আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক প্রসূতির মৃত্যু, সরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ভুমিকা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা!

এক প্রসূতির মৃত্যু, সরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ভুমিকা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা! সাইফুজ্জামান রানা .................................................................................................... মানুষ বড় বিচিত্র। তার থেকেও অধিক বিচিত্র মানুষের মন। সে যে কখন হাসে আর কখন কাঁদে তা বোঝা বড় দায়। চলতি পথে এই যে প্রতিদিন কত কিছু দেখি, শুনি কিন্তু সব ঘটনায় কি আমরা সমানভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়? অবশ্যই দেখায় না। সব ঘটনা আমাদের সমান ভাবে ভাবায় না, আমরা ভাবতে চায়ও না, অথবা সময় কোথায় ভাববার! কিন্তু ভাবনা ছাড়া কি মানুষ আছে পৃথিবীতে? মানুষ হবার প্রাথমিক এবং প্রধান শর্ত হলো ভাবনা চিন্তা করতে পারা, যার বিবেক বুদ্ধি আছে, তিনিই ভাবেন আর সে কারনে তিনিই মানুষ।

আর যিনি বিবেক বুদ্ধিহীন তিনি কি মানুষ? মানুষের এই বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতায় তাকে প্রথিবীর অনান্য প্রাণীকুল থেকে পৃথক করেছে, করেছে সম্মানীত, মহীমান্বিত, অনন্য এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। একমাত্র বৃদ্ধিবৃত্তিক গুণের কারণে মানূষ হয়ে উঠেছে মানবিক। আধুনিক মনোবিঞ্জান বলছে এই মানবিকতা চর্চার মাধ্যমে মানুষ মানবিক হয়ে ওঠে। চর্চার মাধ্যমেই মূলত গুণগুলির বিকাশ নিশ্চিত হয়ে থাকে। দীর্ঘ দিন অনুশীলনের অভাবে মানুষের মানবিক অনুভুতিগুলো মরে যেতে থাকে কিংবা যথেষ্ট পরিমান বিকশিত হয় না।

বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতার উজ্জল সময়ে আমরা কি অনুভুতি শূন্য হয়ে পড়ছি কি না? কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন বিজ্ঞান আমাদের জীবনে বেগ দিয়েছে কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। বাস্তব ক্ষেত্রে তা হয়তো খানিকটা সত্য কিন্তু অনুভুতিহীন মানব সমাজ তা কি কল্পনা করা যায়? বর্তমান সময়ে আমাদের চার পাশে যা ঘটছে তাতে মনে হচ্ছে আমরা এক অনুভুতি শূন্য জাতিতে পরিনত হতে যাচ্ছি। কোন ঘটনায় আর আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয় না; দিলেও অল্প সময়ের জন্য আমরা হা-হুতাশ করি, তার পর ভুলে থাকি। গত ৩০ নভেম্বর ২০১২ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিতকায় প্রকাশিত একটি খবর চেতনার দরজায় কড়া নেড়ে যায়। “পুলিশি হয়রানি ও এক প্রসূতির মৃত্যু” শিরোনামে প্রকাশিত খবরটি নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় মনে।

ঘটনাটি ঘটেছে গত বুধবার অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর তারিখে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ি- গত ২৭ তারিখ সন্ধায় কুষ্ঠিয়া শহরতলীর গ্রাম মোল্লাতেঘড়িয়া এলাকার ওয়াসিম শেখ তাঁর স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠলে সদর হাসপাতালে ভর্তি করান। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের কথা জানালে তিনি প্রয়োজনয়ি ওষুধ কিনে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। স্ত্রীর পাশে রেখে আসেন প্রতিবেশী তাসলিমাকে। রাত দেড়টার দিকে তাকে ফোন করে জানানো হয় যে, তার ছেলে হয়েছে কিন্তু তার স্ত্রীর জন্য জরুরী রক্ত লাগবে।

ওয়াসিম তখন দ্রুত বাড়ি থেকে হাসপাতালের উদ্দেশ্য হেটে বেরিয়ে পড়েন। রাত দুইটার দিকে ওয়াসিম জেলখানার মোড়ে পৌঁছালে টহল পুলিশ তাকে দাড় করায় এবং তাঁর পরিচয় ও অ্যাত রাতে বের হওয়ার কারণ জানতে চান। তিনি স্ত্রীর গুরুতর অবস্থা ও হাসপাতালে থাকার কথা বলেন এবং তিনি সেখানেই যাচ্ছেন। কিন্তু এসআই ওবায়দুর রহমান তাকে চুপ করে বসে থাকতে বলেন। বারবার অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও তাকে হাসপাতালে যেতে না দিয়ে আটক রাখা হয়।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক তাকে নিয়ে টহল পুলিশের এই দলটি শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ায়। শেষে ভোর ৪ টার দিকে তাকে একজন পুলিস সদস্যকে সাথে দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয় ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে যে, ওয়াসিম শেখ মিথ্যা বলছেন না সত্য বলছেন। ঘটনার সত্যতা পেয়ে পুলিশ সদস্য ফিরে যান কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। রুগীর অবস্থা খারাপ থেকে খারাপের দিকে যেতে থাকে সময়মত রক্ত না দিতে পারার কারণে। প্রথম আলোর সংবাদ অনুযায়ি ওয়াসিম শেখ রক্তের ব্যবস্থা না করতে পেরে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে নিজের ‘এ’ পজেটিভ এক ব্যাগ রক্ত জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় ‘বি’ পজেটিভ এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেন।

ততক্ষণে রুগী অচেতন হয়ে পড়েন। সকাল ৫ টা ২০ মিনিটে রক্ত দেয়া শুরু হয় কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হলো না ওয়াসিম শেখের। সকাল ৮টার দিকে প্রসূতি রোকেয়া সদ্যজাত সন্তান, স্বামী, পরিবার পরিজন রেখে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এখন মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রোকেয়া বেগমের এই মৃত্যু কি স্বাভাবিক নাকি অবহেলা জনিত হত্যা? পাঠকগণ একবার ভাবুন তো কি অপরাধ ছিল ওয়াসিম শেখের? কেন তাকে বাধ্য করা হয়েছিল চুপ করে বসে থাকতে? তাঁর কাতর মিনতি কেন জনগণের সেবক নামক পুলিশ সদস্যের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো না? যদিবা তার খেয়াল হলো তাহলে দুই ঘন্টা পরে কেন? অন্যদিকে হাসপাতালের বেডে যখন রোকেয়ার অবস্থার অবনতি হচ্ছিল দ্রুত। জরুরী রক্তের প্রয়োজন।

সময়মত রক্ত দিতে না পারার কারণে রুগীর অবস্থা ক্রমশই খারাপ হচ্ছিল তখন কেন হাসপাতালের ব্লাড ব্যাক থেকে রক্ত সরবরাহ করা হলো না? শুধু কি রুগীর সাথে কোন পুরুষ লোক পাওয়া যায়নি বলে নাকি দেয়ার নিয়ম নেই? হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন- সাধারণত রোগীর লোকজনই রক্ত সরবরাহ করে থাকেন। না থাকলে তাদের কাছ থেকে এক ব্যাগ ব্লাড ব্যাংকে জমা রেখে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ করা হয়। যদি ওয়াসিম শেখ সময় মত হাসপাতালে উপস্থিত হতে পারতেন, প্রয়োজনীয় রক্ত জোগাড় করতে পারতেন তাহলে হয়তো রোকেয়াকে অকালে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হতো না। রোকেয়ার এই অকাল মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? পুলিশের অহেতুক সন্দেহ, হয়রানি ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ নাকি হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তার ও কর্মকর্তাদের উদাসিন মনোভাব ও অবহেলা? বাংলাদেশের পুলিশ এবং হাসপাতাল দুটি প্রতিষ্ঠানই পরিচালিত হয় এদেশের আপামর জনসাধারণের করের টাকায় এবং দুটিই জনগণের সেবাদানের জন্য নিবেদিত। শুধু রোকেয়ার এই ঘটনা নয় এমন বহু ঘটনা প্রতিদিন সরকারের বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান জনগণের সাথে এমন বিমাতাসূলভ আচরণ করে চলেছে।

জনগণ হচ্ছেন বঞ্ছিত সেবা থেকে অথবা বঞ্ছিত করা হচ্ছে তাদের। এই ধরণের হয়রানি কিংবা অবহেলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। রাষ্ট্র বা সরকারের কোন প্রতিষ্টান থেকে এর কোন প্রতিকার মিলছে না। কোথাও কোথাও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় প্রকৃত দোষী কে, তা খুজে বের করতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কমিটি পর্যন্তই সার।

কোন কোন কমিটি হয়তো প্রতিবেদন জমা দেয় তার উর্ধতন কর্তপক্ষের নিকট কিন্তু কি থাকে সেই প্রতিবেদনে তা অজানা থেকে যায় জনতার। আমরা যদি একটু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করি তাহলে হয়তো এর আসল কারণ চিহ্নিত করতে পারবো। কেন এদেশের পুলিশ অহেতুক হয়রানি করে, ভয় দেখায়, স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে? শুধু পুলিশ প্রশাসন নয় সরকারের অনান্য সেবাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কিংবা কর্তা ব্যক্তিরা জনগণকে তার প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্ছিত করছেন। অবহেলা করছেন দায়িত্ব্যে; যার ফলশ্রুতিতে হয়রানির শিকার হতে হয় ওয়াসিম শেখকে, হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে ব্লাড জমা থাকার পরও জরুরী প্রযোজনে ব্লাডের অভাবে অকালেই মরে যেতে হয় রোকেয়াদের। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা সরকারের বিভিন্ন সেবাদানকারী বিভাগে কাজ করছেন তারা কি অবিবেচক, মানবিক অনুভুতিহীন, বোধ শূন্য? জন্মগতভাবে মানুষ মানবিক গুণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে।

কখনো কখনো পারিপার্শিক অবস্থা ও যথাযথ অনুশীলনের অভাবে মানুষ অমানুষ হয়ে ওঠে। যথাযথ অনুশীলনের অভাবে যেমন মানুষ অমানুষ হয়ে ওঠে তেমনি আবার মানুষ হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ অনুশীলন। মানুষ জন্মায় পরিবারে, বেড়ে ওঠে সমাজে, পরিনত হয় সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কোন স্তরে মানবিক গুণাবলি অনুশীলনের নিয়মিত ব্যবস্থা রয়েছে? প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যায় স্তরের সকল পর্যায়ে মানুষ হয়ে ওঠার থেকে যেখানে বেশি গুরুত্ব পায় গ্রেড প্রাপ্তি সেখানে মানবিকতা ভুলুন্ঠিত হবে, মানুষ অযথা হয়রানির শিকার হবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদাসীন থাকবে আর অসময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে রোকেয়াদের মতো অসংখ্য মানুষদের। দোষীদের যথাযথ বিচারের পাশাপাশি ভাবতে হবে মানুষ তৈরির কারখানা অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে।

নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে অধিক গুরুত্ব দিয়ে অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে মানবিক গুণাবলি বিকাশের সহায়ক কর্মকান্ডগুলো; তা না হলে সমাজে এই ধরণের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। লেখক: সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন কর্মী। Email: ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।