আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনী পরে ইংরেজী শেখার পত্তন।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা একদিন পরিবর্তন হয়ে রূপ নেয় ’পালি’ নামক এক ভাষায়, পালি ভাষা ক্রমে আরো পরিবর্তিত হয় তার উচ্চারণ আরো সহজ সরল রূপনের মাধ্যমে জন্ম নেয় প্রকৃত ভাষা। প্রকৃত ভাষা আবার বদলাতে থাকে অনেক দিন ধরে দশম শতকের মাঝভাগে এসে একটি রূপ থেকে উদ্ভুত হয় একটি নতুন ভাষা যার নাম বাংলা। বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ তার গ্রন্থে উলে­খ করেছেন বাংলা সাহিত্য জন্ম থেকেই বিদ্রোহী। এর ভিতরে জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উচু শ্রেণীর লোকের কাছে সহজে মর্যাদা পায়নি।

এর জন্মকালে একে সহ্য করতে হয়েছে উচু শ্রেণীর অত্যাচার উৎপীড়ন। দশম শতকে যখন বাংলা সাহিত্য জন্ম নিচ্ছিল তখন সংস্কৃত ছিলো সমাজের উচু শ্রেণীর ভাষা। তারা সংস্কৃতের চর্চা করতো। ঠিক তখনই সংগোপনে সাধারণ লোকের মধ্যে জেগে উঠেছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। সাধারণ মানুষ একে লালন পালন করেছেন বহুদিন।

সমাজের উচুশ্রেণীর লোকের সব সময়ই হয় সুবিধাবাদী; যেখানে সুবিধা সেখানে তারা। মুসলমান আমলে এ উচুশ্রেণী সংস্কৃতের বদলে সেবা করেছে ফারসির এবং ইংরেজ রাজত্বে তারা আকড়ে ধরেছে ইংরেজিকে। ১৮শ শতকের পূর্বে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পর্তুগিজ মিশনারি পাদ্রি মানোএল দা আসসুম্পসাঁউ Vocabolario em idioma Bengalla, e Portuguez dividido em duas partes নামে বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান ও ব্যাকরণ রচনা করেন; ১৭৩৪ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত ভাওয়ালে কর্মরত অবস্থায় তিনি এটি লিখেছিলেন। ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হালহেড নামের এক ইংরেজ প্রাচ্যবিদ বাংলার একটি আধুনিক ব্যাকরণ লেখেন, (A Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮)) যেটি ছাপাখানার হরফ (type) ব্যবহার করে প্রকাশিত সর্বপ্রথম বাংলা গ্রন্থ।

বাঙালিদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন প্রথম ব্যাকরণ রচয়িতা; তাঁর গ্রন্থের নাম "Grammar of the Bengali Language" (১৮৩২) এ সময়ে ক্রমশ সাধুভাষা থেকে সহজতর চলিতভাষার প্রচলন বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের একমাত্র স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এছাড়াও ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম| ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা হল বাংলা এবং অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকার তিন জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে স্বীকৃত সরকারি ভাষা হল বাংলা এছাড়াও বাংলা ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম প্রধান স্বীকৃত ভাষা। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় কথা বলে। আমরা মুসলমান, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যে যাই হইনা কেন আমরা এই একটি ক্ষেত্রে সকলেই এক ও অভিন্ন আমরা সবাই বাঙ্গালী।

২১শে ফেব্রুয়ারী আজ শুধু বাঙালীর অমর একুশে নয়। এটি আজ আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। আজ এ কথা ভেবে দেখার দিন, যে সকল তরুনরা ১৯৫২সালে তাদের আত্মাদান করেছেন তা যেন বৃথা না যায়। ৭১ পরবর্তী সময়ে আকাশ সংস্কৃতির ও বিশ্বায়নের যুগে সঠিক পরিকল্পনা ও অযত্ন ও অবহেলায় বাংলা ভাষা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে। তার জায়গায় দখল করছে অন্য ভাষা।

আমাদের ব্যাংক-বীমা, তথা বহুজাতিক কোম্পানীগুলো এমনকি এনজিও তাদের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেন ইংরেজী ভাষাকে। দেশের সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারা ৫২সালের ভাষা আন্দোলন এবং ৭১ স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের বুকের তাজা রক্তের প্রতিই অবজ্ঞা পোষন করা ছাড়া আর কিছুই না। চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা পত্র সহ যাবতীয় চিকিৎসা কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকেন ইংরেজী ভাষায়। ময়না তদন্তের প্রতিবেদনের অধিকাংশই বোঝেন না তদন্ত কর্মকর্তা। যার ফলে তদন্তে ঘটে বিলম্ব ও বিপত্তি।

আইন প্রনয়ন হয় বাংলা কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে উচ্চ আদালতে বাংলা এখনও চালু হয়নি। লক্ষ মানুষ আছে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা কি? কবে পালিত হয়? তা জানেন না। বাংলা ভাষা আজ কাগজে কলমে। সর্বত্রভাবে এর ব্যবহার প্রতিফলিত হয়নি। দেশের উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজী ভাষার প্রধান্য থাকায় শিক্ষার্থীরা বাংলা চর্চায় অনেক পিছিয়ে পড়ছে।

তরুন-তরুনীরা বাংলা ভাষার চেয়ে ইংরেজী ভাষা চর্চা করতেই বেশি আগ্রহী। বাংলা ভাষা শিক্ষাকে তাচ্ছিল্য লিখতে না পারাকে তারা গৌরবের মনে করে। মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম বলেছিলেন যারা বাংলায় জন্মে বাংলা ভাষাকে ঘৃনা করে তারা কেন? এদেশ ছেড়ে চলে যায় না? তারা চলে যাক। শুধু আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস এলেই সেমিনার ও বক্তব্যের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার, এর প্রচার-প্রসারের কথা সীমাবন্ধ থাকে। এফএম রেডিওগুলো তাদের নান্দনিক উপস্থাপনায় যেমন তরুন-তরুনীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে তেমনি বিক্রিত ভাষার ব্যবহারে বিভ্রান্ত হচ্ছে প্রজন্ম।

কিছু কিছু চিত্র নাট্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই বিপত্তি। একাধিক ভাষার শিক্ষা করা কোন ক্ষতিকর নয়। তবে মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা, তুচ্চ-তাচ্ছিল্য করে নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর বানী দিয়েই বলতে হয় - ''আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনী পরে ইংরেজী শেখার পত্তন''। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।