আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোম যখন পোড়ে, নিরু তখন বাঁশি বাজায়

লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু। একবার এক বন্ধু বলল, ‘রোমের পোড়া এবং নিরুর বাঁশি বাজনোর প্রবাদটি মিথ্যা। আসলে নিরু একজন প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। ’ উত্তরে কিছুই বলার ছিল না।

কারণ, ইতিহাস সম্পর্কে আমি অজ্ঞ। এরপর অনেকদিন কেটে গেল। হঠাৎ ভূয়োদর্শনসসৃষ্ট কিছু প্রবাদ নিয়ে ভেবে দেখি, এগুলোর ভেতরকার ইতিহাস খুব করুণ। মানে, প্রচলিত ইতিহাসের বাইরে নিগূঢ় সত্যের আবাস রয়েছে এ-সব প্রবাদে। রোম হয়ত পোড়েও নি।

নিরু হয়ত বাঁশি বাজানো জানত না; বা বাঁশকেই চিনত না, বাঁশি তো দূরের কথা। কিন্তু আগেকার সেই নগর রাজ্যের ইতিহাস তো এখন সবারই জানা, যেখানে নগরের প্রধান ব্যক্তিরাই শুধু নাগরিকত্বের সুবিধা পেতেন। নিম্ন শ্রেণির মানুষজন সেখানে শোভা পেত দাস বা গ্লাডিয়েটর হিসাবেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রোমসহ এ-সমস্ত নগর রাষ্ট্রে সবসময় দাউ দাউ করে শোষণ ও নির্যাতনের আগুন জ্বলেছে। আর ইন্ধন হিসাবে ব্যবহার হয়েছে এসব দাস ও গ্লাডিয়েটর।

এ জন্যই প্রবীণ পুরুষরা এ প্রবাদ বানাতে বাধ্য হয়েছেন! বাধ্য? হ্যাঁ, বাধ্যই তো। কারণ, দূরদর্শী-ভূয়োদর্শী এ-সব পুরুষদের জানা ছিল বা অন্তত অনুমান ছিল, যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে মানব-শাসনের হরেক রকমের কল তৈরি হবে। আদতে মানবতা প্রতিষ্ঠিত হবে না, মানুষের কোনো মুক্তি ঘটবে না। দাস ও গ্লাডিয়েটর শ্রেণি আজীবন অন্যের আজ্ঞাবহ হয়ে পুড়তেই থাকবে, জ্বলতেই থাকবে অনন্তকাল। আর তখনও সমকালীন শাসকরা নানা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে থাকবে।

জ্বলে-পোড়া মানুষদের অঙ্গারের কাছ দিয়ে যাওয়ারও ফুরসত হবে না তাদের। তারা বরং দূরে বসে কালের বাঁশি বাজাবেন, যে-বাঁশি যুগ-যুগান্তরে নানা রকম হতে পারে, রঙ পাল্টাতে পারে। যদি জনতা জাদুর দ্বারা মোহিত হয়, সে হবে জাদুর বাঁশি; যদি জনতা সঙ দ্বারা মোহিত হয়, সে হবে সঙের বাঁশি; যদি জনতা রঙ দ্বারা মোহিত হয়, সে হবে রঙের বাঁশি! আর তাই তো আমাদের মহানুভব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এবং যখন বলছেন, তখনও লাশ উদ্ধার সমাপ্ত হয় নি, ‘জামাত-শিবিরদের লাঠি-পেটা করে দেশ থেকে তাড়াতে হবে’! উড়াল পুলের গার্ডার ভেঙে চাপা পড়ে আছে মানুষ, গার্মেন্টস-অগ্নিদগ্ধ হয়ে শ্রমিকরা ছাই হয়ে আছে, তা উদ্ধারের কী হল, কতটুকু হল, তার নাম-গন্ধ নেই। তিনি বাঁশি বাজালেন। তা শোনে বর্তমানের পোলা-বুড়ো সবাই, বিশেষত মিডিয়ার হাওয়াই বুদ্ধিজীবীরা মোহিত হয়ে শুনবে, সে এক তাক লাগানো শোনা; যেখানে হ্যামিলেনের বাঁশিওয়ালাও কুপোকাত! আর হ্যাঁ, যেহেতু জামাত-শিবিরের প্রসঙ্গ এলো, তাদেরটাই বলে নিই।

এক সাঈদীর ফাঁসি হবে বলে তারা দেশসুদ্ধ ঘাই মারছে। মনে হয়, এ দেশে কোনো মানুষ নেই, নাগরিক নেই। তাই তাকে রক্ষার জন্যই মরণপণ কৌশলে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। দেশের নানা প্রান্তে অপঘাতে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এ নিয়ে তাদের কোনোই কৌতূহল নেই। প্রতিবাদ শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে! শুধু জামাত কেন? অন্য কারো কাছে, অন্য কোনো দলের কাছেও কি এ-সব অগ্নিদগ্ধ প্রাণী মনুষ্য পদবাচ্য হবার যোগ্য? ইলিয়াস গুম হলে হরতাল হয়, হতে পারে; লোকমান হুসেন নিজ দলের হাতে খুন হলে হরতাল হয়, হতে পারে; শিক্ষানীতি আর নারী-নীতির অবোধগম্য বিষয় নিয়ে হরতাল হয়, হতে পারে; কিন্তু চিটাগাং আর ঢাকায় এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল, ছাই হয়ে গেল, তাদের নিয়ে কেউ কি সামান্য উদ্যোগী হবে বা হতে পারে? অসম্ভব, তা হবার নয়, হতে পারে না।

কারণ এরা তো দাস ও গ্লাডিয়েটর শ্রেণির। এরা মরবে, পুড়বে এবং জ্বলবে। আর জনতাকে মুগ্ধ করবে, মোহিত নানা রকমের বাঁশি: ধর্মের বাঁশি, মুক্তিযুদ্ধের বাঁশি, স্বৈরাচারমুক্ত দেশের বাঁশি, যুদ্ধাপরাধের বাঁশি, দেশমুক্তির বাঁশি ইত্যাদি। দাসশ্রেণির জীবন-যন্ত্রণা শ্রবণ করার, অনুভব করার সুযোগ সাধারণ জনতার কখনো হবে না। দেশে-বিদেশের সংবাদ-মাধ্যম মৃতের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রায়ই জগাখিচুড়ি পরিবেশন করে।

এবারও এর ব্যতিক্রম হয় নি, হবেও না। ভাগ্যিস, এবারে বিজিএমএই-এর নির্বাচন ছিল। শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা ছিলেন নিজ দলকে টেনে তোলার ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত। না হয়, খুব শিগগির এ লাশকে সরানোর ব্যবস্থা হয়ে যেত। মানুষ জানত, ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে।

দু-একটা লাশের সংবাদ মিডিয়াতে আসত বটে। ব্যস, এই শেষ। অন্য যাদের স্বজন-বিয়োগ ঘটেছে, তারাই শুধু নিজের ভেতরে আমৃত্যু আগুনের দাহ নিয়ে জীবন ধারন করত। মিডিয়া, সংবাদ-মাধ্যমে তাদের সংবাদ চাওর হত না। সে সুযোগও হত না।

এই তো, তাজরিন গার্মেন্টস থেকে গুটিকয় কিলো দূরে স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টস, যেখানে পুরো গার্মেন্টসটিই ধসে গিয়ে ছিল কয়েক বছর আগে। যে কয়টি লাশের সন্ধান পাওয়া গেল, শুধু তাদের কথাই মিডিয়ায় লেখা হল। যারা বিল্ডিংচাপা পড়ে মারা গেল, তাদের সংবাদও চাপা পড়ে গেল। এই হল দেশ, এই হল শাসক, আর এই হল মিডিয়া! একটি সম্ভাবনা এখানে ফেলে দেওয়ার নয়, তাই বলে নেওয়াই ভাল। যদি তাজরিন গার্মেন্টসের মালিক বিএনপি বা জামাত সমর্থক হয়, তাহলে খবর আছে।

হয়ত সরকার-দলীয় লোকজন, এবং অবশ্যই পাচাটা সংবাদকর্মীরা, এতক্ষণে তা উদ্ধার করতে সফল হয়েছেন। এ-ব্যাপারে তাদের সফলতা ঈর্ষনীয়! আজ-কালের ভেতর হয়ত একটি বিবৃতিও পাওয়া যাবে, যার সারমর্ম হবে: ‘ইনি বিএনপি বা জামাত সমর্থক। এরা ইচ্ছে করেই শ্রমিকশ্রেণির অধিকার দলন করে'। , অর্থাৎ মনে হবে, বিবৃতিদাতা ভিন গ্রহের শাসক। তাই এখানে তার কোনো কর্তৃত্ব নেই।

এমন উদাহরণ তো আছেই। যেমন- গত কয়দিন পূর্বে হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য সোনালি ব্যাঙ্কের ওপর দায় বর্তালে শীর্ষ নেত্রী বলে দিলেন, অভিযুক্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বিএনপির সমর্থক! মানে তিনি দায়মুক্ত! মালিক যদি সত্যি সত্যি বিএনপি-জামাত সমর্থক হয়ে থাকে, তাহলে তার তো খবর আছেই। তখন বিএনপি-জামাত খুব একটা উচ্চ বাচ্য করবে না। শুধু মুখ রক্ষার বিবৃতি দেবে। মিডিয়ায় ‘আপনা জান’ বাঁচানোর কৌশল নেবে।

তাহলে বাস্তবতা কিন্তু এটাই দাঁড়াল যে, রোম পোড়ে এবং পুড়েছে। সেই প্রাচীন কালে বাঁশি ছিল শুধু নিরুর হাতে। সে ছিল এক নিরু। এখন নিরুর সংখ্যা অনেক এবং অসংখ্য। এখনকার রোমে যখন আগুন লাগে, তখন সেই সব নিরুরা আপন আপন বাঁশিতে নানা রকমের সুর তোলেন।

সুরভক্ত সমর্থকরা নিজের পছন্দের এবং রুচির, ঠোঁটকাটার মতো বললে বলা যায়, একমাত্র স্বার্থের সুরটুকুই কর্ণকুহরে স্থান দেন। আর অবশিষ্ট সত্য ও বাস্তব সুর, মানব-যন্ত্রণা তার কানে ঢুকার অবকাশ পায় না। ঢুকলেও মনোযোগ পায় না, গুরুত্ব পায় না। তাই ভূয়োদর্শনের সেই প্রবাদই শিরোধার্য। যুগে যুগে রোম পুড়বে, নিরুরা বাঁশি বাজাবে আর এর সত্যতাও প্রমাণিত হবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।