আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফ্লাইওভার প্রকল্পের ১০৭ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারায় সিডিএ চেয়ারম্যানও জড়িত!

আমি যা বলতে চাই... চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ট্র্যাজেডির ঘটনায় অভিযুক্ত দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নামে পুলিশের মামলার পর তাঁরা ইতিমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। পলাতক রয়েছে ১৫ তরতাজা প্রাণের হত্যার জন্য দায়ি প্রকল্প পরিচালক বরখাস্ত প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানও। আবার ঘটনায় দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম নিজেও। ঘটনার সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে উঠেছে একগাদা প্রশ্ন। চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিসহ ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং দোষীদের বিরুদ্ধে শাাস্তির দাবি জানিয়ে নগরজুড়ে মানববন্ধন-সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে।

স্বয়ং সরকার দলীয় নেতা ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীও আবদুচ ছালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফ্লাইওভার ট্রাজেডির জন্য দায়ি ওইসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠলেও তাদের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেন নি সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। কোন দক্ষতা না থাকার পরও ব্যক্তিগত পছন্দে তিনি কাজ দিয়েছেন তাঁরই রাজনৈতিক সহকর্মীর মালিকানাধীন মীর আকতার ও পারিসা এন্টারপ্রাইজকে। অত্যন্ত নিম্নমানের কাজ করায় চলতি বছরের ২৯শে জুন প্রথম দফা ধসে পড়েছিল ফ্লাইওভারটির একটি গার্ডার। সেদিন রাস্তায় লোকজনের চলাচল কম থাকায় ভাগ্যক্রমে অনেকে প্রাণে বেঁচে যান।

পরে এ ঘটনায় সিডিএ কর্তৃপক্ষ গঠন করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। এ কমিটির আহ্বায়ক সিডিএ’র প্রধান প্রকৗশলী নাছির উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতাকে দায়ী করে ৫টি সুপারিশ করেন। সেখানে বলা হয়, নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই গার্ডারটি মূল জায়গায় বসানোর আগে অস্থায়ীভাবে কাঠের গুঁড়ির ওপর বসায়। সেটা ছিল নরম কাঠের তৈরী। পাশাপাশি তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঠিকাদারকে দক্ষ কর্মী নিয়োগ ও লোকবল বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করেন।

একই সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি সেফটি সিস্টেম রাখার কথা জানান। পরে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ চালিয়ে যায়। বিষয়টি সিডিএ চেয়ারম্যানকে কর্মকর্তারা জানানোর পরও তিনি এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সেই সময় এ ঘটনায় প্রকল্প পরিচালক হাবিবুর রহমানকে সরিয়ে দেয়ার জোর দাবি ওঠে। একই সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ তদারকের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়।

অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং দলীয় বিবেচনায় তাদের সেই ঘটনায় বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে চেয়ারম্যানের কল্যাণে আড়ালেই থেকে যায় দোষীরা। আর এর পেছনে সিডিএ’র উদাসীনতা কাজ করেছে বলে সবার ধারণা। সর্বশেষ গত শনিবার ৩টি গার্ডার ভেঙে পড়ে লোকজনের মারা যাওয়ার ঘটনায় সিডিএ’র দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল। তাঁর অপসারণ চেয়েছেন খোদ সরকার দলীয় নেতা ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ক্যাব চট্টগ্রাম, সিডিএ শ্রমিক কর্মচারী লীগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে স্বয়ং সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন সিডিএ চেয়ারম্যান। অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে কেবল ব্যক্তিগত ও দলীয় বিবেচনায় অদক্ষ দু’টি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছেন তিনি। বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের এ কাজটি দলীয় বিবেচনায় হাতিয়ে নিয়েছেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা নিজেরা ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ না করে বেশি টাকায় তা কৌশলে হস্তান্তর করেছে অভিযুক্ত মীর আকতার ও পারিসা এন্টারপ্রাইজকে। বহদ্দারহাট জংশনে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ পেয়েছে মীর আখতার-পারিসা ট্র্রেড সিস্টেম (জেবি)।

তবে নির্মাণের কাজটি করছে পারিসা এন্টারপ্রাইজ। এর মালিক আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু। প্রতিষ্ঠানের হয়ে এখন কাজ তদারক করছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এম আবদুর রাজ্জাক। এত বড় কাজের অভিজ্ঞতা পারিসা এন্টারপ্রাইজের নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। এ জন্য তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তারের লাইসেন্স ব্যবহার করে যৌথ প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে কাজ নেয় ।

এমনকি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান বলেন, ‘গার্ডার ভেঙে পড়লে ঠিকাদারের কী করার আছে? এসব দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের। সিডিএ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের দায়িত্বহীনতার কারণে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাজ পাওয়ার পর থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করায় লোকজনের মনে এই নিয়ে ভীতির সঞ্চার হয়। কেবল তাই নয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ধীরগতিতে কাজ করা, যথাযথ নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খোলামেলাভাবে নির্মাণ কাজ করায় তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতির বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। একপর্যায়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তারা সিডিএ চেয়ারম্যানের কাছে একাধিকবার দাবি জানালে তিনি নিশ্চুপ থাকেন।

বহদ্দারহাট উড়ালসড়কের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী এ এ এম হাবিবুর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১২টি মামলা করেছে। মামলাগুলোর বিচারকাজ চলছে। এবারের দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর পর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ২৯শে জুন ফ্লাইওভারের একটি গার্ডার ধসে নিচে পড়ার পর ওয়াসার একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চট্টগ্রাম আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি।

এ সময় তিনি কাজের মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আবদুচ ছালামের উপস্থিতিতে বলেন, ‘কোন অভিজ্ঞতা না থাকার পরও এ ধরনের একটি কাজ কিভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হলো। এর পেছনে নিশ্চয় দুর্নীতি জড়িত রয়েছে। ’ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ফ্লাইওভার প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৭ কোটি টাকা। পুরো কাজটি দলীয় বিবেচনায় দেয়া হয়েছে। সিডিএ’র কতিপয় কর্মকর্তা ও দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায়সারাভাবে কাজ করে বেশির ভাগ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট এসব ব্যক্তির কারসাজির কারণে তা কিছুতেই সম্ভব নয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর সিডিএ’র এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপকর্মে খোদ চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে ফ্লাইওভারটির ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এর আগে প্রকল্পের মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ানো হয় বলে জানান সিডিএ’র কয়েকজন কর্মকর্তা। বহদ্দারহাটের এই ফ্লাইওভারে পিলার রয়েছে ২৪টি।

প্রতি পিলারের মাঝখানে শক্তিশালী ওজনের গার্ডারগুলো বসানো হয়েছে। প্রতিটি গার্ডার ১৩৮ ফুট দীর্ঘ। প্রস্থ ৭/৮ ফুট। ওজন ১০০ টন। ফ্লাইওভারে ৭টি গার্ডার রয়েছে।

নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে সেগুলো তৈরি করায় তা বারবারই ভেঙে পড়ছে বলে অনেকের মন্তব্য। তাদের মতে, দু’টি পিলারের সংযোগ করার জন্য গার্ডারগুলো নির্মাণ করা হচ্ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে ওজন ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা না রাখায় তা নিচে পড়ে যায়। তবে দুর্ঘটনার সঙ্গে দুর্নীতির কোন সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টি তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে।

সঠিকভাবেই তো কাজ দেয়া হয়েছিল’ দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সিডিএ চেয়ারম্যানের পক্ষে সাফাই গাইলেন প্রাথমিক ও গণ শিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান। পূর্ত প্রতিমন্ত্রী এই ঘটনায় সিডিএ’র দায়কে এড়িয়ে গিয়ে এটাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে দাবি করেছেন! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.