পেলাম না কেন ?আমরা কি এই সুবিধা ভোগ করার অধিকার রাখি না ? হয়তো হেলিকপ্টার ও অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করলে মৃত মানুষের সংখা আরেকটু কম হত । হয়তোবা আমাদেরকে এই গনমৃত্যুর দৃশ্য দেখতে হত না । আগুনে পোড়া আরও এক মুখয়ব করুণভাবে আর্তনাদ করে উঠল ,"আমরা দেশের এমন এক হতভাগা শ্রেণীর মানুষ যে , আমরা মরে লাশ পর্যন্ত হতে পারলাম না । আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম । আমাদের অবশিষ্ট সামান্য হাড়গুলোও কিছু মানুষ সরিয়ে নিল ।

এই অগ্নিকান্ডে মৃত মানুষের সংখ্যা নাকি ১১১ । কিন্তু আমরা যারা পুড়ে ছাই হয়ে গেছি তাদের হিসেব তো কেউ করল না । আমরা কি তাহলে সবার অগোচরেই থেকে যাব । কেউ কি আমাদের মৃত্যুর খবর জানবে না । সব মৃত শ্রমিকরা কিছুক্ষন পরে আরো গভীরভাবে আর্তনাদ করতে থাকল ।

পরিবেশ আরো গম্ভীর হয়ে উঠল । তাদের সবাই আর্তনাদ করে উঠল ,"যাদের কারনে আমাদের মত এত নিরিহ শ্রমিককে প্রাণ হারাতে হল তাদের বিচার হবে কি ? যারা তৃতীয় তলায় মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেট তালাবদ্ধ করে রেখেছিল , তাদের বিচার হবে কি ? যাদের নিষ্টুর ষড়যন্ত্রে আমরা এত শ্রমিক বলি হলাম , তাদের বিচার হবে কি ? নাকি আমাদের এই নৃশংস গনমৃত্যুর ঘটনাও আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে । আসামীরাও কি আইনের ফাকগুলোতে পার পেয়ে যাবে , নাকি আবারও আরেকটি মিথ্যা সাজানো নাটক দেখবো আমরা । " আমরা সেই মৃত কারখানার শ্রমিকরাই বলছি ,দেশের সকল মানুষের কাছে আমাদেত এই দাবি "আমরা এই নৃশংস অগ্নিকান্ডের বিচার চাই ,আমরা আর কোন সাজানো নাটক চাই না । আমরা চাই না দেশের আর কোন কারখানার শ্রমিক এভাবে আমাদের মত মরুক ।

আমরা চাই না আর কাউকে এভাবে জীবন হারাতে । আমরা শুধু এই নৃশংস ঘটনার বিচার চাই এবং সকল কারখানা শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা চাই । " আমাদের এত শ্রমিকদের মৃত্যুর পরও কি আমরা গরিব শ্রেণীর শ্রমিকরা এই দাবিগুলো করতে পারি না । এই দাবি গুলো তো তেমন বিশেষ কিছু নয় , এই দাবিগুলো আমাদের অধিকার । আমরা কি আমাদের এই অধিকারটুকুও পেতে পারি না ??? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।